আজ ২৩ এপ্রিল। ২৯ বছর আগে, এই দিনেই, প্রকাশিত হয়েছিল সুমনের ‘তোমাকে চাই’ এলবাম। বাকিটা ইতিহাস। পরের কয়েকটা প্রজন্মর ‘ভাবনার ভঙ্গি’ বদলে যাবে এরপর। আমরাও বড় হব এ গানের সাথে। জীবনের পথে অপমানিত হতে হতে আর জিতে যেতে যেতে দেখব, এ গানের ২৫ বছরে একটা মস্ত মিছিলের আয়োজন করেছি আমরা, সুমনের শ্রোতারা। সে মিছিল চলেছে যাদবপুর থেকে বৈষ্ণবঘাটায় সুমনের বাড়ির দিকে। এই তো ক বছর আগেই।
এ গান ঘিরে কত কত ছেলেমেয়ে পত্রিকা প্রকাশ করছে, স্লোগান লিখছে, কত কত প্রেম হচ্ছে ও ভেঙে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে কবিতার ভাষা-খবর কাগজের হোর্ডিং। একটা যুগ নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে ক্রমশ; সুমন হ্যামলিনের বাঁশিওলা বা সক্রেটিসের মতোই যে যুগকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে আমাদের নিয়ে, যেখানে ফ্রেম ভেঙে টব আর চুল্লি ফাটিয়ে অনন্তের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে বারবার জাতির শেকড় ও ডালপালা..
সুমনের এই গানকে ঘিরে নানা সময় নানা কথা লিখেছি নানা মাধ্যমে। ভিডিওতে তাঁর পুরনো পাড়া ভবানীপুর ও গড়িয়ায় ঘুরে ঘুরে পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করেছি- ধরে রেখেছি তাঁদের কথা পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য। আজ তবে নতুন কী ভাবার আছে, এ গান ঘিরে?
এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে হল, এ গানের পরতে পরতে যে ইতিহাসচেতনা আর ভাষা আর সুরে যে কীর্তন, তা থেকেই তো আজ বারবার ছিন্নমূল করতে চায় চরমপন্থী রাজনীতি। যখন একটা যুগ আবার দেউলিয়া সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত ভাবে, তখন আবারও নতুন মানে খুঁজে পায় এ গানের আত্মা। প্রেমে পড়ে জ্বরের ঘোরে এ গান লিখেছিলেন সুমন। সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘হারিয়ে যেও না/স্বপ্নের ঝিকিমিক দূরের তারা..’ নামের আর একটি গান।
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই
সুমনের পুরনো বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ১০৩ জ্বর নিয়েও একরাতে খান তিনেক গান বাঁধতেন এই না-ছোড় শিল্পী। আসলে সত্তরের আধুনিকতার যে আন্তর্জাতিকতা, সমর সেন-বিনয় ঘোষ-সুধীন্দ্রনাথ-অলোকরঞ্জন বা হিমাংশু দত্ত-সলিল চৌধুরীর যে মেধাগত নির্যাসে আইপিটিএ পরবর্তী শিল্প আর জীবন খলবলিয়ে উঠছিল, যে নির্যাসে ছায়া দিচ্ছিল আন্তর্জাতিক দুনিয়ার নিয়াকারাগুয়া-ফ্রান্স ৬৮-সোরবোন থেকে শ্রীকাকুলাম তাকেই ধারণ করেছিলেন সুমন। আর তাতেই রেজিস্ট্রেশান খুঁজে পেয়েছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি।
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পরাজয়, বিশ্বায়ন ও হিন্দু রাষ্ট্রের পদধ্বনি, ডিজিটাল দুনিয়ার আগ্রাসনের সামনে তিতুমিরের মতোই গান দিয়ে বাঁশের কেল্লা গড়েছিলেন সুমন। তারপর নিজের দাঁড়ানোর জমিকেই বারবার প্রশ্ন করছিলেন, খুঁচিয়ে আগুন দিয়েছিলেন সমাজের প্রচলিত সমস্ত চিন্তাপদ্ধতিতে, সংশোধন করছিলেন সভ্যতার ফুসফুসে জন্মানো ধুলোময়লা, ব্যাখ্যা করছিলেন নতুন ভাবে ‘শিল্পী’ শব্দের মানে..
অলোকরঞ্জন একবার বলেছিলেন, জরুরি অবস্থা ছাড়া সুমনের গান বাঁচে না। সুমন নিজেও আজীবন বসে থাকলেন সময়ের শিরা ধরেই। তোমাকে চাইয়ের মতোই তাঁর ব্যক্তিপ্রেমের একাধিক গান আসলে কিন্তু কোনও মানুষকে উদ্দেশ্য করে না শেষ পর্যন্ত। তা হয়ে ওঠে এক অনন্ত অদেখা ‘তুমি’। যেমন এ গানও একটি নারী থেকে শহরের পথে চলে যায়।

সভ্যতার দলিল দস্তাবেজে বারবার বদলাতে বদলাতে দেখি লালনের গানের মতোই সুমনের এসব গান যার ভেতরে ঢুকেছে, জীবনের পথে সমস্যা হচ্ছে তাঁর যথেষ্ট। কেন না, তিনি এই ম্যানেজমেন্ট ক্যাম্পাসের মতো শহরে ধান্দাবাজ হতে পারবেন না, তবে বন্ধুও পাবেন তিনি ‘সুমন একক’-এর অনুষ্ঠানে কয়েকজন, যাদের সবার ধর্ম কবীর। সুমন তাঁদের বলবেন, বাঙালির ইতিহাস পড়। বলবেন, বিনয় ঘোষ, নীহাররঞ্জন রায়, অবন ঠাকুরের নাম, বলবেন পজ়িটিভ থিঙ্কিংয়ের কথা…
গত দশ বছর আমরা তাঁকে নিয়ে বলে-লিখে শত্রু বানালাম, কিন্তু বন্ধু পেলাম আরও বেশি… হলাম গর্বিত সংখ্যালঘু… দেখলাম কবীরকে হারিয়ে দেওয়া গেল না। জানলাম, তিনি ধার্মিক, কারণ তিনি সুরে থাকেন। তিনি জানেন, আন্দাজ। সমকালীন হলেই আধুনিক হওয়া যায় না। কাম-প্রেম-ঈশ্বরের ছদ্মবেশে এ গানও বলে সেই একই কথা, মানুষ মানুষ মানুষ। সংসার আর রাজনীতির যান্ত্রিকতা পেরিয়ে যাদের মুখ ভেসে ওঠে সঙ্গীতে, শিল্পে। যা কিছু বারণ, যা কিছু নিয়ম, যা কিছু আইন, তাঁর প্রতিস্পর্ধী এক উচ্চারণ আজ কবীর সুমন আর তোমাকে চাই। কারণ তা জীবনের কথা বলে, সভ্যতার জরায়ুর কথা বলে। বলে, রসের কথা।
প্রেম না থাকলেই প্রেমের গান ভাল লেখা যায়, আজ বোঝেন কবীর। বোঝেন, যে আত্মত্যাগে জন্মান অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা বা যে আত্মত্যাগে হয় আধুনিক বাংলা গান, তা আজ সম্ভব না। এ জীবনের বেশিটাই জবাবদিহি। কৌশল। হিসেব। পণ্ডিত ভীমসেন যোশি যেখানে মিয়াঁ কি মল্লার রাগে ‘করিম নাম’ গান বিলম্বিত লয়ে বা ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি গান যেখানে ‘হরি ওম তৎসত’… সেখানেই বিসমিল্লা মহরমের দিন সানাই নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বেনারসে।
সমস্ত শিল্পীর যেমন একটা ল্যান্ডস্কেপ থাকে, তেমন থাকে সাউন্ডস্কেপ — বলেন কবীর। বলেন, রবিশঙ্করের বা নিখিলের মুখের দিকে তাকাতে, কী শান্তি… যেন দিনান্তের আজান…সভ্যতা জুড়ে। যেন ব্রহ্মা নিজেই নিজেকে জন্ম দিচ্ছেন। যেন মহাকাশের অনন্ত গ্যালাক্সি। যেন সিঙ্গুলারিটি অফ ইভেন্ট…। হিমাংশু দত্ত যেখানে মিশে যাচ্ছেন পিট সিগারে… সমর সেন মিশে যাচ্ছেন কবেকার কলকাতা শহরের পথে… মাদার টেরেসা এসে শুশ্রূষা শেখাচ্ছেন কলকাতায়… কুষ্ঠরোগীদের।
যাদের কাছে যুগ যুগ ধরে ছিল গান, যাদের আমরা অপমান করেছি, অপমান করেছি, অপমান করেছি ইতিহাস জুড়ে… গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স থেকে আফরাজুল হয়ে সে গুপ্তহত্যা, খুনের ইতিবৃত্ত আজও বহমান। আর তার প্রতিবাদে বারবার ধর্ম বদল। কখনও রাইন কখনও কঙ্গো জানে সে সব দাঁতচাপা রাগ, অনাপস ও শয়তানের দলবলের চোখ রাঙানো। আর সেসব রাতের কান্না পেরিয়ে বারবার ভোরে উঠে সুরে বেজে ওঠা রেওয়াজের তানপুরার ওং ধ্বনি ও সরস্বতীর সঙ্গে অনন্ত সংলাপ।
সমাজ ও শিল্পকে এক সুতোয় বেঁধে তার উপর দিয়েই হেঁটে যাওয়াও শেষ বড় বাঙালি কবীর সুমনের। সে সবেরই উদযাপন আজ তিরিশে পা… আবার… তোমাকে চাইয়ের হাত ধরেই।
*ছবি সৌজন্য: wikipedia
*ভিডিও সৌজন্য: Youtube Saregama
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।