আচ্ছা ‘ছদ্মবিজ্ঞান’ এই ব্যাপারে কেউ কি কিছু জানেন?
হ্যাঁ, এই একুশ শতকের বিশের দশকে এটা গুগলে সার্চ করলেই জানা যাবে সহজেই। কিন্তু উনিশ শতকে যদি ফিরে গিয়ে এমন একটা উদ্ভট বিষয়ের কথা জানতে চাওয়া হত, তাহলে মুখ চাওয়াচাওয়ির অভিনয় করতে হত। তবে হ্যাঁ, সে আমলে কদাচিৎ এমন বিজ্ঞানচর্চা কেউ যে করেননি এদেশে, তা কিন্তু নয়। খবরে প্রকাশ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই ‘ফ্রেনোলজি’ বা ‘শিরোমিতি-বিদ্যা’য় পারদর্শী ছিলেন মহর্ষির এক পুত্র। মানুষের মাথার গড়ন তিনি প্রথমে পরীক্ষা করতেন, তারপর তার মনের চলন বলে দিতে পারতেন।
হয়তো এই কারণেই মুখের ছবি আঁকার নেশা জাগত তাঁর। পরিবারের নানা সদস্য তো বটেই, বন্ধুবান্ধব থেকে অতিথি অভ্যাগতদের মুখাবয়বের অজস্র প্রতিকৃতি এঁকেছেন। এবং সত্যি সত্যিই যা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সেকালের অনেক বিখ্যাত মানুষের মুখাবয়বও ধরা আছে তাঁর পেন্সিলে আঁকা ছবিতে। এমন প্রায় ১৮০০ স্কেচ সংরক্ষিত আছে আজও।
ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই সেই মহর্ষিপুত্রের নাম আপনাদের মনে জ্বলজ্বল করে উঠেছে? হ্যাঁ তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। গত ৪ মে ছিল তাঁর জন্মদিন।
বস্তুত, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সব সন্তানই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ সর্বোত্তম। তবে রবীন্দ্রনাথের পরেই মহর্ষির সন্তানদের মধ্যে যাঁর নাম করতেই হয়, তিনি এক এবং অদ্বিতীয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। দীর্ঘ ৭৬ বছরের জীবনে এই প্রতিভাধর মানুষটির শেষ ৪১টি বছর কেটেছে ট্র্যাজিক চরিত্র হয়ে। নিঃসন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অকালে হারিয়েছেন স্ত্রী কাদম্বরী দেবীকে। এরপর ব্যবসায় চূড়ান্ত ক্ষতি তাঁকে পথে বসিয়েছে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের এই ব্যর্থতা তাঁকে জীবনের নাট্যমঞ্চ থেকে আড়ালে নিয়ে গেছে। তাঁর মতো সাহিত্যিক, নাট্যকার, সঙ্গীতস্রষ্টা, স্বরলিপিকার, চিত্রকর এই বাংলায় খুব কম জন্মেছেন। তাঁর ছোটভাইকে শিল্পে-সঙ্গীতে ও সাহিত্যের আঙিনায় তিল তিল করে গড়ে তোলার দান রবীন্দ্রনাথ নিজেই জীবনের উপান্তে এসে স্মরণ করেছেন এমনভাবে,
‘জ্যোতিদাদা, যাঁকে আমি সকলের চেয়ে মানতুম, বাইরে থেকে তিনি আমাকে কোনো বাঁধন পরাননি। তোমার সঙ্গে তর্ক করেছি, নানা বিষয়ে আলোচনা করেছি বয়স্যের মতো। তিনি বালককেও শ্রদ্ধা করতে জানতেন। আমার আপন মনে স্বাধীনতার দ্বারাই তিনি আমার চিত্ত বিকাশের সহায়তা করেছেন। তিনি আমার ‘পরে কর্তৃত্ব করবার ঔৎসুক্যে যদি দৌরাত্ম্য করতেন তাহলে ভেঙেচুরে তেড়েবেঁকে যা-হয় একটা কিছু হতুম, সেটা হয়তো ভদ্রসমাজের সন্তোষজনকও হত, কিন্তু আমার মতো একেবারেই হত না।’
বয়সের এই উপান্তের কথা, ১৯২২ সাল। সেপ্টেম্বর মাস। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসেছেন শান্তিনিকেতন থেকে। সঙ্গে অনেক ছাত্রছাত্রী। রাণু অধিকারীকে চিঠিতে লিখলেন সে কথা,
‘কলকাতায় সব দলবল নিয়ে উপস্থিত হয়েচি। আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়ি একতলা থেকে তিনতলা পর্য্যন্ত কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেচে– পা ফেলতে গেলে সাবধান হতে হয় পাছে একটা না একটা ছেলেকে মাড়িয়ে দিই এমনি ভিড়। আমি অন্যমনস্ক মানুষ কোনদিকে তাকিয়ে চলি তার ঠিক নেই, ওরা যখন তখন কোনো খবর না দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে‘ প্রণাম করে। কখন তাদের মাটির সঙ্গে চ্যাপ্টা করে দিয়ে তাদের উপর দিয়ে চলে যাব এই ভয়ে এই ক‘দিন ধুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে চলচি। মেয়ের দলও এবার নেহাৎ কম নয়– নুটু থেকে আরম্ভ করে অতি সূক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র লতিকা পর্য্যন্ত।’
সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল।
‘বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও ছাত্রীগণের দ্বারা ‘শারদোৎসব’ (নাটিকা) অভিনয়ের আয়োজন হইয়াছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করিবেন। আলফ্রেড থিয়েটার (হ্যারিসন রোড)। শনিবার (১৬ই সেপ্টেম্বর) অপরাহ্ণ সাড়ে ৫ টা। ম্যাডান ভেরাইটিস থিয়েটার। সোমবার (১৮ই সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা।
প্রথম দিনের অভিনয়ের আগে এক মহাসংকট উপস্থিত হল। দিনেন্দ্রনাথ ‘ঠাকুরদাদা‘র অভিনয় করতে পারলেন না, ফিরে গেলেন পিতৃদেব দ্বীপেন্দ্রনাথের অসুস্থতার খবর পেয়ে শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে অবনীন্দ্রনাথ মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন ‘ঠাকুরদা’ ভূমিকায়। যাইহোক, অভিনয় সকলের ভালই হল। ১৮ তারিখ আবার অভিনয় আছে। এদিকে রাঁচি থেকে রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা এসেছেন কলকাতায়। উঠেছেন পিতৃগৃহে। এই সেই জ্যোতিদাদা। যাঁর সম্পর্কে ‘ছেলেবেলা’র কথায় বলেছিলেন,
‘জ্যোতিদাদা এসেছিলেন নির্জলা নতুন মন নিয়ে। আমি ছিলুম তাঁর চেয়ে বারো বছরের ছোটো। বয়সের এত দূর থেকে আমি যে তাঁর চোখে পড়তুম, এই আশ্চর্য। আরো আশ্চর্য এই যে তাঁর সঙ্গে আলাপে জ্যাঠামি ব‘লে কখনো আমার মুখ চাপা দেননি।’
এহেন জ্যোতিদাদা এসেছেন কলকাতায়, আর রবি তাঁর কাছে গিয়ে দু’দণ্ড বসবেন না, তাই কি আবার হয় নাকি! গেলেন জ্যোতিদাদার কাছে। জ্যোতিদাদার তখন ৭৪ এবং তাঁর স্নেহের রবির বয়স ৬২। জ্যোতিদাদাকে এর বছর দশেক আগে ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্বানা শহরে যাবার আগে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘ভাই জ্যোতিদাদা,
গত মেলে আপনার চিঠি পেয়েছি কিন্তু ছবির খাতা এসে পৌঁছতে বোধহয় দু-এক মেল দেরি হতেও পারে। আমরা আবার পর্শু আমেরিকায় যাত্রা করচি।
এখানে বলে দিয়ে যাব খাতায় এসে পৌঁছলে Rothenstein এর কাছে পাঠিয়ে দিতে। তাঁর সঙ্গে ঠিক করছি আপনার ছবি সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ এখানকার Studio কাগজে এবং আমাদের Modern Review তে লিখতে। তাতে কিছু কিছু উদাহরণ আপনার খাতা থেকে সংগ্রহ করে দিতে পারেন। ছবির বই ছাপতে এত বেশি খরচ যে সে আপনাকে অনুরোধ করতে সাহস করিনে। একটা প্রস্তাব আছে এই যে Indian Society থেকে আপনার ছবির গোটাকতক Selection যদি ওরা ছাপায় তাহলে অনেকটা প্রচার হতে পারবে। আপনি কিছু খরচ দিলে ওরা বাকি খরচ দেবে। ওরা বছরে দুটো করে বই ছাপিয়ে সভ্যদের দেয়। এবছরের বই হয়ে গেছে। আর বছরে আপনার এটা যদি ওরা চাপিয়ে দিতে রাজী হয় তাহলে খুব ভালো হবে। আমি আজ ওদের কাছে সেই প্রস্তাব করব। আপনাকে তাহলে হয়ত ৫০/৬০ পাউন্ড দিতে হতে পারে — কিন্তু সে এখনি নয়
— আসচে বছর।…’
এই চিঠির মাস চারেক পর আরেকটি চিঠি এসে পৌঁছায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রাঁচির ঠিকানায়। রবীন্দ্রনাথ সেই চিঠিতে লিখলেন,
‘আপনার খাতাগুলো সমস্তই রটেনস্টাইনের হাতে গিয়ে পৌঁচেছে। আমি লণ্ডনে ফিরে গেলে সেগুলো থেকে ছবি নির্বাচন করে কী ভাবে কী করা যেতে পারে তা স্থির করব। ইতিমধ্যে আপনি সেগুলো ছাপাবার খরচ কিছু সংগ্রহ করে রেখে দেবেন।’
এরপর উইলিয়াম রদেনস্টাইনের সহায়তায় হ্যামারস্মিথের এমারি ওয়াকার লিমিটেড কোম্পানির তরফ থেকে ১৯১৪ সালে ‘Twenty-five Collotypes from the Original Drawings by Jyotirindra Nath Tagore’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য এই স্কেচ বইতেই কাদম্বরী দেবীর দু-দুটি ছবি মুদ্রিত হয়।
এর বছর আষ্টেক পর দুই ভাই মুখোমুখি হলেন জোড়াসাঁকোর সেই দালানে। যে বাড়ির ছাদের ঘরে এই জ্যোতিদাদার সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের গানের ফোয়ারা ছুটে চলেছিল দিকদিগন্তে। সেইদিনের দৃশ্যটি ছিল এমন:
‘বউঠাকুরন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা; বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান।… হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভ’রে।’
১৯২২, সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ আবার দুই ভাই মুখোমুখি বসেছেন। ছেলেবেলার সেই ছোট্ট ভাইটি, রবির ছবি আঁকার শখ হয়েছে তাঁর। হাতে তুলে নিলেন খাতা আর পেন্সিল। সামনে পাশ ফিরে বসালেন রবিকে। শুরু করলেন আঁকা। দেখতে দেখতে একসময় শেষ হয়ে গেল সেই ছবি। স্কেচের উপর প্রথমে তারিখসহ জ্যোতিদাদা স্বাক্ষর দিলেন। তারপর রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষর করলেন। অমর হয় রইল দুই ভাইয়ের শেষ সাক্ষাৎকারের বিরল মুহূর্তটি।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
*তথ্যসূত্র:
১) জীবনস্মৃতি: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত।
২) চিঠিপত্র ৫: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩) রবীন্দ্রজীবনী ১-৪ খণ্ড: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৪) রবিজীবনী ২-৮ খণ্ড: প্রশান্তকুমার পাল
৫) জীবনস্মৃতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৬) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর: সুশীল রায়
৭) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ: মন্মথনাথ ঘোষ
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
মহর্ষির সপ্তম সন্তান , কবির জ্যোতি দাদার ‘ফ্রেনোলজি’ বা ‘শিরোমিতি বিদ্যায়’ পারদর্শীতার যে প্রতিভা তা সুস্পষ্ট ভাবে পাঠকের কাছে উন্মোচিত হলো লেখকের অসাধারণ লেখনীর সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়ে।, আগামীর অপেক্ষায় রইলাম 🌿🌿