নৃত্যগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীতে শক্তিচর্চার আয়োজনও করেছিলেন। শান্তিনিকেতন তথা বাংলায় তো বটেই, ভারতবর্ষে প্রথম জাপানি জুজুৎসু শিক্ষার প্রচলন হল তাঁরই অর্থানুকূল্যে, তাঁরই ব্যবস্থাপনায়।
সেবার ‘নবীন’ নাটকের আয়োজন (৩০ ফাল্গুন ১৩৩৭), নিউ এম্পায়ারে। নাটকের আগে শরীরচর্চার প্রদর্শনী। সুধীরচন্দ্র কর লিখছেন,
‘…কবির মন আগ্রহে ভরা। রঙ্গমঞ্চের এককোণে যথারীতি তিনি প্রস্তুত হয়ে বসেছেন। প্রোগ্রামের দুটি অংশ। প্রথম অংশেই আছে জাপানি জুজুৎসু ও দেশীয় লাঠি-ছোরা খেলার প্রদর্শনী। নামকরা জাপানি জুজুৎসু অধ্যাপক তাকাগাকিকে কবি শান্তিনিকেতনে এনেছেন। তাঁর শিক্ষাতে আশ্রমের ছেলেমেয়েদের জুজুৎসুবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছেন। বহু অর্থব্যয় হয়েছে। এ পর্যন্ত সকল ভারই কষ্টেসৃষ্টে বহন করেছেন নিজে। কিন্তু বাইরের সাহায্য না পেলে আর চলে না। দেশে তখন শারীরিক শক্তিচর্চা এবং আপৎ-প্রতিরোধের আয়োজন নিয়ে আন্দোলন চলছে। দেশবাসীর উৎসাহকে কেবল মুখের কথায় অভিনন্দিত না করে, শক্তিচর্চার একটি শ্রেষ্ঠ উপায়কে কবি সকলের সুমুখে ধরলেন এবং এই বিদ্যায় হাতে-কলমে তৈরি হবার সুযোগ নেবার জন্যে আহ্বান জানালেন শান্তিনিকেতনে।…’ (সুধীরচন্দ্র কর, কবি-কথা, সিগনেট প্রেস, মে ২০১৪, পৃ. ৯৪-৯৫) এই উপলক্ষ্যে তিনি একটি গানও রচনা করেছিলেন– ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’।
শরীরচর্চার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ সেই ছেলেবেলা থেকে। ঠাকুরবাড়ির সব ছেলেরাই তখন কুস্তি শেখে। সেজদা হেমেন্দ্রনাথের ব্যবস্থাপনায় সেই নিয়ম লঙ্ঘন করা সহজ নয়।
‘…সেজদাদার হাতে আমার অন্য বিদ্যের যে গোড়াপত্তন হয়েছিল সেও খুব ফলাও রকমের।…অন্ধকার থাকতেই বিছানা থেকে উঠি, কুস্তির সাজ করি, শীতের দিনে শিরশির করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকে। শহরে এক ডাকসাইটে পালোয়ান ছিল, কানা পালোয়ান, সে আমাদের কুস্তি লড়াত। দালানঘরের উত্তর দিকে একটা ফাঁকা জমি, তাকে বলা হয় গোলাবাড়ি।…এই পাঁচিল ঘেঁষে ছিল কুস্তির চালাঘর। এক হাত আন্দাজ খুঁড়ে মাটি আলগা করে তাতে এক মোন সরষের তেল ঢেলে জমি তৈরি হয়েছিল। সেখানে পালোয়ানের সঙ্গে আমার প্যাঁচ কষা ছিল ছেলেখেলা মাত্র। খুব খানিকটা মাটি মাখামাখি করে শেষকালে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে চলে আসতুম।…’ (ছেলেবেলা, রবীন্দ্ররচনাবলী ত্রয়োদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী সংস্করণ, পৃ. ৭২২)
এছাড়া ঠাকুরবাড়ির সব বালকেরা সেই ছেলেবেলা থেকেই তো তাদের পালোয়ান জমাদার শোভারামকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছে যে, ‘…থেকে থেকে বাঁও কষত, মুগুর ভাঁজত মস্ত ওজনের, বসে বসে সিদ্ধি ঘুঁটত, কখনো বা কাঁচা শাক-সুদ্ধ মুলো খেত আরামে…’। যাঁর ছেলেবেলা এই পরিবেশে কেটেছে, তাঁর শিক্ষাভাবনায় শরীরচর্চার গুরুত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। ছিলও। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তিনি চেয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীদের এমন একটি শরীরচর্চা আঙ্গিকের প্রচলন, যার সঙ্গে তাঁর শিক্ষাদর্শনের সাযুজ্য আছে। তাঁর শিক্ষার দর্শনে যেমন গান আছে, নাচ আছে, নাটক আছে, তেমনি থাকবে শরীরচর্চাও। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা যেন ক্লাসে মিউজিয়ামের অনড় মূর্তির মতো বসে না থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশে হেঁটেচলে পড়াশুনা করে। তাঁর মতে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি; শরীরচর্চা সেইসব মাংসপেশির ওপর মনের নিয়ন্ত্রণ জাগায়। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় শরীর আর মনের যোগটিকে চর্চা করে করে বিকাশ করতে হয়। তা যে পারে না, সে অসম্পূর্ণ মানুষ।

১৯০২ সাল। শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছেলেমেয়েদের জন্য এমন একটি যথাযথ ব্যবস্থার সন্ধান পেলেন কবি জাপানে; ওইখানে জুজুৎসু বিদ্যার প্রদর্শন তাঁকে মুগ্ধ করল। তিনি বুঝলেন এ কোনও সাধারণ মানের শরীরচর্চা নয়, এই বিদ্যাচর্চা শিশু-কিশোরদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, দৃঢ় মানসিকতা এবং নৈতিকতার বিকাশ ঘটাবে; অতীতের সামুরাই যোদ্ধারা এই বিদ্যাচর্চা করে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিলেন। সেই শরীর-নির্ভর সমর শিল্পের আধুনিকীকরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথেরই বয়সী একজন, যার নাম কানো জিগোরো (১৮৬০-১৯৩৮)। কানো-র জুজুৎসু (জুডো) শিক্ষা তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। এই ‘জুজুৎসু দ্য ওল্ড সামুরাই আর্ট অফ ফাইটিং উইথআউট ওয়েপনস’ নিবন্ধটি কানো ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ জাপান’-এ পাঠ করেছেন; রবীন্দ্রনাথ এইসবের খবর রাখতেন। পরবর্তীতে তিনি কানো জিগোরো’র সঙ্গে পত্রবিনিময় করেছেন এবং টোকিওতে দেখাও করেছেন।
১৯০২ সালে জাপানের বিদগ্ধ শিল্প সমালোচক কাকুজো ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হল। ভারতের বিদ্বজ্জন মহলে ওকাকুরা ‘আইডিয়ালস অফ দি ইস্ট’-এর জন্যও বিখ্যাত হয়েছেন। কবি ওকাকুরাকে অনুরোধ করলেন দু’জন জাপানি শরীর-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতকে শান্তিনিকেতনে পাঠাতে। জাপানি শারীর শিল্প শেখানোর জন্য ওকাকুরা তাঁর দুই ছাত্রকে পাঠালেন– আরাই কাম্পো আর শাওকিন কাতসুতা। এই দু’জন ছাড়াও এলেন এস কুসুমাতো কাঠের কাজ শেখাতে। তার ফাঁকেই তিনিও প্রাথমিক কিছু জুডো শেখাতে আরম্ভ করলেন ছাত্রছাত্রীদের।

রবীন্দ্রনাথের এত ভালো লেগে গেল ওই জুডো শিক্ষা, তিনি ওকাকুরাকে অনুরোধ করলেন একজন ভাল জুডো শিক্ষক পাঠাবার জন্য। ১৯০৫ সালে শান্তিনিকেতনে এলেন জাপানের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন ভালো জুজুৎসু শিক্ষক জিন্নোৎসুকে সানো। সানো তিন বছর ছিলেন। এর একবছর আগেই জাপান দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে। জাপানের জয়ে বাঙালি বিপ্লবীরা উত্তেজিত– এশিয়ার ওইটুকু একটা দেশ পশ্চিমের শক্তিশালী দেশ রাশিয়াকে হারিয়ে দিল! (আগ্রহীরা হেমচন্দ্র দাসের ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’ পড়ে দেখতে পারেন) এ হল পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এশিয়ার জয়। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সময়কার অনেকেই জুডোকে দেখতে শুরু করেন জাপানি জাতীয়তাবাদের অঙ্গ হিসাবে।
লম্বা চওড়া রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে বেঁটে-খাটো জাপানিদের জয় নিশ্চয় জুজুৎসু’র জন্যই, এমনই মনে হয় মহাত্মা গান্ধীরও। তিনি ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ পত্রিকায় (২২ এপ্রিল, ১৯০৫) জুজুৎসু বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। লালা লাজপৎ রাই-ও এর পক্ষে কলম ধরেন। ১৯০৬ সালে যিনি ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠা করবেন, সেই পুলিনবিহারী দাস গোপনে সানো-র থেকে জুজুৎসু শিখেছিলেন। পুলিনবিহারী এই জাপানি সমর কৌশলের সঙ্গে দেশজ বিদ্যার সংশ্লেষে এক নতুন কৌশলের জন্ম দেন, যার নাম ভারতীয় জুজুৎসু। ভালোই চলছিল, কিন্তু ১৯০৮ সালে সানো চলে গেলে শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।

তবে সানো চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথের জুজুৎসু শিক্ষার কথা ভোলেননি। ১৯২৯ সালে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরবার সময় তিনি আবার জাপানে যান। এইবার অন্যান্য কিছুর সঙ্গে ঘুরে দেখেন জাপানে জুডো শেখাবার মূল কেন্দ্র, কানো জিগোরো স্থাপিত কোডোকান জুডো ইন্সটিটিউট। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় শিনজো তাকাগাকি-র। তাকাগাকি জুডো-বিদ্যায় জাপানের সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন; খুবই নামী শিক্ষক। দেশের বৃত্তি পেয়ে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। শান্তিনিকেতনে আসবার জন্য কবি তাঁকে রাজি করান। তাঁর খাতে সব খরচ-খরচার দায়িত্ব নিলেন রবীন্দ্রনাথ! দেশে জুজুৎসু প্রচলনে এতটাই আগ্রহী তিনি।
তাকাগাকি শান্তিনিকেতনে যোগ দেন নভেম্বর ১৯২৯। তিনি ছাত্রদের জুডোর কৌশল শেখানোর পাশাপাশি জুডো শেখানোর জন্য বিশ্বভারতীতে একটি উপযুক্ত ব্যয়ামাগার গড়ে তোলেন। (আগ্রহীরা কাজুও আজুমার রচিত ‘উজ্জ্বল সূর্য’ পড়ে দেখতে পারেন)। ছাত্র-বৎসল শিক্ষক বলতে যা বোঝায় শিনজো তাকাগাকি তাই। প্রতিটি ছাত্রকে হাতে ধরে শেখাতেন জুডোর খুঁটিনাটি। যতক্ষণ না সে নিখুঁত আয়ত্ত করছে জুডোর কোনও কৌশল, তাকে ছাড়তেন না। শান্তিনিকেতনে মেয়েদেরও জুডো শেখানো হত। রবীন্দ্রনাথের যুক্তি ছিল, আত্মরক্ষার জন্য মেয়েদের জুডো শেখা খুবই প্রয়োজন।
কবি ওকাকুরাকে অনুরোধ করলেন দু’জন জাপানি শরীর-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতকে শান্তিনিকেতনে পাঠাতে। জাপানি শারীর শিল্প শেখানোর জন্য ওকাকুরা তাঁর দুই ছাত্রকে পাঠালেন– আরাই কাম্পো আর শাওকিন কাতসুতা। এই দু’জন ছাড়াও এলেন এস কুসুমাতো কাঠের কাজ শেখাতে। তার ফাঁকেই তিনিও প্রাথমিক কিছু জুডো শেখাতে আরম্ভ করলেন ছাত্রছাত্রীদের।
সেবার ১৯৩০ সালের ২৬ থেকে ৩০ ডিসেম্বর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে অল এশিয়া এডুকেশনাল কনফারেন্স। জুজুৎসু জনপ্রিয় করবার উদ্দেশ্যে তাকাগাকিকে ওই সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি জানেন সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন ভারতের নামী শিক্ষাবিদদের সঙ্গে এশিয়া এবং ইউরোপের নামী পণ্ডিতেরা। এদের সামনে বিশ্বভারতীর প্রতিনিধি হিসাবে তাকাগাকির উপস্থিতিতে জুডোর যেমন প্রচার হবে, তেমন হবে বিশ্বভারতীরও। স্ত্রী মাকি হোশিকে নিয়ে তাকাগাকি গেলেন বেনারসে। ভাষণ দিলেন, যার শিরোনাম ‘জুডো এবং তার গুরুত্ব’ (জুডো অ্যান্ড ইটস ইম্পর্টেন্স)। শুধু ভাষণ নয়, জুজুৎসু কৌশলের প্রদর্শনীও করলেন উপস্থিত দর্শকমণ্ডলীর সামনে। সবাই মুগ্ধ। সেদিন তাকাগাকির জুডোর প্রদর্শনী দেখেছিলেন ১৩ বছরের ইন্দিরা গান্ধী!
জুডো জনপ্রিয় করবার এমনই তাগিদ কবির যে, দু’বছর তাকাগাকির খরচ চালাবার পর ২৫ এপ্রিল ১৯৩১ একটি চিঠি লিখে সুভাষচন্দ্র বসু এবং কলকাতার মেয়র বিধানচন্দ্র রায়ের (সুভাষচন্দ্রের পরে ৫ এপ্রিল ১৯৩১ কলকাতার মেয়র হন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়) সাহায্য প্রার্থনা করলেন কবি। বললেন যে, তাকাগাকি জাপানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান; জুজুৎসুর নামী শিক্ষক; তাঁর শিক্ষকতায় এই দু’বছরে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীরা জুডোতে খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছে; এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার হবে যদি কলকাতার ছাত্রসমাজ তাঁর তত্ত্বাবধানে আত্মরক্ষার শিল্প এই জুডো-বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ না পায়।
কিন্তু সে ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ীভাবে করা সম্ভব হয়নি। কলকাতার ছাত্ররা তাকাগাকিকে পায়নি। দু’বছর পরেই তিনি ফেরত গেলেন জাপানে। যাবার আগে, শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন জুডোর একটি পাঠ্যবই লিখেছিলেন, পরে যা প্রকাশিত হয়। শিরোনাম– টেকনিকস অফ জুডো (জুডোর কৌশল)। তবে কলকাতায় চালু না করা গেলেও অচিরেই, নভেম্বর ১৯৩১-এ, দু’জন জাপানি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বোম্বে শহরের ক্লেয়ার রোড, বাইকুল্যাতে চালু হয়ে যায় ভারতের প্রথম জুডো শিক্ষাকেন্দ্র।

এখন, একটি প্রশ্ন জাগে। কেন রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষে জুজুৎসুর প্রচলনে এত উৎসাহী হয়েছিলেন? কেনই বা মনে হয়, বিশ্বভারতীতে অনুসৃত তাঁর শিক্ষার দর্শনের সঙ্গে জুজুৎসুর একটা মিল আছে? আসলে কানো জিগোরোর পুনরুদ্ভাবন করা জুডো-তে মনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ মনই হল শরীরের নিয়ন্ত্রক। প্রতিপক্ষের শারীরিক সামর্থ্যের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে লড়তে যাওয়া নয়, মনের জোরে শরীর থেকে শক্তি উৎপাদন করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই– জুডোর এই মূল নীতি রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করেছিল। কারণ, রবীন্দ্রনাথের দর্শনে মানসিক শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।
তাছাড়া আরও একটি কারণ আছে। ভারতেও তখন জুজুৎসু নিয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। জাপানের জয়ের পরে ভারতবর্ষের নানান খবরের কাগজ জাপানের জুজুৎসু নিয়ে লেখা শুরু হয়। ১৯০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, টাইমস অফ ইন্ডিয়া একটি লেখা ছাপে, যার সারমর্ম– জুডোর কৌশল, খাওয়াদাওয়া, জীবনযাপন এমন একটি শিক্ষা দেয় যাতে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী, স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী মানুষ গড়া যায়। আর একটি সাময়িকী, যা রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত পড়তেন, সেই মডার্ন রিভিউ, নভেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় জুডোর নৈতিক গুণাবলী (দ্য মরাল ভ্যালু অফ জুডো) নামে কানো জিগোরোর একটি নিবন্ধ ছাপে। এই রচনায় জিগোরো বলেছিলেন, জুডো শরীরের বিকাশ ঘটায়। এ এমনই এক শিক্ষা, যার ফলে মানসিকতা এবং নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটে। তিনি আরও বলেছিলেন, জুডো শিক্ষা এবং চর্চার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা, সাহস, অধ্যবসায়, নিরপেক্ষ-সততার বোধ এবং অন্যদের সম্পর্কে দয়া ও শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে। রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয় মুগ্ধ করেছিল এই উচ্চারণ। জিগোরোর জুডোর দর্শনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব শিক্ষার দর্শন।
এর পরেই তাকাগাকির সঙ্গে দেখা। জুডো যে কীভাবে মানসিকতার বদল ঘটায়, নৈতিক উন্নতি করে, সেই প্রসঙ্গে তাকাগাকি বলছেন যে, জুডো কোনও শরীরচর্চার শুকনো, একবগ্গা শিক্ষাপ্রণালী নয়। এই শিক্ষণব্যবস্থা এমনই যা শিক্ষার্থীর অজান্তেই তার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই শিক্ষণের ফলে শিক্ষার্থীরা অতীব সূক্ষ্ম কিছু গুণের অধিকারী হবে। যেমন– নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, নিজের এবং দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ। তাকাগাকির মতে, জুডো শিক্ষার্থীকে দয়ালু এবং সমাজের সঙ্গে আদান-প্রদানে নিরপেক্ষ হতে শেখায়। যুক্তির নির্ভরে, সৎ এবং ধীর-স্থির ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছোবার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত জুডোর দর্শন। অন্যায় পথে, গায়ের জোরের রাস্তায় কোনও কিছু কেড়ে নেওয়া নয়, সভ্যতার উন্নতির দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত জুডোর দর্শন।
বোঝা যায় জুডোর দর্শনের সাহায্যে মনের এই গুণগুলি বাড়াবার ঝোঁকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা আর তাঁর উৎকর্ষচিন্তার খুব সাযুজ্য আছে। শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর জন্য রবীন্দ্রনাথ খুঁজে ফিরছিলেন এমন একটি শরীরচর্চা আঙ্গিক যা তাঁর শিক্ষাদর্শনের পরিপূরক হিসাবে কাজ করবে। এইজন্যই তাকাগাকির জুজুৎসু শিক্ষা এবং তার দর্শন, যা মনের পরিসরকে বাড়িয়ে দেয়, শরীরের ওপর মনের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়, কবির ভাবনার সঙ্গে সমসত্ত্বভাবে মিশে যেতে পেরেছিল।
এই তো বিশ্বভারতীতে শরীরচর্চার ঐতিহ্য!
ছবি সৌজন্য: বিশ্বভারতী, কোডোকান জুডো ইন্সটিটিউট ও উইকিমিডিয়া কমনস
প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।