প্রতি বছর এপ্রিল মাসের পনেরো তারিখটি বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিল্পকলা দিবস উদযাপিত হয়। সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি’ খুলে পড়ছিলাম। শিল্পসাধনা নিয়ে কবির একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যে এসে চোখটা আটকে গেল। কবির কথাটি ছিল এমন, ‘আর্টিস্ট আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আর্টের সাধনা কী?’ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রসঙ্গে কবি আর্টের বাইরের দিক অর্থাৎ আর্টের আঙ্গিক, টেকনিক, তার কথা বলেননি। আর্টের ‘ভেতরের কথা’ নিয়ে আর্টিস্টকে বলা তাঁর কথাটি: ‘কিন্তু ভেতরের কথা জানি। সেখানে জায়গা পেতে চাও যদি তাহলে সমস্ত মন দিয়ে গ্রহণ করাই হচ্ছে আর্টিস্টের সাধনা।’ প্রণিধানযোগ্য এমন মন্তব্য খুব স্পষ্ট করে তিনিই বলতে পারতেন কারণ সমস্ত শিল্পকলার ভিতরপানে চাইবার তাঁর দৃষ্টি ছিল গভীর এবং সত্য।
ঠিক এমন আর একটি ঘটনার কথা স্মরণে এল। একবার শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে তাঁর স্নেহধন্য ছাত্রছাত্রীরা ইউরোপীয় আর্টের রীতিতে সড়গড় হতে পোট্রেট থেকে ক্ল্যাসিক্যাল ন্যুড, তেলরং এর ছবি আঁকা শিখছে। অবনঠাকুর তখন আর্টস্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপাল একজন সাহেব। একদিন সাহেব ক্লাসে ঢুকলেন ছাত্রদের কাজ দেখতে। ক্লাসরুমে ঢুকেই তিনি চমকে ওঠেন। দেখেন একটি ছাত্র জানালার খড়খড়ি তুলে বাইরের দৃশ্য দেখছে। তিনি তখন ছাত্রটিকে ডেকে বলেন, ‘তুমি এভাবে সময় নষ্ট করছ!’ একথা শোনার পর তরুণ ছাত্রটি সপ্রতিভভাবে উত্তর দেয়, ‘ক্লাসে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে বলা হয়েছে। বাইরের দৃশ্য তো বিরাট বিশাল, তাই তাকে খড়খড়ির ফ্রেমে আটকে দেখছি।’ সাহেব একথা শোনার পর আর কিছু বলেননি।
এই ছাত্রদেরই ইতালীয় শিক্ষকের ক্লাসে প্লাস্টার মডেল নকল করতে হত। ছাত্ররা বসত খুব নিচু বেঞ্চে আর ইতালীয় শিক্ষক ছিলেন লম্বা চওড়া। ক্লাসে ছাত্রদের কাজ দেখার জন্য টহল দিতেন তিনি। ঘাড় নিচু করে কাজ দেখতে দেখতে ‘এটা ঠিক হয়নি’, ‘ওটা এমন হবে না’ জাতীয় মন্তব্য করতেন। একদিন সেই ছাত্রের কাজ দেখে এমন মন্তব্য করলে ছাত্রটি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে ওই উচ্চতা থেকে আমাদের সব কাজ দেখছেন আর দেখুন তো আমরা কত নিচুতে বসে কাজ করছি। ফলে আপনার দেখা আর আমাদের দেখা তো দু-রকম হবেই। আমরা কি করে আপনার দেখাটা দেখব বলুন।’ ছাত্রের এহেন উত্তরে সেদিন সাহেব নীরবতা পালন করেছিলেন। এই ছাত্রটি হলেন যামিনী রায়। ভারতবর্ষের দুই প্রাতঃস্মরণীয় মনীষার আর্ট সম্পর্কে ধারণার একটা আভাস এখানে একসঙ্গে উপস্থিত করা হল।
রবীন্দ্রনাথ এবং যামিনী রায়ের ভাণ্ডারে তাঁদের আঁকা ছবির সংখ্যাও কম নয়। রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে যতটা মনে রাখা হয়, তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে ততটা আলোচনা সাধারণের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। তবে বিদগ্ধজনেদের কাছে কবির ছবি নিয়ে বহু আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে। ১৯৪১ সালে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ এই শিরোনামে যামিনী রায় লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন খাঁটি ইউরোপীয়ান আঙ্গিকে।’ লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আঁকা মানুষ যখন দেখি তখন মনে হয় না সেটা এখন নেতিয়ে পড়বে, মনে হয় না হাওয়ায় দুলছে যেন। স্পষ্ট দেখি মানুষটার ওজন আছে, সতেজ শিরদাঁড়া আছে। রবীন্দ্রনাথের ছবি যে শক্তিশালী তা এই হাড়ের জোরেই, ছন্দ গঠনেই।’ যামিনী রায় কবির ছবির অন্তর্নিহিত এই শক্তিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। বলেছেন কবির ছবির মধ্যে রূপ ও বোধের গভীর আভাস মেলে। সে দেখা যেন এক সম্মোহন ! রবীন্দ্রনাথের আঁকা মানুষের ছবি সম্পর্কে যামিনীর এই ব্যাখ্যা খুব সহজ। কল্পনার অসামান্য ছন্দোময় শক্তিতে রবীন্দ্রনাথ রেখা ও রঙের ব্যবহার আশ্চর্যরকমে আয়ত্ত করেছিলেন বলে যামিনী রায় মনে করতেন।

এই লেখাটি প্রকাশিত হবার পর যামিনী রায় অত্যন্ত বিনয় ও সংকোচের সঙ্গে অসুস্থ কবির কাছে একটি চিঠি লিখে নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করেন। চিঠিটি বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জি লেন থেকে তেইশ মে লিখেছিলেন। সেই চিঠিটি এমন, ‘আপনার ছবি নিয়ে সম্প্রতি কিছু বলতে হয়েছিল।…আমার মনে হয় আমি ঠিকমত জানাতে পারি নাই।’ তবে স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পকে যেভাবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন, অল্পসময়ের মধ্যে তাঁদেরকে সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। অনুজপ্রতিম শিল্পীর চিঠি ও ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর ছবির আলোচনা পড়ে কবি দুদিন পর অর্থাৎ পঁচিশ মে জবাবে লিখলেন,
‘এখনো আমি শয্যাতলশায়ী। এই অবস্থায় আমার ছবি সম্বন্ধে তোমার লেখাটি পড়ে আমি বড়ো আনন্দ পেয়েছি। আমার আনন্দের বিশেষ কারণ এই যে আমার ছবি আঁকা সম্বন্ধে আমি কিছুমাত্র নিঃসংশয় নই। সুদীর্ঘকাল ভাষার সাধনা করে এসেছি, সেই ভাষার ব্যবহারে আমার অধিকার জন্মেছে এ আমার মন জানে এবং এই নিয়ে আমি কখনো কোনো দ্বিধা করিনে।’
পাশাপাশি এও বলেছেন,
‘কিন্তু আমার ছবির তুলি আমাকে কথায় কথায় ফাঁকি দিচ্ছে কিনা আমি নিজে তা জানি নে। সেইজন্যে, তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।’
এর আগে প্যারিসের মাটিতে কবির প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী দেখে বিদেশিরা শিল্পীরা কবিকে অভিবাদন করেছিলেন যখন কবি সেবার বিস্মিতই হয়েছিলেন কারণ তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী কেন তাঁদের ভালো লাগল এবং কোনখানে কবির কৃতিত্ব স্পষ্ট করে বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু স্বদেশে তাঁর ছবির প্রশংসার বহর ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। একটু অভিমান ছিল এই কারণে। সেই অভিমানের কথা যামিনী রায়কে জানালেন,
‘চিত্রপ্রদর্শনের যে অভিজ্ঞতা থাকলে নিজের সৃষ্টির বিচারশক্তিকে কর্তৃত্বের সঙ্গে প্রচার করা যায়, আমাদের দেশে তার কোনো ভূমিকাই নেই। সুতরাং চিত্রসৃষ্টির গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে পারেন না বলেই মুরুব্বিয়ানা করে সমালোচকের আসন বিনা বিতর্কে অধিকার করে বসেন।’

জানা যায় এর বছরখানেক আগে মংপু যাবার পথে অমিয় চক্রবর্তী কবিকে সঙ্গে করে বাগবাজারে আনন্দ চ্যাটার্জী লেনে যামিনী রায়ের স্টুডিওতে নিয়ে যান। সেখানে যামিনী রায়ের ছবি দেখে কবি খুব খুশি হন। ১৯৪১ সালের সাত জুন এই মর্মে একটি চিঠিতে কবি খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন,
‘পৃথিবীর অধিকাংশ লোক ভালো করে দেখে না— দেখাতে পারে না। তারা অন্যমনস্ক হয়ে আপনার নানা কাজে ঘোরাফেরা করে।’ অথচ যামিনী রায়ের মতো শিল্পী আপন চিত্রকরের সত্তা আবিষ্কার করতে সক্ষম। কারণ নিছক দেখবার জগৎ ও দেখাবার আনন্দের মর্মকথা বুঝেছিলেন। যামিনী রায় যে একজন যথার্থ চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ সেকথা বহুদিন আগেই তার সাক্ষ্য রেখেছেন একটি পত্রে। কবির চারপাশে তাবড় তাবড় চিত্রশিল্পী থাকা সত্বেও অবনীন্দ্রনাথের জামাতা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে ১৯১৪ সালের আট জুলাই তারিখে লেখা পত্রে লিখেছিলেন, ‘রথীকে বোলো আমার নাম করে যামিনীকে দিয়ে বাবামশায়ের ছবি কপি করিয়ে নেবার জন্যে যেন চেষ্টা করে।’
যদিও দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯০৮ সালে। এলাহাবাদে। বিষ্ণু দে’কে যামিনী রায় বলেছিলেন সেই প্রথম দর্শনের কথা। তখন যামিনী রায় এলাহাবাদে ইন্ডিয়ান প্রেসে কাজ করেন। একদিন খবর পেলেন রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। সন্ধ্যার সময় যামিনী রায় তাঁকে দেখতে গেলেন। সেখানে যে বাড়িতে উঠেছেন সেখানে গিয়ে বসলেন একটি ঘরে। যামিনী রায় বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সে ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ছ-সাত-আটটা দরজা। মাঝের বড় হলটায় যারা অতিথি তারা এসে বসেছে। আর রবীন্দ্রনাথ এলেন সেই ঘরেতে— হাতে একটা রঙিন কাচের লন্ঠন। আর সেই দাড়ি, সেই পোশাক। যেই তিনি ঢুকলেন সেই ঘরেতে, তারা আর কথা কইবে কি? সবাই হকচকিয়ে গিয়েছে, সবাই একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল।’
সেবার পরিচয় হবার পর যামিনী রায় কবির কাছে একাধিকবার গিয়েছেন। দুজনের মধ্যে চিত্রকলার নানা বিষয়ে আলোচনা হত। ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতা বাড়ে। দুই সুরসিকের তাই মিলে যেতে বেশি সময় লাগেনি। যেহেতু পশ্চিমী চিত্রকলার অনুকরণ করা যামিনী রায়ের স্বভাববিরুদ্ধ ছিল তাই তিনি কবির সমাদর পেয়েছেন। জানা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘তপোবন’ লেখাটি যামিনী রায়ের জীবনের এক চরম সংকটকালে ভীষণভাবে আলোকিত করে। প্রবন্ধটি পড়াকালীন বিভিন্ন পাতায় লিখে রেখেছিলেন ‘আমার মনের কথা আজ লিখায় পড়লাম।’ বোঝা যায় অগ্রজের শুধু সান্নিধ্যলাভেই অনুজ উপকৃত, অনুপ্রণিত, প্রভাবিত হননি, তাঁর সাহিত্যের, ছবির দর্শনেও যামিনী রায় মুগ্ধ হয়েছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন।
একবার নরেশ মিত্রের সঙ্গে যামিনী রায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যান। রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটক মঞ্চস্থ করবেন বলে নরেশ মিত্র কবির কাছে দরবার করতে গেছেন। যামিনী রায়কে নীচে বসিয়ে নরেশ মিত্র উপরে রবীন্দ্রনাথের কাছে নাটক নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। কথায় কথায় কবি জানতে পারেন যামিনী নীচের ঘরে বসে, ব্যস। কবি উপর থেকে হাঁক দিলেন, ‘যামিনী আর গোপন থেকো না, এসো। যামিনী তুমি প্রকাশ হও।’ সত্যি সত্যি কবির সাহচর্যে যামিনী রায় প্রকাশ হবার প্রাণশক্তি অর্জন করেছিলেন।
ছবি সৌজন্য: Pinterest, Logically
তথ্যঋণ:
যামিনী রায়: বিষ্ণু দে
পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি: রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের ছবি: চিত্রীর দৃষ্টিতে: সুশোভন অধিকারী
পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রসংখ্যা ১৪০২
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।