আজ যাঁর জন্মদিন, তিনি বাঙালির ইতিহাসে এক বিরল বহুমুখী প্রতিভা। একদিকে বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও অন্যদিকে কবি-সাহিত্যিক— এই সমণ্বয় শুধু সেকালে কেন একালেও বিরল। তিনি, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, যিনি ‘গুপ্তকবি’ নামেও সমধিক পরিচিত। তাঁর কাব্যপ্রতিভা যেমন বহুল আলোচিত, তেমনই সংবাদপত্র সম্পাদক হিসেবে তাঁর ভূমিকাও ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কারণ উনিশ শতকের যে সময়টিতে তাঁর কাগজ ‘সংবাদ প্রভাকর’ আত্মপ্রকাশ করে, বাংলায় তখন এক অস্থির টালমাটাল সময়।
একদিকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি, অন্যদিকে ব্রাহ্মসমাজের ক্রমউত্থান এবং তারই পাশাপাশি নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গলের অতি প্রগতিশীলতা— এই ত্র্যহস্পর্শে বঙ্গসমাজ তখন হাসফাঁস করছে। সেই সময়টিতে দাঁড়িয়ে সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নিজের মত প্রকাশ এবং মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বেড়া টপকে আধুনিকতার পথে হেঁটে চলতি নিয়মনীতিকে শাণিত ব্যঙ্গের কষাঘাত করা – দু’ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্ম ১৮১২ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার কাঞ্চনপল্লিতে, যার পরবর্তী নাম কাঁচরাপাড়া। পিতা হরিনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন কবিরাজ। পাঁচ ভাইবোনের একজন ঈশ্বরের মাত্র দশ বছর বয়সে মা শ্রীমতী দেবী প্রয়াত হন। বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে সৎমায়ের সঙ্গে ঈশ্বরের সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। তিনি কাঁচরাপাড়া থেকে কলকাতায় এসে জোড়াসাঁকোয় তাঁর মামারবাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে থেকেই অল্পস্বল্প লেখাপড়ার শুরু। তবে দারিদ্র্য এবং প্রথাগত শিক্ষায় অনীহা – এই দুই কারণেই খুব উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়া হয়নি ঈশ্বরের। যদিও পরবর্তীকালে নিজের চেষ্টায় বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেন, বেদান্তদর্শন পড়েন। ইংরেজি আর ফারসি জানতেন কাজ-চালানো গোছের।
আসলে তদানীন্তন শিক্ষার পীঠস্থান হিন্দু কলেজ বা তৎসম উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাননি ঈশ্বর গুপ্ত। কারণ তিনি ছিলেন দরিদ্র এবং পুঁথিগত শিক্ষাগ্রহণে অনিচ্ছুক। ফলে বরাবরই রামমোহনের ব্রাহ্মসভার অদ্বৈতবাদ অথবা ডিরোজ়িওর নেতৃত্বাধীন ইয়ং বেঙ্গলের পাশ্চাত্যমুখী ধরনধারণ – এই দুই ধারা থেকে তাঁর একটা দুরত্ব ছিল। ফলে দুয়েরই বিরোধী হিসেবে তাঁর একটা পরিচিতি তৈরি হয়।
এই সময় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। তাঁরই উৎসাহে এবং পাথুরিয়াঘাটা রাজপরিবারের সদস্য যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের অর্থানুকূল্যে তিনি ১৮৩১ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা সম্পাদনার ভার নেন। সংবাদ প্রভাকর আগে সাপ্তাহিক ছিল। ঈশ্বর গুপ্ত তাকে দৈনিকে রূপান্তরিত করেন ১৮৩৬ সালে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলায় মুদ্রণ ব্যবসার সার্বিক স্বীকৃতি এবং উন্নতির প্রবাহে কিন্তু তখনও কিছু বিলম্ব ছিল। ফলে সংবাদপত্র ছাপা হত প্রচুর, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হত না। এমতাবস্থায় ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর মতো কাগজের দায়িত্ব নিয়ে সাংবাদিক-সম্পাদকের ভূমিকায় কাজ চালানো কিন্তু বড় সহজ কাজ ছিল না। সে কাজে ঈশ্বর গুপ্তকে পথিকৃৎ বললে অত্যুক্তি হয় না। তবে প্রাথমিকভাবে ‘সংবাদ প্রভাকর’ কিন্তু ডিরোজ়িও অতি প্রগতিবাদের বিরোধীর ভূমিকাই গ্রহণ করেছিল। ‘সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ গ্রন্থে বিনয় ঘোষ লিখেছেন—
“১৮৩১ সালের সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ বা পাশ্চাত্য ভাবোন্মত্ততা, কোনটাই তাঁর পক্ষে সহজপাচ্য ছিল না। সহজ ছিল হিন্দু সমাজের সাধারণ জনস্রোতে (যা অবশ্যই রক্ষণশীল) কিছুদূর ভেসে যাওয়া। প্রভাকরের প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়, বেশ খানিকটা এই জনস্রোতে তিনি ভেসে গিয়েছিলেন। তবে অচৈতন্যের মতন একেবারে যে তিনি গা ভাসিয়ে দেননি তা অল্পকালের মধ্যে সামাজিক মতামতের ক্ষেত্রে তাঁর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে বোঝা যায়।… তিরিশের শেষ দিক থেকে সমাজের ভিন্নমুখী গতিধারা তাঁর কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায় এবং পত্রিকার পরবর্তী রচনাবলী থেকে মনে হয়, এই সময় থেকে তাঁর নিজস্ব স্বাধীন চিন্তাধারার সুস্পষ্ট বিকাশ হতে থাকে। চল্লিশ থেকে প্রভাকর স্বতন্ত্র উদারপন্থী হিন্দু মধ্যবিত্তের মুখপত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।”
এবং এই কাগজ থেকেই প্রাথমিকভাবে শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাহিত্যকৃতি। তাঁর রচনায় কিন্তু একজন ঈশ্বর গুপ্তকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক ঈশ্বর সেখানে ছড়িয়ে রয়েছেন। কখনও ইংরেজ স্তাবকতা, কখনও বিদ্রোহী সিপাইদের কটাক্ষ, এও যেমন আছে, তেমনই আছে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শাণিত বিদ্রুপ। এছাড়া বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে সেই অভিজ্ঞতা সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে লিখতেন তিনি। লেখার শিরোনাম ছিল, ‘ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র’। পরবর্তীকালেও ঈশ্বর গুপ্তের অধিকাংশ রচনা ‘সংবাদ প্রভাকর’-এই প্রকাশিত হত।
উল্লেখ্য হল, সাংবাদিকতার মতোই সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঈশ্বর গুপ্ত এক যুগসন্ধিক্ষণের প্রতীক। মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের সূচনা— এই মধ্যবর্তী সময়টিকে বলা যেতে পারে বাংলা গদ্যের উদ্ভবকাল। গদ্য তখনও সাহিত্যের যথার্থ বাহনের উপযোগিতা অর্জন করেনি। এই সময়ের সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যেই বিরাজমান ছিল যুগসন্ধির বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর গুপ্তের কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল এই সময়েই। বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে সব্যসাচীর মত দু’হাতে দু’দিকে নির্দেশ দিয়েছেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। এই সময়ের একমাত্র খ্যাতিমান কবি তিনি। তাঁর ভাষা, অলঙ্কার, ছন্দ কিছুটা মধ্যযুগীয় হলেও তার সঙ্গে মিশেছিল সমকালীনতাও। সমাজ ও জীবনকে ব্যঙ্গবিদ্রুপের দৃষ্টিতে দেখতে পছন্দ করতেন ঈশ্বর গুপ্ত।
ঈশ্বরগুপ্ত ব্যঙ্গকবিতার জন্য অতুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কবিয়ালদের জন্য ‘সখীসংবাদ’ লিখেও তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তাঁর শখ ছিল প্রাচীন কবিদের জীবনী সংগ্রহ। ভারতচন্দ্র, রামনিধি গুপ্ত, হরু ঠাকুর প্রমুখের লুপ্তপ্রায় জীনবকথা তিনি উদ্ধার করেছিলেন। ইংরেজ আচার-আচরণকে অন্ধভাবে অনুকরণের প্রবণতাকে ব্যঙ্গ করে ‘ইংরেজি নববর্ষ’ কবিতায় লিখেছিলেন:
‘গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে।
ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁসে॥
রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম।
ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানী ড্যাম ড্যাম ড্যাম॥
পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম।
মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম?
শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম।
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্ ॥
ধন্যরে বোতলবাসি ধন্য লাল জল।
ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতার ফল॥’
মধ্যযুগীয় দেবত্মবাদ থেকে সাহিত্যকে বের করে এনে সাধারণের গুণে গুণান্বিত করে তুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর রচনা বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন,
“ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায়, রান্নাঘরের ধূয়ায়, নাটুরে মাঝির ধ্বজির ঠেলায়, নীলের দাদনে, হোটেলের খানায়, পাঁঠার অস্থিস্থিত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুর রস ছাড়া কাব্যরস পান, তপসে মাছে মৎস্যভাব ছাড়া তপস্বীভাব দেখেন, পাঁঠার বোকা গন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান।… ইহা তাঁহার সাম্রাজ্য এবং ইহাতে তিনি বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়।… আমার বিশ্বাস যে, তিনি যদি তাঁহার সমসাময়িক লেখক কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বা পরবর্তী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় সুশিক্ষিত হইতেন, তাহা হইলে তাহার সময়েই বাঙ্গালা সাহিত্য অনেক দূর অগ্রসর হইত। বাঙ্গালার উন্নতি আরও ত্রিশ বৎসর অগ্রসর হইত। তাঁহার রচনায় দুইটি অভাব দেখিয়া বড় দুঃখ হয়- মার্জিত রুচির অভাব এবং উচ্চ লক্ষ্যের অভাব। অনেকটাই ইয়ারকি। আধুনিক সামাজিক বানরদিগের ইয়ারকির মত ইয়ারকি নয়-প্রতিভাশালী মহাত্মার ইয়ারকি। তবু ইয়ারকি বটে।”

এর প্রমাণস্বরূপ তাঁর ‘নীলকর’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন দেওয়া যেতে পারে যেখানে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মতো গুরুতর বিষয় নিয়েও তিনি ঠাট্টার ছলি মহারানি ভিক্টোরিয়াকে বলছেন:
‘তুমি মা কল্পতরু,
আমরা সব পোষা গরু
শিখিনি শিং বাঁকানো,
কেবল খাব খোল বিচালী ঘাস।
যেন রাঙ্গা আমলা, তুলে মামলা,
গামলা ভাঙ্গে না;
আমরা ভুসি পেলেই খুসি হব,
ঘুসি খেলে বাঁচব না-’
তাই বহুমুখী এই প্রতিভাকে বিচার করতে দৃষ্টিও হতে হবে বহুমুখী। একদিকে যেমন তাঁর কিংয়দংশে নারীমুক্তি বিরোধী মনোভাব, ইংরেজের স্তাবকতার কথা মনে রাখতে হবে, অন্যদিকে একেবারেই ভুললে চলবে না তাঁর সাংবাদিক দৃষ্টিভঙ্গি, ইংরিজি বুলিকে আপন করে মাতৃভাষার অনাদর, ধর্মের নামে কাটাকাটির বিরুদ্ধ কলম ধরার সৎসাহসকে।
* তথ্যসূত্র: রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, ঈশ্বর গুপ্ত রচনাবলী প্রথম খণ্ড, সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র
*ছবি সৌজন্য: wikipedia, facebook, wikisource
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!
বাংলালাইভ আবার বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের অল্প আলোচিত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ভালো উদ্যোগ।