সে বহুযুগ আগের কথা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমীর এক দুর্যোগময় রাতে গোকুলে জন্মেছিল একটি মেয়ে। আজকের দিনেই। তার বাবার নাম নন্দ, মা যশোদা। সদ্যোজাত মেয়েটির মা প্রসব যন্ত্রণায় অচেতন। বাইরে প্রবল দুর্যোগ। আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে পৃথিবীর বুকে! তার মধ্যেই উত্তাল যমুনা পেরিয়ে এলেন এক পুরুষ। তাঁর বুকের কাছে পরম যত্নে ধরে রাখা এক সদ্যোজাত শিশুপুত্র। অচেতন যশোদার কোলে সেই শিশুকে রেখে সর্ন্তপণে তুলে নিলেন মেয়েটিকে। তখনও কি চোখ ফুটেছিল শিশুকন্যার? দেখতে পেয়েছিল মায়ের মুখ? মাতৃদুগ্ধের অমোঘ টানে মুখ গুঁজেছিল কি যশোদার বুকে? এ সব অর্থহীন প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। আমরা শুধু জানি, জন্মের কয়েক মূহুর্ত পরেই চিরকালের জন্য পরিবারহারা হয়েছিল সেই মেয়ে। কখনও তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি মায়ের মুখ। কখনও সে চেনেনি বাবার আদর। বৃহত্তর স্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া সেই একরত্তির নাম আহ্লাদিনী। একটি মেয়ে। আদতে যোগমায়া।

মায়ের বুক থেকে তুলে এনে মেয়েটিকে পাচার করা হয় কংসের কারাগারে। সেখানে অপেক্ষা করছিল মৃত্যু আর অন্ধকার। সদ্যোজাত ছেলেটির জন্য ওঁত পেতে ছিল ঘাতক রাজার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। তারা জানত বসুদেব আর দেবকীর এই অষ্টম সন্তানের হাতেই মৃত্যু লেখা আছে নৃশংস কংসরাজের। এহেন শিশুপুত্রের জীবন যে মহামূল্যবান! তাকে কি মরতে দেওয়া যায়! তাই প্রক্সি দিতে নিয়ে আসা হল মেয়েটিকে। নিয়ে আসা হল মৃত্যুর মুখে তাকে ফেলে দেওয়া হবে বলেই। মথুরার রাজা কংস সদ্যোজাত ছেলেটিকে খুন করতে এসে দেখতে পেলেন মেয়েটিকে। ভাবলেন, এই তার ভবিষ্যৎ ঘাতক! আর কে না জানে ক্ষমতা কখনও সহ্য করে না সম্ভাব্য বিনাশককে! কংস তুলে নিয়ে গেলেন মেয়েটিকে, হত্যা করবেন বলে। জন্মের কয়েক দণ্ডের মধ্যেই ফের হাতবদল হল মেয়েটির। দ্বিতীয়বারের জন্য।

কারাগারের দেওয়ালে আছাড় মারতে চেয়ে দুই হাতে মেয়েটিকে তুলে ধরলেন রাজা। সজোরে নিক্ষেপ করলেন পাথরে। কিন্তু তাকে মারবে সাধ্য কার! তৎক্ষণাৎ সেই কন্যা কংসের হাত থেকে মুক্ত হয়ে উড়াল দিল আকাশে। আট হাতে ধারণ করল ধনুু, শূল, বাণ, চর্ম, অসি, শঙ্খ, চক্র, গদা! ঝলসে উঠল যোগমায়া রূপে। কংসের উদ্দেশ্যে ভেসে এল আকাশবাণী- ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!’

তারপর কী হল সেই মেয়ের? আমরা জানি না তেমন। কোনও এক অজানা ঘটনা পরম্পরায় তার ঠাঁই হয় দুর্গম বিন্ধ্য পর্বতের কন্দরে। সেখানেই বড় হয় সে। সিংহাসন সংঘাতের বৃত্ত তাকে ছোঁয়নি কোনওদিন। কিন্তু বৃহত্তর ইতিহাসের ফুটনোট হয়ে থাকা সেই একরত্তি কন্যা না থাকলে হয়তো বাঁচত না মহামূল্যবান ছেলেটির প্রাণ।

আর ছেলেটির কী হল? তার জন্য অপেক্ষা করছিল যাবতীয় সাফল্য আর সমৃদ্ধির রোশনাই। সে বড় হল মেয়েটির বাবা-মায়ের কাছে, গোকুলে। ননীচুরি, মাখনচুরির দুষ্টুমি আর পালক পিতামাতার আদরে তার শৈশব ছিল ভরপুর। ছোট থেকেই প্রতিভার অন্ত নেই তার। শৈশব থেকেই সে স্বাভাবিক নেতা, কৈশোরে দুরন্ত প্রেমিক। তার বাঁশির সুরে উথলে ওঠে হাজার নারীর প্রাণ। এমন করে কাটল অনেক দিন। বহু বছর পর অবশেষে সামনে এল প্রকৃত সত্য। জানা গেল সে কাদের সন্তান, কী তার দায়িত্ব। ছেলেটি তখন ফিরে গেল মথুরায়, তার সত্যিকারের বাবা-মায়ের কাছে। দখল  নিল সিংহাসনের। অবসান হল অত্যাচারী কংসরাজের। গোটা দুনিয়া নতজানু হল ছেলেটির সামনে। স্বীকার করল তার শ্রেষ্ঠত্ব। তার তখন দু জোড়া বাবা-মা, বিরাট পরিবার। অসংখ্য নারীর প্রেমে সে স্নান করতে পারে প্রত্যহ। তাকে ঘিরে থাকে অক্ষৌহিনী নারায়ণী সেনা, বিপুল ঐশ্বর্য। তিনি এখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, সভ্যতার মুক্তিসূর্য। হাজার হাজার বছর ধরে সসাগরা জম্মুদ্বীপের আদর্শ পুরুষ।

মেয়েটির কিন্তু কোনও খোঁজ করেনি কেউ। কৃষ্ণ তাঁদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কি একবারও কোনও নিভৃতক্ষণে যশোদার মনে পড়েছিল তার কথা? হয়তো পড়েছিল, হয়তো নয়। পাচার হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া মেয়েদের ফের খুঁজেপেতে ঘরে আনার কথা ভাবে কি কেউ? আমরা তো জানি, আত্মত্যাগেই নারীজন্মের পরম সার্থকতা। তাই সিনেমার শেষে যে মেয়েটির চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায়, তার নাম নীতা নয়, কিন্তু সে-ও নীতার মতোই বলিপ্রদত্ত। যোগমায়া, পরম শক্তিশালী শ্রীকৃষ্ণের সহোদরাও তাই। বলিপ্রদত্ত।

আজ জন্মাষ্টমী। যোগমায়ার জন্মদিন। মার্কণ্ডেয় পুরান মতে, তিনি আদ্য শক্তি মহামায়া। তিনিই আবার জন্ম নিয়েছিলেন সীতারূপে। তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী, দেবী লক্ষী। অগ্নিপুরাণ এবং ভাগবত মতে, তিনি কৃষ্ণের জন্মলগ্নে যশোদার কোল আলো করে জন্মেছিলেন আহ্লাদিনী হয়ে। কংসের হাতে আছাড় খেয়ে কৃষ্ণের প্রাণরক্ষা করবেন বলে।

তিনি যোগমায়া। বলিপ্রদত্ত নারী একজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *