তরুণ বয়সে একটি কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম ‘ছবি ও গান’ রাখলেও সেই পর্বে চিত্রকলার প্রত্যক্ষ জগতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল বেশ খানিকটা দূরে। যদিও কবিতা লেখার খাতায় আঁকিবুকি কাটার কাজ চলেছে বহুদিন আগে থেকে— ‘মালতী’ পুঁথির সময়ে এর সূচনা। তবে স্বীকার করতে হবে, পরিণত বয়সের ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি, সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরবর্তীকালের চিত্রকরের মিল খুঁজতে চাওয়া ঠিক নয়। এই পর্বে রংতুলির পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ ছবি রচনা করেছেন শব্দের প্যালেট হাতে নিয়ে। সাহিত্যের বর্ণনা হয়ে উঠেছে এক একটি মিনিয়েচার পেইন্টিং, নিসর্গের অনুপম চিত্রমালায় গাঁথা তাঁর ‘ছিন্নপত্রাবলী’কে আমাদের ডাকতে ইচ্ছে করে ছিন্ন-চিত্রাবলীর সম্বোধনে৷

ক্রমে বিশের দশকের গোড়ায় কলাভবন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চিত্ররচনার দিকে তাঁকে আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায়। যদিও তার অনেক আগে জোড়াসাঁকোয় ‘বিচিত্রা’ স্কুলের সূচনা হয়েছে। কিন্তু শৌখিনভাবে চলা সেই আর্টের আবহাওয়ায় রবীন্দ্রনাথের তেমন সায় ছিল না। খেয়াল করলে দেখি, নোবেল-অধ্যায়ের পর প্রথম বিদেশযাত্রায়, জাপানে গিয়ে সে দেশের শিল্পকলার প্রসঙ্গ টেনে অবন-গগনকে যথেষ্ট বকুনি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকী তাঁদের আর্ট যে ষোলো আনা সত্যি হয়ে উঠতে পারেনি— বলছেন সেই কথাও। 

Kalobari old
কলাভবনের ‘কালোবাড়ি’ তখন সবে তৈরি হয়েছে।

এই সময়ে ‘বিচিত্রা’ স্কুল থেকে তাঁর মন যেন কিছুটা সরে যেতে চাইছে। মনে হচ্ছে শিল্পকলায় আরও একটু জোর চাই। বিদেশে গিয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে অনুভব করেছেন যে, আমাদের দেশে আর্টের হাওয়া সেভাবে প্রবাহিত হয়নি। মনে হয়েছে, দক্ষিণের বারান্দা থেকে বেরিয়ে না পড়লে তা বুঝতে পারাও সহজ নয়। জাপান থেকে কঠিন স্বরে বলেছেন— 

‘জাপানে যতই ঘুরলুম, দেখলুম, ক্রমাগতই বারবার এইটে মনে হল যে আমার সঙ্গে তোমাদের আসা খুবই উচিত ছিল। আমাদের দেশে আর্টের পুনর্জীবন সঞ্চারের জন্য এখানকার সজীব আর্টের সংস্রব যে কত দরকার সে তোমরা তোমাদের দক্ষিণের বারান্দায় বসে কখনই বুঝতে পারবে না। আমাদের দেশে আর্টের হাওয়া বয়নি, সমাজের জীবনের সঙ্গে আর্টের নাড়ির যোগ নেই— ওটা একটা উপরি জিনিস, হলেও হয় না হলেও হয়, সেইজন্যে ওখানকার মাটিতে থেকে কখনই তোমরা পুরো খোরাক পেতে পারবে না। একবার এখানে এলে বুঝতে পারতে এরা সমস্ত জাত এই আর্টের কোলে মানুষ— এদের সমস্ত জীবনটা এই আর্টের মধ্যে দিয়ে কথা কচ্চে। এখানে এলে তোমাদের চোখের উপর থেকে একটা মস্ত পর্দা খুলে যেত, তোমাদের অন্তর্যামিনী কলাসরস্বতী তাঁর যথার্থ নৈবেদ্য পেতে পারতেন। এখানে এসে আমি প্রথম বুঝতে পারলুম যে তোমাদের আর্ট ষোলো আনা সত্য হতে পারেনি।’

Kala Bhavan
কলাভবনের গায়ে ফ্রেস্কো

এই তীব্র বকুনির উত্তর অবনীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন কিনা জানি না। ‘রবিকা’র ভাবনার সঙ্গে সব সময় অবন-গগনের ভাবনার মিল হয়েছে, তাও নয়। আমরা দেখেছি, শিল্পী ভাইপোরা বরাবর নিজেদের মতো করে পথ কেটে এগিয়ে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মনে একটা সংকল্প এই সময়ে গড়ে উঠতে দেখি, যা ‘বিচিত্রা’ স্কুলের বিপরীতে ‘সজীব আর্টের’ আবহাওয়া রচনা করতে পারে। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তাঁর নিজের মতো করে একটা শিল্পনিকেতন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন। সেখানকার ব্রহ্মবিদ্যালয়ে গোড়া থেকেই ছবির নিয়মিত পাঠের প্রচলন ছিল। তবে স্বতন্ত্র একটি শিল্পকলার আখড়া গড়ে তোলার ভাবনা কবির মনে সুস্পষ্ট আকার নিতে থাকে এই সময় থেকেই। বলা বাহুল্য, সে কাজ খুব একটা সহজ ছিল না। শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে রবীন্দ্রনাথকেও অনেকটা বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে।

এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন ছিল এমন একজন শিল্পী ও শিক্ষক, যাঁর ওপর নিশ্চিন্তে সেই শিল্পনিকেতনের ভার দেওয়া যায়। আর আর্ট-স্কুলের দায়িত্বভার প্রসঙ্গে যে নামটি প্রথমেই তাঁর মনে পড়েছে, তিনি নন্দলাল বসু৷ নন্দলালের হাতে কলাভবনের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে সমস্যা এখানেও কম নয়। নন্দলাল আচার্য অবনীন্দ্রনাথের প্রিয়তম ছাত্র, গুরুর অনুমতি না-পেলে শিষ্য এখানে আসবেন কীভাবে! আবার নন্দলাল তখন ‘বিচিত্রা’য় চিত্রকলার পাঠ দিচ্ছেন, অবনীন্দ্রনাথ যে কিছুতেই তাঁকে কাছছাড়া করতে চান না, তা সকলে অবহিত। এ অবস্থায় শান্তিনিকেতন আর্টস্কুলের ভার কাকে দেওয়া যায়— এই ভাবনা কবিকে চিন্তিত করেছে, কিন্তু প্রয়াস থেমে থাকেনি। অবশেষে ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে পৌষ উৎসবের মধ্যেই ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের বার্ষিক সভার পরে বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। আরও কিছু পরে ১৯১৯-এর এপ্রিল নাগাদ রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, নন্দলাল ও সুরেন্দ্রনাথ কর সেখানে চিত্রকলার পাঠ দেবেন। 

Kala Bhavan students
কলাভববেনর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কবি। কবির ডাইনে নন্দলাল বসু

কাছাকাছি সময়ে ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে ঘোষিত হয়েছে ‘চিত্রবিদ্যা’র শিক্ষা দেবেন নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ কর। এরই মধ্যে জোড়াসাঁকোর ‘বিচিত্রা” স্কুলের শিক্ষকতার ফাঁকে নন্দলাল শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়েছেন, এবং কিছুদিনের মধ্যে সে কাজ ছেড়ে কলকাতায় ফিরেও গিয়েছেন। শান্তিনিকেতন থেকে নন্দলালের চলে যাওয়ার ব্যাপারে গুরু অবনীন্দ্রনাথের নির্দেশ কাজ করে থাকবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ও অবন, কাকা-ভাইপোর মধ্যে মতান্তর গড়ে উঠলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সে কথায় পরে আসছি। তবে সেই দুর্যোগে কলাভবনের হাল ধরেছেন ঠাকুরবাড়ির আর এক তরুণ শিল্পী, অবনীন্দ্রনাথের অন্যতম শিষ্য অসিতকুমার হালদার।

কাকা-ভাইপোর সেই অভিমান পর্বে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি আমাদের হাতে এসেছে। এই চিঠি আমাদের একেবারে অজানা, তা নয়। তবে কলাভবন গড়ে ওঠার প্রাক্কালে বার বার চিঠিটি পড়ে সেই সময়ে কবির মনের কথাকে বুঝে নিতে হয়। চিঠির ভাষা থেকে উপলব্ধি করতে পারি, কলাভবনের জন্য তাঁর ভাবনা ও প্রতিজ্ঞার শিকড় কত গভীরে নিহিত ছিল। ঘটনাটি পুনরায় বলা প্রয়োজন, কারণ রবীন্দ্রনাথ যে কেবল একটি আর্ট-স্কুল তৈরি করতে চেয়েছিলেন তাই নয়, তিনি চেয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার দিগন্তটি আরও প্রসারিত হোক। তবে রবীন্দ্রনাথের সেই অভিমান-ভরা চিঠির দিকে নজর দেবার আগে প্রেক্ষাপটের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। 

Kalobari
কলাভবনের বিখ্যাত ‘কালোবাড়ি’

খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মাবকাশ সারা হলে কলকাতার ‘বিচিত্রা’ স্কুল ছেড়ে জুলাই মাসের গোড়ায় নন্দলাল সেখানে এসে কাজে যোগ দিলেন। অবশ্য এই প্রথম পর্বে খুব বেশিদিন শিল্পশিক্ষার পাঠ তিনি দিতে পারেননি। সমগ্র প্রেক্ষাপটের দিকে তাকিয়ে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, গুরু অবনীন্দ্রনাথের নির্দেশে নন্দলাল ফিরে গিয়েছিলেন। সময়ের নিরিখে তিনি পাঠ দিয়েছেন গ্রীষ্মাবকাশের পর থেকে শারদাবকাশের আগে পর্যন্ত মাত্র কয়েকটা মাস। উল্লেখ্য, এর মধ্যেই গুরু অবনীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়তম শিষ্যকে এমন একটি চিঠি লেখেন যে নন্দলাল শান্তিনিকেতনের কাজ ছেড়ে দেন। যদিও অবনীন্দ্রনাথের চিঠিটির হদিশ পাওয়া যায়নি। রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে সে বিষয়ে কিছুটা অনুমান করা যায় মাত্র। সন তারিখের হিসেবে, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ায় বিশ্বভারতীর শারদাবকাশের পর তিনি ছুটি থেকে ফিরে আর কাজে যোগ দিলেন না। 

এদিকে রবীন্দ্রনাথ সেই মুহূর্তে শিলং, গৌহাটি ও আগরতলা থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে নন্দলালের কাজে যোগ না-দেওয়ার খবরটি জানলেন। অত্যন্ত আহত ও ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ একটি মর্মস্পর্শী চিঠিতে ভাইপো অবনীন্দ্রনাথকে বেশ কঠিন সুরে লিখলেন— 

‘নন্দলালকে যে চিঠি দিয়েছ সেইটি পড়ে বড় উদ্বিগ্ন হয়েছি। তার জন্যে আমাকে অনেক ব্যবস্থা ও খরচ করতে হয়েছে এবং আশাও অনেক করেছিলুম। আমার আশা নিজের জন্য নয়— দেশের জন্যে, তোমাদের জন্যে। এই আশাতেই আমি আর্থিক অসামর্থ্য সত্ত্বেও বিচিত্রায় অকৃপণভাবে টাকা খরচ করেছিলুম।… আমি ক্ষতিকে ক্ষতি মনে করিনি— আজও করিনে। কলকাতায় ভাল করে শিকড় লাগল না বলেই এখানে কাজ ফেঁদেচি। সফলতার সমস্ত লক্ষণই দেখা দিয়েছে। ছাত্রেরা উৎসাহিত হয়েছে, শিক্ষকেরাও— একটা atmosphere তৈরি হয়ে উঠবে। নন্দলালের নিজের রচনাও এখানে যেমন অব্যাহত অবকাশ ও আনন্দের মধ্যে অগ্রসর হচ্ছে এমন কলকাতায় হওয়া সম্ভবপর নয়— সেইটেই আমার কাছে সবচেয়ে লাভ বলে মনে হয়। নন্দলাল এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন— বাহির থেকে তাঁর উপরে কোনো দায়িত্ব চাপানো হয়নি— তাছাড়া এখানে তাঁর নিজের কাজের ব্যাঘাত করবার কোনো প্রকার উপসর্গ নেই। আরও একটি সুবিধা এই, এখানে সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় নন্দলাল যোগ দেওয়ায় মনের মধ্যে সে যে একটি নিয়ত আনন্দলাভ করচে সেটা কি তার প্রতিভার বিকাশে কাজ করবে না? তোমাদের সোসাইটি প্রধানত চিত্র প্রদর্শনীর জন্যে— এখান থেকে তার ব্যাঘাত না হয়ে বরঞ্চ অনুকুল্যই হবে।… 

Kala Bhavan exhibition
কলাভবনের প্রদর্শনী মহাত্মা গান্ধীকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন নন্দলাল বসু

অর্থাৎ আমার বক্তব্য এই যে নন্দলাল এখানে থাকাতে তোমাদেরই কাজের সুবিধা হচ্চে— অথচ এ’তে আমার আনন্দ। যদি তোমরা এর ব্যাঘাত কর তাহলে আমার যা দুঃখ এবং ক্ষতি তাকে গণ্য না করলেও এটা নিশ্চয় জেনো নন্দলালের এতে ক্ষতি হবে এবং তোমাদেরও এতে লাভ হবে না। যদি সাংসারিক উন্নতির টানে নন্দলালের এই সুযোগ গ্রহণ করার প্রয়োজন হয় তাহলে কোনো কথাই নেই— কিন্তু আমার একান্ত অনুনয় এই, তুমি গুরু হয়ে তাকে এক্ষেত্রে ডেকো না— কেননা তোমার ইচ্ছা তাকে বিচলিত করবে— অর্থের প্রয়োজন না থাকলেও করবে। নন্দলালের পরে আমার কোনো জোর নেই— কিন্তু ওর পরে আমার অনেক আশা আছে— নিশ্চয় জেনো, সে আমার কাজের দিক থেকে নয়— দেশের দিক থেকে। গবর্মেন্টের সঙ্গে আমি অর্থের প্রতিযোগিতা করতে পারব না— কিন্তু অন্য সকল বিষয়েই মঙ্গল কামনা এবং আমাদের সম্মিলিত তপস্যার দ্বারা ওর যে সাহায্য করতে পারব টাকার দ্বারা তা কখনোই হবে না। এখানে আমরা স্বার্থচিন্তা ত্যাগ করে ঈশ্বরের নাম করে যে সাধনায় প্রবৃত্ত হয়েচি, টাকার চেয়ে তার কি বড় inspiration নেই— আর সেই inspiration-ই কি সমস্ত সৃষ্টিকাৰ্য্যের সব চেয়ে বড় প্রেরণা নয়? আমার কথাটাকে তোমরা বড় করে এবং মনকে নিরাসক্ত করে চিন্তা কোরো— তবু যদি তোমাদের অন্যরূপ ইচ্ছা হয় তবে তাই ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করব, এ পর্যন্ত যেমন একলাই আমার সব কাজ করেছি, এই চেষ্টাতেও আবার সেই রকম একলাই চলতে থাকব। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন৷’ 

রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মাবকাশ সারা হলে কলকাতার ‘বিচিত্রা’ স্কুল ছেড়ে জুলাই মাসের গোড়ায় নন্দলাল সেখানে এসে কাজে যোগ দিলেন। অবশ্য এই প্রথম পর্বে খুব বেশিদিন শিল্পশিক্ষার পাঠ তিনি দিতে পারেননি। সমগ্র প্রেক্ষাপটের দিকে তাকিয়ে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, গুরু অবনীন্দ্রনাথের নির্দেশে নন্দলাল ফিরে গিয়েছিলেন। সময়ের নিরিখে তিনি পাঠ দিয়েছেন গ্রীষ্মাবকাশের পর থেকে শারদাবকাশের আগে পর্যন্ত মাত্র কয়েকটা মাস। উল্লেখ্য, এর মধ্যেই গুরু অবনীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়তম শিষ্যকে এমন একটি চিঠি লেখেন যে নন্দলাল শান্তিনিকেতনের কাজ ছেড়ে দেন।

স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি অবনীন্দ্রনাথের মনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কয়েকমাস পরে ১৯২০-এর মার্চে নন্দলাল আবার কলাভবনে ফিরে এলেন। তবে সোসাইটির সঙ্গেও তাঁর যোগ পুরোপুরি ছিন্ন হল না। ইতিমধ্যে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন অসিত হালদার। ১৯২৩ সালে নন্দলাল পাকাপাকিভাবে কলাভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হলেন। এ ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হলেন। তবে শুরু থেকে রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো করে ভাবছিলেন— তা বোঝা যায় যখন দেখি বিশের দশকের গোড়াতেই তাঁর আমন্ত্রণে কলাভবনে যোগ দিয়েছেন আঁদ্রে কার্পেলে এবং স্টেলা ক্ৰামরিশের মতো শিল্পব্যক্তিত্ব।

শান্তিনিকেতনে ক্রাফট বিভাগের উদ্বোধনে ও শিল্প-ইতিহাসের ক্ষেত্রে বিশ্বশিল্পের আধুনিক দিকটি উন্মোচনের ব্যাপারে এই দুই নারীর অবদান অসামান্য। মনে রাখতে হবে, এঁরা এসেছিলেন কলাভবনে নন্দলালের অধ্যক্ষ পদে যোগদানের আগেই৷ নন্দলালকে তখন সোসাইটি এবং কবির আর্ট-স্কুল দুটোকেই একসঙ্গে সামাল দিতে হচ্ছিল। একটু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারি, গোড়া থেকেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আর্ট-স্কুলকে পূর্বপশ্চিমের হাওয়ায় অভিষিক্ত করতে চেয়েছেন। জাতীয়তাবাদের আবহাওয়ায় কেবলমাত্র ভারতীয়ত্বের দিকে তাঁর নজর ছিল না। এমনকী স্টেলার শিল্প-ইতিহাসের ক্লাসে নন্দলালকেও উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। 

Abanindranath Tagore
নন্দলালের গুরু অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিল্পবিষয়ে কিছু দ্বন্দ্ব ছিল তাঁর কাকা রবীন্দ্রনাথের

কলাভবনের প্রথম যুগের ছাত্র বিনোদবিহারীর লেখা থেকে জানতে পারি, ‘টিশিয়ান, ডুরার ও রেমব্রান্ট সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেন ক্রামরিশ।’ এ ছাড়া পশ্চিমের আধুনিক শিল্প-আন্দোলন বিষয়ে তাঁর আলোচনা— ইম্প্রেশনিজম থেকে কিউবিজম পর্যন্ত— সেই সময়ে আমাদের দেশের যা প্রেক্ষিতে ছিল একেবারে নতুন। আর ফরাসী শিল্পী আঁদ্রে কার্পেলে শিল্পভবনে কারুশিল্পের শিক্ষাদানের পাশাপাশি কলাভবনের ছাত্রদের তেলরঙের পাঠ দিয়েছেন। স্টিল লাইফ, প্রতিকৃতি অঙ্কন ও নিসর্গচিত্র ছিল ছাত্রদের শিক্ষার প্রধান বিষয়। অর্থাৎ প্রথম পর্বের কলাভবনে পাঠে ‘কল্পনা ও চিত্রবিদ্যা শিখানো’র পাশাপাশি পশ্চিমের আধুনিক পাঠচর্চাকেও অঙ্গীভূত করার ব্যবস্থা হয়েছে। বিনোদবিহারীর কথায়: 

‘যে সংকীর্ণ গৃহে কলাভবনের কাজ শুরু হয়েছিল সেখানে উপকরণের আতিশয্য ছিল না। বিচিত্রাসভার কালে সংগৃহীত লোকশিল্পের কিছু নিদর্শন, অল্পসংখ্যক বই, জাপানি চিত্রের কলো-টাইপ প্রিন্ট— মোটামুটি এই ছিল কলাভবনের সংগ্রহালয়। সেই সঙ্গে দেয়ালে টাঙানো ছিল লেডি হেরিংহামের অনুকৃত অজন্তার কয়েকখানি ছবি। অসিতকুমার ও তাঁর শিষ্যবর্গ একই জায়গায় বসে কাজ করতেন। উপরতলায় কলাববন, নীচের সংগীতভবন। ছবি, গান, আলাপ-আলোচনা, অসিতকুমারের স্বতঃস্ফূর্ত রহস্যপূর্ণ উক্তি, অপর দিকে মাঠে মাঠে স্কেচ খাতা হাতে যথেচ্ছ ভ্রমণ—এই ছিলো কলাভবনের পরিবেশ। এই পর্বে নন্দলাল সপ্তাহে একবার কলাভবনে আসতেন, তখন সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে ছাত্রেরা তাঁর কাছে উপস্থিত হতেন। প্রধানত যে বিষয়গুলির ওপর নন্দলাল জোর দিতেন, সেগুলি হল ছবির মূল কাঠামো এবং ছবিতে ড্রয়িং ও রঙের ক্ষেত্রে সাদা-কালোর সুষ্ঠ বিভাজন। ছাত্রদের খাতায় তার সংশোধনগুলির কারণ আলোচনা করতে অসিতকুমারকে নির্দেশ দিতেন নন্দলাল। নেচার-স্টাডি নন্দলালের আরেকটি অন্যতম উপদেশের অংশ ছিল। আর অসিতকুমার প্রধানত স্টুডিয়োর কাজ পরিচালনা করতেন।’ 

‘যদি সাংসারিক উন্নতির টানে নন্দলালের এই সুযোগ গ্রহণ করার প্রয়োজন হয় তাহলে কোনো কথাই নেই— কিন্তু আমার একান্ত অনুনয় এই, তুমি গুরু হয়ে তাকে এক্ষেত্রে ডেকো না— কেননা তোমার ইচ্ছা তাকে বিচলিত করবে— অর্থের প্রয়োজন না থাকলেও করবে। নন্দলালের পরে আমার কোনো জোর নেই— কিন্তু ওর পরে আমার অনেক আশা আছে— নিশ্চয় জেনো, সে আমার কাজের দিক থেকে নয়— দেশের দিক থেকে। গবর্মেন্টের সঙ্গে আমি অর্থের প্রতিযোগিতা করতে পারব না— কিন্তু অন্য সকল বিষয়েই মঙ্গল কামনা এবং আমাদের সম্মিলিত তপস্যার দ্বারা ওর যে সাহায্য করতে পারব টাকার দ্বারা তা কখনোই হবে না।’

অর্থাৎ বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, কাগজে-কলমে অধ্যক্ষের পদে না-থাকলেও গোড়া থেকে কলাভবনের ভার সামলেছেন স্বয়ং নন্দলাল। ১৯২৩ সালে পাকাপাকি কলাভবনে চলে আসায় রবীন্দ্রনাথ যেমন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর নিজের চিত্রচর্চার দিকটিও উন্মোচিত হয়েছে এই পর্বে, ‘রক্তকরবী’র পান্ডুলিপিতে যে কবির আঁকিবুকিতে জান্তব আকারের এক পরিবর্তিত চেহারা ফুটে উঠেছে তা এই ১৯২৩ সালে। ক্রমে যা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে এক আধুনিক চিত্রকরের দরজায়। বিনোদবিহারী বলেছেন,

‘কেবল হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যেই নন্দলালের কর্মজীবন সীমাবদ্ধ ছিল না। শিক্ষকতা ছাড়া আশ্রমের উৎসব-অভিনয় সম্বন্ধে পরিকল্পনা ছিল তাঁর আর একটি দায়িত্ব। একদিকে ঘরে বসে চিত্রচর্চা অপর দিকে গোষ্ঠীগত জীবনের ক্ষেত্রে এই শিক্ষার প্রয়োগ, উভয়ের সংযোগে গড়ে উঠেছে নন্দলালের বিশিষ্ট শিক্ষার পদ্ধতি।’ 

Nandalal Padma Award
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে (ডাইনে চেয়ারে) নন্দলাল বসু এবং (বাঁয়ে চেয়ারে) সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

মাঝে মাঝে আমাদের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে চায়, পূর্বপশ্চিমের খোলা হাওয়ায় আন্দোলিত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নন্দলালের জাতীয়তাবাদী ঘেঁষা শিল্পভাবনা সব সময়ে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছিল তো? কলাভবনের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটিকে নন্দলাল ঠিকমতো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলেন তো? আমরা জানি, নন্দলালের ওপর আর্ট-স্কুলের ভার সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর মনে কখনেও কি সংশয়ের মেঘ দেখা যাচ্ছিল? রামকিঙ্করের সহপাঠী শিল্পী সুধীররঞ্জন খাস্তগীরের একটি স্মৃতিকথা এই বিষয়ে আমাদের একটু চিন্তিত করে বৈকি! ‘ভারতীয় চিত্র ও মূৰ্ত্তি-শিল্পের ষাট বৎসর’ প্রবন্ধে সুধীর লিখেছেন— ‘রবীন্দ্রনাথ যখন ছবি আঁকতে আরম্ভ করেন, সেই সময়ে এই প্রবন্ধের লেখক শান্তিনিকেতনের ছাত্র। যতদূর স্মরণ হয়, ১৯২৬ সালে গুরুদেব কলাভবনে এলেন সকালে। আমরা সকলে তাঁকে ঘিরে বসেছিলাম। মাস্টারমশাই-এর (নন্দলাল বসু) সঙ্গে তাঁর শিল্পালোচনা হচ্চিল।… কিন্তু আলোচনার বিশেষ কিছু তখন আমাদের (অন্ততঃ আমার) বোধগম্য হয়নি৷ অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর কথা তখনই আমি প্রথম শুনি। মনে আছে কয়েকটি কথা। গুরুদেব বলেছিলেন, বড় করে বাহুর জোরে মনের জোরে কল্পনার জোরে ছবি আঁকতে— ছোট সরু তুলি তুলে রাখতে বলেছিলেন। “মোটা তুলিতে নির্ভয়ে আঁকতে শেখ বলেছিলেন।” 

আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, কলাভবনের প্রথম পর্বে ঘটে যাওয়া এই ছোট্ট ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ আর নন্দলালের শিল্পভাবনায় কোথাও কি একটা ফারাক ঘনিয়ে উঠেছে?

 

*ছবি সৌজন্য: Pakka Patriot, Banglapedia, wikiart

sushobhan adhikary

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুশোভন অধিকারী একইসঙ্গে শিল্প-ঐতিহাসিক এবং সংরক্ষক। একদা কলাভবনের ছাত্র হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পরে সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘকাল। বর্তমানের রবীন্দ্র-গবেষকদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে রয়েছে বিশেষ অধ্যয়ন ও চর্চা। মাস্টারমশাই নন্দলাল নামে তাঁর লেখা বই পাঠকমহলে বহুল সমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *