কলকাতার বিশিষ্ট মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রামের সঙ্গে কথোপকথনে কস্তুরী ভারভাদা জেনে নিলেন স্ট্রেস বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও স্ট্রেসের সঙ্গে মোকাবিলা করার সহজ কিছু উপায়। বাংলালাইভের পাঠকদের জন্য রইল শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনন্দিন জীবনে স্ট্রেস কমাতে ড. রামের  কিছু সময়োপযোগী উপদেশ। 

 

“এত চিন্তা করিস না তো!”

“চিন্তা করে আর কী করবি?”,

“যা করার তা তো করতেই হবে” –

এই কথাগুলো বলার লোক যবে থেকে কমে গেছে, ‘চিন্তা’ তখন থেকে আর হাল্কা চিন্তা নেই। ‘স্ট্রেস’ নাম নিয়ে এক ভয়ানক বোঝা হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। আজকের জীবনে সত্যিই স্ট্রেস কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? চাইলেই কি স্ট্রেস কমানো যায়?

বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. জয়রঞ্জন রাম বলছেন – “একদিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের জীবনে স্ট্রেস থাকাটা অবশ্যই দরকার। একটুও স্ট্রেস বা চাপ না থাকলে আপনি কোনও কাজই জীবনে ঠিক ভাবে করবেন না। স্ট্রেস কিন্তু একপ্রকারে মানুষের জীবনের সেরা অবদানটাকে বার করে নিয়ে আসে। চাপে আমাদের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়। তবে স্ট্রেসের কিন্তু কোনও বয়স নেই। যে কোনও বয়সের মানুষ স্ট্রেসের কবলে পড়তে পারেন। তবে বয়সভেদে স্ট্রেসজনিত অসুস্থতার লক্ষণগুলি এক এক রকম।”

ডক্টর রামের মতে, স্ট্রেস থেকে বড়দের হার্টের সমস্যা হতে পারে। বাড়তে পারে রক্তচাপ ও ব্লাডসুগার। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যাঁদের নানারকম ব্যথার সমস্যা আছে স্ট্রেসের কারণে সেগুলি আরও বাড়তে পারে। স্ট্রেস থেকে মুক্তিলাভের পথ হিসেবে মদ ও সিগারেটকে খুব সহজেই অবলম্বন করে তোলেন পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। তবে তাতে কিন্তু আখেরে ক্ষতি অনেক বেশি হয়।

ছোটদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘ্যানঘ্যান করা, কথায় কথায় বায়না করা, মাকে একদম ছাড়তে না চাওয়া (পারলে মায়ের পিছু পিছু বাথরুমেও চলে যাওয়া), বারবার পেটব্যথা-মাথাব্যথা নিয়ে অভিযোগ, স্কুল যেতে না-চাওয়া, খাওয়ার প্রতি অনীহা, এগুলো হতে থাকে। কিন্তু এগুলো সবই স্ট্রেসের উপসর্গ। বাচ্চাদের স্ট্রেস হবে কেন?

ডক্টর রামের মতে, “মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া, পারিবারিক হিংসা-অশান্তি, স্কুলে বন্ধু না-হওয়া, দিনের পর দিন বুলি-র শিকার হওয়া, এবং সর্বোপরি সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা যৌন নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে না-পারা, বাচ্চাদের মধ্যে চূড়ান্ত স্ট্রেসের জন্ম দেয়। ছোটদের প্রধান সমস্যা, ওরা বাড়ির লোক বা শিক্ষক–শিক্ষিকা কাউকেই খুলে বলতে পারে না এই ধরনের কথা। ফলে স্ট্রেস জমতে থাকে এবং সেটা প্রকাশ পায় ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। ওরা ক্রমশ অমনযোগী হয়ে পড়ে, পড়াশুনো-খেলাধুলোর প্রতি আগ্রহ কমে যায়, অল্পেই অধৈর্য হয়ে পড়ে, অসন্তোষ প্রকাশ করে। আমাদের দেশে শিশুদের যৌন নির্যাতন বিষয়ে প্রায় কোনও কথাই হয় না। বড়রাও বাচ্চাদের শেখান চুপ করে ব্যাপারটা হজম করে নিতে। ফলে বাচ্চারাও এই বিষয়টা লুকিয়েই রাখতে চায়। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে স্ট্রেসের সঠিক কারণটা খুঁজে বার করা। সেটা জানা গেলে সমস্যার সমাধান অনেকটাই হয়ে যায়। একদম ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হয় সাময়িক। দ্রুত কোনও চিকিৎসক বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিলে সমাধান সম্ভব। তবে সর্বাগ্রে জরুরি স্ট্রেসের কারণ খুঁজে বার করা।”

বড়দের ক্ষেত্রে স্ট্রেস বাড়লে কী হয়? ডক্টর রাম জানালেন, “একসঙ্গে অনেকটা কাজের চাপ হঠাৎ বেড়ে গেলে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। আমরা যদি একটা প্লেটে একসঙ্গে অনেক খাবার নিই, সবটা কি ঠিক করে খেতে পারি? অধিকাংশ সময়েই নষ্ট করি বা সামলাতে না-পেরে বেশি খেয়ে ফেলে হাঁসফাঁস করি, বুঝতে পারিনা কী করব। ওয়র্কপ্লেস স্ট্রেসও অনেকটা ঠিক এই রকম। কাজ বেড়ে গেলে আমরা বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিই। যাঁদের জিমে যাওয়া অভ্যেস, তাঁরা যাওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে যে কারণগুলো আমাকে ভালো রাখে, কাজের চাপে প্রথমেই সেগুলোকে জীবন থেকে সরিয়ে দিই। ফলে খারাপ লাগাটা আরও বাড়তে থাকে।”

যাঁদের বয়স ৬৫ বা তার ওপরে তাঁদের মধ্যেও কিন্তু স্ট্রেস দেখা যায়! তবে তার ধরনটা অন্য। ডক্টর রামের কথায়, “এই বয়সে পুরুষ-নারী দু’জনেই সংসার থেকে কিছুটা বিযুক্ত হয়ে পড়েন। কাজ–দায়িত্ব কমে যায়। ফলে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে শুরু করে। স্ট্রেস বাড়ার এটা একটা বড়ো কারণ। তার চেয়ে বয়স্ক মানুষেরা যদি কোনও কাজ খুঁজে নেন নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্য… কোনও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলে নিজেদের গুরুত্ব বুঝতে সুবিধে হয়। সেক্ষেত্রে স্ট্রেসও কমে যায়।”

ডক্টর রামের মতে, “অল্পবয়সীদের চেয়েও বাড়ির প্রবীণ সদস্যটির জন্য স্মার্ট ফোন খুব জরুরি! শুনতে অবাক লাগলেও, কথাটা কিন্তু একশো শতাংশ সত্যি। কারণ স্মার্ট ফোন তাঁদের ব্য়স্ত রাখবে। ব্যবহার শিখতে কিছুটা সময় যাবে। তারপর গান শোনা, সিনেমা দেখা, হোয়াটস্যাপে দূরের আত্মীয়দের সঙ্গে ভিডিও কলিংয়ে কথা বলা ওঁদের মন অনেকটা ভালো রাখবে। কাজেই আজই মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমার জন্য স্মার্ট ফোন অর্ডার দিন! বাড়িতে সবাই আনন্দে থাকবেন। বয়স্কদের দিকে গোড়া থেকেই ঠিকঠাক নজর না-দিলে একাকিত্ব ওঁদের ঘাড়ে চেপে বসবে। স্ট্রেস বাড়তে বাড়তে এক সময় এমন জায়গায় পৌঁছবে যে চিকিৎসা করানো মুশকিল হয়ে পড়বে। ফলে প্রথম থেকেই একটু একটু করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে পরে চরম বিপদ আটকানো যায়।”

শেষমেশ বলা চলে, সব বয়সি মানুষের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ – ‘না’ বলতে শেখা। ‘না’ বলতে না-পারা মানুষকে বড় বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়। ডক্টর রামের কথায়, “না বলতে শিখুন। লজ্জা আড়ষ্টতা কাটিয়ে যে কাজটা পারবেন না সেটা পরিষ্কার ভাবে অপর পক্ষকে জানিয়ে দিন। দেখবেন আপনার হাল্কা লাগবে, বড় বোঝা মাথা থেকে নেমে যাবে। এর ফলে আপনার স্ট্রেস কমবে, আপনি অনেক ভালো থাকবেন। আপনার অফিসের বস-ই হোন বা স্বামী, ভয় না-পেয়ে ‘না’ বলুন।”

কস্তুরী ইতিহাসে এমএ পাশ দিয়েছেন। চাকরিও করেছেন বেশ কিছু কাল। এখন ফ্রিলান্স লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। বেশ কিছু বছর আনন্দবাজার পত্রিকার "উৎসব" পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। গান শুনতে আর সিনেমা দেখতে ভারী ভালবাসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *