জোকার, ডাইনি ও ক্রিকেট— তিন তুমুল বৈপরিত্যের সহাবস্থান
যে কবির সদ্য প্রকাশিত বই নিয়ে আজ কথা বলব সেই কবি পেশায় একজন ক্রীড়া সাংবাদিক। গত তিন দশকের অধিক সময় ধরে এই কবি পেশার কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নানা দেশে। ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশে বেশ কয়েকবার ম্যাচ কভার করতে গেছেন। এঁর আরেকটি পরিচয় হল— বাংলা সাহিত্যে ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে প্রথম উপন্যাসের রচয়িতা তিনিই। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার যে, অন্তত পনেরোটি উপন্যাস আছে তাঁর। তার মধ্যে নটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয় আনন্দমেলায়। এখন ‘এই সময়’ দৈনিকের শারদীয় সংখ্যায় এই লেখকের উপন্যাস পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় প্রতি বছর।
দেশ-বিদেশ ঘুরে ক্রীড়া সাংবাদিকতা করা এবং প্রতি বছর উপন্যাস লেখার ব্যস্ততার মধ্যেও এই কবি কিন্তু তাঁর প্রথম প্রেম কবিতার কাছ থেকে সরে আসেননি। দুটি কবিতার বই আগে বেরিয়েছিল তাঁর। আগে মানে? কতদিন আগে? কুড়ি বছর আগে। কুড়ি বছর? হ্যাঁ, দুই দশক পর বেরলো তাঁর নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘জোকার ও ডাইনির স্ক্রিনসেভার’।
কিন্তু এই বই নিয়ে কথা বলার আগে নিজের কয়েকটি অজ্ঞানতা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত আমার। সেই সব অজ্ঞানতার তালিকা খুব ছোট নয়। এই কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে বারবারই সর্বাধুনিক যোগাযোগ-প্রযুক্তির কয়েকটি পরিভাষা। যেমন – অনলাইন, কি-বোর্ড, সেলফোন, রিংটোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ল্যাপটপ আর স্ক্রিনসেভার তো আছেই। এইসব জিনিস নাড়াচাড়া করতে যিনি খুবই অভ্যস্ত এমন কারও উচিত এই বই বিষয়ে কলম ধরা। সেই জন্যে আমার সীমাবদ্ধতাগুলি জানিয়ে আগেই পাঠকের কাছে মার্জনা চেয়ে রাখলাম।

বাংলা কবিতায় দুটি প্রধান ধারা বহমান দেখা যায়। একটি ধারা সংকেতধর্মী কবিতার, অন্যটি ধরে আছে বিবরণধর্মী কবিতাকে। কখনও কখনও, বাংলার গত সত্তর বছরের কাব্য ইতিহাসে, একই কবি এই দুই ধারার কবিতা লিখেছেন। যেমন—সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষের ‘মেজাজ’ কবিতা বা ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’—এই দুটি কবিতার পাশে যদি আমরা ‘যত দূরেই যাই’ ও ‘টানা ভগতের প্রার্থনা’ লেখা দুটিকে স্থাপন করি, তাহলে এর মর্ম বোঝা যাবে। আবার বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ আদ্যন্ত সংকেতধর্মী। পাশাপাশি বিনয়ের ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’, অথবা ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ নামক কাব্যগ্রন্থগুলি যদি পড়া যায় তবে দেখা যাবে বিনয় মজুমদার শেষ জীবনে ঠাকুরনগর নামক যে-গ্রামে বাস করতেন, তার গাছপালা-মাঠ-পাখি ও দূর দিয়ে রেলগাড়ির যাওয়া-আসা কী অপূর্ব বিবরণধর্মীতায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর শেষদিকের কাব্যগ্রন্থসমূহে। এমন উদাহরণ আরও বাড়ানো যায়, কিন্তু আমরা সরাসরি ‘জোকার ও ডাইনির স্ক্রিনসেভার’ কবিতাগ্রন্থটির মধ্যে ঢুকে পড়াই উচিত কাজ বলে মনে করছি।
প্রথমে একটি কবিতা দেখা যাক:
৩
জোকারকে খুন করার জন্য একটা রিভলভার কিনতে গোপনে যে দোকানটায়
পৌঁছোলাম, তার দোকানদারের মুখে একটা কালো রঙের মাস্ক ছিল। হাতে
চুরুট। কাচের শো-কেস থেকে সে একটা একটা করে রিভলভার বের করে
এনে দেখাচ্ছিল। কোনোটা জার্মানির, কোনোটা আমেরিকার। একটা আমার
পছন্দ হতে তড়িঘড়ি কিনে ফেলি। ট্যাক্সিতে চড়ে ঠিক বাড়ি ফিরে আসি।
ছাদের ঘরে চাঁদমারি টাঙিয়ে প্র্যাক্টিস করি। কিন্তু কয়েকটা বুলেট বেরোতে
না বেরোতে লোডশেডিং হয়। মোমবাতি খুঁজতে রান্নাঘরে যাই। আর তখনই
আলো জ্বলে ওঠে। ড্রইংরুমের সোফায় আমারই রিভলভার হাতে বসে সেই
দোকানদার। তারপর একটু একটু করে জোকার হয়ে যায় সে…

এই কবিতাটির শিরোনামে ‘৩’ সংখ্যাটি বসানো আছে দেখে যদি পাঠকের বিভ্রম হয়, তবে জানিয়ে রাখি, ‘লকডাউনে জোকারের সঙ্গে কথোপকথন’ নামক একটি কবিতা-সিরিজের তৃতীয় সংখ্যক কবিতা এইটি। এই কবিতা পড়লে বোঝা যায় বিবৃতিধর্মী কাব্যের পথিক এই কবি কী আশ্চর্যভাবে কবিতাটিকে বিবরণের স্তর পার করে এক সুররিয়ালিস্ট ফিল্মদৃশ্যের রহস্যে পৌঁছে দিলেন।
কবিতাটির মধ্যে গল্প বলার ধরন থাকলেও কবিতাটি কেবল কাহিনি হয়ে রইল না। সে যেন পাঠককে এক আততায়ীর মুখোমুখি করে দিল, যে-আততায়ী হয়তো কবি নিজেই। অথবা কে বলতে পারে পাঠকই নিজে সেই আততায়ী নন?
৬
কোথাও একটা পালিয়ে এসেছি আমি। ঠিক কোথায়, বলতে পারব না।
জোকারের পোষা কুকুর আর ভাড়াটে সৈনিকদের এড়িয়ে টানা দৌড়ে চলেছি।
অলি-গলি পেরিয়ে এঁকে-বেঁকে। রাস্তার মৃদু আলোয় ফিসফিস করছে মাস্ক
পরা সব লোকজন। কানে মোবাইল। এরা কি ফোন করছে জোকারকে?
আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য? দম ফুরিয়ে আসছে। হাঁপিয়ে উঠছি আমি।
বুঝতে পারছি ওরা আসছে মোটরবাইকে চড়ে। আমার মৃত্যুদশা ফেসবুক
লাইভে তুলে রাখবে বলে …

এই কবিতাটি উপরোক্ত কবিতা-সিরিজের সর্বশেষ রচনা। এখানেও দেখা যায় একটি আসন্ন হত্যার প্রচ্ছায়া এসে পড়ছে কবিতার মধ্যে। যে-প্রচ্ছায়ার বাইরে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রাণপণ দৌড়ে চলেছে এ রচনার কথকস্বর। পরপর দুটি কবিতা পড়ে আমাদের মনে হয় সভ্যতার যে মাফিয়া-মুখোশ আমাদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে মানুষকে মেনে চলতে হয়— সেই মুখোশের মত অনুযায়ী চলতে বাধ্য হতে হয়— এ যেন তারই হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা।
আবার এই ‘জোকার’-কেই আমরা অন্য চেহারায় দেখতে পাই এমন দুটি কবিতা পরপর তুলে দিচ্ছি:
৫
আঙুলের ফাঁক দিয়ে অনেক কিছুই গলে গিয়েছে জোকারের। প্রেম ভেঙেছে,
প্রেমে পড়েছে, আবার ভেঙেছে। কিন্তু লণ্ঠন আর নিস্তব্ধতা ছাড়া কিছুই সে
মনে রাখেনি। বরং সূর্যাস্তে লেকের ধারে ডাইনির সঙ্গে বাদাম ভাজার লোভে
রোজ ঘুম ভেঙেছে তার।
কুয়াশা জোকারের পাশের বাড়ি থাকে। আর ডাইনি ৫৭ নম্বর ধোঁয়াশা
অ্যাভিনিউতে। এই দুইয়ের মাঝখানে কখনো সার্কাসের তাঁবু পড়ে, কখনো-বা
ফিসফিস করে কথা বলে কেউ। নেতিয়ে পড়া চাউমিনের মতো শুয়ে থাকে
নিঃসঙ্গতা।
এসব নিয়ে জোকার উদাসীন থাকে। আবার একটা খুনখারাপি পরকীয়ার খোঁজে
সে গড়িয়াহাটের দিকে হেঁটে যায় …
উইন্ডো শপিং
উইন্ডো শপিং করার ফাঁকেই মেয়েটির দিকে চোখ রাখে ক্ষুধার্ত জোকার। একাই
তো। প্রেমিক কি কাছাকাছি আছে? বার বার ইতিউতি তাকানোটা কীসের
ইশারা? সন্দেহ গিঁট পাকিয়ে ঢুকতে থাকে জোকারের মাথায়। সে আমল দেয়
না। উসখুস করে। অন্তত পাঁচ লক্ষ বছর পরে তার বিষাদগ্রস্ত স্যাঁতস্যাঁতে
ফুসফুসে ভাইরাস ঢুকছে। পরকীয়ার তীব্র গন্ধে সে আবার বেঁচে থাকার কথা
ভাবছে…

এই কবিতা দুটির মধ্যেও আমরা ‘জোকার’-কে দেখতে পাচ্ছি। আর পাচ্ছি ‘ডাইনি’কে। যে দুটি নাম বইয়ের মলাটে প্রথমেই দেখেছি আমরা। এ কবিতায় জোকারের একটি ঠিকানা দেওয়া আছে। ঠিকানাটি রহস্যময়! কী সেই ঠিকানা? ‘কুয়াশা জোকারের পাশের বাড়ি থাকে।’ ডাইনির ঠিকানাও আছে। ডাইনির বাস ’৫৭ নম্বর ধোঁয়াশা অ্যাভিনিউ’-তে। এবং এই দুটি কবিতার মধ্যেই জোকারকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ‘পরকীয়ার তীব্র গন্ধে সে আবার বেঁচে থাকার কথা ভাবছে।’ অর্থাৎ জোকারের চরিত্রে নতুন এক রশ্মিপতন ঘটল।
এরপর অন্য একটি কবিতায় আসি :
পুতুল নাচ
রেললাইনের গলা দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে চেপে রেখে জোকার স্টেশনের ধারে
একটা চায়ের দোকানে এসে বসল। চার টাকার লাল চায়ে চুমুক দিয়ে সে
দেখল, মাটির ভাঁড়ের মধ্যে একটা পুকুর। কাঠাফাটা রোদ, কিছুটা দোনামনা
করে সে নামল সেই পুকুরে। দূরে কোথাও একটা শোনা গেল হাসির খিলখিল
আওয়াজ।
ওই আওয়াজে বিদ্যুৎচমকের মতো ফিরে এল সেই দুপুর, যখন ডাইনির হাতে
ধরা মাটির ভাঁড় থেকে তার দিকে ছিটকে উঠেছিল পুতুল নাচের ইতিকথা …
এই কবিতায় আবারও এক সুররিয়ালিজমের ইন্দ্রজাল দেখা গেল। কেন-না, চার টাকার লাল চায়ে চুমুক দিয়ে সে দেখল মাটির ভাঁড়ের মধ্যে একটা পুকুর! কে দেখল? যে রেললাইনে গলা দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে চেপে রেখে স্টেশনের ধারে একটা চায়ের দোকানে এসে বসেছিল, সে দেখল। চায়ের ভাঁড়ের মধ্যেই কিনা জেগে উঠল পুকুর? আর এই মাটির ভাঁড়ের অতীত ইতিহাস জানা গেল, যেখানে সেই মাটির ভাঁড় ধরা ছিল ডাইনির হাতে। রেললাইনে গলা দেওয়ার ইচ্ছে চেপে রেখে স্টেশনে কে এসেছিল? হ্যাঁ, জোকার। এ কবিতায় ডাইনিও আছে। কবিতার নাম ‘পুতুল নাচ’। কে পুতুল? জোকার নিজেই? নাকি ডাইনি ও জোকার দুজনেই পুতুলনাচের দুই কুশীলব? কোনও অদৃশ্য ভবিতব্যের দড়ির টানে তারা নেচে বেড়াচ্ছে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আবার একে অপরের কাছে আসছে নিজেদের নিরুপায়তা নিয়ে। এসব প্রশ্নের উত্তরের পিছনে ছুটতে ছুটতে পাঠক কখনও ‘জোকার’ হয়ে যায়। আবার কখনও নিজের জীবনে দেখা পাওয়া কোনো অলৌকিক ‘ডাইনি’র স্মৃতির ভিতর তলিয়ে যেতে থাকে।
এই বই— ‘জোকার ও ডাইনির স্ক্রিনসেভার’ আসলে কবির আত্মপ্রক্ষেপণ, একবার ছুটে যাচ্ছে জোকারের দিকে, আবার কখনও তা ধাবমান সভ্যতার ভয়ানক বিপজ্জনক গলির মধ্য দিয়ে চলা একাকী এক ভ্রমণকারীর দিকে। আর ডাইনি? সে তো এখানে চিরকালের প্রেম। ডাইনি বলার মধ্যে কোনও ঘৃণা নেই কিন্তু। বরং এক ছদ্মবেশী আদর আছে।
নীচের কবিতাটির মধ্যে তার অব্যর্থ প্রমাণ স্থাপিত।
প্রেম
জোকার ভেবেছিল, এভাবেই নষ্টামি আর বিষাদের মধ্যে বসে সে কাটাকুটি
খেলবে। নিশ্চিন্তে ল্যাপটপনির্ভর কেটে যাবে বাকি জীবন
ডাইনি ভেবেছিল, লেখালেখির দুনিয়ার ঝোপঝাড়ে কোথাও একটা দীপ্ত
চিতাবাঘ বসে আছে, যে ঠিক শিকারী নয়।
এইসব ভাবনা কখন এক মহাদেশ থেকে সমুদ্রের গভীরতম তলদেশে পৌঁছে
যায়, দুজনের কারও আন্দাজ করার ক্ষমতা ছিল না।
তবু অজস্র গোলাগুলি, ঝিমিয়ে পড়া সময় আর জানালা দিয়ে ঢুকে আসা
একইরকম অক্সিজেন দুজনের গালেই ঠাস করে মারল থাপ্পড়।
দুজনেই অবাক হয়ে দেখল, বিশাল একটা পাহাড়ে খাদের ধারে পা ঝুলিয়ে
বসে আছে। কেউ কি কাউকে ঠেলে দেবে নীচে? না কি একে অপরকে জড়িয়ে
ধরবে?
আসলে ওরা কিছুই করছে না, শুধু একে অপরের ঠোঁটে আটকে আছে—

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে, কোনওদিন সামাজিকভাবে পরিণতি পাবে না যে সম্পর্ক তার অবধারিত প্রণয়বন্ধন নিয়ে, এক অতলস্পর্শী খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর কোথায় কোথায় কোন কোন নরনারী, তার চিরজীবী চিত্র শিলালিপিতে মুদ্রিত করে দেয় এ কবিতা। শ্লেষ-তীর্যকতায় মিশ্রিত ভাষা দ্বারা তৈরি হয়েছে মূলত আত্মব্যবচ্ছেদ ও অনিবারণীয় প্রেমার্তির এই কাব্যগ্রন্থ। আত্মব্যবচ্ছেদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে সমাজ। আমি যে সমাজের সমালোচনা করব, আমি কি সেই সমাজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি? কখনোই না। এই সচেতনতা কবিতাগুলিকে ছেড়ে যায় না বলেই কবিকথক নিজেকেও বিদ্ধ করতে ছাড়েন না। আবার কখনও কখনও এসে পড়ে পড়ে এক ধরনের অদ্ভুত রসের কৌতুক।
মোহিনীমোহন
ঠিক কী করতে চাইছে, বুঝতে না পেরে বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে ছিল
জোকার। যেভাবে বেশ কিছু সন্ধে সে একটা সুড়ঙ্গে পাচার করেছে। আরও
কিছু অপছন্দের বস্তু তার ওই সুড়ঙ্গের দিকে ঠেলে দেওয়ার ইচ্ছে। যেমন
সাদা রঙের নিয়ন লাইট, ক্লাস নাইনের ক্লাসরুম, মিসেস বাসু আর সুড়ুৎ করে
মুখে সাপের মতো নুডলস পুরে নেওয়া মোহিনীমোহন চক্রবর্তী। বহুদিন ধরে
জোকার মোহিনীমোহনকে খুঁজছে।
মোহিনীমোহনকে কি আপনারা চেনেন? নাহ্, জোকারও চেনে না!

এই কবিতার মধ্যে এক বিচিত্র অ্যাবসার্ডিটি আছে। আছে, কৃষ্ণবর্ণ রঙ্গকৌতুক। কালো আচ্ছাদনে ঢাকা এই হাস্যরস, কাব্যগ্রন্থের অন্যত্রও দুষ্প্রাপ্য নয়। এবং এই কবিতাটির ক্ষেত্রে বোঝা যায়, জোকার এবং কবিকথক কীভাবে কখনও একত্রে মিলে যাচ্ছেন, কখনও কখনও পৃথক হয়ে যাচ্ছেন। এক্ষুনি ‘কালো’ শব্দটি ব্যবহার করেছি হাস্যরসের ক্ষেত্রে—কারণ সেই কালো রং আসলে এক ছদ্মবেশ। তবে সত্যিকারের কালো রঙের কবিতা এ বইয়ে আছে, যেখানে জোকারের কোনও উপস্থিতি নেই। নেই ডাইনিরও কোনও অবস্থান। যে কবিতায় দেখা যাবে কবিকথকের স্পষ্ট আত্মমুখ। সে-কবিতাটি এবার পড়ব আমরা।
হাউজ দ্যাট
১
বাঁ-হাতে একটু দৌড়ে এসে,
মাত্র সাত পা—
বিড়ি সুইং করাচ্ছিলাম,
ভাই কিপ করছিল
আর মা ব্যাট করছিল—
নন স্ট্রাইকার এন্ডে বাবা,
স্লিপে আমার মেয়ে,
যে ক্যাচ এলে জীবনেও ধরবে না—
পেস, আরও পেস।
কনুই একটু ভেঙে টেনে দে,
এখন ফিফটিন ডিগ্রি পর্যন্ত ছাড় দেয়,
ইয়র্কার লেংথ না হোক, ফোর্থ স্ট্যাম্পে খেলা—।
দেখি মা কতক্ষণ পারে!
ওভারের পর ওভার,
সেশনের পর সেশন,
দিনের পর দিন,
রাতের পর রাত চলে যাচ্ছিল
আর মা ব্যাট করে যাচ্ছিল
ঠিক সুনীল গাভাসকারের মতো।
অবিশ্বাস্য সেই ডিফেন্স,
যেখানে প্রতিটি বল খেলছে ব্যাটের মাঝখান দিয়ে.
জানতাম, স্লিপে ক্যাচ গেলে মেয়ে ফেলে দেবে,
স্পিন করালেও সহজ স্টাম্পিং মিস করবে ভাই,
নন স্ট্রাইকার বাবা কিছুতেই রান আউটের চান্স তৈরি করবে না—
তা হলে আউটটা হবে কী করে?
একটা ক্রিকেট টেস্টও পাঁচ দিনে শেষ হয়ে যায়,
অথচ মা এই নিয়ে প্রায় ২০০ দিন ক্রিজে—
সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একদিন অ্যাম্বুলেন্সে করে ক্রিজে
গেল,
তারপর থেকেই চলেছে আমার এই বোলিং।
আমি ছাড়াও হাজার হাজার বোলার আসছে।
কতরকমের বোলিং মেশিন, কতরকমের বাউন্সার—
আমি স্লিপে লোক বাড়ালাম—
এতক্ষণ ভিতরে রাখছিলাম বলটা,
এবার বাইরে রাখব—
একটা ভিতরে যাবে, একটা বাইরে।
কোনটা ভিতরে যাবে, কোনটা বাইরে
মায়েরা ঠিক জানে।
ব্যাট তুলে ছেড়ে দেয়.
কিপারের হাত ঘুরে বল ফেরত আসে।
মুখস্থ হয়ে যায় লিফটম্যান, নার্স আর আয়াদের মুখ,
অত বড়ো স্টেডিয়ামে
শয়ে শয়ে বেডে আউট হওয়ার অপেক্ষায়
আরও আরও বিপন্ন ব্যাটসম্যান,
আউট ও নট আউটের মধ্যে শুধু তো একটা ‘নট’,
অসংখ্য অ্যাপিল, তবু সবই নাকচ
মনিটরে এখনও দাপাদাপি করছে হৃৎস্পন্দন,
রক্তের মধ্যে মিশে যাচ্ছে ধারাবাহিক সব আর্তনাদ।
আমি আবার বাউন্সার দিয়েছি,
মা মৃদু হেসে ছেড়ে দিয়েছে,
তবু আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠি,
হাউজ দ্যাট—
আম্পায়ার কে আমি জানি না,
কিন্তু কেউ আউট দেয় না,
চলতেই থাকে এই টাইমলেস টেস্ট।
কোত্থেকে আসবে সেই বল?
চাঁদের আলোর মধ্যে থেকে?
মায়ের ফেলে যাওয়া শাড়ির গন্ধ থেকে?
মদের বোতলের ভেতর থেকে?
নাকি অফিসের দশতলার ছাদ থেকে?
প্রতি রাতে গুগল ঘেঁটে আসি বলে থুতুর সঙ্গে মেশাই গোপন ইচ্ছে,
সহানুভূতির বিষাক্ত তীর এড়াতে এড়াতে
অফিসে থেকে ফিরি,
তবু বলটায় রিভার্স সুইং হয় না,
পা বাড়িয়ে মাথা নীচু করে খেলে দেয় না।
আর আমি প্রতি রাতে
ঘুমোতে যাওয়ার আগে
খুঁজে যাই মা-কে আউট করার নানা সম্ভাব্য ফর্মূলা।
যতদিন নট আউট, ততদিন টাকা।
মা ব্যাট করছে আর টাকা উড়ছে।
বোলারের পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে,
কিপারের নাভিশ্বাস উঠছে,
তবু মা ১৮৭ ব্যাটিং।
নির্ঘাত ব্রায়ান লারার ৪০০ ভাঙার কথা ভাবছে।
তারপর একদিন বোলিং রান আপে ফেরার সময়
মা বলল, ‘আর নয় …’
পরদিনই ভেন্টিলেশনে,
সেখানেও ১২ দিন।
১৩ নম্বর দিনে ঘি ও চন্দন মেখে
প্যাভিলিয়নের দিকে হেঁটে যায় মা।
চুল্লির মাঝখানে একা।
সব শেষে
যে ভাবে উড়তে পারে
সেভাবেই উড়ছিল ছাই,
মাঝরাতে গ্লাস হাতে আমি আর ভাই!

আমরা জানি শোকের রং কালো। দীর্ঘদিন ধরে মা নিশ্চিত মৃত্যুশয্যায় শায়িত আছেন, যুদ্ধ করছেন চিকিৎসকেরা, যুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেছে মুমূর্ষুর পরিবারের অর্থনীতি। তবু শেষ আশা যাচ্ছে না। নিজের মাকে দিনের পর দিন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখার যে প্রবল ভারী প্রস্তরখণ্ড বুকে চেপে বসে থাকতে পারে একজন সন্তানের, কবিতাটির মধ্যে তার সবটুকু ভারবহন পরিস্ফুট হয়েছে। শুধু এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী স্বরভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়েছে সেই অভিজ্ঞতারাশি। আমাদের অবাক করে দিয়ে, এ কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে, প্রথম থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত—কেবল ক্রিকেটে খেলার বিভিন্ন পরিভাষা ও অনুষঙ্গ। একটি শোকের কবিতার মধ্যে ক্রিকেটকে মিশিয়ে দেওয়া আমি এর আগে কোনও বাংলা কবিতার মধ্যে দেখিনি। নিঃসন্দেহে এই কবি, তাঁর ক্রীড়া সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে অত্যন্ত অভিনব উপায়ে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন তীব্রতম শোকের অভিব্যক্তির ভিতরে। মনে রাখা দরকার, আগে এই কবির যে দুটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল, সেই বইদুটির নাম যথাক্রমে—’শুধু উইকেট বোঝে’ এবং ‘শচিন, ক্রিজে আয়’। শেষ বইটি বেরিয়েছিল দুই দশক আগে। ক্রিকেট দিয়ে কবিতার বইয়ের নাম দেওয়া হচ্ছে, এমন আগে দেখিনি, যেমন দেখিনি, ‘হাউজ দ্যাট’ নাম দিয়ে লেখা হচ্ছে কোনেও এলিজি। কবিতার শেষাংশে ‘ঘি ও চন্দন মেখে প্যাভিলিয়নের দিকে হেঁটে যায় মা’। এখানে যে প্যাভিলিয়ন শব্দটি আসতে পারে, তা আমার কাছে অভাবনীয় ছিল। কেননা প্যাভিলিয়ন এক্ষত্রে ‘পরলোক’ অথবা মৃত্যুর পরবর্তী অন্তহীন শূন্যের বিস্তারকে সংকেতায়িত করছে। কবিতাটির শেষ কয়েকটি লাইন ভুলতে পারা যায় না, যেখানে দুই ভাই নিঃশব্দে বসে আছে গ্লাস হাতে। আমিও আমার ভাইয়ের সঙ্গে মার দাহ করার সময় হালিশহর শ্মশানে এইভাবে বসেছিলাম, যদিও আমাদের হাতে কোনও গ্লাস ছিল না। প্রত্যেক মাতৃহারা পাঠক এ কবিতার শেষ দিকে এসে নিজেকে দেখতে পাবেন। ক্রিকেটের পরিভাষা সেখানে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বরং বাংলা কাব্যে শোকগাথা-মূলক কবিতায় এক অভাবনীয় নতুনত্বের সংযোজন হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে এ-কবিতা।
যে-কবির বই নিয়ে এতক্ষণ কথা বললাম, তাঁর নাম সব্যসাচী সরকার। তাঁর এই কবিতার বইয়ের জন্য আমাদের কুড়ি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, সেইজন্যেই পরের কাব্যগ্রন্থটি অনেক তাড়াতাড়ি হাতে পাব এই আশা জানিয়ে আমার আজকের কথা থামাচ্ছি।
অলঙ্করণ: চিরঞ্জিৎ সামন্ত
ছবি সৌজন্য: Wallpaper Flare, Flickr, Picryl, Fineartamerica,
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।