“হকারি করার ফাঁকে ফাঁকে চষে ফেললাম গ্রন্থাগার, মহাফেজখানা। অসংখ্য সাক্ষাৎকার নিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল সুন্দরবনের ইতিহাস লিখব। ঠিক করলাম ক্যানিং বন্দর গড়ে ওঠা এবং তাকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনের সমাজ-সংস্কৃতির বদল ধরে রাখব আমার লেখায়। শুরু করলাম গবেষণা। প্রায় দুই দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ২০১৭ সালে প্রকাশিত হল – ‘ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক্যানিং’। অনেক জায়গা থেকে ডাক পেলাম, পণ্ডিতরা বললেন ভাল কাজ করেছি। বেশ লাগল।” বললেন পূর্ণেন্দু ঘোষ। যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন ফুটপাথে বই বিক্রি করেন। আশেপাশের অন্য দোকানদারদের প্রিয় পূণ্যদা।

পুরনো বইয়ের বিক্রেতা পূর্ণেন্দু ঘোষ কিন্তু কেবল এক জন হকার নন। নিজেকে শব্দ-শ্রমিক বললেও আসলে তিনি এক জন ইতিহাস সন্ধানী। ফুটপাথের ধারে বই বিক্রির ফাঁকেই তিনি লিখে ফেলেছেন পোর্ট ক্যানিং তথা সুন্দরবনের একাংশের ইতিহাস। সেই বই সমাদৃত হয়েছে গবেষক মহলে। দেশ-বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রের বিবলয়োওগ্রাফিতে রয়েছে পূণ্যবাবুর বইয়ের উল্লেখ।

সপ্তাহের শুরুর দিনের সকালের ব্যস্ততার ফাঁকে পূণ্যবাবু দীর্ঘক্ষণ গল্প করলেন বাংলালাইভ ডট কম-এর সঙ্গে। জানালেন, পেটের দায়ে প্রতি দিন ঘন্টা দেড়েক ট্রেন জার্নি করে এসে তাঁকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করতে হয়। দিনশেষে শরীর ভেঙে পড়ে ক্লান্তিতে। কিন্তু বাড়ি ফিরে কাগজকলম হাতে নিলেই প্রাত্যহিকতার যাবতীয় গ্লানি মুছে যায়। বললেন, “লেখাই আমার অক্সিজেন। আমাকে বাঁচিয়ে রাখে অক্ষর।”

বাবা ছিলেন তালাচাবির মিস্ত্রি। কিন্তু সে কেবলই পেটের দায়ে। আসলে ছিল আড়বাঁশি বাজানোর নেশা। বিভিন্ন জায়গায় বাঁশি বাজাতে যেতেন তিনি, যাত্রার দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। ফলে বছরের কোনও সময়ই পরিবারে বিশেষ টাকাপয়সা থাকত না। এমনকি, গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান করাও কষ্টকর হত। তাই পূর্ণেন্দুবাবুর ছোটবেলায় মিশে ছিল সীমাহীন অভাব। তার মধ্যেই স্থানীয় স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার কলেজে ভর্তি হওয়া। কিন্তু প্রবল অভাবে শেষ করতে পারেননি স্নাতকস্তরের পড়াশোনা। যাদবপুরের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মধ্য ষাটের পূর্ণেন্দু বললেন, “সে এক দুঃসহ দারিদ্র! বলে বোঝাতে পারব না। কলেজ ছাড়লাম, কারণ বাড়িতে টাকা দিতে হবে। চাকরি পাওয়ার উপায় নেই, কারণ কলেজের ডিগ্রি পাইনি। রোজগারের জন্য নানা কিছু করেছি তখন। হকারি করেছি, সাইনবোর্ড লিখেছি, মাটির প্রতিমা বানিয়ে বিক্রি করেছি। এমন করেই কেটে গেল আস্ত একটা জীবন। গত ১৫ বছর ধরে যাদবপুরের ফুটপাথে পুরনো বই বিক্রি করি।”

কিন্তু এই গল্পটা কেবল এক জন ফুটপাথের হকারের নয়। বরং দারিদ্রের চোখ রাঙানিকে হারিয়ে এক জন লেখকের জিতে যাওয়ার গল্প। ছোটবেলা থেকেই প্রবল অভাবের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বেঁচে থেকেছে পূণ্যবাবুর লেখালিখি। ছেদ পড়েনি কখনও। বললেন, “আমি নিয়ম করে লিখতাম। প্রতি দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লিখতাম, রাতে শুতে যাওয়ার আগে লিখতাম। খেয়ে, না খেয়ে বই কিনতাম। গবেষণার কাজ করতাম। আমার প্রধান আগ্রহ ছিল সুন্দরবনের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিতে।” জানালেন, প্রথমে লিখতেন দেওয়াল পত্রিকায়। তার পর বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। এর পর আচমকাই বাংলায় জনপ্রিয়তম সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হল পূর্ণেন্দুবাবুর প্রথম গল্প। সেই সূত্রেই আলাপ হল আবুল বাশার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে। ফুটপাথে বই বিক্রির ফাঁকে পূণ্যবাবু বলেন, “ওঁরা সব দূরের নক্ষত্র। আমি অতি তুচ্ছ শব্দ-শ্রমিক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বই বেচি। কিন্তু ওঁদের সংস্পর্শে আসতে পেরে বড্ড তৃপ্তি পেয়েছিলাম।”

পূণ্যবাবুর প্রথম বইয়ের নাম- ‘রাখালবন্দনা’। নিজেই জানালেন, খুব বেশি মানুষ পড়েননি সেই বই। কিন্তু পেয়েছিলেন আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস। বললেন, “আমার মতো হতদরিদ্র মানুষও যে লেখক হতে পারে, এই বিশ্বাসটা তৈরি হল তখন থেকে। ঠিক করলাম, যা-ই হয়ে যাক, লেখা আমি ছাড়ব না।” দ্বিতীয় বই লিখলেন ছোটদের জন্য। বিষয় কলকাতার গড়ে ওঠার ইতিহাস। নাম- ‘গল্পকথায় কলকাতা’। পূণ্যবাবুর কথায়, পূণ্যবাবু হেসে ফেলেন। তৃপ্তির হাসি।

পূর্ণেন্দুবাবুর বাড়ি ক্যানিং থানার অর্ন্তগত এক নম্বর পূর্বদিঘির পাড় গ্রামে। গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে মাতলা নদী।  তার পাশেই আদিবাসীদের পাড়া। পূণ্যবাবুদের পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বালিতে। তাঁর কথায়, “আমাদের পরিবার ছিল কৃষিজীবী। আর্থিক অবস্থা মোটের উপর স্বচ্ছলই ছিল। কিন্তু ১৯৪৩ সালে এই এলাকায় ভয়াবহ বন্যা হয়। আমাদের ভদ্রাসন চলে যায় মাতলা নদীর গ্রাসে। সর্বস্ব হারিয়ে আমরা কার্যত পথের ভিখিরি হয়ে যাই। তার পর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে অভাব আমাদের অঙ্গের ভূষণ।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েের গবেষক সুরঞ্জিত দেবদাসের কথায়, “পোর্ট ক্যানিংয়ের ইতিহাস সংংক্রান্ত বিষয়ে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখেছেন পূণ্যবাবু। কঠোর জীবনযুদ্ধের মাঝে যে ভাবে তিনি অতীতের ধুলো ঝেড়ে ক্যানিং বন্দরের ইতিহাস খুঁজে বের করেছেন, তার তুলনা নেই। এই ধরনের গবেষণা দুর্লভ।”

পূণ্যবাবুর বই আদৃত হয়েছে গবেষক মহলে। কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রায় কোনও পরিবর্তন আসেনি। এখনও তাঁর নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মধ্য ষাটে পৌঁছেও প্রতি দিন দেড় ঘন্টা ভিড় ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে যাদবপুরে আসেন তিনি। বললেন, “আমি কেন এত কিছুর পরেও লিখতে পারি জানেন? আমার স্ত্রী পাশে আছেন বলে। উনিই আমার প্রথম শ্রোতা, প্রধান সমালোচক। অনেকে হাসাহাসি করেন আমায় নিয়ে, ফুটপাথের হকারের সাহিত্যচর্চার স্পর্ধা অনেকের পরিহাসযোগ্য বলে মনে হয়। সেই সময় আমায় আগলে রাখেন আমার স্ত্রী রেখা। আমায় সাহস দেন। বলেন, সংসার ঠিক চলে যাবে, আমার কলম যেন বন্ধ না হয়।”

কথা বলার ফাঁকেই ফের বই বিক্রিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পূর্ণেন্দু। বললেন, “নিজেকে নিয়ে ভাবি না। কিন্তু রেখার দুরারোগ্য কিডনির অসুখ। প্রতিজ্ঞা করেছি, চিকিৎসায় কোনও খামতি রাখব না।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *