কলকাতা শহরে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা মিত্র ও ঘোষ। সংস্থার খ্যাতি ছাপিয়ে গেছে তার কর্ণধার শ্রীসবিতেন্দ্রনাথ রায়ের সুপরিচিতি। প্রকাশনা জগতের সঙ্গে সামান্য যোগসূত্রও যার আছে, তিনিই চেনেন ভানুদাকে। শ্রীসবিতেন্দ্রনাথ রায় ভানুদা নামেই বিখ্যাত। বাংলা সাহিত্য সম্ভারের বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলি তাঁর প্রকাশনা সংস্থার অবদান। বইপাড়ার ইতিহাস এবং প্রকাশনা জগতের ইতিবৃত্ত রচনা করলে ভানুদা তার বিরাট অংশ জুড়ে— থাকবেন। তাঁর সুদীর্ঘ প্রকাশক জীবনের ইতিকথা আলাপচারিতায় উপস্থাপিত করলেন কবি বিভাস রায়চৌধুরী।



বিভাস রায়চৌধুরী
: বাংলা প্রকাশনা জগতে আপনি জীবন্ত কিংবদন্তি। সেই কিশোর বেলা থেকে আজও কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় আপনি উপস্থিত। অসুস্থতা অগ্রাহ্য করেও বইপাড়ার সঙ্গে আজও ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার পেছনে নিশ্চিত তীব্র ভালবাসা আছে। কীভাবে এই ভালবাসা জন্মাল? বইপাড়ায় পা রাখার ইতিহাসটা বলুন।

সবিতেন্দ্রনাথ রায়ঃ সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের স্ত্রী প্রতিমা মিত্রের কাছে আমি পড়তাম। কাকিমা প্রতিমা মিত্র ছিলেন সেকালের বেথুন কলেজের গ্রাজুয়েট। বাড়িতে অনেককে পড়াতেন। মা গিয়ে বলতে উনি রাজি হয়ে যান। সেই আমার জীবনের নতুন দিগন্তের শুরু। ওই বাড়িতে আমি প্রথম বিভূতিভূষণকে দেখি। নামী সাহিত্যিকদের নিত্য যাওয়া-আসা ছিল ওই বাড়িতে। কাকিমার কাছে পড়তে গিয়ে আমি যেন এক স্বপ্নের জগতের স্পর্শ পেতাম। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হবার পর কাকিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে পরীক্ষায় পাশ করবার পর আমি কী করব। আমাদের বাড়িতে যে আর্থিক টানাটানি আছে তিনি জানতেন। আমি তাঁকে বললাম যে রাতের কলেজে ভর্তি হতে চাই, যাতে দিনের বেলায় আমি কোথাও কাজ করতে পারি। তখন কাকিমা, কাকাবাবু গজেন্দ্রকুমার মিত্রকে বলে ‘মিত্র ও ঘোষ’-এ আমার একটা কাজ ঠিক করে দিলেন। সেই যে ১৯৪৯ সালের মে মাসে মিত্র ও ঘোষ-এ কাজের সূত্রে প্রবেশ করলাম, বইপাড়া চলে এলাম, সেই অল্প বয়স থেকে আজও বইপাড়ায় আছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা লেখা আছে আমার ‘কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে।




বিভাস রায়চৌধুরী
: আমরা জানি আপনার প্রিয় মানুষ, জীবন-অভিভাবক সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র।

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: জন্মদাতা অন্নদাতা আশ্রয়দাতা শিক্ষাদাতা – এইরকম পিতার কথা শাস্ত্রে বলে। গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং তদীয় পত্নী শ্রীমতী প্রতিমা মিত্র আমার শিক্ষাদাতা ও আশ্রয়দাতা দুইই। তাঁদের হাত ধরেই আমার বই-জগতে প্রবেশ। প্রকাশন সম্বন্ধে যাবতীয় শিক্ষা। গজেন্দ্রকুমার নিজেও কষ্টে মানুষ হয়েছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন, স্বপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন, বিরাট প্রকাশনা তৈরি করেছেন এবং আমার মতো আরও অনেককে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি যেমন সাহিত্যিক তেমনই মহান মানুষ। কত লেখক তৈরি করেছেন এবং কত লেখকের বন্ধু ও সহায় ছিলেন ইয়ত্তা নেই। তাঁর হাতেই আমার প্রকাশন শিক্ষা। এবং যা কিছু সাহিত্য রচনা অর্থাৎ গ্রন্থ রচনা, তার প্রেরণাও জুগিয়েছেন গজেন্দ্রকুমার ও তদীয় পত্নী প্রতিমা মিত্র।

বিভাস রায়চৌধুরী: সেই সময়ের কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় বড় প্রকাশনা সংস্থা ছিল কারা? প্রকাশকে-প্রকাশকে সম্পর্ক কেমন ছিল?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: প্রকাশকে-প্রকাশকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন ছিল, হৃদ্যতাও তেমনই ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি বেঙ্গল পাবলিশার্স তখন আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার অন্যতম অংশীদার লেখক মনোজ বসু আমাদের আড্ডায় এসে আড্ডা দিতেন। সমসাময়িক প্রকাশকদের মধ্যে ছিলেন বেঙ্গল পাবলিশার্স, নিউ এজ, সিগনেট প্রেস, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, ডি এম লাইব্রেরী।

আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সান্ধ্য আইন দেখেছি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছি। দেশভাগ দেখেছি। নকশাল আন্দোলন দেখেছি। তখনও বইবাজারে চরম মন্দা এসেছে। কিন্তু সেসব সাময়িক। বইবাজার আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আবারও কাউন্টারে কাউন্টারে ক্রেতা আসছে। একই সঙ্গে অনলাইন মার্কেটিং ব্যবস্থা এসেছে। বইবাজার অবশ্যই বাঁচবে।

Bhanuda Sabitendra Roy Mitra O Ghosh
কলকাতা বইমেলায় কন্যা ইন্দ্রাণীর সঙ্গে। ছবি সৌজন্য়ে ফেসবুক। 

বিভাস রায়চৌধুরী: আপনার লেখা বইতে অনেক কথা আমরা পড়েছি। প্রকাশন দপ্তরে সাহিত্যিকদের আড্ডার সেইসব গল্প স্বপ্নের মতো লাগে। দু’-একটি গল্প বলুন।

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: কাকাবাবু গজেন্দ্রকুমার মিত্রই আমার জীবনে দেখা প্রথম লেখক। কাকিমার বাড়ি পড়তে গিয়ে আমি প্রথম অনেক সাহিত্যিককে চিনি। সাহিত্যের আড্ডায় আসতেন তাঁরা। কাকাবাবুর লেখকবন্ধু সুমথনাথ ঘোষ তো আসতেনই, তাঁরা দুই বন্ধু মিলেই গড়ে তুলেছিলেন মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স। এছাড়া গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, প্রবোধকুমার সান্যাল। ১৯৪৮-এ বিভূতিভূষণের জন্মদিন পালিত হয় এই বাড়িতে। সেদিন কাকিমার কাছে পড়া ছিল না, কিন্তু কাকিমা বিকেলে যেতে বলেছিলেন। সেদিন গিয়ে দেখেছিলাম এক কিশোরের চোখে, ঘরভর্তি সব নামী সাহিত্যিক। সজনীকান্ত দাস, বাণী রায়, জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। লেখকরা পুজোর পর বেড়াতে যেতেন এদিক-ওদিক – ঘাটশিলা, মনোহরপু্‌র, পুরী। একটা অন্যরকম আনন্দ-আড্ডায় তাঁরা মেতে থাকতেন। আমার পরম সৌভাগ্য অল্প বয়স থেকেই এরকম ঘটনার সাক্ষী থেকেছি।

বিভাস রায়চৌধুরী: কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় কাজে যোগ দিয়ে এরকম আড্ডার মধ্যেই বসত হল আপনার!

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: সে যেন চাঁদের হাট! কে আসতেন না? কবিশেখর কালিদাস রায়, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কবি কৃষ্ণদয়াল বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, মৌমাছি বিমল ঘোষ। অন্যদের কথা তো আগেই বলেছি। এছাড়াও কতজন। কাকে ছেড়ে কাকে বলি? কত স্মৃতি। সেইসব স্মৃতির টুকরো টুকরো উদ্ধারেই লেখা হয়ে গেল ‘কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর’ গ্রন্থের কয়েকটা খণ্ড। সেগুলো পড়লে সেদিনের ছবিটা আজকের মানুষ কিছুটা অনুভব করতে পারবে। একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, কবি কৃষ্ণদয়াল বসুর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি punning-এ অসাধারণ দক্ষতা! মনে পড়ে আড্ডার মধ্যে একবার সুমথবাবু কাকাবাবু গজেনবাবুকে বাইরে ডাকলেন। বললেন, একটু প্রাইভেট কথা আছে। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণদয়াল বাবু বলে উঠেছিলেন, আপনাদের দু’জনের প্রায়ই ভেট (অর্থাৎ দর্শন) হয় মশাই, আবার প্রাইভেট!

ঠিক এরকমই একবার আড্ডায়, মুড়ি বাদামের সঙ্গে নুন খাওয়া ভাল না, এই কথা কেউ বললে একজন লেখক বলেন যে, তাঁর নুন ছাড়া খাওয়া হয় না, রোজই নুন চাই। শোনা মাত্র কৃষ্ণদয়াল বাবু বলে ওঠেন – আপনি মশাই তাহলে ফি রোজ খান নুন!

আসলে তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিল ফিরোজ খান নুন।




বিভাস রায়চৌধুরী
: কলেজ স্ট্রিটে এইরকম আড্ডার পরিবেশ এখন বিরল। গ্রন্থ প্রকাশ, সাহিত্যচর্চা কি এখন শুধুই জীবিকা?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের নানা মানুষ এই ব্যবসায় এসে পড়েন। ফলে গ্রন্থ প্রকাশ, সাহিত্যচর্চায় অবধারিতভাবে বহু মানুষ লিপ্ত। এখন এই সবই তাঁদের জীবিকা। একই সঙ্গে ভালবাসার অবলম্বন।

বিভাস রায়চৌধুরী: অতীতের সাহিত্যিক ও বর্তমান সাহিত্যিকদের মধ্যে কী তফাত্‍ লক্ষ করেন?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: অতীতের সাহিত্যিকদের অনেক কষ্ট করে সাহিত্য অবলম্বন করতে হয়েছিল। আজ লেখকদের সামনে টেলিভিশনের জগৎ এসেছে। সুতরাং সাহিত্য রচনার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রনাট্য প্রভৃতি রচনার সুযোগ এসেছে।

বিভাস রায়চৌধুরী: কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার খ্যাতি বিশ্বময়। বাইরে থেকে সাহিত্যপ্রেমীরা দেখতে আসেন কলেজ স্ট্রিট। গবেষণা করেন। আমরা গর্বিত হই। কিন্তু অধিকাংশই তো টেক্সট বইয়ের ব্যবসা, সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশনা সে তুলনায় কম। কী বলবেন?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: মানুষের কাছে সাহিত্যের গ্রন্থের চেয়ে টেক্সট বুকের প্রয়োজন বেশি। এটি সব ভাষাতে, সব দেশে সমান। সুতরাং এদেশেও সেটি হবে আশ্চর্যের কি? অর্থাৎ সাহিত্যের তুলনায় টেক্সট বইয়ের প্রকাশনা বেশি।




বিভাস রায়চৌধুরী
: সাম্প্রতিক অসুখ-পর্বে দেশ অন্যরকম হয়ে গেছে। সবকিছু বন্ধ ছিল। এখন খুলতে শুরু করলেও বাজার মন্… এইরকম সংকট আপনি আগে কখনও দেখেছেন? অনলাইন মার্কেটিং কি বাঁচাতে পারবে বইবাজার?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সান্ধ্য আইন দেখেছি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছি। দেশভাগ দেখেছি। নকশাল আন্দোলন দেখেছি। তখনও বইবাজারে চরম মন্দা এসেছে। কিন্তু সেসব সাময়িক। বইবাজার আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আবারও কাউন্টারে কাউন্টারে ক্রেতা আসছে। একই সঙ্গে অনলাইন মার্কেটিং ব্যবস্থা এসেছে। বইবাজার অবশ্যই বাঁচবে।

বিভাস রায়চৌধুরী: ই-বুককে কী চোখে দেখেন? ভবিষ্যৎ কি ছাপা বই পড়বে?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: ই-বুক এসেছে। কিছু মানুষ পড়েন। কিন্তু বই পড়ার আনন্দ ই-বুকে মিটবে না। ছাপা বইয়ের সমাদর অক্ষুণ্ণ থাকবে।

বিভাস রায়চৌধুরী: যে রূপেই আসুক, বই থাকছে। আপনার মতে বইয়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী?

সবিতেন্দ্রনাথ রায়: বই মানুষের অন্যতম সঙ্গী। নির্জনবাসে বন্ধু। এমনকী পঙ্গু, অর্ধ-অসুস্থ মানুষেরও অভিন্ন সঙ্গী বন্ধু। ওমর খৈয়াম বলেছেন – পানীয়, প্রিয়া ও সেইসঙ্গে একটি বই – এদের সঙ্গ স্বর্গসুখ দেয়।

কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক বিভাস রায়চৌধুরী দীর্ঘদিন কবিতার প্রকাশনা ও চর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। 'কবিতা আশ্রম' পত্রিকার মুখ্য পরিকল্পক। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ওঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম নষ্ট প্রজন্মের ভাসান (১৯৯৬)। এর পরে কবি পাঁচটি উপন্যাস সহ কুড়িটিরও বেশি কবিতা গদ্য ও প্রবন্ধের বই লিখেছেন।

3 Responses

  1. দুটি ভুল তথ্য। ১) বিভাস রায়চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট প্রজন্মের ভাসান’, ভাষণ নয়। ২) কবিতা আশ্রম পত্রিকা সম্পাদনা বিভাস রায়চৌধুরী করেন না, প্রধান সম্পাদক রণবীর দত্ত এবং অন্যান্য সহ সম্পাদক।

  2. সবিতেন্দ্র রায়কে জানা মানেই বাংলা সাহিত্যের ক্রম অগ্রগতিকে জানা। তদানীন্তন সকল সেরা সাহিত্যিকদের খুব কাছের থেকে দেখা ও জানা । বিশেষ ওনার – কলেজস্ট্রীটে সত্তর বছর – এর প্রতিটি খন্ডে সাহিত্য ও সাহিত্যিক দের খুঁজে পাওয়া। ওনার বর্তমান ফেসবুকের লেখাগুলিও নিশ্চয় গ্রন্থবদ্ধ হবে কোন নতুন শিরোনামে। ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *