শূূূন্য দশকের শুরুতে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় একই সময়ে পড়াশোনা করেছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সৃজিত দু’বছরের সিনিয়র হলেও একসঙ্গে ক্যুইজ, নাটক ইত্যাদি অনেক কিছুই করেছিলেন দু’জনে। পেশায় কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রবীরেন্দ্র শেষ সতেরো বছর প্রবাসে কাটালেও খুব আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সৃজিতের লাগাতার উত্থান। হয়তো সেই আগ্রহ থেকেই জমে উঠেছিল অনেক প্রশ্ন। এই বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সেই সব প্রশ্ন নিয়েই প্রবীরেন্দ্র আড্ডা জমিয়েছিলেন সৃজিতের সঙ্গে। ‘ফেলুদা ফেরত’ ওয়েবসিরিজ নিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করেছিলেন সৃজিত। সেই আড্ডা ছাপার অক্ষরে রইল বাংলালাইভের পাঠকদের জন্য। বাংলা সিনেমার অন্যতম সফল পরিচালক নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছেন সব প্রশ্নের। অনুপম রায়ের গানের মতোই গভীরে ঢুকে আত্মদর্শন করেছেন। নিজে ভেবেছেন। ভাবিয়েছেন প্রবীরেন্দ্রকেও।
প্রবীরেন্দ্র: গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। তোমার প্রজন্মের অগ্রগণ্য পরিচালকরা সবাই নিজেদের লেখা গল্প নিয়েই মূলত কাজ করছেন। তোমাদের আগে অপর্ণা-ঋতুপর্ণরাও যত দিন গেছে নিজেদের গল্প নিয়েই কাজ করতে উৎসাহ দেখিয়েছেন। তার আগে কিন্তু এই ট্রেন্ডটা ছিল না। সত্যজিৎ-ঋত্বিকই হোক, বা তরুণ মজুমদার-তপন সিনহা, বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে তাঁরা অনেক বেশি খোঁজাখুঁজি করেছেন। এ বিষয়ে তোমার কী বক্তব্য?
সৃজিত: আমার মনে হয় এর দু’টো কারণ। প্রথমটা আমার কনজেকচার অবশ্য। কারণ বলা যাবে না। সমকালের যে প্রশ্ন এবং উত্তর আমাদের ভাবাচ্ছে, তার অনুরণন বা প্রতিফলন আমরা আগের ক্লাসিকসের মধ্যে কম পাচ্ছি। রাগ-দুঃখ-ঘৃণা-ভালোবাসা-ঈর্ষা ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠা বৃহত্তর দার্শনিক প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর অবশ্যই এখনও ক্লাসিকস দেবে। তাই জন্যই ধ্রুপদী সাহিত্য ধ্রুপদী। কিন্তু দৈনন্দিন সমস্যা বা ক্রাইসিসগুলো নিয়ে ভাবতে গেলে এ কথা মেনে নিতেই হবে কবীর সুমনের গান পুরনো গানের তুলনায় আমাদের অনেক কাছের হয়ে উঠেছে। সেই একই ব্যাপার। বর্তমান সময়ের প্রতিবিম্বটি ধরার জন্যই সম্ভবত আমরা চেষ্টা করছি নিজেদের গল্পটাই পর্দায় তুলে আনার। হতেই পারে সেটা করতে গিয়ে গল্পের কোয়ালিটি কখনও কখনও সাফার করছে, ক্লাসিক হয়ে উঠছে না।
প্রবীরেন্দ্র: আর ক্লাসিকস বাদ দিয়ে যদি ভাবো? সমসাময়িক সাহিত্য?

সৃজিত: কনটেম্পোরারি লিটারেচারের প্রসঙ্গেই আমার দ্বিতীয় পয়েন্ট। আমার ধারণা বইয়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ খুব কমে এসেছে। একজন সাধারণ মানুষ এখন খুব কম বই পড়েন। তাঁদের সাহিত্যের যে এক্সপোজার, সেটাও অনেক কমে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত লেখকদের নাম বলতে বললে তাঁরা মূলত সেই পুরনো লেখকদেরই নাম করবেন। সেই কারণেই হয়ত তিলোত্তমা মজুমদার ন্যায্য জায়গাটা পাচ্ছেন না। সবাই তো শ্রীজাত নয় যে সোশ্যাল মিডিয়ার দরুণ পাঠকদের সঙ্গে একটা গভীর যোগাযোগ রেখে যেতে পারবেন। তাছাড়া সাহিত্যনির্ভর সিনেমা কিন্তু শাঁখের করাতের মতন। মানুষ প্রথমেই ধরে নেবেন সিনেমাটা বইয়ের মতন ভালো হবে না। একটা ভালো বই পড়ে নিজের কাল্পনিক ইউনিভার্সে সেটা নিয়ে ভাবার জন্য অল্প কল্পনাশক্তি হলেই চলবে। এবার বইটাকেই হুবহু পর্দায় তুলে আনার মতন প্রযুক্তি আমাদের নেই। আবার আমি যেই নিজের ইন্টারপ্রিটেশন দিতে যাচ্ছি, দর্শক চটে যাচ্ছেন। “আমি তো বাপু সন্তুকে এরকম ভাবে দেখিনি”, “কই কাকাবাবু তো এরকম ছিলেন না” ইত্যাদি।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু নস্টালজিক ভ্যালু তো তোমাদের সাহায্য করতেই পারে? আর সব সময় যে বিশেষ প্রযুক্তির দরকার তাও তো নয়। ধরো এখনও যারা ‘বয় মিটস গার্ল’ গোত্রের সিনেমা বানিয়ে চলেছেন তাঁরা তো বুদ্ধদেব গুহর রোমান্টিক গল্প-উপন্যাসগুলোর কথা ভাবতেই পারেন। উপরন্তু সেখানে বনজঙ্গল আছে, অল্পবিস্তর অ্যাডভেঞ্চার আছে, প্রবাসের পটভূমিকা আছে। কিন্তু তাঁরাও তো বুদ্ধদেবের লেখা নিয়ে সিনেমা করার কথা ভাবছেন না!
সৃজিত: আমার মনে হয় দুনিয়াটা এতটাই অডিওভিস্যুয়াল হয়ে গেছে, যে দু’ঘন্টা সময় হাতে পেলেও আমরা নেটফ্লিক্সে একটা সিনেমা দেখব, একটা বই না পড়ে। আমি নিজেও সে দোষে দুষ্ট। যদিও এখন একটা চমৎকার বই পড়ছি – ‘স্যালভেশন অফ আ সেন্ট।’ আমার খুব প্রিয় জাপানি এক লেখকের বই……
প্রবীরেন্দ্র: আমিও পড়েছি। প্রথমটাও দারুণ লেগেছিল, ‘ডিভোশন অফ সাসপেক্ট এক্স।’
সৃজিত: দ্বিতীয়টাও অনবদ্য, ‘ম্যালিস’। স্যালভেশনটা তিন নম্বর। যাই হোক, এই বইটা আমি পড়ছি কারণ আমার ‘প্যারাসাইট’, ‘১৯১৭’ আর ‘জোজো র্যাবিট’ দেখা হয়ে গেছে। এদিকে বইমেলা থেকে কিন্তু আমি প্রচুর বই কিনেছি। প্রচুর ‘সন্দেশ’ কিনলাম। কিছু অরিজিনাল স্ক্রীনপ্লে-র কালেকশন কিনলাম। শ্রীজাতর নতুন কবিতার বই কিনলাম। বিদ্যুৎলতা বটব্যাল বলে এক নতুন গোয়েন্দা আত্মপ্রকাশ করেছেন (অধীশা সরকারের লেখা)। সেই বইটাও নিলাম। কিন্তু এই সব বাড়িতে এসে রেখে দিয়ে ‘বুক মাই শো’-তে গিয়ে দেখলাম ‘১৯১৭’-এর টিকেটটা পাওয়া যাচ্ছে কিনা। কারণ ওদিকেই আমার বেশি লোভ। বই তো পড়াই হয়ে উঠছে না।
প্রবীরেন্দ্র: তুমি কি চিরদিনই বই কম পড়তে? নাকি একটা পরিবর্তন এসেছে?

সৃজিত: এসেছে। কিন্তু সেটা হয়েছে, কারণ চারপাশের দুনিয়াটাও পাল্টে গিয়েছে। আগে খেতে খেতে বই না পড়লে আমার সত্যি বায়োলজিক্যালি অস্বস্তি হত। এখন পড়ার অভ্যাসটাই চলে গেছে। রেয়ারলি কিছু পড়ি। স্পৃহাটাই চলে গেছে।
প্রবীরেন্দ্র: তোমার বেশ পুরনো একটা ইন্টারভিউতে তোমাকে বলতে শুনেছিলাম তোমার মধ্যে সবসময় একটা মৃত্যুভয় কাজ করে। সেই মৃত্যুভয় থেকেই কী নিজের গল্প বলতে চাওয়ার এত তাগিদ? ভেবে চলেছ হাতে আর বেশি সময় নেই?
সৃজিত: একদম। এই মৃত্যুভয়টা এখন প্রত্যেক সেকেন্ডে জাঁকিয়ে বসছে। আমি মৃত্যু নিয়ে রোজ ভাবি। সাধ করে ভাবি না। কিন্তু ভাবনাটা চলে আসে।
প্রবীরেন্দ্র: এত মৃত্যুভয় কেন? এটা কি একটা ইনসিকিওরিটি নাকি ক্রিয়েটিভ জিনিয়াসদের যেমন…
সৃজিত: না না। জিনিয়াস টিনিয়াস নয়। আয়্যাম আ ভেরি অর্ডিনারি স্টোরিটেলার। আমি বলছি। আমি প্রতিদিন ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখি আমি মরে গেছি। এখানে ভয়টা কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণার নয়। ভয়টা ল্যাক অফ নলেজের। জানি না মরে গেলে কী হবে। ল্যাক অফ পাওয়ার-ও।
প্রবীরেন্দ্র: সম্পূর্ণভাবে ‘টেরা ইনকগনিটা’। কোনও আইডিয়াই নেই।
সৃজিত: এক্কেবারে তাই। প্যারালিসিস অফ ইওর কগনিটিভ সেন্সেস। আমি শুয়ে আছি। আমি হাত-পা নাড়াতে পারছি না। ভয়াবহ ব্যাপার। এইখানে ফিয়ার অফ স্টপিং এসে যাচ্ছে।
প্রবীরেন্দ্র: বুঝতে পারছি। এরকমটাও কী হতে পারে যে তুমি জানো তোমার ম্যাগনাম ওপাস এখনো আসেনি? দর্শক বা ক্রিটিকদের রেকগনিশন অনেকদিন ধরে পেলেও তুমি তোমার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নও। তাই নতুন গল্প বলার তাগিদ ক্রমাগত এসে যাচ্ছে?
সৃজিত: প্রচণ্ড ভাবে। একটু বেটার হতে পারে। আরও অনেক বেটার হতে পারে। এবং তারপরেই মনে হচ্ছে বেটার হওয়ার টাইমটুকুও নেই। তার আগেই মরে যাব। সিনেমার ভাষায় বলতে গেলে, হাফটাইম পেরিয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোচ্ছি। একটু পরেই আলো জ্বলে উঠবে। লোকজন এসে আমার ডেডবডিটা নিয়ে মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে চলে যাবে। আমি সেই বিশেষ ছবিটা বানিয়েই উঠতে পারলাম না। মাঝে মাঝে ভাবি যদি চাইল্ড প্রডিজি হতাম! বারো বছর বয়সে ‘অটোগ্রাফ’ বানানোর পরেও পঁচিশ-তিরিশ-পঞ্চাশ-ষাট বছর থাকতে পারত সেই সিনেমাটা বানানোর জন্য! কিন্তু অটোগ্রাফটা বানিয়ে উঠতে পারলাম তেত্রিশ বছর বয়সে। লাস্ট দশ বছরে আমি আঠারোটা সিনেমা বানিয়েছি, হুইচ ইস ফেয়ারলি প্রলিফিক। সেগুলোর মধ্যে চোদ্দোটা বক্স অফিসে বেশ ভালো সাফল্য পেয়েছে। আটটা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু সেই সিনেমাটা আমি এখনও বানিয়ে উঠতে পারিনি। ওটা বেসিকালি ‘গোডো।’
প্রবীরেন্দ্র: চিরন্তন অপেক্ষা। প্রসঙ্গত একটা কথা মনে এল। বহুবার হয়েছে আমি একটা লেকচার দিয়ে বেরিয়ে এসে ভেবেছি বেশ ভালো বলেছি। তারপর সেটার অডিও শুনতে গিয়ে দশ মিনিট পর বন্ধ করে দিয়েছি। ‘ম্যারেজ স্টোরি’-র অভিনেতা অ্যাডাম ড্রাইভার-এর কথাও ক’দিন আগে পড়ছিলাম। অ্যাডাম নিজের অভিনয় বসে দেখতেই পারেন না। প্রথম দিকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতেন। এখন দেখতেই অস্বীকার করেন। তোমারও কী এই অনুভূতিটা আসে? যখন বুঝতে পারলে যে এই সিনেমা সেই সিনেমা নয়, তখন কী একটা ডিট্যাচমেন্ট চলে আসে?
সৃজিত: ইট ইজ স্টিল মাই বেবি। আই ডোন্ট ডিসওন দেম। বাট আই ডোন্ট লিভ উইথ দেম ইদার। তাদের ভালো-মন্দ-শক্তি-দুর্বলতা সবই জানি। তাদের ছবি আমার বাড়িতে আছে। কিন্তু আমরা আলাদা বাড়িতে থাকি। তাদের বড় করার জন্য যা দরকার সবই করি। তারপর তারা আলাদা হয়ে যায়। একটা সি-হর্সের মতো রিপ্রোডাকটিভ সাইকল আমার।
প্রবীরেন্দ্র: সত্যিই তুমি অনেক কিছু কাজ একসঙ্গে করো। তুমি গল্প লিখছ, চিত্রনাট্য লিখছ, পরিচালনা তো করছই…
সৃজিত: লিরিক লিখছি। এডিট করছি। বেনামে কিছু গানে সুরও দিচ্ছি…
প্রবীরেন্দ্র: ঠিক কথা। কিন্তু তুমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলে, ‘থিয়োরি অফ কম্প্যারেটিভ অ্যাডভ্যান্টেজ’

তুমি জানো। তুমি এই যে এত কাজ একসঙ্গে করছ, এই ব্যাপারটা কিন্তু সেই থিয়োরি মানে না। কাজগুলো কী তুমি স্বেচ্ছায় করছ নাকি তোমার কলিগদের ওপর তুমি ভরসা রাখতে পারছ না?
সৃজিত: গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ এগুলো ধরলে অবশ্যই পুরো ভরসা রাখতে পারছি না। সবই যে অসুখি কোলাবরেশন তা নয়। যেমন একাধিক এডিটর আছেন যাদের হাতে আমি রাশ দিয়ে চলে যেতে পারি। এডিট করে ফার্স্ট কাট তৈরি করে দেবে। তারপর আমি বসব। ডিওপি (ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি) বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁদের আমি চোখ বুজে ভরসা করতে পারি। আর হ্যাঁ, ভালো আইডিয়া পেলে তো কোলাবরেট করিই। তবে মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষেত্রে নিড ছাড়াও একটা ইন্সটিংকটিভ কম্পালশন কাজ করে। না করে থাকতে পারি না। নিজে কাজটা না করলে অস্বস্তি হয়। যদিও জানি কাজটা করার লোক আছে। যেমন ট্রেলার কাটার এখন আলাদা এজেন্সি আছে। আমি কিন্তু আমার সিনেমার সব ট্রেলার নিজে কাটি। সব পোস্টারের ডিজাইন কিন্তু আমি করে পাঠাই। হতে পারে এটা একটা ডিজঅর্ডার। লাইটিং নিয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু অনেক সময় সেখানেও আমাকে কিছু বলতে হয়।
প্রবীরেন্দ্র: পুণের ফিল্ম ইন্সটিটিউট কোর্স করাচ্ছে। শেখাচ্ছে কী ভাবে চিত্রনাট্য লিখতে হয়। তুমি এরকম কোনও কোর্স করোনি কিন্তু। এখন নয় তুমি আঠারোটা সিনেমা করেছ। কিন্তু প্রথমে যখন মাল্টিটাস্কিং শুরু করলে, তখন কী ভাবে তুমি আত্মবিশ্বাসটা পেলে? কেন মনে হল তোমার পক্ষে সব কটা কাজই করা সম্ভব?
সৃজিত: আত্মবিশ্বাস ছিল না। ছিল স্রেফ বোকামি। সিনেমা বানানোর পেছনে অত ভাবনাচিন্তা কেউ করে কিনা আমি জানি না। আমি অন্তত করি না। কনশাসলি এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিইনি। একটা সিনেমা আমি বানাচ্ছি। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সেটার কী স্থান হবে, সেটা কী পাদটীকা হবে নাকি একটা অধ্যায় হবে, নাকি একটা পাসিং রেফারেন্স হবে, এটা কী ভুল হল করা, নাকি ঠিক হল, এসব নিয়ে ভাবিনি। ভাবি না। আমি laissez faire (লেসেফেয়ার) অ্যাপ্রোচে বিশ্বাসী। মানুষ বলে দেবে ঠিক হচ্ছে না ভুল হচ্ছে।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু তুমি না চাইলেও তোমার কাঁধে একটা গুরুভার রয়েছে। নয় কী? যেমন ধরো, তামিল নিউ ওয়েভ হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে মরাঠিতে একের পর এক অন্য স্বাদের, অন্য ধাঁচের সিনেমা বানানো হচ্ছে। বাংলায় সেরকম কিছু হচ্ছে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। যাঁরা তোমার সমালোচক, অনেকে অবশ্য খুব চটজলদিও সমালোচনা করে ফেলেন, তাঁরা এইসব তামিল-মরাঠি সিনেমার সঙ্গে তোমার কাজের তুলনা করছেন।
সৃজিত: সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে মারো গোলি। সৌকর্য ঘোষাল কী ভালো সিনেমা বানাচ্ছে! আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্ত কী ভালো সিনেমা বানাচ্ছে! ইন্দ্রাশিস আচার্য কী দারুণ কাজ করছে……
প্রবীরেন্দ্র: তুমি জড়িয়ে পড়তে না চাইলেও বহু বাঙালি দর্শক এটা বিশ্বাস করেন, আজকের বাঙালি সিনেমার মুখ হচ্ছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়……
সৃজিত: এই কারণেই প্লাস্টিক সার্জারির জন্য টাকা জমাচ্ছি। এই চাপটা নেওয়া যায় না। মুখ তাই বদলে ফেলতে হবে। সেইজন্যই লোকে যখন আমাকে মাস্টারক্লাস নিতে বলে, আমি ভাবি কী বলব। আমি ফার্স্ট ইয়ার-ও নয়, ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র।
প্রবীরেন্দ্র: এটা তোমার বিনয় নয়?
সৃজিত: একেবারেই নয়। এটা আমার অসহায়তা। যে গুরুভারের কথা হচ্ছিল সেটা আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমি তো নিজে থেকে নিতে চাইনি। আমি শুধু সিনেমা বানাতে চেয়েছি। কিছু একটা ভাবে আমার সিনেমাগুলো বক্স অফিসে বাজিমাত করতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ডাক পেয়েছে। জাতীয় স্তরে একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছে– এই সাফল্যটা দুর্লভ। এই ত্র্যহস্পর্শটা চট করে হয় না। আমার ক্ষেত্রে কেন হয়েছে আমি জানি না।
প্রবীরেন্দ্র: আমি একটা ঘটনা বলি। আমার এক দিদির সঙ্গে ‘গুমনামি’ দেখতে গেছিলাম। আমি সিনেমাটা খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। আমার নিজের যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেটার সঙ্গে সিনেমাটার দৃষ্টিভঙ্গি মিলছে কিনা, না মিললে কেন মিলছে না ইত্যাদি ভাবছি। ভাবনাটা হয়ত সিনেমার শেষেও বেশ কিছুক্ষণ চলত। কিন্তু চলল না। কারণ দেখলাম আমার সেই দিদি তোমার সিনেমাটা দেখে কাঁদছেন। তোমাকে এতদিন ধরে চিনি। তুমি জেএনইউ-তে আমার সিনিয়র ছিলে। তোমার নির্দেশনায় ইউনিভার্সিটিতে কত নাটক করেছি। একসঙ্গে ক্যুইজ করেছি। তাই তোমার কাজ নিয়ে একটা বায়াস আছেই। কিন্তু এই জাতীয় ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট নেই। হ্যাঁ, কিছু সিনেমা অবশ্যই উপভোগ করেছি। বাইশে শ্রাবণ দেখে তোমাকে ই-মেল করে ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি না তোমার সিনেমা দেখে আমি কখনও কাঁদব কিনা। কিন্তু অনলাইনের বিভিন্ন ফোরামে আলোচনার পর আলোচনা দেখে আমি এটুকু জানি আমার সেই দিদির মতন আরও অনেকেই তোমার সিনেমা দেখে কখনও না কখনও কেঁদেছেন।
সৃজিত: আমি নিজেও কিন্তু নিজের সিনেমা দেখে কাঁদি।
প্রবীরেন্দ্র: সত্যি কাঁদো?

সৃজিত: সত্যি কাঁদি। আমি গুমনামি দেখে কেঁদেছি। রাজকাহিনীর ক্লাইম্যাক্সে যতবার দরজাটা বন্ধ হয় আমি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে পাগলের মতো কাঁদি। একটা জিনিস বুঝতে হবে। আমি ইন্টেলেকচুয়াল নই। আমি ইন্টেলেকচুয়ালদের জন্য সিনেমা বানাই না। আমি অবশ্য অন্যের সিনেমা দেখেও কাঁদি। অঝোরে কাঁদি। আমি ‘সিনেমাওয়ালা’ দেখে কেঁদেছি। আমি ‘নগরকীর্তন’ দেখে কেঁদেছি। ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’ দেখে আমার এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। আমি নিজে ইমোশনাল তো বটেই, সেই সঙ্গে একটা শিশুসুলভ উত্তেজনাও থাকে। একটা শট আরেক শটে ডিসলভড হতে দেখে আমার হাততালি দিতে ইচ্ছে করে। একটা টাইট শটে একজন হাত তুলছে, লং শটে সেই হাত তোলাটা কন্টিনিউ করছে। একে বলে ‘ম্যাচ কাট’। এরকম ম্যাচ কাট দেখে মনে হয় আমার বয়স বারো আর আমি মহাজাতি সদনে বসে পিসি সরকারের ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’ দেখছি। সিনেমা আমার কাছে ম্যাজিক। এই যে আজ সন্ধ্যাবেলা ফেলুদার ডাবিং করছিলাম, এটাও একটা ম্যাজিক। সম্পূর্ণ অন্য দিনে তোলা একটা সিনে অন্য আর এক দিনে তোলা গলা বসছে। এরপর কাঠমান্ডুর বাজারের শব্দ আলাদা করে বসবে। সব মিলিয়ে একটা অন্য ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হবে। এটা ম্যাজিক না? এই অন্য ব্রহ্মাণ্ডে ফেলুদা হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেখানে কাকাবাবু আছে। সেখানে প্রবীর রায়চৌধুরী আছে। নেতাজিও আছেন। এই ম্যাজিকটা আছে বলে কোনও সমালোচনাই গায়ে লাগে না। আমার তো টানা সিনেমা বানিয়ে যাওয়ার প্ল্যানও নেই। ইংরেজি বর্ণমালার ছাব্বিশটা অক্ষরের প্রতিটা দিয়ে একটা করে সিনেমা বানিয়ে আমি থামব, এই হল প্ল্যান। ‘বেগমজান’ আর ‘বাইশে শ্রাবণ’ হয়েছে বলে ব্যাপারটা ছাব্বিশের জায়গায় সাতাশে চলে গেছে। সাতাশ যখন হয়েই গেছে, ওটা রাউন্ড অফ করে তিরিশটা সিনেমা বানিয়ে আমি থামব।
প্রবীরেন্দ্র: এই ছাব্বিশ-সাতাশের খেয়ালটা কোন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের? যে চুটিয়ে ক্যাও-কুইজ করত, পানিং যার ভীষণ প্রিয়, সেই তার? নাকি অন্য কেউ?
সৃজিত: একেবারেই সেই সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের। এবং সেই সৃজিত মুখোপাধ্যায় যার সিরিয়াল কিলিং নিয়ে বেশ ভালো পড়াশোনা আছে। তাই একটা প্যাটার্ন খুঁজে বার করছে। করেই যাচ্ছে। ‘এল’ দিয়ে ‘লকীর’ বানাতে চেয়েছিলাম। করে দিল বেগমজান। তাই চৈতন্য আর নটী বিনোদিনীর ডাবল বায়োপিক যেটা করছি তার নাম দিলাম ‘লহ চৈতন্যের নাম রে’। টি দিয়ে ‘দ্য মান্টো মার্ডারস’ নামে একটা কাজ করার প্ল্যান আছে। লেখা হয়েও গেছে। এক্স দিয়ে ‘এক্সরে’ বলে একটা কাজ নেটফ্লিক্সের জন্য করছি। তাই অনেকটাই হয়ে গেছে। ডাব্লিউটা নিয়েই এখন ভাবনাচিন্তা চলছে। আমি তাই সিনেমা একদমই সিরিয়াস মুখে বানাচ্ছি না। প্রচুর হাসিঠাট্টামজা করতে করতেই কাজগুলো করছি।
প্রবীরেন্দ্র: তাহলে যে গুরুভারের কথা হচ্ছিল, সেটা তোমার কাজকে একেবারেই প্রভাবিত করছে না?
সৃজিত: কাজকে প্রভাবিত করছে না, কিন্তু মানসিক অশান্তি বাড়াচ্ছে। এতরকমের পরস্পরবিরোধী মতামত! আমি এটাই বলি সবাইকে– ভালো-খারাপ যা-ই লাগুক আমাকে অযথা টেনো না। আপনি যেই দেখে ফেলছেন, তখনই সিনেমাটা আপনার হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ভালোমন্দ কিছুই বলতে হবে না। ট্রেলার দেখেই তো আপনার ঠিক করে ফেলা উচিত সিনেমাটা দেখবেন কি দেখবেন না। যদি আমার পাঁচটা পরপর সিনেমা দেখে খুব নিরাশ হয়ে থাকেন, তাহলে কেন ফের পয়সা খরচ করে ছ’নম্বর সিনেমাটা দেখতে যাচ্ছেন? আমি পায়ে পড়ছি আপনি দেখবেন না। আমি তো বলছি না, আমি সমস্ত ছবি ভালো বানিয়েছি। এরকম বহুবার হয়েছে নিজের সিনেমার বেশ কিছু জায়গা দেখে চোখ ঢেকে ফেলেছি। এদিক ওদিক তাকিয়েছি। পাশে যে বসে আছে তার সঙ্গে কথা বলে তার মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করেছি।
প্রবীরেন্দ্র: বহুবার হয়েছে? কিছু উদাহরণ?
সৃজিত: প্রচুর, প্রচুর। এই তো ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ সিনেমাটায় একটা ডায়ালগ ছিল, “আপনি ওনাকে মার্ডার স্পটে ডেকেছেন।” সেটা কিছুভাবে, সম্ভবত ইম্প্রোভাইজ করতে গিয়ে ফাইনালি হয়ে গেল, “আপনি ওনাকে ফোন করে মার্ডার স্পটে ডেকেছেন।” এই ‘ফোন করে’ অ্যাডিশনটা পুরো লজিকে একটা খুঁত এনে দিল। ফোন করলেই তো গলা চিনে যাবে! কারণ যে ফোন করছে সে তো আর মিমিক্রি আর্টিস্ট নয়! এটা একটা জেনুইন মিসটেক।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু হতেই তো পারে তুমি তোমার নিজের কাজ বলে বেশি খুঁটিয়ে দেখছ। এই উদাহরণটা ধরে বলছি না, কিন্তু অন্য সময় হয়তো দর্শক সেই খুঁতগুলো ধরতেই পারছে না।
সৃজিত: ধরতে পারছে না মানে? সবসময় পারছে। দর্শকরাই তো বলে। বারবার বলে। তারা যেভাবে আমার ছবি দেখে আমি নিজেও অত খুঁটিয়ে দেখি না। গুমনামিতে একটা দৃশ্য আছে, আমি ব্যোমকেশ পড়ছি। ২০০৩ সালে। দর্শক আমাকে বলেছে “দাদা, যে ব্যোমকেশ সমগ্রটা পড়ছিলেন সেটার প্রচ্ছদটা কিন্তু ২০১১ সালের। ২০০৩ সালে অন্য কাভার ছিল।” আই হ্যাড আ গুড লাফ। কিন্তু সারাজীবন গুমনামি দেখতে গেলেই জিনিসটা ভাবাবে।
প্রবীরেন্দ্র: এরকম ভাবে ভাবতে পারো যে এই ফিডব্যাকগুলো তোমার ‘অ্যাটেনশন টু ডিটেইল’ ব্যাপারটা আরও নিখুঁত করে তুলছে। কিন্তু এই ভুলগুলো কী মাল্টিটাস্কিং এর জন্যই হচ্ছে?

সৃজিত: আমি ডিটেলের দিকে খুবই নজর দিই। কিন্তু কখনওসখনও ভুল হয়ে যায়। আর মাল্টিটাস্কিংটা ইস্যু নয়। আমি যখন বছরে একটা করে সিনেমা বানাতাম, তখনও এরকম ভুল হয়েছে। বেন-হার সিনেমায় যেমন সেই রথের দৌড়ের সময় দেখা গেছিল প্লেন উড়ে যাচ্ছে, সেই ধরণের ভুল আর কি!
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু বছরে একটা করেই বা করতে হবে কেন? দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন চার বছরে একটা সিনেমা বানাচ্ছেন……
সৃজিত: উনি তো মাঝের সময়টা অ্যাডফিল্ম বানাচ্ছেন। উনুন তো ধরাতে হবে। এবার সেটা প্রচার পায় না অ্যাড ফিল্ম বলে। আমি অ্যাড ফিল্ম করি না বা আমাকে কেউ ডাকে না বানাতে। অবশ্য ডাকলেও মনে হয় না করতাম। কারণ আগেই বলছিলাম আমি গল্প বলে যেতে চাই। তাছাড়া আমার ক্যাপাসিটি-ও তো বেড়েছে। আমার এখন একটা ফিক্সড টিম আছে। এদের অধিকাংশই আমার সঙ্গে প্রথম থেকে রয়ে গেছে। আমার অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর সৌম্য যেমন আমার সঙ্গে আছে ‘অটোগ্রাফ’ থেকে। সোহিনী শেষ পাঁচটা ছবিতে আমার সঙ্গে কাজ করেছে। অনেকে তৈরি হয়ে আসে। অনেককে গ্রুমিং করতে হয়। তো এদের দিকটাও তো আমাকে ভাবতে হবে। তাদেরকে তো আমায় মাইনে দিয়ে যেতে হবে, যখন কাজ নেই তখনও।
প্রবীরেন্দ্র: আগেকার দিনের পরিচালকদের নিয়ে যেরকম পড়ি, মায়ের টাকা নিয়ে বৌয়ের গয়না বন্ধক দিয়ে সিনেমা বানাতে হয়েছিল, তোমারও কী সেরকম অবস্থা হয়েছিল? শুরুর দিকে?
সৃজিত: থ্যাঙ্কফুলি না। যখন চাকরি ছেড়েছিলাম তখন আমার একটা সেভিংস ছিল। হিসেব কষে দেখেছিলাম এই সেভিংস নিয়ে আমি এক বছর লড়তে পারব। তার মধ্যে কিছু না দাঁড়ালে অন্য পেশায় চলে যাব। বাংলা সিনেমার পরিচালক হব, এই উচ্চাশা কখনই ছিল না। ‘অটোগ্রাফ’ বানাতে গিয়ে ভেবেছিলাম বন্ধু, আত্মীয়স্বজন দেখবে সিনেমাটা। এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তারপর ক্রিকেট জার্নালিজমে চলে যাব।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু পরিচালক না হতে চাইলেও, এটা ঘটনা যে তুমি যখন ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করছ তখন ওখানকার নাটকমহলে তোমার বেশ নাম। রাস্তায় বড় বড় হোর্ডিং পড়েছে, যেখানে তোমাকে অভিনেতা হিসাবে দেখা যাচ্ছে। কোনো সুপ্ত বাসনাই ছিল না বলতে চাইছ?
সৃজিত: না। কোনও বাসনাই ছিল না। বেড়াতে যাওয়া, ক্রিকেট দেখা, আর ভালো খাওয়াদাওয়া ছাড়া। আমি অর্থনীতি কেন পড়েছিলাম? তখনও কোনও বাসনা ছিল না। আমার বন্ধুরা পড়তে যাচ্ছিল। আমিও বললাম “চ যাই”। আমার জীবনটা এভাবেই কেটেছে। গল্প বলার তাগিদটা অবশ্য সব সময়েই ছিল। নাটক করতে গিয়ে মনে হয়েছিল সব ধরনের গল্প বলতে পারছি না। চার দেওয়ালের প্রসেনিয়ামে আটকে যাচ্ছে কিছু গল্প। এসেনশিয়ালি আমি একজন স্টোরিটেলার।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু গল্প তো তুমি লিখেও শোনাতে পারতে পাঠকদের। নয় কী? যে গল্প লিটারেরি ম্যাগাজিনে ছাপা হতে পারত। সত্যজিৎ তো ছেড়েই দাও। সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে ঋতুপর্ণ-ও ‘ফার্স্ট পার্সন’-এ দারুণ লিখতেন! সেসব যদিও গল্প নয়।
সৃজিত: ব্যাপারটা যে মাথায় আসেনি তা নয়। ‘রাজকাহিনী’ ভেবেছিলাম গল্পাকারেই লিখব। কিন্তু সিনেমা মিডিয়ামটায় যে বৈচিত্র্য আছে, যে জোরদার একটা ব্যাপার আছে, সেটা আমি অন্য মিডিয়ামে পাই না। স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে সাদা কালো অক্ষরে ওই যে গল্পটা আটকে থাকল, তাতে পুরো স্যাটিসফ্যাকশনটা পেলাম না। সৃষ্ট চরিত্রদের রক্তমাংসের চেহারায় দেখার আনন্দটাই আলাদা। তাছাড়া সিনেমা মিডিয়ামটা আমার অনেক বেশি হিউমেন মনে হয়। গল্প নিজে লিখলাম ঠিক আছে। কিন্তু সিনেমায় শুধু তো আমার গল্প নেই। আছে আরও কত মানুষের শ্রম, আরও কত মানুষের শরীর।
প্রবীরেন্দ্র: কিছুটা হলেও ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের ব্যাপার থাকতে পারে কী? মানে সিনেমা বানিয়ে তুমি যত তাড়াতাড়ি মানুষের মতামত পাবে এবং যত বেশি মানুষের মতামত পাবে সেটা শুধু গল্প লিখে পাবে না?
সৃজিত: আমার ধারণা গল্প থেকেই বরং আরও তাড়াতাড়ি মতামত পাওয়ার সম্ভাবনা। সিনেমাটা বানাতে কত বেশি সময় লাগছে! একটা যুদ্ধ প্রায়। আর এই যুদ্ধটা আমি ভালোবাসি।
প্রবীরেন্দ্র: গল্প, চিত্রনাট্য নিয়ে বেশ কিছু কথা হল। সংলাপে আসি। তোমার সিনেমা দেখতে গিয়ে বহুবারই মনে হয়েছে তোমার সৃষ্ট চরিত্রগুলো যেন তোমার মতো করেই কথা বলছে। এটা কি আমার ভুল, নাকি তুমি এটা জানো বা জেনেই করো?
সৃজিত: শুরুতে এটা একটা একটা দোষ ছিল। ‘অটোগ্রাফ’ করার পরেই বুঝেছিলাম। আসলে প্রথম ছবির লোভটা সামলাতে পারিনি। প্রথম ছবিতে সব কিছু করে ফেলার একটা সাঙ্ঘাতিক চেষ্টা থাকে। প্রত্যেকটা সংলাপই সেখানে স্পেশ্যাল। কিন্তু বাস্তবে তো সেটা হয় না। তাই কানে লাগবেই।

প্রবীরেন্দ্র: অনীক দত্তর সিনেমা দেখতে গিয়েও এটা মনে হয়েছে। এত ঘন ঘন পানিং, এত ওয়র্ড ট্যুইস্ট। আমি ওঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু মনে হয়েছে মানুষটির নিজেরই সম্ভবত এই বিষয়গুলিতে ইন্টারেস্ট আছে।
সৃজিত: ইন্টারেস্ট তো আছেই। কিন্তু অনীকদা’র সিনেমার স্ট্রাকচারগুলো অনীক দা’কে হেল্প করে। আমার সেই সুবিধা নেই। তাই ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ ব্যাপারটা আরেকটু কমালাম, ‘হেমলক সোসাইটি’ তে পুরো ব্যাপারটাই পুঞ্জীভূত করলাম আনন্দ করের চরিত্রটায়। এখনও ওই একটা-দুটো চরিত্রের মধ্যেই ব্যাপারটা রেখে দেওয়ার চেষ্টা করি। আর ঐতিহাসিক সিনেমাগুলোও করতে শুরু করলাম এই সমস্যাটা দূর করার জন্য। স্মার্ট, ক্যাচি ডায়লগ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা।
প্রবীরেন্দ্র: ইন্টারেস্টিং! আমার ধারনা ছিল না তুমি এই ব্যাপারটা জানো বলে। আর সেটা নিয়ে এতটা ভেবেছ শুনে দারুণ লাগল।
সৃজিত: প্রচুর ভেবেছি। ‘এক যে ছিল রাজা’-তে আমার ধারনা একটাও ওরকম সংলাপ পাওয়া যাবে না। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর পক্ষে ওরকম সংলাপ বলা সম্ভব নয়।
প্রবীরেন্দ্র: সেলফ-প্রোজেকশনের কথাই যখন হচ্ছে, তোমার ক্যামিও চরিত্রগুলো কী স্রেফ মজার ছলেই আসে? নাকি হিচকককে অনুসরণ করার একটা ইচ্ছে ছিল?
সৃজিত: হিচকককেও নয়, সুভাষ ঘাইকেও নয়। (হাসি) ‘অটোগ্রাফ’-এর ক্যামিও রোলটা দায়ে পড়ে করতে হয়েছিল। যে জুনিয়র আর্টিস্টের ড্রাইভার হওয়ার কথা ছিল তিনি এলেনই না। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ আবার আমার চরিত্রে যিনি কাজ করছিলেন তিনি এত খারাপ অভিনয় করছিলেন যে বুম্বাদা, পরম সবাই বিরক্ত হচ্ছিল। শেষে পরম বলল, “ঋজুদা, তুমিই করে দাও।” তারপর থেকে ব্যাপারটা রিচুয়ালে দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রবীরেন্দ্র: বুম্বাদা যখন এসেই পড়লেন এই প্রশ্নটা করতেই হবে। তুমি কুরোসাওয়া হলে… বাই দ্য ওয়ে, কুরোসাওয়া বললাম সুগত বসুর কিউ ধরে (সৃজিতের অট্টহাস্য)… বুম্বাদা কী তোমার তোশিরো মিফুনে?
সৃজিত: না। আমার মনে হয় বুম্বাদা, যিশু, পরম আর অনির্বাণ এই চারজনেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আমার সিনেমায় করেছে। এই চারজনেই আমার ফেভরিট অভিনেতা। তবে চরিত্রের ওপর নির্ভর করে।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু এতদিন ধরে এই যে সৃজিত-প্রসেনজিৎ জুটির কথা মিডিয়া বারবার বলে চলেছে?

সৃজিত: বিজনেস। পুরোপুরি ভাবে। সেখানেও একটা কথা বলার আছে। চারটে জুটির মধ্যে কিন্তু বক্স-অফিসের হিসাবে সবথেকে সফল জুটি আমার আর পরমের। ইন ফ্যাক্ট, আমার-বুম্বাদার বা আমার-অনির্বাণের সাফল্যও রীতিমতো ভালো। যিশুর সঙ্গে আমার জুটি বক্স-অফিসে অতটা ভালো করতে পারেনি।
প্রবীরেন্দ্র: কিন্তু যিশুর পুনরুত্থান তোমার হাত ধরেই।
সৃজিত: হ্যাঁ। যিশু, চিরঞ্জিৎ, ইভেন বুম্বাদা। বুম্বাদার বেশ ব্যাড প্যাচ চলছিল অটোগ্রাফের সময়। রাজকাহিনীতে ঋতু-র একটা কামব্যাক হয়। রুদ্রনীলের কথাও ধরতে হবে। ‘ভিঞ্চি দা’ ওর জন্য কামব্যাক রোল।
প্রবীরেন্দ্র: এবার একটু কনটেন্ট নিয়ে কথা হোক। তোমার সিনেমায় ভায়োলেন্স যেভাবে এসেছে, বাংলা সিনেমা তা আগে দেখেনি। তুমি কি ইচ্ছাকৃতভাবেই সেটা এনেছ নাকি গল্পের খাতিরে?
সৃজিত: আমার মধ্যেই তো প্রচুর ভায়োলেন্স। অনেক ভায়োলেন্ট জিনিস পড়েছি। অনেক ভায়োলেন্ট জিনিস দেখেছি। আমি যে পাড়ায় বড় হয়েছি সেটাই বেশ ভায়োলেন্ট ছিল। ভবানীপুরের গলির মধ্যে গ্যাং-ওয়ার দেখেছি আমি। আমার ছোটোবেলা থেকে থ্রিলারের প্রতিও একটা ঝোঁক ছিল।
প্রবীরেন্দ্র: আমি শুধু ফিজিক্যাল ভায়োলেন্স বলছি না কিন্তু। সত্যজিৎ থেকে শুরু করে তরুণ মজুমদার হয়ে ঋতুপর্ণ কারও সিনেমাতেই এত অনায়াসে শ-কার, ব-কার আসেনি। অফকোর্স, তাঁদের আপাত পরিশীলিত কাজের মধ্যেও অনেক লেয়ারস ছিল। কিন্তু তারপরেও…
সৃজিত: হ্যাঁ, লিঙ্গুইস্টিক ভায়োলেন্স আমি বাংলা সিনেমায় এনেছি। কিন্তু কোনও বিপ্লব ঘটানোর ইচ্ছে ছিল না। আপনাআপনিই এসেছে। আমার আলাপ কিন্তু অনেক রকম স্ট্রেটার মানুষের সঙ্গেই ছিল। আছেও। আমি ক্রিকেট খেলেছি বস্তির ছেলেদের সঙ্গে। আই কাম ফ্রম আ ব্রোকেন হোম। তাই বাড়িতেও প্রচুর ভায়োলেন্ট সিনস দেখতে হয়েছে। অতএব আমার পৃথিবীটাই আমার সিনেমায় ধরা পড়েছে। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে আমার বাবা-মা দু’জনেই অধ্যাপক ছিলেন। তাই শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর ভাষাও আমার ভালোমতো আয়ত্তে আছে। আমার জীবনটা অ্যাকচুয়ালি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (হাসি)। বাংলা কবিতাও আছে, খিস্তিও আছে, রক্তপাত, নৃশংসতা সব আছে।
(চলবে)
(ছবি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)
প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক। অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন সংবাপত্রে অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবীরেন্দ্র। এছাড়াও লিখেছেন একাধিক কল্পবিজ্ঞান ও রহস্যকাহিনী। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি হল 'বাইট বিলাস', 'ক্যুইজ্ঝটিকা', 'পরিচয়ের আড্ডায়', 'আবার ফেলুদা, আবার ব্যোমকেশ', এবং 'চার'।
Heavy laglo… waiting for the next
The second part is already live. You can read it here https://banglalive.today/first-person-part-two/