শুধুই কি পাণ্ডিত্য? দু’শো বছর পরও কার কাছে আমরা মাথা নত করি? একটু ভাবলেই দেখি– তিনি যেন এক সর্বত্রগামী ও সর্বরোগহর নির্মল বাতাস। যেমন সংসারী তেমনই সন্ন্যাসী। যেমন প্রাচীন তেমনই আধুনিক। যেমন পণ্ডিত, তেমনই পাহাড়ের মতো দৃঢ়। অথচ একজন সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ। অক্টাভিয়ো পাজ়ের মতো তিনিও তাঁর টুপিতে গোঁজা সব পালকের আড়ালে দেখতে পান তাঁর আসল মানব সত্ত্বাকে। তিনিও যেন বলে ওঠেন– আই আ্যম এ ম্যান। তাই দুখি মানুষ দেখলেই, সেবায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। বটগাছের তলায় বসে ধ্যান না করেও তিনি যেন বুদ্ধের প্রতিরূপ। মাটির প্রতিমায় বিশ্বাসী না হয়েও তিনি যেন পরমহংস। মহাপ্রভু না হয়েও তিনি যেন মূর্তিমান চৈতন্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক হয়েও তিনি আধুনিক। স্বসময় থেকে বহু এগিয়ে। যুগে যুগে প্রমাণিত যে, আধুনিকতা মানে নিজের চোখ দিয়ে দেখা। পুরনো চাপিয়ে দেওয়া চশমার কাচ দিয়ে নয়। আধুনিকতা পরনির্ভরতা শেখায় না। বরং শেখায় আত্মবিশ্বাস। স্বাধীনতা। নিজস্ব খনিগর্ভে ডুব দিয়ে অনন্ত সম্ভার থেকে মণি-মুক্তো তুলে আনার নির্দেশ। কিন্তু আমরা এই মেকি আধুনিকতার যুগে দাঁড়িয়ে কী করছি? বুলেট ট্রেনে চড়ে জাগতিক প্রাপ্তির দিকে ভয়ংকর গতি তুলে এগিয়ে চলেছি। আর সেরকমই গতি নিয়ে আধ্যাত্মিক পথ থেকে সহস্র যোজন দূরে সরে যাচ্ছি। ঢুকে পড়ছি শরীরসর্বস্ব ভোগবাদের ব্ল্যাকহোলে। এমন এক কঠিন পরিস্থিতে তিনিই আমাদের পথ দেখাতে পারেন যিনি কখনও আগুয়ান হতে পিছপা হননি। যিনি পুরনো অযৌক্তিক সংস্কার ভেঙে আলোর সন্ধান দিয়েছেন। যা কিছু প্রগতি-বিরোধী, যা কিছু প্রাচীন শ্যাওলার মতো, তাকে দূরে সরিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। নিজেকে প্রকৃত আধুনিক প্রমাণ করেছেন প্রতিনিয় । বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ, নারীশিক্ষা বিস্তারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ, সবার জন্য সংস্কৃত শিক্ষা, বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা… সেই শ্যাওলা সরানোর দৃঢ় পদক্ষেপ।
তাঁর আধুনিকতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত সব শ্রমের মূল্যদান। কোনও কাজই যে খাটো নয়, এ শিক্ষা বোধহয় আমাদের তাঁর কাছ থেকেই নিতে হবে। হাড়ি-মুচি-ডোমের মেয়েদের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে তখন অনেকে দূরে দূরে থাকতেন। এসব দেখে বিদ্যাসাগর তাদের ডেকে রুক্ষ চুলে নিজের হাতে তেল মাখিয়ে দিতে থাকলেন। তাঁর কাছে যে কোনও পোশাক মানেই ছিল নগ্ন মানব-মানবীর ছদ্মবেশ। তাই উড়িয়া বামুন থেকে পাইক, পাচক, মালি ও কুলির কাজ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে অনায়াস ভঙ্গিমায়। যে ডিগনিটি অফ লেবারের জোরে আজ উন্নতদেশগুলি ময়ূরাসনে উপবিষ্ট তার শিক্ষা নিতে হত এই আধুনিকতম মানুষটির কাছে।

গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নামঞ্জুর করা নিয়ে তিনি উড্রো সাহেবের অধীনতা স্বীকার করলেন না। মাসিক ৫০০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিলেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের সম্মানীয় পদ ছেড়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন লেখনীর ওপর নির্ভর করে ঝাঁপ দিলেন বিরাট এক কর্মযজ্ঞে। এও কি একপ্রকার স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়? তাঁর মৃত্যুর ১৩০ বছর পরও কি আমরা এমন আধুনিক হতে পেরেছি? ধর্ম ও জাতপাতের প্রাচীর সরিয়ে, কুসংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে স্বাধীন হতে পেরেছি? মধুকবি ঠিকই লিখেছিলেন, ‘তাঁর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ঋষির প্রতিভা ও প্রজ্ঞা, ইংরাজের সতেজ কর্মশক্তি এবং বাঙালি মায়ের হৃদয়।’
ঈশ্বরচন্দ্রের সমানুভূতির নজির দেখলে তাঁকে অনায়াসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্যের কষ্ট যেমন ঠাকুরের কষ্ট হয়ে উঠত, প্রহৃত মাঝির আঘাত যেমন তাঁর পিঠে ফুটে উঠেছিল, তেমনি কারো দুঃখ দেখলে বা দুঃখের কথা শুনলে তিনি আর স্থির থাকতে পারতেন না। এমনকি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনও মানুষের মনঃকষ্টের আঁচ পেলেই যেচে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেন। কলেরা রোগীকে বুকে তুলে নিয়েছেন, অসুস্থকে দু’বেলা খাইয়ে দিয়ে এসেছেন, রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ ব্যক্তিকে নিজের পালকিতে চড়িয়ে নিজে হেঁটে গিয়েছেন। মা-বাবা, ভাই-বোন, পুত্রবধূর মোটা ভাত কাপড়ের দায়িত্বও মাথায় তুলে নিয়েছেন হাসিমুখে। কত মানুষকে যে অর্থসাহায্য করেছেন, তার হিসাব নেই কোনও গবেষকের কাছে। কিন্তু এই সব সেবা, দানের কথা তিনি কখনও কারও কাছে যেমন বলতেন না, তেমনি কেউ সেগুলো যাতে প্রচার না করে সে দিকেও দৃষ্টি দিতেন।

সাঁওতাল পরগনার কার্মাটাঁড়ের বাড়িতে যখন ছুটি কাটাতে যেতেন, তখন তাদের ‘তুই’ ডাক শোনার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। এমনকি তাদের ফরমাস অনুযায়ী হার, ঘুনসি, চিরুনি, আয়না, খেজুর, মাছ, কাপড়, জামা, মিষ্টি থেকে শুরু করে কী না এনে ভাগ করে দিতেন সবার মধ্যে। সকালে চড়া দামে ভুট্টা কিনে নিয়ে বিকালে বিনা পয়সায় ওই ভুট্টাই ওদের মধ্যে বিলি করতেন। পড়াশুনার জন্য নিজের খরচে ওদের জন্য একটা স্কুলও খুলে দিলেন। ১৮৬৬ সালের মাঝামাঝি দেশে যখন চরম দুর্ভিক্ষ, কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরকে দেখা গেল নিজের হাতে ডাল, তরিতরকারি পরিবেশন করতে। শুধু তাই নয়। কিছুদিনের মধ্যেই বীরসিংহ গ্রামে একটা অন্নসত্র খুলে দিলেন। একবার তাঁর বাড়ির এক পরিচারক বিদ্যাসাগরের অসুবিধা হবে ভেবে এক ভিক্ষুককে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেননি। বিদ্যাসাগর একথা জানতে পেরে ভৃত্যকে কাজ থেকে বরখাস্ত করেন। আবার যাতে তার অন্নসংস্থানের অসুবিধে না হয়, তাই কিছু মাসোহারারও ব্যবস্থা করে দেন।
মাইকেল মধুসূদনের পাশে দাঁড়াতে তিনি ধার করে তখনকার দিনে ছ’হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। ফ্রান্স থেকে ফিরে যাতে তিনি ভালোভাবে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারেন, তাই তাঁর জন্য তিনতলা ঘর সাজিয়ে রাখলেন। নিজের ছাপা কারখানা ও বই বিক্রি থেকে বছরে কম বেশি ত্রিশ হাজার টাকা আয় করছেন, অথচ নিজের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন চটি জুতো, মোটা ধুতি, কম দামি চাদর ও বেশিরভাগ সময়েই নুন ও মোটা চালের ভাত। বাদুড়বাগানের বাড়িতে একা একা আনন্দযাপন করেননি। মেয়ে, নাতি-নাতনি ও অন্যান্য পরিজনদের থাকার ব্যবস্থা করছেন আর মানুষের মঙ্গল কামনায় বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কেটে চলেছেন একনাগাড়ে। এ যেন বোসপাড়া লেনের ঘুপচি ঘরের নিবেদিতা নামক সূর্য, যিনি নিঃস্ব হতে হতে নিজের যা কিছু সব পরমানন্দে উজাড় করে দিচ্ছেন দেশের সেবায়, মঙ্গল কামনায়। এ যেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজের সমস্ত উপার্জনই ব্যয় করে দিচ্ছেন অকাতরে।

সমাজকে বন্ধুতার আলো দেখানোর জন্যই যাঁর জন্ম, ‘লাভ দাই নেবার’ মন্ত্র যাঁর মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে, ‘বিশপক্যান্ডলস্টিক্স’-এর বিশপের মতো যিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার উদ্দেশে বাড়ির দরজা খুলে রাখেন, বিদ্যাসাগরকে সেই মানবরূপী ঈশ্বর বললে কি অত্যুক্তি হয়? অগণিত সংস্কৃত শ্লোক ও কবিতার জনক, প্রতিভার বরপুত্র ঈশ্বরচন্দ্র জন্ম থেকেই যেন ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত। জন্মের কাছে সমর্পিত। সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃজনীকে প্রায় অগ্রাহ্য করে বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে তিনি লগ্ন হয়ে গেলেন। ব্রতী হলেন সহজে সংস্কৃত শিখে ফেলার পথ খুঁজে দিতে। লিখতে থাকলেন একের-পর-এক বই। অনুবাদের মাধ্যমে দেখাতে থাকলেন কী ভাবে উচ্ছশৃঙ্খল বাংলা ভাষার সুর ঠিকঠাক বাঁধতে হয়। যাতে সেই সুর থেকে তৈরি হতে পারে সাহিত্যের বিচিত্র সব সেলুলয়েড। যাতে তার প্রকৃত রূপ-রস- গন্ধ বিচ্ছুরিত হতে থাকে সৃজনশীল হাতে। যাতে ডানা মেলতে পারে একে একে নবকুমার থেকে অমিত, অপু থেকে কলকাতার যিশু।

এই স্ব-আরোপিত কষ্ট ও আত্মত্যাগের পরেও তিনি কী পেয়েছিলেন? যত না ভালবাসা, সমাদর তার চেয়ে অনেক বেশি কটাক্ষ, প্রতিরোধ, প্রবঞ্চনা, অসম্মান ও যন্ত্রণা। নিজের ভাই, এমনকি নিজের ছেলের কাছ থেকেও অসহনীয় ও অপ্রত্যাশিত দু:খ। মাতৃভক্ত সন্তান মায়ের কাছে ফিরতে পারছেন না। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁর ভাই-সহ গ্রামের কিছু মানুষের মিথ্যাচার ও প্রবঞ্চনা। হালদার পরিবারকে কোনও অজ্ঞাত কারণে কথা দিয়েছিলেন তিনি, যে তাঁদের ধর্মপুত্র মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনও বিধবার বিবাহ হবে না। কিন্তু কিছু গ্রামবাসী ও ভাই শম্ভুচন্দ্র মিলে তাঁকে না জানিয়ে বিধবা মনমোহিনীর সঙ্গে তাঁদেরই বাড়িতে এই বিবাহটি দেন। এই প্রতারণা বিদ্যাসাগর মেনে নেননি। তিনি চিরতরে গ্রাম ত্যাগ করলেন। বাবা ঠাকুরদাসের কাছে ফিরতে পারছেন না, কারণ তিনি তাঁর উড়নচণ্ডী ছোটভাই ঈশান ও তাঁর বিপথগামী একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। স্ত্রী দীনময়ী দেবীর সঙ্গেও তাঁর মৃত্যুর (১৩ অগস্ট ১৮৮৮) কাছাকাছি সময়ে ছাড়া আর দেখা হয় না। কারণ একটাই। তিনি নারায়ণকে উইল করে (৩১ মে ১৮৭৫) ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।
অনেক অনুরোধের পরও বিদ্যাসাগর যেমন বীরসিংহে যেতে চাইলেন না, তেমনি প্রভাবতী দেবীও কলকাতায় আসতে চাইলেন না। কিন্তু মায়ের জন্য তখন তাঁর চিঠি লেখা ও চোখের জল ছাড়া আর কিছু পড়ে রইল না। মায়ের জন্য কেঁদে পুড়ে বাইরে থেকে তিনি যেন পাথর হয়ে যেতে থাকলেন। কিন্তু ভিতরে থৈ থৈ করতে থাকল জল। যে কোনও মায়ের কষ্টের কথায় তাই তাঁর হৃদয় ভিজে উঠত, শিশুর মতো কেঁদে ফেলতেন। অন্ধ মুসলমান গায়ক অখিলুদ্দিন, যিনি বেহালা বাজিয়ে শ্যামাসংগীত গাইতেন, তাঁর কাছে মাতৃবন্দনা শুনতেন আর অঝোরধারায় কাঁদতেন। কনিষ্ঠা কন্যার শ্বশুর জগদুর্লভ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও তিনি সেই গান শুনতে চাইতেন যাতে ‘মা-মা’ ধ্বনি উচ্চারিত হত। মায়ের চলে যাওয়ার পর বহুদিন ঈশ্বরচন্দ্র কৃচ্ছ্রসাধন করে কাটিয়েছিলেন। কেউ মায়ের কথা উত্থাপন করলেই তিনি শিশুর মতো কেঁদে ফেলতেন। জীবনীকার বিহারিলাল সরকারের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, পিতামাতার যে ছবি তিনি আঁকিয়েছিলেন, তা না দেখে কোনওদিন সকালে জলও খেতেন না। জীবনের একদম শেষ অবস্থায় (জুলাই, ১৮৯১) যখন তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেছে, তিনি অচেতন, তখনও কী এক মন্ত্র প্রভাবে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরে গিয়ে মায়ের ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ‘অবিরলধারে’ অশ্রুবিসর্জন করতেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে তাঁর অস্তিত্ব এখানে যেন হুবহু মিলে যায়। ঠাকুরের ‘মা’ যখন মৃণ্ময়ী তাঁর ‘মা’ হলেন চিন্ময়ী। অর্থাৎ ঠাকুরের কাছে ঈশ্বর বিমূর্ত থেকে মূর্ত। আর ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে তা শুধুই মূর্ত। সাধনমার্গের দু’টি আপাত ভিন্ন পথ ধরে সেই একই জায়গায় যেন পৌঁছে যাওয়া।

এমন একজন মানুষ, যাঁর মাতৃভক্তি, বন্ধুতা সম্বন্ধে কোনও কথা বা গল্পই অতিরঞ্জন নয়, তিনি কি না নিন্দার শিকার হচ্ছেন। নিন্দা করছেন কারা? যারা তাঁর দ্বারা বিভিন্নভাবে উপকৃত। বিশ্বকবি যথার্থই বলেছিলেন যে, যাঁরা মহাপুরুষ ‘বাহিরের অগৌরব তাঁদের অন্তরের সেই সম্মানের টীকাকেই উজ্জ্বল করে তোলে– অসম্মানই তাঁদের পুরস্কার।’ বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে তিনি বহু মানুষের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁকে বিদ্রুপ করে কবিতা লেখা হচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সাহিত্যিকও বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন। বিষবৃক্ষ উপন্যাসের সূর্যমুখী চরিত্রের মাধ্যমে বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে কটাক্ষ করছেন তীব্র ভাষায়। লিখছেন,’যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত তবে মূর্খ কে?’ এমনকি তাঁর প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ কষ্ট কোথায় রাখবেন তিনি? তিনি তো এক দিকে সাধারণ মানুষ। তাই আঘাত পান। গভীর দুঃখের সঙ্গে মানুষের বোধোদয়ের জন্য হয়তো বলেন,’এদেশের উদ্ধার হতে বহু বিলম্ব আছে। পুরনো স্বভাব ও প্রবৃত্তির মানুষের চাষ উঠিয়ে দিয়ে, সাত পুরু মাটি তুলে ফেলে, নতুন মানুষের চাষ করতে পারলে, তবে যদি এদেশের ভালো হয়।’
তিনি ঈশ্বরবাদী যিশু নন, বস্তুবাদী মার্কস নন, বেদান্তবাদী বিবেকানন্দ নন, অজ্ঞেয়বাদী বুদ্ধও নন। সারা জীবনে তিনি কখনও বক্তৃতা দেননি। কোনও গালভরা তত্ত্ব কথা লিখে যাননি। তবু তাঁর অনন্ত কর্মযোগের, অপরের অক্ষতিকর বিশ্বাসে আঘাত না দেওয়ার ও নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমের সাধারণ দর্শন অতি অনায়াসে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ‘রামকৃষ্ণের পর বিদ্যাসাগরের অনুবর্তী’ স্বামী বিবেকানন্দের মুখে তাঁর বর্ণনা শুনে নিবেদিতা বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি কেবল নৈতিক বলে বহুবিবাহকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তিনি যে গভীরভাবে আধ্যাত্মিক, তাহা আমরা অনুধাবন করিতে পারিলাম।’
উৎপল চক্রবর্তী ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি। ২০১৭ সালে প্রথম দেশ পত্রিকায় ওঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। সিগনেট থেকে প্রকাশিত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'উড়ন্ত ডলফিন' এবং শাম্ভবী থেকে প্রকাশিত প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ, 'দ্যা মার্ক'। কলকাতার নবোদয় পাব্লিকেশন থেকে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ওঁর দশটিরও বেশি বই।