লকডাউন হোক, হোক আমপান, আসুক কালবোশেখি, লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাক শহরজুড়ে, বচ্ছরকার এই দিনটায় বাঙালি শাশুড়িরা মনে মনে হলেও একবার হাতপাখার বাতাসে ভেজাবেনই তাঁদের আদরের বাবাজীবনদের। ষাট ষাট ষাট ষষ্ঠীর ষাট, ষষ্ঠীর পুত গোবিন্দ বেঁচে থাক। জামাইরা খেয়ে পরে আয়েস করে প্রফুল্লচিত্তে ঘরের পানে গেলে তবেই না মেয়ে তাঁদের সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করবে বচ্ছরভর? বংশের সুখ সমৃদ্ধি ফুলে ফেঁপে উঠবে? অতএব জামাই ষষ্ঠী যুগ যুগ জিও।

কিন্তু জামাইরা কি আর সে জামাই আছে? এক থালা বেড়াল ডিঙুনো ভাত দিয়ে শুক্তোনি থেকে মাছমাংস চব্যচোষ্য শেষ করেই পঁচিশটা রসগোল্লা, গোটা কুড়ি পান্তুয়া আর এক ভাঁড় দই টক করে মেরে দেবে? এখনকার জামাইরা সব মহাব্যস্ত ভিভিআইপি। তার উপরে ডায়েটের কুলোপানা চক্কর। অধিকাংশেরই উইকেন্ডে ষষ্ঠীপালন। নাহলে সর্বকর্ম সমাধা করে রাত্তিরে ডিনারে আগমন। নেহাত এখন লকডাউন, রেস্তোরাঁ বন্ধ তাই। নইলে জামাই ষষ্ঠীতে রেস্তোরাঁতেও ভিড় থাকে দেখার মতো! কর্মব্যস্ত শাশুড়িরা আরও ব্যস্ত জামাইদের ‘ট্রিট’ দিয়ে দেন সেখানেই! জামাইরা কলকাতার বাইরে (দেশের বাইরেও) থাকলে তো কথাই নেই। শাশুড়ি মা নেটব্যাঙ্কিংয়ে টাকাটা পাঠিয়ে মেয়েকে বলে দেন, “ওরে, তোরা পছন্দমতো খেয়ে নিস, পছন্দমতো কিছু কিনে নিস!”

তবে কিনা এখনও কেউ কেউ আছেন যাঁরা ট্র্যাডিশন আর আধুনিকতার সূক্ষ্ম দড়ির ওপর দিয়ে গটগটিয়ে হেঁটে চলেছেন অনায়াসে। জামাই ষষ্ঠীর বাঙালিয়ানাটুকু ষোলো আনা বজায় রেখে আধুনিক জামাইয়ের সফিস্টিকেটেড রসনাবিলাসের ব্যবস্থা বাড়িতেই করে ফেলতে পারেন বাড়তি বয়সকে দুয়ো দেখিয়ে! তেমনই এক ‘হ্যাপেনিং’ শাশুড়ি-জামাই জুটি হলেন মন্দার মুখোপাধ্যায় ও তাঁর জামাই অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। একই হাউজিং কমপ্লেক্সের বাসিন্দা হওয়ায় লকডাউনেও মুখে মাস্ক সেঁটে, স্যানিটাইজার বগলে ভোজ খেতে যেতে সমস্যা নেই। তাই শাশুড়ি মা সকাল থেকেই লেগে রয়েছেন রান্নাবান্নায়। যদিও এলাহি বাজার টাজারের আয়োজন হয়নি এ বারে, ঝড় আর রোগের সাঁড়াশি আক্রমণে। তবে কিনা তাতে মন্দারদির কুছ পরোয়া নেই। ঘরে যা আছে তাই দিয়েই, যাকে বলে ‘রকিং স্প্রেড’ সাজিয়ে ফেলতে সিদ্ধহস্ত তিনি।

আর সেলেব্রিটি জামাই বাবাজি? ঝড়ে ভেঙে পড়া নেটওয়ার্কের ‘হ্যালো হ্যালো, ও অনিন্দ্যদা, শুনতে পাচ্ছেন’ সামলিয়ে সুমলিয়ে অবশেষে ভরদুপুরে তাঁকে ধরা গেল টেলিফোনে। জিজ্ঞেস করা গেল, কেমন লাগে এই জামাইষষ্ঠী ব্যাপারটা? অনিন্দ্যদার জবাব, “আসলে আমি ছেলেবেলা থেকেই এমন একটা বাড়িতে বড় হয়েছি, যেখানে বাড়ির মধ্যেই ছিল মন্দির। এখনও আছে। বিডন স্ট্রিটের কাছে আমাদের বাড়িটা চণ্ডীবাড়ি নামেই পরিচিত। সামনের রাস্তার নামও এই বাড়ির নামেই। ফলে সেই জন্ম ইস্তক সারাক্ষণই পুজো-পার্বণ উপোস-কাপাস, ব্রত-আচার, আরতি-প্রসাদ দেখেই চলেছি। সেই জন্যই হয়তো একটা বয়সের পর এগুলো থেকে পালাতে চাইতাম। আর জামাই ষষ্ঠীটা বিশেষ ভাবে খারাপ লাগত কারণ, ওই যে দেখতাম রাস্তায় চড়া রোদ্দুরে গলগল করে ঘামতে ঘামতে নতুন পাঞ্জাবির বোতাম আঁটা জামাই ধুতির খুঁট আর মিষ্টির হাঁড়ি ব্যালেন্স করতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছে, বৌ জরিদার সিল্কের শাড়ি নিয়ে আঁচল সামলে ঘাম মুছতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে… সব মিলিয়ে ব্যাপারটা ভালো লাগত না একদম। তাই বিয়ের আগেই মধুজাকে (স্ত্রী মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়) বলে দিয়েছিলাম, দ্যাখো, আর যাই বলো, তোমার বাড়িতে জামাই ষষ্ঠী খেতে যেতে বলবে না। ওই সবের মধ্যে কিন্তু আমি নেই!”

তাই বিয়ের আগেই মধুজাকে (স্ত্রী মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়) বলে দিয়েছিলাম, দ্যাখো, আর যাই বলো, তোমার বাড়িতে জামাই ষষ্ঠী খেতে যেতে বলবে না। ওই সবের মধ্যে কিন্তু আমি নেই!

তাহলে? সে বরফটা গলল কী করে? অনিন্দ্যদা একটু হেসে বললেন, “আসলে বিয়ের সময় এবং তার আগে পরে আমার একটা উপলব্ধি হল, যে এই অনুষ্ঠানগুলো, যেগুলোকে আমরা শুধুই আচারবিচার বলে বাঁকা চোখে দেখি, সেগুলো আসলে এক একটা পারিবারিক রিইউনিয়নের মতো। আচার বিচার ধর্মপালন হয়তো কিছু আছে। মহিলাদের একটা নিরন্তর ক্লেশস্বীকারও আছে। আচারের গেরোয় তাঁদের বহুকাল নানা ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেটাও দেখেছি। কিন্তু এখন মনে হয়, এই আচার-নিয়মের গোঁড়ামিটা না রেখে, শুধু যদি উদযাপনের দিকটায় নজর দিই, তাহলে দেখা যায় সেটার মধ্যে একটা ভারি সরেস ‘বেঁচে থাকা’ আছে! এই যে একটা বিশেষ দিনে সকলের সঙ্গে দেখা হওয়া, আড্ডা দেওয়া, খাওয়াদাওয়া, হাসি-তামাশা, এটাকেই যদি প্রাধান্য দেওয়া যায় তাহলে অনুষ্ঠানগুলো ভারি উপভোগ্য হয়। সে ভাইফোঁটাই হোক বা জামাই ষষ্ঠী। সকলে মিলে হইচই করে একটা দিন কাটানোর সুযোগ কে আর ছাড়তে চায়! আমার বিয়ের পর প্রথম জামাই ষষ্ঠীর মাসখানেক আগেই আমার শাশুড়ি মা আনোয়ার শাহ রোডে একটা নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করলেন। সে বার জামাই ষষ্ঠীতে ওঁর নতুন বাড়িতে গিয়ে দারুণ আড্ডা জমেছিল আমাদের। আমার শাশুড়ি বরাবরই নানারকম এক্সপেরিমেন্টাল রান্নায় সিদ্ধহস্ত। আমিও খেতে খুব ভালোবাসি। ফলে সব মিলিয়ে খুব উপভোগ করেছিলাম।”

কী খেতে ভালোবাসেন কিম্বা মন্দারদির হাতের কোন রান্নাটা সবচেয়ে প্রিয়, এটা জিজ্ঞেস করতে হাসিই পাচ্ছিল কারণ হেঁশেলপনায় তাঁর যে জুড়ি মেলা ভার এইটে সবাই জানে। অনিন্দ্যদাও যথারীতি সেটাই বললেন। “জামাই ষষ্ঠী হোক বা না-হোক, আমি কিন্তু সব সময় আমার শাশুড়ির রান্নার খুব ভক্ত। আমার যে সব সময় এলাহি খাওয়া দাওয়াই ভালো লাগে তা কিন্তু নয়। আমার বরং বেশি ভালো লাগে, এই যে হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়ে মিলিয়ে জুলিয়ে, এটার সঙ্গে ওটা দিয়ে কী সব দারুণ দারুণ পদ তৈরি করে ফেলেন, সেই ব্যাপারটা। এটা কিন্তু ওঁর মতো আর কাউকে বিশেষ করতে দেখি না। কোনও একটা সবজির খোসাসেদ্ধ দিয়েও এমন একটা রান্না করে ফেললেন, যে খেয়ে একেবারে ক্লিন বোল্ড হয়ে গেলাম! কে বলবে ওটা কী দিয়ে করা!”

মন্দারদি সকালেই বলেছিলেন এটা অনিন্দ্যদার ষোলোতম জামাই ষষ্ঠী। কাজেই পনেরো বছর আগে প্রথম জামাই ষষ্ঠীতে কী কী রান্না হয়েছিল, সে প্রশ্ন করে কি আর জামাইকে বিড়ম্বনায় ফেলা উচিত? ভাবতে ভাবতে অবশ্য মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়েই গেল। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অনিন্দ্যদা দু’টো সাঙ্ঘাতিক ইন্টারেসটিং পদের কথা মনেও করে ফেললেন। বললেন, “আমিষ টামিষ তো অনেকরকম হয়েছিলই। তবে একটা হয়েছিল লিচু দিয়ে ভাপা দই। অসম্ভব ভালো খেতে। আর মধুজা খুব ভালোবাসে করমচার চাটনি। সেটা সম্ভবত সেবার রান্না হয়েছিল। আর আমার শাশুড়ি যে কত রকম চাটনি আর রান্নার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন, বলে শেষ করা যাবে না! একটা আম দিয়ে টমেটোর চাটনি যা করেন, ফাটাফাটি খেতে।” কাজেই শাশুড়ি মায়ের নেমন্তন্ন পারতপক্ষে মিস করেন না মহাব্যস্ত জামাই, সে ব্যস্ততা যতোই মাথায় চড়ে বসুক। সেটা একবাক্যে মানলেন মন্দারদিও। বললেন, “এ কথাটা কিন্তু সত্যি যে আজ পর্যন্ত একটা ষষ্ঠীও মিস করেনি আমার আলাভোলা মহাদেব জামাই। জন্মদিন, শোকের দিন, বিবাহবার্ষিকী হয়তো অনেক সময়েই ব্যস্ততায় মিস হয়ে গেছে। আসতে পারেনি। কিন্তু জামাই ষষ্ঠীতে আমি নিমন্ত্রণ করেছি, আর ও আসেনি, এমন হয়নি একবারও।”

তবে মন্দারদির হেঁশেলে রান্নার যেমন অভাব নেই, তেমনই নিমন্ত্রণের উপলক্ষও তো কম নয়! জামাই ষষ্ঠীতে কি আলাদা কিছু মনে হয়? অনিন্দ্যদা এবার ওঁর ট্রেডমার্ক সলজ্জ খুকখুকে হাসিটা দিয়ে বললেন, “আলাদা বলতে এই একটা দিনে আমার একটা প্রাধান্য থাকে, এই আর কী! থালা সাজিয়ে খেতে দেন আমাকে উপলক্ষ করে। তবে জুজু (অনিন্দ্যদা-মধুজাদির একমাত্র পুত্র আহির) আসার পর থেকে যে কোনও অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র ও-ই হয়ে ওঠে। ওকে ঘিরেই সবকিছু হতে থাকে। সে জামাই ষষ্ঠীই হোক বা অন্য কিছু। আর এখন বছর পাঁচেক ধরে যেহেতু আমি, আমার বাবা-মা, আমার শাশুড়ি সবাই এক হাউজিংয়েই থাকি, ফলে চায়ের আড্ডাটা আমাদের মোটামুটি নিয়মিতই চলে। আজ তার বদলে ডিনার টেবিলে আড্ডাটা জমবে, এই আর কী!”

Jamai shashthi
বিদূষিনী শাশুড়ি মায়ের রান্নার এক্সপেরিমেন্টে জামাই ক্লিন বোল্ড! ছবি – মন্দার মুখোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে

আচার-বিচার-নিয়ম-নিষ্ঠে এমনিতেও অনিন্দ্যদার না-পসন্দ্। আর মন্দারদির মতো বিদূষী সুলেখিকা কবি শাশুড়ির কাছে যে জামাই ষষ্ঠীতে সে সবের হাঁসফাঁস উপদ্রব থাকবে না, এ কথা আলাদা করে না বললেও হয়তো চলে। কিন্তু তাঁর নিজের লেখায়-পদ্যে মন্দারদি এত অনায়াসে অপরূপে এই সব মা-ঠাকুমার ট্র্যাডিশনের কথা তুলে আনেন, যে মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজের জীবনেও কি ধরে রাখেন না সেসব একটুও? অনিন্দ্যদাকে প্রশ্নটা করতে বললেন, “আসলে সবাই কিন্তু এসব নিয়ম-ঐতিহ্য-প্রথা ভালো করে জানে না। বা তার নেপথ্যে কী যুক্তি ছিল সেটাও জানে না। আমার শাশুড়ি নিজে লেখক বলেই বোধহয় ওঁর নিরীক্ষণের ক্ষমতাটা ঈর্ষণীয়। তাই সেই সব পুরনো দিনের রান্না, প্রথা খুব ভালো করে জানেন-পারেন। ফলে তাতে আমার মতো পেটুক লোকের একদিকে সুবিধেই হয়!”

মুখে এ কথা বললেও, আসলে কিন্তু অনিন্দ্যদা মোটেই ঘরোয়া ডাল-ভাত খাওয়া লোক নন! সে কথা ফিসফাসে নিজেই কবুল করে ফেললেন এক সময়। ভাত না-খেয়ে দিব্যি কেটে যায় দিনের পর দিন। প্রিয় খাবারের তালিকায় প্রথমেই আসে ‘স্টেক!’ কাজেই এহেন জামাইকে ঘরের হেঁশেলে তৃপ্ত করতে পারেন যিনি, সেই শাশুড়ির হাতযশ যে প্রশ্নাতীত, এ আর বলার কথা কি?

অনিন্দ্যদা অবশ্য যতোই কেতাবি বিলিতি খানার ভক্ত হোন, এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন যে বাঙালি রান্নার মতো এমন শাঁসিয়ে কষিয়ে রসিয়ে মিশিয়ে রান্না আর একই রাজ্যে, মায় একই শহরের মধ্যেই রান্নার এমন বৈচিত্র, ভারতের অন্য কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ। কাজেই শাশুড়ির হাতের মেথি চিকেন পেলে সংযম ভুলে ভাত খেয়ে ফেলেন বেশ। বললেন, “মায়ের এই গুণটা মধুজারও আছে। এমনিতে হয়তো কাজের চাপে রোজ রান্না করা ওর পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু ইচ্ছে হলে চটজলদি হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়ে দিব্যি সুস্বাদু কিছু একটা বানিয়ে ফেলতে পারে। আর আমি আমিষ ভালোবাসলেও যেহেতু তেল-মশলা ব্যাপারটা খুব একটা খেতে পারি না, আমার শাশুড়ি মা এই কম তেল-মশলায় অদ্ভুত ভালো স্বাদের রান্না করতে পারেন।” তবে সামান্য মুশকিল একটাই। অনিন্দ্যদা মোটে ঝাল খেতে পারেন না। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে সবাই একটু ঝালমশলার ভক্ত। মন্দারদিও সে কথা বললেন, “আমার জামাই ঝালের মানুষ নয়। ও মিষ্টিই বেশি ভালোবাসে।”

অনিন্দ্যদার মিষ্টিপ্রীতি নাকি প্রায় কিংবদন্তী। খাস উত্তর কলকাত্তাইয়া ঘটিবাড়ির ছেলে হওয়ার সুবাদে হেন মিষ্টি নেই যা অনিন্দ্যদার রসনাতৃপ্তি এবং উদরপূর্তি ঘটায়নি। সেই অনিন্দ্যদাও শাশুড়ি মায়ের বাড়িতে বানানো মিষ্টির ভক্ত। বললেন, “প্রতিবারই জামাইষষ্ঠীতে মরসুমি ফল দিয়ে একটা নতুন কিছু মিষ্টি মেনুতে থাকেই। সেটা সারপ্রাইজ হয়।” জামাইয়ের মিষ্টি-দাঁতের কথা হাড়ে হাড়ে জানেন শাশুড়ি মা-ও। বললেন, “মিষ্টি তো ওর খুবই প্রিয়। আর ভালোবাসে আম খেতে। আম রাখতেই হবে মেনুতে।” পুরনো দিনের জামাই ষষ্ঠীর কথা মনে করে একটু দুঃখও করলেন- “গোড়ার দিকে বয়সও দশ পনেরো বছর কম ছিল। এনার্জিও ছিল। পঁচিশ ছাব্বিশ রকম পদ করতাম। এখন আর সে রকম করতে পারি না। পায়ে ব্যথা-ট্যথা নিয়ে জেরবার। তবে এখনও পর্যন্ত বাইরে থেকে কোনওদিন কিচ্ছুটি আনাইনি।”

এ বার তাহলে কী কী রান্না হল? এতে অবশ্য মন্দারদি একটু বেঁকে বসেছিলেন। জামাই আসার আগেই বাংলালাইভ জেনে যাবে মেনু? কিন্তু আমি ধরে পড়ায় বলেই ফেললেন- “আজ করেছি কষা মাংস আর লুচি। সঙ্গে অনিন্দ্যর একটা প্রিয় খাবার, ধনেপাতা বাটা দিয়ে গ্রিলড পমফ্রেট। আম আর আঙুরের একটা চাটনি। আর শেষপাতে ফ্রুট কাস্টার্ড।” তবে জামাই বেশি খেতে পারেন না। যাকে বলে ফ্রুগাল ইটার। কিন্তু পছন্দ করেন বেশ বড়সড় একটা স্প্রেড, যার থেকে অল্প অল্প করে চাখা যাবে নানা রকম! রাত বাড়লে জানা গেল, শাশুড়ি মায়ের জন্য মিঠাই-রসিক জামাই এনেছেন বলরামের লিচুর পায়েস আর ‘ইমিউনিটি’ সন্দেশ।

Anindya chatterjee
বিয়ের দিনে শাশুড়ি মায়ের জামাইবরণ! ছবি – মৌসুমী দত্ত রায়ের ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে

কিন্তু পঞ্চব্যঞ্জন রেডি থাকলেও শাশুড়ি মায়ের এ বার মনটা একটু খারাপই। এক তো মেয়ে আর নাতি রয়েছে সেই মুম্বইতে। ভালোমন্দ রান্না একটুও খাওয়ানো যাচ্ছে না তাদের। আর দ্বিতীয়ত, লকডাউন বলে জামাইয়ের জন্য সাধের উপহারটি কেনা হয়নি। কী উপহার কিনতেন? এবার হাসতে হাসতে মন্দারদির জবাব, “তোকে তো বললাম আমার মহাদেব জামাই। ওর অপছন্দ বলে কিছু নেই। যা দিই তাতেই খুশি। তবে সুতির হাল্কা প্রিন্টের শর্ট কুর্তা, নইলে হাফ-হাতা শার্ট কিম্বা পাঞ্জাবি… এ সবই কিনি আর কি। খুব পছন্দ হলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট খুলে পরে ফেলে। আর ভালোবাসে বাইরের নানা রকম খাবার, মানে ভালো চা, ভালো কফি, ভালো দোকানের মিষ্টি এইসব। তবে এসবের খবর বেশি রাখে আমার মেয়ে। ও-ই বলে টলে দেয়। আমি এসব অত জানি না।”

শাশুড়ির ষষ্ঠী-স্মৃতির পরেই অনিন্দ্যদাকে ধরলাম। আপনার প্রিয় জামাই ষষ্ঠীর স্মৃতি বলুন একটা! অনিন্দ্যদা দু’টো স্মৃতির কথা বললেন। যদিও সেগুলোর একটাও নিজের শাশুড়ি সংক্রান্ত নয়, কিন্তু কোনও না কোনও ভাবে জামাই ষষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। বললেন, “আমাদের বাড়ির খুব কাছেই ইন্দ্রাণী পার্কে থাকতেন ঋতুদা। ঋতুপর্ণ ঘোষ। বিয়ের পর প্রথমবার জামাই ষষ্ঠীর দিনই আমি মধুজাকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। এমনিই। মধুজার সঙ্গে সেটাই ঋতুদার প্রথম আলাপ। ফেরার সময় আমাদের একটা মহার্ঘ্য উপহার দিয়েছিলেন ঋতুদা। গণেশ পাইনের সই করা ওঁর আঁকা ছবির ফার্স্ট প্রিন্ট। সেটা আজও আমাদের ঘরে সযত্নে রাখা। আর দ্বিতীয় স্মৃতিটা মধুর হলেও বেদনাবিধুরও বলতে পারও। আমার শাশুড়ি আমাকে প্রথম থেকে অনিন্দ্য বলেই ডাকেন। এই পৃথিবীতে এমন একজনই ছিলেন যিনি আমাকে চিরকাল ‘জামাই’ বলে ডেকে এসেছেন, কারণ মধুজার সঙ্গে কন্যাসম্পর্ক ছিল তাঁর। তিনি হলেন নবনীতাদি। নবনীতা দেবসেন। কোনও দিন জামাই ষষ্ঠীর দিন ডেকে খাওয়াননি বটে, কিন্তু খাওয়াতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। যখনই যাই না কেন, আদর করে নানা কিছু খাওয়াতেন। সামান্য মশলামুড়ি খাওয়ালেও সেই যত্ন, সেই আদর, সেই আন্তরিকতা, কোনও দিনের হিসেবে মাপা যাবে না! এই বছরটা নবনীতাদিকে ছাড়া আমার প্রথম জামাই ষষ্ঠী।”

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

9 Responses

  1. ব্যাপক লেখা। প্রিয় লেখিকা মন্দার দির জামাই আমারো খুব প্রিয়। সেটা অবিশ্যি চন্দ্রবিন্দু সূত্রে আর তার সম্পাদকীয় কলমের মুগ্ধতায়। জামাই ষষ্ঠী জিন্দাবাদ!

  2. অনিন্দ্য কেমন আছো? তোমার reception এর দিন খুব আনন্দ করেছিলাম । তোমার আর তোমার শাশুড়ির এতো সুন্দর সম্পর্কের কথা জেনে খুব ভালো লাগল । আজকাল তো কাজের চাপ এ এই আনন্দ অনুষ্ঠান গুলো জীবন থেকে হারিয়ে ই গেছে ।তার মধ্যে ও তোমরা যে এতো সুন্দর ভাবে আছো,জেনে খুব ভাল লাগল । ভাল থেকো গো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *