আগের পর্ব পড়তে: [১]
শতবর্ষে পা দিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ। বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাঁর লেখায় কোনওদিনই কোনও গ্ল্যামারের ঝলকানি বা রাজনৈতিক উস্কানিমূলক মন্তব্য থাকত না। থাকত এক শান্ত সৌন্দর্য, ধৈর্যবান পর্যবেক্ষণ আর ভারসাম্যময় বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দী ব্যাপী কর্মজীবন নিয়ে তিনি যেন সাংবাদিকতার এক খোলা পাঠ্যপুস্তক। তাঁকে বাংলা সাংবাদিকতার শিক্ষক বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। ১৯৪৫ সালে তাঁর সাংবাদিকতায় যোগদান। তারপর নানাভাবে তা প্রবাহিত থেকেছে গত শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যন্ত। সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদপত্রে। নতুন পথ দেখিয়েছেন ‘ওভারল্যান্ড’ সম্পাদনা করতে এসে। স্পষ্ট, অকম্পিত বাচন বরাবর তাঁর পছন্দ। নিজের কলমেও এর প্রকাশ অবিচল থেকেছে। এর জন্য বহু উঁচু পদ ও নানা সুযোগসুবিধা হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু বদলাননি শংকর ঘোষ। তাঁর বিপুল রচনারাজি পড়লে আজ তাঁকে এক একক ‘ক্রুসেডার’ মনে হয়। যেন সময়-পথের একলা অভিযাত্রী। এক নির্ভীক মেধাবী বাঙালি, এক সত্যদ্রষ্টা বিশ্বজনীন ভারতীয়ের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
যে নিবন্ধ বাংলালাইভ পুনঃপ্রকাশ করতে চলেছে, তার প্রথম প্রকাশকাল ছিল ডিসেম্বর ১৯৬০। তখন ভারতে নেহরু শাসনের স্বর্ণযুগ। আর শংকর ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি। নেহরু পাকিস্তান গিয়েছিলেন সে বছর। সেই সময়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে অন্যতম বাধা ছিল সিন্ধুনদের জলবণ্টন। আয়ুব খান তখন পাকিস্তানের সামরিক প্রধানমন্ত্রী। সিন্ধুর জল-বিরোধ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করতে নেহরুর পাকিস্তান যাত্রা। সবার আশা ছিল সিন্ধুর জল সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা হলে অন্য দুটি বিরোধ, কাশ্মীর এবং পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করাও সহজ হবে। দু’দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষই চেয়েছিলেন ভারত-পাকিস্তান মৈত্রী।
দেশের সব কটি বড় কাগজ থেকে নেহরুর সঙ্গে পাকিস্তানে সাংবাদিক পাঠানো হয়েছিল। নেহরুর জন্য পাকিস্তানে যে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হয়েছিল তা দেখে ভারতীয় সংবাদিকরা প্রায় সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা লিখলেন, পাকিস্তানের আমজনতা নেহরুকে দেখে উদ্বেলিত, তাঁরা নেহরুকে একবার চোখের দেখবার জন্য কড়া রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। গলদঘর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন কিন্তু এতটুকু ধৈর্য হারাননি। শংকর ঘোষের কিন্তু তা মনে হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল, রাস্তার দু’পাশে যেমন বেশকিছু জায়গায় লোক জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, তেমনি অনেক জায়গায় রাস্তার দুপাশ খালি ছিল, নেহরুকে দেখার জন্য ভিড় ছিল না কোনও দর্শনার্থীর। পাকিস্তান সরকারের অভ্যর্থনায় কোনও আন্তরিকতা ছিল না, ছিল না কোনও উষ্ণতার প্রকাশ। শংকর ঘোষ লিখলেন, সরকারি অনুশাসন মেনে একজন বিদেশি প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনার জন্য যেটুকু করা প্রয়োজন, পাকিস্তান সরকার ঠিক সেটুকুই করেছে, তার বেশি কিছু করেনি। প্রশাসনিক সব ব্যাপারে সামরিক শাসনের সুস্পষ্ট ছাপ। নেহরুর আপ্যায়নে কোথাও সাধারণ মানুষের অন্তরের যোগ নেই।
পাকিস্তানে ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেল থেকেই টেলিগ্রাফ মারফত ভারতে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই খবর দেশের কাগজে বেরনোর আগেই একজন সরকারী কর্মী শংকর ঘোষকে জানালেন যে নেহরুর সঙ্গে যেসব ভারতীয় সাংবাদিক এসেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সকলেই নেহরুর প্রতি পাকিস্তানের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়েছেন, তাঁদের রিপোর্টেও সে কথা তাঁরা লিখেছেন, কেবল একজন ছাড়া। তিনি লিখেছেন, শুধু প্রোটোকল মেনে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে, তার বেশি কিছু হয়নি। শংকরের বুঝতে বাকি থাকল না যে ব্যতিক্রমী সাংবাদিকটি যে তিনি, সেকথা বুঝতে ওঁদের বাকি নেই। এই রিপোর্টি যে সংশ্লিষ্ট দফতরের চোখ এড়িয়ে যায়নি, সেটাও জানিয়ে গেলেন। নেহরু সফরের পরবর্তী ধাপে শংকর ঘোষকে অন্য সাংবাদিকদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হল। ওঁর স্থান হল হোটেলের আউটহাউসে।
পাকিস্তানে যা দেখেছিলেন, দেশে ফেরার পরে শংকর তাঁর তৎকালীন কর্মস্থল আনন্দবাজার পত্রিকায় সে বিষয়ে লিখেছিলেন। ওঁর ধারণা হয়েছিল, ওদেশের সর্বত্র একটি নির্মাণকার্য চলেছে, জেনারেল আয়ুবের ভাবমূর্তি নির্মাণ। পাকিস্তান সরকার তাতে আরও চটেছিল এবং পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে যে সব সরকারি খবর ও বিজ্ঞপ্তি তিনি নিয়মিত পেতেন, তা আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শংকর নিজের মতামত থেকে একচুল সরেননি। চিরদিন নিজের কাছে যা সত্য বলে মনে হয়েছে, তাই রিপোর্ট করেছেন। তার জন্য কাগজের মালিক বা কোনও সরকারের বিরাগভাজন হলেও তার পরোয়া করেননি। পাকিস্তানের ওপরে লেখা তাঁর এই নিবন্ধমালা প্রমাণ করে সাংবাদিক হিসাবে শংকর ঘোষ কতখানি নির্ভীক ও নিরপেক্ষ ছিলেন।
তাঁর স্ত্রী ও সুলেখক শ্রীমতী আলপনা ঘোষের বদান্যতা ও প্রশ্রয়ে এই দুষ্প্রাপ্য লেখাদুটি পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। উপরের ভূমিকাটিও তাঁরই লেখা। শ্রীমতী ঘোষকে বাংলালাইভের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।
মধ্যপর্বলোপী নয়া জমানা–
জঙ্গিনেতা থেকে জননেতা, আয়ূূব খাঁর লক্ষ্য
তেরো বছরের স্বাধীনতায় পাকিস্তানে কতজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তা হিসাব না করে বলা শক্ত। তার সঙ্গে গভর্নর জেনারেল, প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের যোগ করলে তো কথাই নেই। এই যে কয়েকশত লোক গত তেরো বৎসরে কোন না কোন সময় পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন, আজ পশ্চিম পাকিস্তানের কোথাও তাঁদের দর্শন মিলবে না। রাজনীতি থেকে তাঁদের অনেকেই অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন, সেকথা জানা ছিল। কিন্তু সামাজিক জীবন থেকেও যে তাঁরা নির্বাসিত, তা পাকিস্তান যাওয়ার পর জানলাম।
পাকিস্তানের ইতিহাস যাঁদের জানা নেই, তাঁরা আজ পাকিস্তানে গেলে ভাবতে পারেন জিন্নার পরই পাকিস্তানের নেতা জেনারেল আয়ূব খান। মধ্যের দশ বছরের ইতিহাস মুছে ফেলবার জন্য আয়ূবতন্ত্র প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। সরকারি দপ্তরখানা, হোটেলে, স্টেশনে সর্বত্র সামরিক, বেসামরিক পোশাকে আয়ূব খানের ছবির ছড়াছড়ি। অধিকাংশক্ষেত্রেই তিনি অদ্বিতীয়, এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদ-ই-আজম জিন্নার ছবিও নেই। মনে পড়ে, মাত্র দু’টি জায়গায় আয়ূব খানের ছবির সঙ্গে জিন্নার ছবিও দেখেছিলাম— লাহোরের গভর্নমেন্ট হাউসে আর রাওলপিণ্ডি এয়ারপোর্টে। করাচি পৌঁছে নেহরুজীর প্রথম কাজ ছিল জিন্নার সমাধিতে মাল্যদান। সেই উপলক্ষ ছাড়া আর কোথাও জিন্নার নাম উচ্চারিত হতে শুনিনি, সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য আলোচনায় জিন্নার উল্লেখ কেউ করেননি।

স্বয়ং জিন্নার যখন এই অবস্থা, তখন অন্য নেতাদের কথা উঠতেই পারে না। অথচ জিন্নার পরে যাঁরা পাকিস্তানের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সকলেই যে কূটচক্রের বলে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তা নয়। তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের অবিসম্বাদী নেতা লিয়াকৎ আলি খান ছিলেন; গোলাম মহম্মদের জনপ্রিয়তাও কিছু কম ছিল না। কিন্তু আয়ূবী সরকার এঁদের সকলের উপরেই এক বুরুশে রং লাগিয়েছেন, বলেছেন এই বারো বৎসরের ইতিহাস একটানা দুর্নীতির ইতিহাস, রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তানকে সর্বনাশের অতল খাদের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আয়ূব খানের আবির্ভাব না হলে আজ পাকিস্তানের অস্তিত্ব পর্যন্ত থাকত কিনা সন্দেহ। এরই সঙ্গে তাল রেখে প্রচারণ হচ্ছে যে, ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে যে উপায়ে আয়ূব খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন তা ‘ক্যূ’ নয়, ‘রেভল্যুশন’। ১৯৬০ সালের অগাস্ট মাসে পাকিস্তানের স্বাধীনতার চোদ্দ বছর পূর্ণ হয়েছে বটে, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা আর কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বিপ্লব তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করবে।
বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের তোড়জোড় এখন থেকেই শুরু হয়েছে। যে সংবাদপত্রটি প্রথমে মুসলিম লিগ, পরে পাকিস্তানি নীতির নিয়ামক ছিল, সেই কাগজটিও আজ বিপ্লব এবং বিপ্লবের নায়কের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিপ্লবের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একশ পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে কাগজটি আয়ূবী শাসনের প্রতি তার আনুগত্য ঘোষণা করবে। শুধু একটি কাগজের কথা বললে অন্যায় হবে, সব কাগজেরই এক রা। কাগজে কাগজে প্রতিযোগিতা কেবল আয়ূবস্তুতির। করাচিতে একদিন একটি ‘দায়িত্বশীল’ কাগজের সম্পাদকীয় পড়লাম, নেহরুজীর আয়ূব খানের মতো জনপ্রিয়তা নেই বলে তাঁর পক্ষে কাশ্মীর সমস্যার কোন ন্যায় ও যুক্তিসিদ্ধ সমাধানে সম্মত হওয়া শক্ত। তবে ভারত ও পাকিস্তানের কল্যাণার্ধে তাঁর মতো নেতার কাছ থেকে সেই ঝুঁকি নেওয়ার উদারতা আশা করা অন্যায় হবে না।

এই প্রচারণে ফল হয়েছে। সামরিক আইন সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছিল, পাকিস্তানের সকলেই আজ আয়ূবী শাসনের গুণকীর্তনে ব্যস্ত। তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন, দুর্নীতি একেবারে দূর করতে না পারলেও (কার পক্ষেই বা তা সম্ভব?) দমন করেছেন, আমলাতান্ত্রিক লালফিতা তাঁর শাসনে গজ থেকে ইঞ্চিতে নেমেছে, তিনি দেশে আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আয়ূব ও তাঁর সামরিক আইন ছাড়া এই অসাধ্যসাধন সম্ভব হত না। প্রশ্ন করেছি, আয়ূব খানের আবির্ভাবের আগে যে বারো বছর কেটেছে, তখন তো এসব অভিযোগ কখনও ওঠেনি। আজ না হয় অভিযোগকারীর বিপদের সম্ভাবনা আছে কিন্তু তখন তো সমালোচনার অধিকার অব্যাহত ছিল। অধিকাংশই উত্তর দিয়েছেন, এসব তথ্য তখন তাঁদের জানা ছিল না, আয়ূবী ঝাঁটার কল্যাণে এরা অন্ধকার থেকে দিনের আলোয় এসে পড়েছে। এঁদের বিব্রত করার ইচ্ছা ছিল না বলেই মন্তব্য করিনি যে, আয়ূবী শাসনের যদি কোনদিন অবসান হয় এবং তাঁর আসনে যদি পুরনো নেতাদের কেউ ফিরে আসেন তাহলে আয়ূব খান সম্বন্ধে তিনি যে রায় দেবেন তার প্রতিবাদ জানাবেন কি।
মন্তব্যের পরিবর্তে জানতে চেয়েছি, তাহলে কি আপনারা গণতন্ত্র চান না, আপনাদের মতে কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়। তাঁরা বলেছেন, দোষ গণতন্ত্রের নয়, দোষ পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের। তাঁদের দুষ্কার্যের জন্যই পাকিস্তান থেকে সাময়িকভাবে গণতন্ত্রের অন্তর্ধান ঘটেছে। তাঁরা দেশের যে ক্ষতি করেছেন তা পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানে আবার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে। দেশের কল্যাণে পাকিস্তানের জনসাধারণ তাঁদের স্বাধীনতা খর্বে রাজি হয়েছেন বটে, কিন্তু বিনা শর্তে নয়। তাঁদের শর্ত সময় এলেই পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, যে-স্বাধীনতা হরণে তাঁরা স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছেন সেই স্বাধীনতা তাঁদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ক্ষমতালাভের অব্যবহিত পর থেকে সে প্রতিশ্রুতি আয়ূব খান তাঁদের বারবার দিয়েছেন। এ মনোভাব আয়ূব খানের অজানা নয়। তিনি জানেন যত সহজে ক্ষমতা দখল করেছেন তত সহজে বরাবরের জন্য ক্ষমতা হাতে রাখা সম্ভব হবে না। জরুরি অবস্থার দোহাই দিয়ে কয়েক বছর চালানো যায়, তারপরও জরুরি অবস্থার কথা তুললে তার দায়িত্ব তাঁর নিজের উপরই বর্তাবে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবির্ভাবের সময় আয়ূব খান নিজেকে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলেই প্রচার করেছিলেন, বলেছিলেন সুস্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই তিনি কঠোর হয়েছেন। আজ তিনি গণতন্ত্রের পথরোধ করলে সেদিন যাঁরা সহজে তাঁকে মেনে নিয়েছিলেন তাঁরা বিরোধিতা করতে পারেন। তা যে সম্ভব তার প্রমাণ তিনি ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত কী, তা স্পষ্ট করে জানানো সত্ত্বেও পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিক ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। ক্ষমতা বজায় রাখা এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গের ঝুঁকি এড়ানো দুই-ই সম্ভব, একমাত্র জঙ্গিনেতা থেকে তাঁর গণতান্ত্রিক নেতার রূপান্তরে। আয়ূব খান সেই পথই বেছে নিয়েছেন। সন্দেহ নেই পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হলে তিনি সংবিধানসিদ্ধ উপায়ে দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণের চেষ্টা করবেন। তার জন্য শুধু সেনাবাহিনীর আস্থাই যথেষ্ট নয়; তাঁকে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে আয়ূব খান আজও জনপ্রিয়। নিভৃত কক্ষে অন্তরঙ্গ আলোচনায় কী হয় জানি না, তবে প্রকাশ্য আলোচনায় আয়ূব খান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য কোথাও শোনা যায় না। কিন্তু আয়ূব খান জানেন, তার কারণ শ্রদ্ধা না হয়ে সামরিক আইনের ভয়ও হতে পারে। যেদিন সে-ভয় দূর হবে, সেদিন এই কয় বছরের রুদ্ধ আক্রোশ তাঁর উপর অনাস্থার আকারে প্রকাশ পেতে পারে। সামরিক আইনের পাহারাদারির সামনে পাকিস্তানের জনগণ তাঁকে যে আনুগত্য দেখাচ্ছেন, তার উপর নিজের ভবিষ্যৎ বাজি রাখতে তিনি নারাজ। তিনি নিজেকে জননেতা হিসাবে গড়ে তুলতে চান, জনগণের শ্রদ্ধাভাজন হতে চান। তাই একদিকে তিনি যেমন সামরিক আইনের কঠোরতা শিথিল করছেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁরই ইঙ্গিতে প্রচারণের বন্যা শুরু হয়েছে। এ-বন্যার স্রোতে যদি পাকিস্তানের ভোটদাতারা শেষ পর্যন্ত ভাসতে রাজি না হন, তাহলে হয়ত আয়ূব খানের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিই ভেসে যাবে।
ঠিক একই কারণে নেহরুজীর সঙ্গে আলোচনায় আয়ূব খানের এত আগ্রহ। পাকিস্তানের জঙ্গি সরকার ও জঙ্গি নেতাকে পাকিস্তানের প্রকৃত প্রতিনিধ বলে মেনে নিতে নেহরুজীর প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল। আয়ূব খানের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার আলোচনায় তাঁর বরাবরের অনাগ্রহ। আয়ূব খান পছন্দ করুন চাই না করুন, একথা তাঁর অজানা নয় যে, দেশে বিদেশে গণতান্ত্রিক নেতা বলে গণ্য হতে হলে তাঁর নেহরুজীর সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই দু’বার ব্যর্থ হওয়ার পরও তিনি তৃতীয়বার নেহরুজীর সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। নেহরুজীর পাকিস্তান সফরে ভারত-পাকিস্তান সমস্যাগুলি সমাধানের দিকে কতখানি এগিয়েছে তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ব্যক্তিগতভাবে আয়ূব খান লাভবান হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে নেহরুজী স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আয়ূব খান যেভাবেই ক্ষমতা দখল করে থাকুন না কেন, আজ তাঁর পিছনে পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন আছে। (ক্রমশ)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৭ জুলাই ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, The Hindu, Aaj Tak
*মূল বানান অপরিবর্তিত
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।