অমৃতা নিজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করলেও তাঁর চিন্তাজগৎ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সও অনুধাবণ করেছে। তাঁর একটি কবিতার বইয়ের নাম: ‘ভর বাড়ছে শ্বেত বামনের’।
‘শ্বেত বামন’ বা ‘White Dwarf’ কাকে বলে? এ হল নক্ষত্রের এমন এক অবস্থা যখন সূর্যের ন্যায় প্রকাণ্ড কোনও নক্ষত্রের সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত হয় পৃথিবীর আকারের ছোট একটি গ্রহের আয়তনের মধ্যে। একটি ক্ষুদ্র কিন্তু অত্যধিক ভরযুক্ত নক্ষত্র সে, ‘White Dwarf’। তখন তার সমস্ত হাইড্রোজেন জ্বালানি সে পুড়িয়ে ফেলেছে। সেই নক্ষত্রের কেন্দ্র বা Core-থেকে একটা বহির্মুখী বল কাজ করে। কিন্তু সেই চাপকে নক্ষত্রের নিজের কেন্দ্রের মধ্যে অবস্থিত প্রচণ্ড ভর তার গ্র্যাভিটি নিয়ে ভিতরদিকে টানতে থাকে। ফলে দু’দিকের চাপে নক্ষত্রটি একটি স্ট্যাটিক অবস্থায় আটকে যায়। এই পর্যায়ে নক্ষত্রটির কোনও বৃদ্ধি হয় না, হ্রাসও হয় না। এই স্ট্যাটিক অবস্থার আরম্ভে একটি প্রবল সংকোচন শুরু হয়, নক্ষত্রটির কেন্দ্রে।
অমৃতা তাঁর ‘ভর বাড়ছে শ্বেত বামনের’ গ্রন্থে সাঙ্কেতিকভাবে এই প্রসঙ্গ ব্যবহার করেছেন কোনও কোনও মানবমনের অবস্থা সম্পর্কে। অত্যধিক আত্মকেন্দ্রিকতার চাপে মানবমনও কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজের ভার নিজের মধ্যে কেবল বাড়িয়েই চলে। তার অস্তিত্বের কেন্দ্র সংকুচিত হতে থাকে ক্রমশই। ‘White Dwarf’ বা ‘শ্বেত বামন’ জাতীয় নক্ষত্র যেমন এক স্ট্যাটিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, মানবমনও তেমন পৌঁছয় এক আবদ্ধতার পর্যায়ে। আত্মকেন্দ্রিকতার অতিরেক মানবমনের মধ্যে এই স্থবিরতার সৃষ্টি করে। মানুষ হিসেবে তখন তার বৃদ্ধি হয় না। তার অস্তিত্বের কেন্দ্র কেবলই সংকুচিত হতে থাকে। অমৃতার এই যে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের চর্চা, তা ফলপ্রসূ হয়েছে তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করার মাধ্যমে। অগ্নিপিণ্ডময় তারকার অবস্থাকে বসানো হল মানবচরিত্রের উপর। যদিও এ-কবিতা আমরা পড়ছি কোনও এক ‘আমি’-র অভিজ্ঞতার বর্ণনা হিসেবে– কিন্তু এই ‘আমি’ ঠিক একলা ‘আমি’টুকু হয়েই থাকছে না। হয়ে উঠছে ‘অন্য’। গবেষণার মতোই ‘আমি’ শব্দটিকে আশ্রয় করে বিজ্ঞানীর চোখে মানবমনকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং পাঠকের সামনে তুলে ধরছেন অমৃতা, নিজের ‘আমি’-কে বিষয়কেন্দ্র রূপে ব্যবহার করে।

একটু আগে ছন্দের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলাম। তখন অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার দেখিয়েছি। এবার স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা অমৃতার দুটি কবিতা পাঠকদের পড়তে দিই। তার আগে অক্ষরবৃত্ত-আশ্রিত আরও একটি কবিতা তুলে দিতে চাই। এর কারণ পরে জানাচ্ছি। পাঠক আগে কবিতাটি পড়ে দেখুন:
বিশ্বাসী
ডানায় ডানাটি লাগে। নৈঃশব্দ যা দেখে,
সত্যি-জল, সত্যি-মেঘ, সত্যি-পারাপার–
কালো মণি, যক্ষ সেজে ধরে রাখে
অচেতন জ্যোৎস্না-সৎকার!
মাত্র চারলাইন। পুরো কবিতাটিই ধরে আছে সঙ্কেতধর্মকে। এই কবিতা বারবার পড়তে পড়তে তবে সেই সঙ্কেতের আলো দেখতে পাওয়া যায়। ‘ডানায় ডানাটি লাগে’। অর্থাৎ এক জনের স্পর্শ অন্যজন পাচ্ছে। মৃদু স্পর্শ। আর কিছু নেই। নৈঃশব্দ শুধু। যেন দু’জন বসে আছে পাশাপাশি। সামনে কি কোনও জল? জানি না। শুধু জানি, এ কবিতায় নৈঃশব্দ এসেছে এক দ্রষ্টার ভূমিকা নিয়ে– নৈঃশব্দও কি দেখতে পায়? এ কবিতা পড়ার আগে আমি অন্তত জানতাম না। কবি সে কথা জানিয়ে দিলেন।
সশব্দ এই পৃথিবী, প্রতি আধঘণ্টায় ফোনে এসে আছড়ে পড়ছে মেসেজের পর মেসেজ– আমার চোখে অসুস্থতা, মেসেজ পড়ায় বারণ আছে ডাক্তারের– এ কথা মানুষকে জানিয়েও ফল হয় না– মেসেজ করেই চলে তারা। মেসেজও একরকম শব্দ। মেসেজের উত্তর টাইপ করতে হয়। চোখে কষ্ট, তবু করতে হয়। উত্তর না দিলে অপমানিত বোধ করবে প্রেরক। মেসেজ ছাড়াও বাজে ফোন। সারাদিনে বারবার। কোনও পড়ার কাজে, লেখার কাজে মনোনিবেশ করব, তার সাধ্য কী আমার? ফোন ধরতে হবে, নয়তো উত্তর টাইপ করতে হবে মেসেজের। অতিরিক্ত ব্যবহারে শব্দ সারাদিন ধরে আমার উপর দিয়ে বয়ে যাবে স্রোতের মতো। যেতে হবে সভায়। অন্যেরা বলবেন, শুনব। শব্দ শুনব। আমি বলব, অন্যেরা শুনবেন। আমি কী বলব? শব্দই বলব পরপর। শব্দ, কেবল শব্দ।
আত্মকেন্দ্রিকতার অতিরেক মানবমনের মধ্যে স্থবিরতার সৃষ্টি করে। মানুষ হিসেবে তখন তার বৃদ্ধি হয় না। তার অস্তিত্বের কেন্দ্র কেবলই সংকুচিত হতে থাকে। অমৃতার এই যে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের চর্চা, তা ফলপ্রসূ হয়েছে তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করার মাধ্যমে। অগ্নিপিণ্ডময় তারকার অবস্থাকে বসানো হল মানবচরিত্রের উপর। যদিও এ-কবিতা আমরা পড়ছি কোনও এক ‘আমি’-র অভিজ্ঞতার বর্ণনা হিসেবে– কিন্তু এই ‘আমি’ ঠিক একলা ‘আমি’টুকু হয়েই থাকছে না। হয়ে উঠছে ‘অন্য’।
তাই আমার জীবন কী করে জানবে নৈঃশব্দও দেখতে পায়? নৈশঃব্দেরও দেখার শক্তি আছে? আমি বুঝিনি। কিন্তু এই কবিতা আমাকে বোঝাল যে নৈঃশব্দও দেখতে পায়। আর নৈঃশব্দ যখন দেখার শক্তি অর্জন করে, তখন সত্যি-জল, সত্যি-মেঘ, সত্যি-পারাপার কতদূর থেকে যেন পরিলক্ষিত হয়– যেন সেই পারাপার, সেই জল, সেই মেঘ সময়ের বহির্দেশে অবস্থান করছে! মেসেজে মেসেজে ভারাক্রান্ত, ফোনে ফোনে বধির, সভায় সভায় শুষ্ককণ্ঠ আমার ন্যায় ব্যক্তির জীবনদৃষ্টিতে ওই সত্যি-মেঘ, সত্যি-জল, সত্যি-পারাপার কতদূরের জিনিস, তা যেন নিজেও জানি না।
অনুভবকে এই পর্যন্ত এনে কবিতাটি আচমকা ঘুরে যায়– তার শেষ দুটি লাইনে ঘনিয়ে আসে রহস্যভরা এক আবহাওয়া! তার অর্থস্তর কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে? স্তরের পর স্তরে মন চলতে থাকে যখন পড়ি: ‘কালো মণি, যক্ষ সেজে ধরে রাখে/ অচেতন জ্যোৎস্না-সৎকার!’ দেখা যাচ্ছে ‘জ্যোৎস্না’ ও ‘সৎকার’ কথাদুটিকে যুক্ত করা হয়েছে হাইফেন দিয়ে। যেভাবে ‘সত্যি’ আর ‘মেঘ’, ‘সত্যি’ আর ‘জল’, ‘সত্যি’ আর ‘পারাপার’ হাইফেন দ্বারা নিজেদের একাত্ম করেছিল, সেইভাবে। তাহলে ‘জ্যোৎস্না-সৎকার’ আসলে কী? যক্ষই বা কে? বোঝা না-বোঝায় আমরা কবিতাটির গভীর রহস্যের জলে ডুবে যেতে থাকি, আর ধীরে ধীরে এক একটি অর্থস্তর খুলে যায়। এমন সার্থক সঙ্কেতধর্মী ও অবচেতনের উদ্ভাসে বিস্ময়কর কবিতা, মানতেই হবে, পড়ার অভিজ্ঞতা কমই হয়।
স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা যে দুটি কবিতার কথা বলেছিলাম, এবার পাঠকের সামনে নিয়ে আসি তাদের। প্রথম লেখাটি হল এইরকম:
কুঞ্জকথা
উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে চিহ্ন সব
সন্ধে শুরু রাস্তা জুড়ে আদিম নীল–
ফিরছে রাধা, রূপাই চটি, জ্যোৎস্নাময়
একটুদূরে ভিড় পেরিয়ে অন্ত্যমিল।
জানত এ সব মুহূর্ত নয় খুব প্রাচীন,
বটের গায়ে সূর্য যেমন কলমচি
জানত এ সব প্রশ্ন নিছক অর্বাচীন
মুখোশ হয়ে রোজ ধরা দেয় নিজস্বী।
লাগলে আঁচড় হিসেব শুরু মাঝরাতে
ভাসছে আবার ডুবছে আকাশ খুব স্রোতে
বাঁচার আভাষ দূরভাষে ছোঁয় নষ্টনীড়
রাধার অবতারের ছায়া ঘুমচোখে–
কথার শেষে ফিরছ তুমি, হে চঞ্চল
হাতের মুঠোয় ঘুড়ির সুতো, পদ্মে বিষ!
একক রাধা কেউ চেনে না শ্যাম ছাড়া–
আয়নাতে শ্যাম রাই খুঁজে নেয় অহর্নিশ।
নির্ভুল স্বরবৃত্তের চলনে এ-কবিতা ধ্বনিগতভাবে শেষ লাইনে একটি আশ্চর্যকে গোপন করে রেখেছে, সে কথায় পরে আসব। আগে বলি, রাধা ও শ্যাম কবিতার চিরকালের বাহন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষার কবিতায়। শুধু কবিতায় নয়, গানেও। কত ঠুমরি, কাজরী, ঝুলা, শাওনি রচিত হয়েছে রাধা ও শ্যামকে কেন্দ্র করে– হিন্দুস্তানি উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। আমাদের বাংলায় তৈরি হয়েছে কীর্তনের মতো অনন্য সঙ্গীতধারা। রবীন্দ্রনাথ বেঁধেছেন তাঁর ভানুসিংহের পদাবলি। এই কবিতায় প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইনটি আমাদের চমৎকৃত করে একটি নতুন প্রয়োগের ব্যবহার ঘটিয়ে, যা রাধা ও শ্যাম বিষয়ক কোনও কবিতা বা গানের মধ্যে কখনওই দেখিনি।
প্রাচীন অথবা সাম্প্রতিক সকল কবিতার মধ্যেই রাধার পায়ে নূপুর থাকে, এ আমরা জেনেছি। গানের মধ্যে গীত হতে শুনেছি। কিন্তু এই কবিতায় রয়েছে এমন লাইন: ‘ফিরছে রাধা, রূপাই চটি, জ্যোৎস্নাময়…’। রাধার পায়ে চটি? এবং সেই চটি কীরকম চটি? রূপাই চটি! ‘র’ বর্ণে ‘ঊ’-কার দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ ‘রূপ’ শব্দের অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে কোথাও। রাধা থাকবে আর রূপ থাকবে না, তা কি হয়? ‘রূপাই চটি’ শব্দটি এক মধুরতাকে স্পর্শ করে যায়, কারণ তার পরেই আসে ‘জ্যোৎস্নাময়’ শব্দটি।
পাঠক লক্ষ করুন, আগের কবিতায় ‘জ্যোৎস্না’ শব্দটির সঙ্গে হাইফেন দিয়ে ‘সৎকার’ শব্দটি যুক্ত হওয়ামাত্র যেন এক জনহীন শ্মশানঘাটের ছবি মনে এনে দিয়েছিলেন অমৃতা ভট্টাচার্য। অর্থাৎ ‘জ্যোৎস্না’ শব্দটি দিয়ে দুটি কবিতায় দু’রকম অর্থ নিষ্কাষণ করা হল। জ্যোৎস্নার রং যেন সেই আগের কবিতায় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছিল। কেন বলছি কৃষ্ণবর্ণ? কারণ ‘জ্যোৎস্না-সৎকার’ শব্দটি ছিল উক্ত কবিতার শেষ শব্দ এবং তার ঠিক আগের লাইনেই উপস্থিত ছিল এক ‘যক্ষ’, ছিল ‘কালো মণি’। মণি অর্থাৎ রত্ন, সে তো উজ্জ্বলতা বিকীরণ করবে! কিন্তু না, সে কবিতায় মণি কৃষ্ণ বর্ণের, যেন যক্ষের চোখের মণির রং। অথচ সেই যক্ষ যেন যক্ষও নয়, সেজে থাকা যক্ষ। কারণ মানুষ তো কখনও কখনও যক্ষের জীবন নিয়েও বাঁচে।

যেমন গ্যালিলেও বেঁচেছিলেন– বের্টোল্ট ব্রেশটের লেখা ‘গ্যালিলেও গ্যালিলাই’ নাটকে আমরা দেখতে পাই গৃহবন্দি, সম্মানচ্যুত, প্রহরী-নিয়ন্ত্রিত জীবনে একা একা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন গ্যালিলেও– আর যক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তাঁর পাণ্ডুলিপি, ‘ডিসকোর্সি’ যার নাম। সেখানে গ্রথিত আছে সূর্যের চারিদিকে যে পৃথিবী-সহ অন্য সকল গ্রহ প্রদক্ষিণ করছে, সেই আবিষ্কারের যাবতীয় গণিত ও পর্যবেক্ষণ-তথ্য। একটা পুরনো গ্লোবের ভেতর গ্যালিলেও লুকিয়ে রেখেছেন সেই পাণ্ডুলিপি, প্রহরীদের চক্ষু থেকে, চার্চের শাসনরোষ থেকে। শেষ জীবনের একমাত্র অবলম্বন, কন্যা ভার্জিনিয়ার উপরেও থেকে থেকেই ক্ষোভপ্রকাশ করছেন বৃদ্ধ গ্যালিলেও। যদিও অবশেষে ব্রেশটের নাটকে দেখা যায়, প্রিয় ছাত্র আন্দ্রেয়ার হাতে সেই পাণ্ডুলিপি গোপনে তুলে দিতে সক্ষম হচ্ছেন গ্যালিলেও এবং সেই পাণ্ডুলিপি রওনা হচ্ছে রোমের সীমান্ত পেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর দিকে।
শম্ভু মিত্র অভিনীত গ্যালিলেওর চরিত্রায়ণ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের তখনই মনে হয়েছে এ যেন এক যক্ষের জীবনে বন্দি হয়ে আছেন সেই মহান বিজ্ঞানী। আর অমৃতার কবিতায় যে যক্ষের কথা বলা হয়েছে, সেই যক্ষ যেহেতু যক্ষ সেজে আছে, অর্থাৎ যক্ষ সাজতে বাধ্য হয়েছে, তাই ডানায় ডানাটি লাগার মতো মাধুর্যের স্পর্শ দিয়ে শুরু হওয়া কবিতা পৌঁছে যায় ‘কালো মণি’, ‘যক্ষ’ এবং ‘জ্যোৎস্না-সৎকার’ সম্পন্ন এক অপ্রত্যাশিত উপসংহারে। কবিতাটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র চারটি পংক্তি। মনে রাখতে হবে, এই চারটি পংক্তিই কিন্তু জমাট অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বাঁধা– যদিও তৃতীয় লাইনটিতে ছন্দের অপূর্ণ পর্বটি দেখা দেয়নি, ফলে আমাদের শ্বাস আমরা ধরে রাখতে বাধ্য হয়েছি, এবং এক নিশ্বাসে চতুর্থ লাইনের শেষে এসে দম ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে আমাদের। কবিতাটিও তখন তার পরিণাম দেখতে পাচ্ছে, যেখানে ওই আধিভৌতিক ‘জ্যোৎস্না-সৎকার’-এর অবস্থান।
‘কুঞ্জকথা’ কবিতাটির প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। প্রথমে বলেছিলাম, এ-কবিতার শেষ লাইনে একটি আশ্চর্যকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কী সেই আশ্চর্য? সে কথা বলার আগে বলি, শেষ লাইনের আগের লাইনটির কথা। সেখানে নিখুঁত ছন্দে গাঁথা আছে এক অবধারিত সত্যবার্তা। এই সূত্রে শেষ স্তবকের পুরোটাই আবার মনে করিয়ে দিই পাঠককে:
কথার শেষে ফিরছ তুমি, হে চঞ্চল
হাতের মুঠোয় ঘুড়ির সুতো, পদ্মে বিষ!
একক রাধা কেউ চেনে না শ্যাম ছাড়া–
আয়নাতে শ্যাম রাই খুঁজে নেয় অহর্নিশ।
শেষ স্তবকটির প্রথম লাইনে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী’ লাইনটির ‘চঞ্চল হে’ কথাটিকে ব্যবহার করা হল ‘হে চঞ্চল’ এইভাবে। ‘হে চঞ্চল’-এ এসে ছন্দে একটা ধাক্কা লাগে। ‘হাতের মুঠোয় ঘুড়ির সুতো’ পর্যন্ত আমাদের ধারণার মধ্যে আসছে। কিন্তু একটি কমা-র পরেই আমরা পাচ্ছি এক অপ্রত্যাশিতকে– পদ্মে বিষ! ‘হাতের মুঠোয় ঘুড়ির সুতো’ অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু আগের লাইনের ‘হে চঞ্চল’ কথাটিতে প্রথমে ‘হে’ রেখে ‘চঞ্চল’-কে মহত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ শ্যাম বা কৃষ্ণ তো মহত্বেরই অনুষঙ্গ বহন করেন। অন্যদিকে শ্যামের নানা লীলার সঙ্গে তাঁর বালকস্বভাবও মিশে থাকে, তাই ‘হাতের মুঠোয় ঘুড়ির সুতো’ যেমন থাকে বালকদের ও কিশোরদের– এই প্রয়োগকে তাই স্বাভাবিকই লাগে।

কিন্তু পরক্ষণেই আসছে ‘পদ্মে বিষ!’ এইখানে বোঝা যায় পদ্মের আগে বা সুতোর পরে কমা-র ব্যবহার কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ শ্যাম তাঁর বালকস্বভাব তো যৌবনেও গোপন করেননি। আর রাধা, যাঁর পায়ে রূপাই চটি, তিনি তো ফিরেই গেছেন। তাঁর জীবনে যে বিরহ-বিষ, তা তো শ্যামেরই দেওয়া। তারপরে সেই অমোঘ সত্য উচ্চারণ: ‘একক রাধা কেউ চেনে না শ্যাম ছাড়া’। সত্যিই তো, যে কোনও মন্দিরে যান, যুগলমূর্তিই দেখবেন। যে কোনও গৃহস্থবাড়ির ঠাকুরঘরে শ্যামের পাশেই রাধা। অথচ কাহিনি বলে শ্যাম রাধাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মথুরাতে। আর আসেননি। তাই ‘পদ্মে বিষ।’ পদ্ম হল শ্যামের দেওয়া প্রণয় মধুরতা। তাঁর সেই পদ্মেই বিষ।
এরপর শেষ লাইন, যার কথা প্রথমেই বলেছি। সেই লাইনটি কী? ‘আয়নাতে শ্যাম রাই খুঁজে নেয় অহর্নিশ।’ এই লাইনটি তার বাইরের অর্থ যা দেখায়, সে অর্থ হল শ্যাম নিজেও রাইকে খুঁজছে, নিশিদিনই খুঁজছে– কোথায় খুঁজছে? আয়নাতে। জীবনে নয়। কারণ জীবনে তো আর মথুরা যাবার পরে রাধাকে খোঁজেননি শ্যাম। সেইজন্যই এ-কবিতা দেখাচ্ছে, শ্যাম তার রাইকে খুঁজছে, কিন্তু আয়নাতে। এই লাইনে যে আশ্চর্যটির উপস্থিতির কথা আছে, তা এবার খুলে বলি। পাঠক, লাইনটি একটু মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন। ‘আয়নাতে শ্যাম রাই খুঁজে নেয় অহর্নিশ।’ লাইনটিতে কী পাচ্ছি আমরা? দেখছি, এখানে শ্যাম রাই শব্দদুটি একদম পাশাপাশি আছে। অর্থাৎ শ্যামরাই একে অন্যের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন এই লাইনটিতে। শ্যাম ও রাইয়ের মধ্যে কোনও যতিচিহ্নও নেই। ফলে শ্যামরাই দু’জনেই পাশাপাশি, যেমন মন্দিরে দেখি, যেমন ক্যালেন্ডারে, ঠাকুরঘরে।
প্রাচীন অথবা সাম্প্রতিক সকল কবিতার মধ্যেই রাধার পায়ে নূপুর থাকে, এ আমরা জেনেছি। গানের মধ্যে গীত হতে শুনেছি। কিন্তু এই কবিতায় রয়েছে এমন লাইন: ‘ফিরছে রাধা, রূপাই চটি, জ্যোৎস্নাময়…’। রাধার পায়ে চটি? এবং সেই চটি কীরকম চটি? রূপাই চটি! ‘র’ বর্ণে ‘ঊ’-কার দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ ‘রূপ’ শব্দের অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে কোথাও। রাধা থাকবে আর রূপ থাকবে না, তা কি হয়? ‘রূপাই চটি’ শব্দটি এক মধুরতাকে স্পর্শ করে যায়, কারণ তার পরেই আসে ‘জ্যোৎস্নাময়’ শব্দটি।
কিন্তু শ্যাম আর রাইয়ের তো বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। দূরত্ব হয়েছিল দু’জনের মধ্যে। যে দূরত্ব আর ভরাট হয়নি। শ্যাম তো রাইকে ছেড়ে মথুরা চলে গেলেনই। তাহলে? তাহলে কি এ-কবিতা সেই বিচ্ছেদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে? তাতে কি সত্যের মর্যাদা থাকে? এখানেই আসছে ছন্দের প্রয়োগকৌশল, যার ফলে ঘটছে আশ্চর্যের সেই আবির্ভাব। ছন্দকে জানলে কবি কত কী রত্নরাজি উপহার দিতে পারেন, তারই একটি প্রমাণ এখানে দেখা দিচ্ছে। শেষ লাইনটিকে যদি ছন্দযতি অনুযায়ী পাঠ করি আমরা, তাহলে কী পাচ্ছি? কীভাবে ছন্দটি চলছে? ‘আয়নাতে শ্যাম/ রাই খুঁজে নেয়/ অহর্নিশ।’ ‘আয়নাতে শ্যাম’ ছন্দযতির একটি খণ্ডে পড়ছে, ছন্দযতির অন্য খণ্ডে পড়ছে ‘রাই খুঁজে নেয়’, তারপর ছন্দযতির শেষ খণ্ডে ‘অহর্নিশ’ শব্দটি আসছে। তাহলে কবিতার লাইনে ‘শ্যাম-রাই’ দু’জনেই পাশাপাশি রইলেন। কিন্তু ছন্দযতির সূক্ষ্মতা শ্যাম আর রাইকে আলাদা করে উচ্চারণ করাল। বিচ্ছিন্ন করল। এইভাবে শ্যাম-রাইয়ের বিচ্ছেদও ধরা রইল এই কবিতায়। সমস্যা হচ্ছে, ছন্দে লেখেন না যাঁরা, তাঁরা নির্ভুলভাবে ছন্দ পড়তেও শিখবেন না, তা নিশ্চিত। দু’একটি কথা বিনিময় করলেও বোঝা যায় সে কথা।
এই একই কবিতায় আরও একটি লাইন আছে, যা ছন্দের ব্যবহার ছাড়া উত্তীর্ণ হতে পারত না, নিজের বক্তব্য বিষয়কে একাধিক অর্থস্তর দিয়ে স্পর্শ করতে পারত না। লাইনটি কী? ‘রাধার অবতারের ছায়া ঘুমচোখে–’ চার স্তবকে গঠিত কবিতাটির তৃতীয় স্তবকের শেষ লাইনটি দেখুন। রাধার অবতার? এ কথা কখনও শুনেছি কী? বিষ্ণুর অবতার হয়, যে দশাবতারের কথা আমরা জানি, তার মধ্যে তো রাধা নেই। যদিও চৈতন্যের মধ্যে রাধাভাব ছিল, ছিল মীরাবাঈয়ের মধ্যেও। কিন্তু রাধার অবতারের কথা কি কোনও শাস্ত্রে বা সঙ্গীতে বা কীর্তনে বলা আছে? আমি তো জানি না। তাহলে? এক সম্ভাব্য উত্তরের কথা পেশ করি ছন্দে অভিজ্ঞ পাঠকদের সামনে। তাঁরা নিজেরা বিচার করে দেখবেন, আমার সন্ধান ঠিক পথে চলেছে কিনা।

একটু আগে আমরা দেখেছি, এই কবির হাতে ছন্দের সূক্ষ্ম কারুকাজ কীভাবে শ্যামরাইকে পাশাপাশি রাখল, আবার তাদের বিচ্ছেদকেও জানিয়ে দিল। এবার দেখা যাক ‘রাধার অবতারের ছায়া ঘুমচোখে–’ লাইনটির ভিতর সন্ধান করলে কী পাওয়া যায়। রাধার অব/ তারের ছায়া/ ঘুমচোখে– অর্থাৎ ছন্দের কারণে ‘অবতারের’ শব্দটি দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে– ‘রাধার অব’ একটি খণ্ড, ‘তারের ছায়া’ অন্য খণ্ড। রাধার জীবন যে কেবল এক ভেঙে যাওয়াকেই বয়ে বেড়াল আজীবন, সে কথা ছন্দের ভেতর শব্দ স্থাপনের অমোঘতায় বোঝানো হল। এই কবিতা, আগেই বলেছি, এক নারীকবির রচনা। যে সকল নারী, প্রেমে সংযুক্তা হয়েছেন, এবং যাঁদের ছেড়ে গেছেন তাঁদের প্রিয় পুরুষ, যাঁরা বিরহকণ্টকে বিদ্ধ হতে হতেও ভুলে যেতে পারেননি তাদের প্রেমাস্পদকে– অন্য পুরুষে নিমগ্ন হতে পারেননি পরবর্তী সময়ে– ওই বিরহের রক্তপাত তাঁদের কেউ শিল্পকাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ বা নিয়োগ করেছেন মানুষ গড়ার ব্রতে। এঁরাই হয়তো রাধার অবতার।
এবারে যে কবিতাটি বলব, তার নাম ‘আমরা সবাই পালক আঁকি’।
ঊর্ধ্বমুখী নরক যখন
রাতবিরেতে
আমরা সবাই পালক আঁকি
নরম পালক, নকশা কাটা
সুড়সুড়িতে বিবেক সাঁটা
হিমপোড়ানো, কর্পোরেটের আতর মাখা
পালক আঁকি, আমরা সবাই–
রাতবিরেতে–
আমরা সবাই পালক আঁকি।।
ঊর্ধ্বমুখী নরক যখন
বক্স-অফিসে
তিন-চারটে-কফিন রাখা—
জরাসন্ধ নামের বানান– ঘুণ ধরা কাঠ
রাগতে রাগতে ভুলে যাওয়া চুমুর আওয়াজ
সরলরেখাই– মোড়ের মাথায়
আচম্বিতে ঘুরে দেখা, উড়তে থাকা, দু-একখানা
পালক আঁকি, আমরা সবাই–
ঊর্ধ্বমুখী-নরক দেখে
দিন ফুরোলেই
আমরা সবাই পালক আঁকি।
এ-কবিতা বলছে, ‘নরক যখন ঊর্ধ্বমুখী’ তখনও সমস্ত ‘বক্স-অফিসে তিন-চারটে কফিন রাখা’, যখন ‘হিমপোড়ানো কর্পোরেটের আতরমাখা’ জীবন আমাদের, তখনও রাতের নির্জন সময়ে ‘আমরা সবাই পালক আঁকি’। বাস্তবের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার চাপ সহ্য করেও কী করে শিল্পী তাঁর শিল্পের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন, এ-কবিতা সেই বার্তাই দিতে চাইছে। ‘আমরা সবাই পালক আঁকি’ কথাটি বারবার ধ্রুবপদের মতো ঘুরে আসে এ লেখায়। যদিও অমৃতা ভট্টাচার্যের বইয়ের তৃতীয় প্রচ্ছদে বলা আছে, অমৃতা ছবি আঁকতে ভালোবাসেন, তবুও এ কবিতায় কেবল অঙ্কনশিল্পী আর চিত্রকরদের কথাই বলা হয়েছে, এমন ভাবলে ভুল করা হবে। যাঁরা আমরা লেখালেখির চেষ্টা করে চলি, যাঁরা নাটক রচনা করেন, নির্দেশনা দেন, মঞ্চে বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, পরিচালনা করেন চলচ্চিত্র– সকল শিল্পীই আসলে একমনে পালক এঁকে চলেছেন। সারাজীবন ধরে পালক আঁকার কাজ করে চলেছি আমরা। লক্ষণীয় যে, এ-কবিতা কোথাও গিয়ে শেষ হচ্ছে না। চলতেই থাকছে, চলতেই থাকছে– কারণ সব শিল্পীই নিজের কাজ করে চলেছেন। এই সভ্যতার দেওয়া গরল উপেক্ষা করে সকলেই যথাসাধ্য সৎ থাকার চেষ্টা করে চলেছেন। সেই চলা থামেনি। তাই এ কবিতাও থামে না, শেষ হয় না। আমরা সবাই পালক এঁকেই চলি।
অমৃতা ভট্টাচার্যের যেসব কাব্যগ্রন্থ থেকে এই কবিতা অথবা কবিতাংশগুলি নিয়েছি, একে একে তাদের নাম জানিয়ে রাখি পাঠকদের– যদি সম্ভব হয়, তাঁরা সংগ্রহ করে পড়বেন এই আশায়। অমৃতার তিনটি বই বেরিয়েছে ‘পাঠক’ প্রকাশনা থেকে– যে প্রকাশনার দায়িত্বে আছেন অগ্রজ দুই কবি শ্যামলকান্তি দাস এবং শংকর চক্রবর্তী। তাঁরা ‘কবিসম্মেলন’ নামক কাব্যপত্র প্রকাশ করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে, সেখানেই অমৃতা ভট্টাচার্যের লেখা আমি প্রথম পড়ি। ‘পাঠক’ থেকে প্রকাশিত অমৃতার বই তিনটির নাম– ‘ভর বাড়ছে শ্বেত বামনের’, ‘পাইন, ঘাটসিঁড়ি আর শ্রীঘরের গল্প’ এবং ‘আমরা সবাই পালক আঁকি’। ‘ধানসিঁড়ি’ প্রকাশনাও প্রতিশ্রুতিমান কবি ও লেখকদের বই প্রকাশ করেন নিয়মিতভাবে। ‘ধানসিঁড়ি’ থেকে বেরিয়েছে অমৃতার ‘নগ্ন, আনন্দঘর’ নামক কবিতার বই। একটি ষোলো পৃষ্ঠার পুস্তিকাও প্রকাশ পেয়েছে অমৃতার ‘বইওয়ালা বুক ক্যাফে’ থেকে। বইটির নাম ‘ও অস্পৃশ্য! ও আশ্চর্য!’ ওই পুস্তিকা থেকে আমি এই গদ্যে ব্যবহার করেছি ‘বিশ্বাসী’ কবিতাটি। শেষে বলি, এই বইয়ের উৎসর্গপৃষ্ঠায় লেখা আছে, ‘আলো ও জল’, অর্থাৎ অমৃতার কবিতা আলো ও জলের প্রত্যাশী।
উপসংহারে এসে পাঠকদের হাতে তুলে দিই অমৃতা ভট্টাচার্যের আরো একটি কবিতা, যা অক্ষরবৃত্তের দশ মাত্রা মান্য করে রচিত। এই কবিতার ভিতরে গিয়ে আমি খুব বেশি বিশ্লেষণের পথ আর নিচ্ছি না– বরং পাঠকই দেখে নিন কীভাবে স্তবক থেকে স্তবকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হল এই লেখা। স্তবকবন্ধ আয়ত্ত করাও নতুন কবির কথনদক্ষতার একটি বড় পরিচয়। এ লেখায় দেখা যায় শেষ স্তবকে পরিণতির সামনে এসে কবিতাটি একটি প্রশ্নমাত্র রেখে দিয়ে সম্পূর্ণ করল নিজেকে– প্রশ্ন শুধু, সমাধান নয়। এমন অনেক উচ্চাঙ্গের কবিতা আমি পড়েছি, যা প্রশ্ন তুলে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে নিজেকে– এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে পাঠক যাতে আরো নিবিষ্ট হতে পারেন। কবিতার নাম: ‘ঋণকথা।’
সবকিছু ঋণী তার কাছে
পশম, ধোঁয়ায় ধরা দাগ
সে-উষ্ণ চোখের কোণ ভিজে
অভিযোগ? নাকি তা মৌতাত?
বিনিময়ে মুঠোভরা আলো
পরিচয় পায় কাচ ছুঁয়ে
অচেনার থরথর জানে
মেঘ সিঁদুরের কাছে গিয়ে
কানে কানে সইকথা বলে
বলে– জানো? আমাদের বাড়ি–
রূপকথা তোমাদেরই মতো;
রোজই শ্রাবণ, চোখ ভারী!
বলে– শোনো, সেঁজুতির আলো
উঠোন ভরিয়ে রাখে ত্রাসে
যেমন রূপকথারা থাকে
সিঁদুরে মেঘের পাশেপাশে।
স্বপ্নেও যেমন বুদ্বুদে
মরা ছায়া রোজ খোঁজে শোক–
প্রতিটি শ্রাবণ তার চোখে
ঝকঝকে যন্ত্রণাই হোক!
এইসব ঋণ তার কাছে
এইসব ভুল তার আলো
বলো ঋণ, ইতিহাস ভুলে
বোঝাবে আমায়?– ঋণ ভালো?
কবিতাটির শেষ স্তবকের প্রথমে এসে আমরা দু’টি লাইন পাই: ‘এইসব ঋণ তার কাছে/ এইসব ভুল তার আলো…।’ দ্বিতীয় লাইনটির শেষে কোনও যতিচিহ্ন নেই– অর্থাৎ আলো জ্বলেই রয়েছে, নির্বাপণ নেই তার। কীসের আলো? ‘এইসব ভুল তার আলো।’ ভুলের কি কোনও আলো হয়? সে তাহলে কীরকম ভুল?
আমার মনে আসছে জাপানের দুই বিখ্যাত গণিতবিদের কথা– ইয়োটোকো তানিয়ামা এবং গোরো শিমুরা। ‘তানিয়ামা-শিমুরা কনজেকচার’ গণিতজগতে অত্যন্ত পরিচিত ও আলোচিত একটি নাম। এই তানিয়ামা তিরিশ বছর পার করেই গণিতজ্ঞ হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই তানিয়ামার মনে হয়, তাঁর মস্তিষ্ক খালি হয়ে গেছে। নতুন কিছু উদ্ভাবন করার শক্তি তাঁর আর আসবে না। ৩৭ বছর বয়সেই তানিয়ামা আত্মহত্যা করেন। পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণে আসছে প্রখ্যাত রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি আত্মহত্যা করেন এই ৩৭ বছর বয়সেই, চিত্রকর ভ্যান গখের আত্মহননও ৩৭-এ পৌঁছেই ঘটে। ওদিকে ‘তানিয়ামা-শিমুরা কনজেকচার’ গণিতবিশ্বে চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যায়, যেমন থেকে গেছে ভ্যান গখের ছবি, মায়াকভস্কির কবিতা। ১৬৩৭ সাল থেকে অংকের যে জটিলতম থিওরেম সমাধান করা যায়নি, সাড়ে তিনশো বছর পরে, ১৯৯৪ সালে, সেই ‘ফেরমা’জ় লাস্ট থিওরেম’ নামে প্রসিদ্ধ জটিল অংকটির সমাধান করেন ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যান্ড্রু ওয়াইলজ়। ১৭২ পৃষ্ঠাব্যাপী এই অংক কষে চলার সময় ওয়াইলজ় ‘তানিয়ামা-শিমুরা কনজেকচার’-এর সহায়তা গ্রহণ করেন এবং সেই ‘কনজেকচার’-ও সমাধান করে ফেলেন।

শিমুরা তাঁর তরুণ বয়সের বন্ধু তানিয়ামাকে ভুলতে পারেননি কখনও। ২০১৯ সালে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে শিমুরা বলে যান, তানিয়ামা অংক কষার সময়ে– ‘…made lot of mistakes. But he made mistakes in a good direction. I tried to imitate him. But I have realised it is very difficult to make good mistakes.’ সমস্ত জীবন ধরেই তানিয়ামার বিষয়ে কথা বলতে হয়েছে শিমুরাকে। অন্যত্র একবার এক সাক্ষাৎকারে তানিয়ামার কথা উত্থাপিত হলে, তাঁর বেপরোয়া ভুল করার প্রসঙ্গ এসে পড়ে। শিমুরা সেখানে বলেন, ‘Yes, he often made mistakes desperately. But oh, how elegant those mistakes are!’
এই হল সেইরকম ভুল, যে ভুলে আলো জ্বলে, জ্বলে থাকে চিরদিন– তাই শেষ স্তবকের দ্বিতীয় লাইনটির শেষে কোনও যতিচিহ্ন বসানো হয়নি। আসলে এক-এক ধরনের কবিতালেখক থাকেন, যাঁদের লেখা পড়তে পড়তে মন দূরদূরান্তে চলে যায়। অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতা সেই চরিত্রবহনকারী।
‘কবিতার সঙ্গে বসবাস’ পরবর্তী কিস্তি প্রকাশিত হবে ৫ মার্চ
*ছবি সৌজন্য: AAS Nova, Space.com, Pinterest, Medium.com
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
অসাধারণ