কলকাতার অনতিদূরে কোনওদিন ইংরেজ বশ্যতা স্বীকার না করা এক শহরের নাম চন্দননগর। অবশ্য পরাধীনতার শৃঙ্খল তারও ছিল— ফরাসিদের হাতে। তার গঙ্গার ধারে,পাশে রেলিং লাগানো পাথরে বাঁধানো সাত মিটার চওড়া ফুটপাথের মতো শতাব্দীপ্রাচীন জায়গাটার পোশাকি নাম স্ট্র্যান্ড। একলপ্তে হাঁটলে প্রায় এক কিলোমিটার। ভোরের সূর্য যখন ওপারের আকাশ থেকে আলো দেওয়া শুরু করছে, জোড়াঘাটের ক্যানোপির বেঞ্চিতে ততক্ষণে বেশ কিছু নানা বয়সের মানুষ স্ট্র্যান্ডের এমুড়ো ওমুড়ো ছ’পাক দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে শুরু করে দিয়েছেন। আজ বিজনদা বেশ দেরি করে ফেলেছেন। তাই বিজনদা যখন চারপাকের মাথায়, তখন তাঁর নিত্যদিনের পার্টনার সুবোধ মুখুজ্যে বসে গেছেন বেঞ্চিতে। এখানেও একটা অলিখিত মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা আছে। দেরি করলেই দুঃখ— কপালে নয়, হাঁটুতে। এতটা হাঁটার পর হাঁটুর ব্যথা জানান দেয় তারা আছে, সশব্দে, সকাতরে।
আজ বসে বসে সুবোধ লক্ষ করলেন, বিজন একটু যেন ডানদিকে হেলে হেলে চলছেন। কাছে আসতে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলেন “বাতটা বেশ বেড়েছে ভায়া। আজ সাড়ে চার পাকেই ক্ষান্ত দিলাম।” এই বলে তখনও ফাঁকা থাকা সুবোধবাবু্র পাশের আসনটাতে বসে হাঁফাতে লাগলেন বিজন। গলায় আফশোসের সুর, “রোজ এতটা হাঁটছি, দুবেলা খাবার পরে বজ্রাসন, তারপরও ব্যাটা পোষ মানে না।” একটু বিশ্রাম নিয়ে এগোলেন ফুটপাতের ধারে রাখা সাইকেলের দিকে। প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো হারকিউলিস সাইকেল। বয়সের ছাপ প্রকট। নেহাতই তোলা তোলা করে ব্যবহার হয়, তায় সে-সময়ের জিনিস, তাই আজও সচল আছে। ধীরগতিতে তাতে চড়ে যেতে যেতে হঠাৎই কথাটা মনে এল বিজনদার।
হাঁটুদুটোও তো প্রায় সত্তর বছর হল কাজ করছে। আজ যখন তাতে ব্যথা উঠছে, তখন হাঁটাহাঁটি-বজ্রাসনের বোঝা চাপিয়ে তাদের সচল রাখার চেষ্টায় কি কিছু ভুল হচ্ছে না? সাইকেলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে তাকে তোলাতোলা করে ব্যবহারের তোয়াজ, আর হাঁটুর বেলায় পরিশ্রমের চাবুক! ভাবনাটায় একটা গলদ থাকছে মনে হচ্ছে।
গলদ সত্যি আছে। হাঁটু আসলে দুটো হাড়ের সন্ধিস্থল। উরুর লম্বা হাড় আর পা (বা leg)-এর হাড় মুখোমুখি হয় এখানে। একে অপরের গায়ে ঘষাঘষি হয় দাঁড়ানোর সময়, হাঁটার সময় বাঁ হাঁটু ভাঁজ করার সময়। সেই ঘর্ষণ যাতে হাড়ের গায়ে কোনও দাগ না ফেলতে পারে, তার জন্য হাড়ের প্রান্তভাগ ঢাকা থাকে তরুণাস্থি বা কার্টিলেজ দিয়ে। কম বয়সে সেই কার্টিলেজ বেশ মোটা। তবে চলতে চলতে টায়ারের গায়ের ‘থ্রেড’ ক্ষয়ে যেমন টায়ার পাতলা হয়ে যায়, কার্টিলেজও সেই একই প্রক্রিয়ায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাতলা হতে থাকে। শেষে এক সময়ে জায়গায় জায়গায় সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গিয়ে নীচের হাড় বেড়িয়ে পড়ে। ঠিক যেমন পিচের রাস্তায় পিচ উঠে গিয়ে গর্ত তৈরি হয়, কার্টিলেজের গায়ে তৈরি হয় ‘ডিফেক্ট’। সেই গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসা হাড় যখন ঘষা খায় উল্টোদিকের কার্টিলেজ বা হাড়ের সঙ্গে, তখন বাতের ব্যথার আসল চেহারাটা মালুম পড়ে।
এটা ঠিক যে কার কতটা কার্টিলেজ ক্ষয় হবে তা শুধুমাত্র পরিশ্রমের ওপরেই নির্ভর করে না। হাড়ের ঘনত্ব ও জোর (ঠিক যেমন রাস্তার সোলিং-এর ওপর নির্ভর করে তার উপরিতল কতটা ঠিক থাকবে গাড়ির চাপ নিতে), খাদ্যাভ্যাস, জেনেটিক গঠন (কোনও কোনও পরিবারের প্রায় সকলেই আক্রান্ত হন), শরীরের ওজন, মাংসপেশির দৃঢ়তা, পুরনো আঘাত ইত্যাদি নানা উপাদানের পারস্পরিক প্রক্রিয়ার ফল ‘অস্টিও আর্থ্রাইটিস’ নামের এই বাতরোগ। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো যে বাত বা সন্ধিস্থলের প্রদাহজনিত রোগের হাজার একটা কারণ, তাদের চিকিৎসা ও ফলাফল বিভিন্ন, কখনও কখনও আপাতবিরোধী। যেমন, এক ধরনের বাতে যদি গরম সেঁক উপকার করে, তো অন্য ধরনের বাতে তাই চরম ক্ষতির কারণ। তাই চিকিৎসার প্রশ্নে নিজের, বন্ধুর বা কোনও ‘বাবা’-র পরমর্শ নিজের ওপর প্রয়োগ করে নিজের ক্ষতি করবেন না।
ঠিক যেমন বিজনদা লোকের পরামর্শে হাঁটা বাড়িয়ে দিলেন। ভাবলেন বাতের ব্যথা কমবে। ব্যথা তো কমল না-ই, তার বদলে আরও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হল কার্টিলেজের। ফলে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন বাতজনিত পঙ্গুত্বের দিকে।
চিকিৎসা:
বয়সজনিত এই বাতের অপারেশন ছাড়া ‘ভালো করে দিলাম’ চিকিৎসা নেই। কারণ এর মূলে আছে কার্টিলেজের ক্ষয়, এতাবৎ আবিষ্কৃত ওষুধেরা যাকে রোধ করতে পারে না, তার অবনতির গতিকে কিছুটা প্রভাবিত করতে পারে মাত্র। চিকিৎসার অভিমুখ তাই তরুণাস্থির ওপর চাপ কমানো— এই লক্ষে বাঁধা। এই চিকিৎসার তিনটি স্তর—
১) প্রাথমিক স্তরে চিকিৎসার ভিত্তি কিছু বিধিনিষেধ মানা, যাতে কার্টিলেজে চাপ কম পড়ে। যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটা, হাঁটু মুড়ে বসা, সিঁড়ি ওঠানামা— এগুলো কম করে করতে হবে। অর্থাৎ ভোজন শেষে ‘গ্যাস’ মুক্তির লক্ষে বজ্রাসন না করে ভোজনেই রাশ টেনে তার চেষ্টা করাটা যুক্তিযুক্ত। আতান্তরে পড়লে গাড়ির চাকার গল্পটা মনে রাখলেই যে কোনও পরিস্থিতিতে কোনটা হ্যাঁ আর কোনটা না, তা নিজেই স্থির করতে পারবেন। হাঁটুতে ওজন না দিয়ে ব্যায়াম করা যাতে তরুণাস্থির ওপর নতুন আঘাত ছাড়াই হাঁটুর আশপাশের পেশীরা দৃঢ় হয় এবং হাঁটুর স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, সেইরকম ব্যায়াম এতে উপকারি। সাঁতার কাটা, বিছানায় বসে হাঁটুর পেছনে রাখা ছোট বালিশে চাপ দেওয়া ও ছাড়া, যাতে থাই-এর পেশীর জোর বাড়ে— এই ধরণের ব্যায়ামের উদাহরণ। একটি দৃঢ়বদ্ধ হাঁটু স্বভাবতই অল্প আঘাতে কাতর হয়ে পড়বে না।
২) মাঝামাঝি স্তরে ব্যথা কমানোর ওষুধ ও অধুনা আবিষ্কৃত কিছু ওষুধ যা ক্ষয়ের গতিকে কিছুটা হ্রাস করে বলে দাবি করা হয়, সেরকম কিছু অস্ত্রে একে কিছুটা কম যন্ত্রণাদায়ক করে রাখা হয়। ব্যথা কমানোর ওষুধ ব্যথার পাশাপাশি হাঁটুর প্রদাহ (যার বাড়াবাড়ি হাঁটুর সমস্ত তন্তুর ক্ষতি করে) নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করে। তাই হাঁটুর অস্টিও-আর্থ্রাইটিসে এরা essential medication হিসেবেই গণ্য হয়। ‘আমি ব্যথা সহ্য করতে পারি’— এই কলার তোলা মনোভাবে কখনও কখনও কিন্তু লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। এর বাইরে গত এক দেড় দশকে বেশ কিছু ওষুধ এসেছে যারা কার্টিলেজের স্বাস্থের কিছু উন্নতি করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করা প্রচুর সমীক্ষার ভিত্তিতে এ দাবির সবটাই ফাঁকা, তা বলা যাচ্ছে না। দীর্ঘ সময়ের প্রয়োগে এদের সাহায্যে হাঁটুর সার্বিক স্বাস্থ্যের অবনতির গতি অন্তত কিছুটা কমিয়ে রাখা যাচ্ছে।
হাঁটুর ভেতরে ইনজেকশন দেওয়া নিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসা অনেক। এই ইনজেকশন দু’ধরণের। একটি স্টেরয়েড। শুনেই আঁতকে উঠবেন না। অসুখের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন প্রদাহের কারণে ব্যথা প্রচুর কিন্তু কার্টিলেজ ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এমন পর্যায়ে এক বা দুটি ইনজেকশন প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যথা এবং প্রদাহজনিত ক্ষতি, দুই’ই কমাতে পারে। আর এক ধরণের ইনজেকশন হাঁটুর দুই হাড়ের মধ্যে তৈলাক্ত পদার্থের মাত্রা বাড়িয়ে তাদের ঘর্ষণজনিত ক্ষয় কমায়। তাতে হাঁটুর কিছু আয়ুবৃদ্ধি হয়। তবে একটি ডোজের কার্যকারিতা এক থেকে দেড় বছরেই শেষ হয়ে যায়। কোন স্থায়ী সমাধান দেওয়ার ক্ষমতা এদের নেই।
এই স্তরে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, নি-ক্যাপ ও বিভিন্ন ধরণের নি-সাপোর্ট হাঁটুর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বেশিরভাগ রোগীর হাঁটুর ব্যথা এই সবের কুশলী প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব আজীবন। তবে ‘নিয়ন্ত্রণ’, এই শব্দটা মনে রাখতে হবে। ষাট বছর কাজ করা হাঁটু কুড়ি বছরের সুন্দরী হয়ে আপনার সঙ্গ করবে এটা ভাবা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
৩)বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যে নির্দিষ্ট চিকিৎসায় হাঁটুর যন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব, তার নাম ‘joint replacement’ বা সন্ধি প্রতিস্থাপন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত তরুণাস্থি ও সংলগ্ন হাড়ের একটা স্তর কেটে ফেলে দিয়ে একটি ধাতু ও প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থের স্তর বসিয়ে দেওয়া হয়। দুটো প্লাস্টিক তলের ঘর্ষণ হাড় অবধি পৌঁছয় না। ফলে ব্যথার অনভুতি থেকে দীর্ঘস্থায়ী মুক্তি মেলে। তবে নির্দিষ্ট বয়সের আগে এই অপারেশন করা যায় না। তাই তুলনায় তরুণ কিন্তু বেশিরকম ক্ষতিগ্রস্ত হাঁটু যাদের, তাদের জন্য থাই বা পায়ের হাড়ের কোনও একটিকে কোনাকুনি কেটে ওজন নেওয়া অংশের পরিবর্তন করে (অস্টিওটমি) কয়েক বছরের সময় কেনা সম্ভব। তবে তারপর প্রতিস্থাপনই মুক্তির উপায়। মনে রাখা দরকার, যে কোনও অপারেশনের মতো এতেও একটা অতি অল্প শতাংশ অসাফল্য আছে। আজ শতাংশের হিসেবে সাফল্য কিন্তু ৯৮% ছুঁয়েছে। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন রাস্তার পিচ অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হলে সম্পূর্ণ নতুন প্রলেপ ছাড়া যেমন দীর্ঘস্থায়ী ফল মেলে না, হাঁটুর ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ক্ষতি হয়ে গিয়ে থাকলে প্রতিস্থাপনই তার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান।
নতুন মোরাম দেওয়া রাস্তায় গাড়ি চালাবার মজা বিজনদার জন্য অপেক্ষা করছে। সে মজা চেখে দেখবেন কিনা বিজনদারা, সেটা অবশ্য তাদের বিবেচনা।
ছবি সৌজন্য: লেখক
ডাঃ ভাস্কর দাস পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। নেশা ফোটোগ্রাফি, লেখালেখি। ভ্রমণ ও বাংলার অতীত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির খোঁজ প্রিয় বিষয়।
লেখা প্রকাশিত দেশ, হরপ্পা, কৃত্তিবাস, সাপ্তাহিক বর্তমান, ইত্যাদি পত্রিকায়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন। এ বছরে ভ্রমণআড্ডা সংস্থার 'কলম' সম্মান প্রাপক।