‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!’ 
— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ওরা আসুক

“I wish you bluebirds in the spring
To give your heart a song to sing
And then a kiss
But more than this
I wish you love.”

আমি পাখিদের জন্য গাছের গায়ে প্রতিবছর বসন্তে কিছু কাঠের নেস্টবক্স ঝুলিয়ে দিই। ব্লুবার্ড বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধে ট্রি সোয়ালো, হাউস স্প্যারো, হাউস রেন, ক্যারোলিনা রেন, ভায়োলেট-গ্রিন সোয়ালো, ব্ল্যাক-কেপড চিকাডি, টাফটেড টিটমাউস, অ্যাশ-থ্রোটেড ফ্লাইক্যাচার। মাঝেমাঝে দেখেছি মাকড়সা পর্যন্ত বাসা বেঁধে ফেলেছে। বাসা বেঁধেছে কালো পিঁপড়েও। আমি ওদের কাউকেই নাকরতে পারি না। যে আসতে চায় আমার বাসায়, আসুক।

যেমন আমি নাকরতে পারি না আগাছাদের আমার বাগানে। গোলাপের পাশে একইরকম গর্ব নিয়ে ছড়িয়ে থাকে ক্রিপিং চার্লি।আমি আমার জীবনে আগাছা মানুষগুলোকেও নাকরতে পারিনি। তাদের যত্ন করে রেঁধেবেড়ে খাইয়েছি। আমি মনে মনে ভেবেছি আমি নিজে বরং ওকগাছের মতো মাথা তুলে দাঁড়াব। আকাশটা ছোঁব। ওকগাছের পায়ের কাছে কিছু এলেবেলে আগাছা গজালেই কী আর না গজালেই কী? ‘ওকগাছমহীরুহ। তার গায়ের নেস্টবক্সে কোন পাখি বাসা বাঁধল আর কোন পাখি বাসা বাঁধল না, তাতে ওকগাছের কিছু যায় আসে না। আমিও তাই এ বছর নেস্টবক্সে কড়া নেড়ে জানতে চাইনি ভিতরে কোন পাখি এসেছে। 

সব পাখি আসুক!

Birdhouse
পাখিদের জন্য গাছের গায়ে প্রতিবছর বসন্তে কিছু কাঠের নেস্টবক্স ঝুলিয়ে দিই
মধু আর মধুময় ঘর

আজ দরজা খুলেই দেখি কী অপূর্ব দিন! সবকিছু ঝলমল করছে সোনাঝরা সূর্যে। পাখিরা ডাকছে দিনের আলোয় ঝিঁঝিঁ পোকার স্বরে। এ কোন পাখি? ব্ল্যাক জ্যাকোবিন হামিংবার্ড নাকি গ্রাসহপার ওয়ারবলার? ওরা বাসা বাঁধতে এসেছে বুঝি? মহা ভাগ্য আমার! প্রতি বসন্তে বাগানের গাছে গাছে আমি পাখিদের জন্য শুধু নেস্টবক্স নয়, নানারকম নেস্টিং মেটিরিয়ালও ঝুলিয়ে দিই- তুলো, ছোট ছোট কাঠি, পালক। নরম পালক আর তুলোয় মোড়া বাসায় যেন ওরা আয়েশে ডিম পাড়তে পারে। লম্বা ঠোঁটের ফুল বুনে দিই হামিংবার্ডদের জন্য। ওরা ঠোঁট ঢুকিয়ে মধু খায়। 

মৌমাছিরা ভালোবাসে এমন অনেক ফুলও বাগানে লাগাই। আমি তো মৌমাছিদের ব্যস্ততা দেখে অবাক হয়ে যাই। ছোট্ট একটা প্রাণী। অথচ কী অধ্যবসায়ী আর পরিশ্রমী! কিন্তু মানুষ বড় নিষ্ঠুর প্রাণী। মৌমাছিদের চাক ভেঙে মধু চুরি করে ওদের সুগার সিরাপ সাপ্লিমেন্ট খেতে দেয়। সুগার সিরাপের কথা জানতে পেরে এত মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার, যে আমি নয় বছরের জন্য ‘ভিগান’ (Vegan) হয়ে গিয়েছিলাম।

Bee hive in tree
প্রতি বসন্তে বাগানের গাছে গাছে আমি পাখিদের জন্য নেস্টিং মেটিরিয়ালও ঝুলিয়ে দিই

কিন্তু আমার জিহবা আমার আদর্শের থেকে লম্বা। ফলে নয় বছর ভিগান থাকবার পর আমি আবার ছোট ছোট মৌমাছিদের; শ্রেষ্ঠ কর্মবীর মৌমাছিদের মধুর চাক ভেঙে মধু খাওয়ায় মত্ত হয়েছি। ওদের এত কষ্টের, এত পরিশ্রমের ফসল চুরি করছি। আসলে শরীরটাও বাধ সেধেছিল। ভিগান হওয়া বেশ কঠিন কাজ। বিশেষতঃ ছেলেবেলা থেকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, মধু, ঘি খেয়ে বড় হয়ে ওঠা আমার মতো নধর মানুষদের পক্ষে। অন্য খাবার দিয়ে এসব খাবার রিপ্লেস করবার কথা। যথারীতি আমি তা করিনি। ফলে ভিগান হওয়া আমার জীবনের আর একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। যদিও স্বপ্ন দেখি অচিরেই আমি আবার ভিগান হয়ে যাব। পাখির জন্য বাসা বেঁধে মুরগির ঠ্যাং খাওয়া আমায় মানায় না!

আমার ক্ষমতা খুব সীমিত। পাখিদের ঘর বাঁধায় সাহায্য করি। কিন্তু গৃহহীন মানুষদের জন্য কিছুই করতে পারি না। আমার বাচ্চারা ছেলেবেলায় বেহালা শিখত। ওদের ক্লাস হত গির্জায়। বুর্জোয়া দেশ আমেরিকার অফুরান ধন-সম্পত্তি থাকলেও গৃহহীন মানুষের সংখ্যাও এখানে কিছু কম নয়। প্রায়দিনই দেখতাম গির্জের কিছুটা অংশ গৃহহীনদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এক একটা পরিবারকে একটা করে ঘর দিয়েছে, দিয়েছে ক্যাম্পকটের মতো খাট। ওদের ব্যবহার করবার জন্য ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, টিভিও থাকত। আমেরিকা বলে কথা! গৃহহীন জীবনেরও যেন একটা নূন্যতম মাপকাঠি আছে! যত দেখতাম তত আমার সর্বহারা দেশের কথা ভাবতাম। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের শুরুটুকুই শুধু আছে, শেষ নেই। কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাসমান জীবনের ছবি চোখে ভেসে উঠত। ঢাকার পাঁচতারা হোটেলের পাশেই বস্তি আর বস্তি উচ্ছেদের কথা মনে পড়ত। নীল প্লাস্টিকে ঢেকে যাওয়া সে বস্তির আকাশের কথা ভাবতাম।

যে সব মেয়েরা সকাল, সন্ধ্যা মাতাল স্বামীর কাছে মার খেয়েও ঘর ছাড়তে পারে না, আমি তাদের কথাও ভাবি। ওদের ঘর আছে। কিন্তু সে ঘর আক্রান্ত। আসলে ঘর এক নেশার মতো। শত অত্যাচারেও তা ধুয়েমুছে যায় না। আর তাই বছর বছর এই মেয়েরা জগতের জন্য ফেসবুকে বিবাহবার্ষিকীর ছবি পোস্ট করে! জামদানি শাড়ি আর গয়নাগাটি পরে– হাসিমুখে। ঘর– সে এক স্বপ্নের শব্দ। যার ঘর নেই, তার কাছে। যার ঘর আছে তার কাছেও।

Jasmine
উইস্কনসিনে দুষ্প্রাপ্য বেলি কিংবা জুঁই ফুটলে আমি তাদের একটা ছোট ট্রেতে করে রাখি
জীবনের বীজ

আমার জীবনের ‘Sunken Spanish Ship’ থেকে অনেক গোল্ড কয়েন কুড়ানো হল। এবার ঠিক করেছি অনলাইনে অকেজো গয়নাগাটি কেনাও বন্ধ করে ফেলব। তার বদলে এই আমেরিকায় বসে সজনে গাছের বীজ কিনব! বকফুলের বীজ কিনব! তারাই আমার জীবনের ডুবে যাওয়া স্প্যানিশ জাহাজ থেকে পাওয়া স্বর্ণমুদ্রা! জীবনের রূপসাগরে লালরঙের বকফুলেরও খোঁজ পেয়েছি! আর সেভাবেই আমি-

‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি 
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।’

আমার প্রিয় বন্ধু সেদিন একটা ভিডিও ক্লিপও পাঠাল। যথারীতি আমার ঈশ্বর অবিশ্বাসী মন ধর্মকথায় বিশ্বাস করল না। কিন্তু আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। ‘যত অতীতকে নিয়ে চিন্তা করবে, তত বর্তমানের সুখ তোমায় ছেড়ে যাবে। মনে রেখ, কোনও ক্ষত সারাতে হলে বারবার তোমার সেই ক্ষত ছুঁয়ে দেখা বন্ধ করতে হবে। নমঃ বুদ্ধায়!’ চোখে জল এল। চোখের জল পুরাতন ক্ষত থেকেই, বুকের ভিতর থেকেই ঝর্ণাধারায় নামে। আমি চেষ্টা করে ভবিষ্যতের দিকে তাকালাম। একদিন আমার সজনেগাছ বড় হবে, বকফুল বড় হবে। গৌতম বুদ্ধ কি ভবিষ্যতের দিকেও তাকাতে মানা করেছেন? স্বপ্ন দেখতে মানা করেছেন? শুধু বর্তমানের পথে হাঁটতে হবে? ‘শুধু অকারণ পুলকে?’ বিড়বিড় করে মন্ত্রের মতো বলতে থাকলাম- 

‘ফুরায় যা দে রে ফুরাতে। 
ছিন্ন মালার ভ্রষ্ট কুসুম
ফিরে যাসনেকো কুড়াতে… 
ফুরাইলে দিস ফুরাতে।
ওরে থাক্‌ থাক্‌ কাঁদনি!
দুই হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দে রে 
নিজে হাতে বাঁধা বাঁধনি… 
শুধু অকারণ পুলকে 
নদীজলে-পড়া আলোর মতন
ছুটে যা ঝলকে ঝলকে।
ধরণীর ‘পরে শিথিলবাঁধন 
ঝলমল প্রাণ করিস যাপন, 
ছুঁয়ে থেকে দুলে শিশির যেমন 
শিরীষ ফুলের অলকে। 
মর্মরতানে ভরে ওঠ্‌ গানে 
শুধু অকারণ পুলকে।’

আমি যেন আলোকিত হয়ে উঠলাম। সব কষ্ট দূর করতে শুধুমাত্র বর্তমানে ঘোরাফেরা শুরু করলাম। আমার ভালোবাসায় আমার অতীত, আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যত এক হয়ে গেল। শুধু ভালোবাসাটুকু সত্য। আর কিছু নয়। আমার হাতের তালুতে ভবিষ্যত জীবনের বীজ। ‘শুধু অকারণ পুলকে…’

কাছে রেখ

আজ ঘরের ভিতর বেলি আর জুঁই ফুটেছে। আমার এই পোলার-বিয়ার-ল্যান্ডে যখন এই আশ্চর্য ঘটনাগুলো ঘটে, আমার অলৌকিকতাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় মোজেস বুঝি সত্যিই লোহিত সাগর দুভাগ করে দিয়েছিলেন। তবে আমার জীবনে লোহিত সাগর দুভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল বাচ্চাদের জন্মের সময়। হাই-রিস্ক প্রেগনেন্সির জন্য আমি বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম। তখনও বাড়িতে বেলি ফুটত। জুঁই অবশ্য ছিল না। মা প্রতিদিন আমার জন্য বেলিফুল নিয়ে যেত হাসপাতালে। মানুষের জন্ম দেওয়া সহজ কাজ নয়। মানুষ হয়ে ওঠাও সহজ কাজ নয়। মরুভূমির মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো।

তারপর বহু বছর কেটে গেছে। আজকাল আমার এই উইস্কনসিনে দুষ্প্রাপ্য বেলি কিংবা জুঁই ফুটলে আমি তাদের একটা ছোট ট্রেতে করে রাখি। ট্রেটা আমার প্রিয় বন্ধু লিন্ডার কাছ থেকে পেয়েছি। ওর ঠাকুমা, ঠাকুরদার বিবাহ বার্ষিকীর ট্রে। ওঁদের নাম খোদাই করা। রূপার। দুটো লতা উঠে গেছে। পাশাপাশি। সেদিন লিন্ডা ট্রেটা গুডউইলে দিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। আমি কাছে ছিলাম।
করছ কী?
না, ছেলেমেয়েদের জন্য নানাকিছু জমিয়ে রেখেছিলাম। ওরা জানিয়েছে ওদের বাড়ির ডেকর আলাদা। ওরা এসব নেবে না।
দাও, দাও, আমাকে দাও। আমি তো এক স্মৃতি আগলে রাখা পাখি
চোখের জলে বললাম।
ঘরে এসে টেবিলের উপর ছোট ট্রেটা রাখতেই পপি এসে গন্ধ শুঁকে বুঝে নিল এটা এখন থেকে এ বাড়ির জিনিষ। দুষ্টু পপি মানুষ না হয়েও সে পথেই চলেছে। বাড়ির স্মৃতিজড়ানো সবকিছু ও পাহারা দিয়ে রাখে। যেখানে যা যেমনভাবে পড়ে আছে… বাচ্চাদের ছেলেবেলার বেহালা, রেকর্ডার, সায়েন্স প্রজেক্ট, স্টিক ফিগার আঁকা খাতা; রান্নাঘরের কাঠের টুল যা আমার সুপ্রিয় বন্ধু ডেবরার বাবা বানিয়ে দিয়েছিলেন; টেবিলের উপর রাখা দিদার চশমা, দাদুভাইয়ের শেভিং ব্লেড ধার করবার না-জানি কী… এমনকী ঘরের ভিতর আমার গাছের মরা পাতা পর্যন্ত ও ছিঁড়তে দেয় না। দৌড়ে ছুটে এসে তাকে বাঁচাতে চায়!

Shaluk Flower
ফুল না ফুটলে কাঁদি। ফুল ফুটলেও কাঁদি
গাছ আর জুঁইফুল

ভেবেছিলাম রোদ উঠবে। কিন্তু ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল আজকের এই সকালবেলা। তাপমাত্রা ৬৮ডিগ্রি ফ্যারেনহাইট। মানে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এই হল জুনের প্রায় শেষে উইস্কনসিনে আমাদের তাপমাত্রা। গরমকাল কবে আসবে সুপর্ণা?’ এদিকে আমাজন থেকে লাউবীজ এসেছে। মাটি গরম হচ্ছে না বলে বীজ লাগাতে পারছি না। বহুবার বলেছি শীতকালে আমাদের মাটি ডিপ ফ্রিজে রাখা মুরগির মতো হয়ে যায়। একটা পেরেক পর্যন্ত মাটিতে গাঁথা যায় না। তারপর মাটি করলে লালশাকের বীজ লাগাতে পারি। ঠিক যেমন জীবনের মাটি নরম হলে লাগানো যায় লাল আনন্দের ছবি। অবশ্য আনন্দ নিয়ে আমার ব্যবসাবাণিজ্য বেশি নয়। আমি চোখের জলের ধারায়বাস করি। 

একলা ঘরে চুপে চুপে,
এসো কেবল সুরের রূপে
দিয়ো গো, দিয়ো গো,
আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া
নিশীথরাতের বাদলধারা…

কিছু মানুষ আছে যারা সবেতেই কাঁদে। আমি সেই দলের। ফুল না ফুটলে কাঁদি। ফুল ফুটলেও কাঁদি। অথচ গত এক বছর ধরে যে আমি বাড়ির বাইরে হাঁটতে পারছি না, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই আমার। ঘরের ভিতর গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা, বেলী ফোটানোর ব্যবস্থা করেছি। বৃষ্টিধারার মতো জুঁইফুল। আর কী চাই জীবনে?

তবে এবার হাঁটতে বের হলাম। দেখলাম দুটো খরগোশ সামনে দিয়ে ছুটে চলে গেল। একটা লাল রঙের কার্ডিনাল পাখি আপেল গাছের ফাঁকে হারিয়ে গেল। ওদের দেখে আমার ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার কথা মনে হল। চোখের-পলকশব্দের এই বুঝি মানে। তিনটে কাঠবিড়ালি লাফিয়ে গাছের মগডালে উঠে গেল। আর তাই দেখে সামনের বাড়ির কুকুরটার কী যে চিকার! জীবনের আওয়াজ। 

রাস্তায় ফুলদের কাছে কাছে ঘুরতে শুরু করলাম। একবছর দেখিনি ওদের। কেমন আছ? এ বছর একটু দেরিতে ফুটলে নাকি?’  ফুলেরা, গাছেরা বছর পর আমায় দেখে বুঝি খুশি হয়ে উঠল। বাতাসে ওদের মাথা দুলে উঠল। আমি বিশ্বাস করলাম বাতাস নয়, ওরা আমায় দেখে ইচ্ছে করেই মাথা দুলিয়েছে। ভালোবাসার তো এই মানে, তাই না? শুধু বাতাসে অল্প একটু নেচে ওঠা! অল্প একটু তরঙ্গ! জলের উপর নীলরঙা জলফড়িংয়ের উড়ে যাওয়ার মতো। পথে দেখি এক বাড়ির সামনে, বাগানের মাঝে প্রায় আমার কাঁধসমান এক বুদ্ধমূর্তি। সন্দেহ নেই ম্যাডিসন এক eclectic শহর। 

আমার পা ধীরে ধীরে সারছে। সেইসঙ্গে আমার কচুরিপানা, শাপলাও বড় হচ্ছে। হয়তো অন্যান্য বছরের মতো আবার ওরা ফুটবে। মাঝে মাঝে ভাবি, হয়তো সুযোগ পেলে আমি চাঁদে গিয়েও কচুরিপানা লাগাব। আমি জলের গন্ধ ভালোবাসি। এক সোঁদা গন্ধ। বাংলাদেশের গন্ধ। 

Water Hyacinth
হয়তো সুযোগ পেলে আমি চাঁদে গিয়েও কচুরিপানা লাগাব

বাড়ির আশপাশের মোটামুটি সব গাছ আমি চিনি। মানুষদের না চিনলেও। দেখলাম ঠিক যে কোণাটায় বেগুনি ডেলফিনিয়াম ফুটত, তারা আবার ফুটেছে। একবছর পর দেখা। আইভরি সিল্ক, জাপানিজ় লাইলাক ট্রি-র গন্ধে আমার মাতাল করা মহুয়া ফুলের কথা মনে পড়ল। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির সামনের রাস্তাটায় কার জন্য যেন অপেক্ষা করছিলাম। তার নাম ভুলে গেছি। মহুয়ার গন্ধটুকু মনে আছে। অপেক্ষাটুকু মনে আছে। আমি নিষ্ঠুর প্রাণী। শুধু মাথার তাজটুকু মনে থাকে। ময়ূরপেখম। কী জানি হয়তো একদিন আমি মানুষদেরও গাছের মতো, ফুলের মতো, পাখির মতো, কাঠবিড়ালির মতো, কিংবা খরগোশের মতো ভালোবাসতে পারব… ঠিক যেদিন মানুষ গাছের মতো হবে।

 

*সব ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি টেক করেছেন। বর্তমানে আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। পেশাগতভাবে অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে। প্রকাশিত বই 'আমার ঘরোয়া গল্প', 'হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা', 'রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন', 'রেশমগুটি', 'জলরঙ' 'দমবন্ধ' ও অন্যান্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *