(১)
“একটু সর, আর একটু সর, বসতে পারছি না তো।” বসতে পারবার কথা তো না। আমাদের খাবার ঘর, বসবার ঘর, বারান্দা, করিডোর সব বোঝাই। আমার ছোটমাসী মণিমা একশ’টা বাচ্চা নিয়ে অনুষ্ঠান করবে। কোনওমতে আমরা ঠেলাঠেলি ক’রে বসবার চেষ্টা ক’রি। কাঁকন, পিয়া, গীতি, ফেরদৌসী, মুনা, প্যামেলা, শ্যামা, শিউলি, সিমি, কুহিন, ইরাম, এলি, দীনা, কেয়া, ক্যামেলিয়া, শাওন, নিক্কন, লুবু, শ্যামলী, মিতু, সালেহা, সুস্মি, ময়না, শিমকি, আনন্দ, টুম্পা, কুসুম, রবিন, লিসা, তানিয়া, লোপা, বিদিশা, নাজ, ইয়াসমিন, টিসা, শুচি,সুমন, চুমকি, সুরভি, শ্যামলিনা, সীমা…
আমাদের বাড়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাড়ায়। পূর্ব পাড়া থেকে রিহারসাল দিতে আসত সুস্মি, ইয়াসমিন, প্যামেলা, সালেহা, আনন্দ, টুম্পা, কুসুম। প্রায় এক মাইল হেঁটে। পথের মাঝে পড়ত শহীদ মিনার। ১৯৭৪ সালে পোড়া ইঁটের টুকরো দিয়ে শহীদ মিনারে অপূর্ব মোজাইক করেছেন বিখ্যাত শিল্পী মুর্তজা বশীর। সন্তানেরা আত্মাহুতি দিচ্ছে আগুনে। আগুনের নীচে উর্ধ্বমুখী হাত। নয়’টি সন্তান যেন নয়’টি মাস মুক্তিযুদ্ধের। মায়ের উত্সর্গ ক’রা সন্তানেরা আকাশের তারা হ’য়ে মা’র হাত থেকে ফুলের মত ঝরে পড়ছে। মা’র ছবির বিপরীতে বিশাল সূর্য। ম্যুরালের পোড়া ইটের মোজাইক বরেন্দ্র ভূমির আবহ আনতে করা হয়েছে । আশ্চর্য এই ম্যুরাল দেশের জন্য আত্মত্যাগের এক অবিনশ্বর ছবি।
শহীদ মিনারের চারপাশ ঘিরে বড় বড় মেরুন, গোলাপি আর হলুদ রঙের ডালিয়া, সোনালি রঙের গাঁদা, বেগুনি বোতাম ফুল। শহীদ মিনারের পিছনের দিকটা টিলামত। তার ঢাল বেয়ে না গড়িয়ে আমরা ওই পথ পার হ’ই না। পাশেই রাকসু ভবনের সামনে কড়ই আর শিরীষের গাছ। চুলবুলি কাটা তার ফুল। হালকা সবুজ আর গোলাপি রঙের। আলতো ভালোবাসায় চোখের উপর বুলাতাম কড়ই আর শিরীষের ফুল। আর ছিল প্যারিস রোডে আকাশ ছোঁওয়া মেঘ শিরীষ। ওয়াহিদুল হক কাকুর কাছে গাছের নাম শিখতাম আমরা।

অনুষ্ঠানের নাম ‘ছেলে ঘুমিও না।’ ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো গানটার কথা পালটে আমাদের গান, ‘ছেলে ঘুমিও না, পাড়া জুড়াবে না, বর্গী আছে দেশে।’ এখনো মাথার ভিতর গুনগুন করে ওই সুর। ঘরে শত্রু। অস্ত্র তো হাতে তুলে নিতেই হ’বে।
একশ জনের অনুষ্ঠানে কি যে উত্তেজনা। গায়ক গায়িকার বয়স তিন থেকে ষোল। সাদা শাড়ী লাল পাড় পড়ে গান গাইব। নাচ হ’বে। চর্যাপদ থেকে শুরু ক’রে আধুনিক সময় সব ফুটে উঠবে সেখানে। হরিপদ দাদুর ছেলে অনুপমামা তবলা বাজাবে। অসাধারণ মিউজিক সেন্স অনুপমামার। রাজশাহীর বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওস্তাদ হরিপদ দাস। মনিমা বহুদিন হ’ল ওঁনার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখে। খুব একনিষ্ঠ ছাত্রী। ভোরবেলা উঠে রেওয়াজ ক’রে, বিকালবেলা রেওয়াজ ক’রে। গলা খুসখুস করলে বড়ই-এর পাতা গরম জলে সিদ্ধ ক’রে সেই জল খায়।কিন্তু সবাই তো আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ভালোবাসে না। ‘সা’ শুনলেই তাদের ‘যা রে যা’ বলতে ইচ্ছা ক’রে। এমনই এক প্রতিবেশী তো শেষ পর্যন্ত বলেই বসল মণিমাকে নাকি চাঁদা তুলে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেবে। সব ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া কেন? কোয়ালাদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখাবে?
বিস্ময়ে আমরা তাকিয়ে থাকতাম পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবির দিকে। পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী, ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার উপস্থিতিতে স্বাক্ষর করছে। অপলকে দাঁড়িয়ে দেখতাম বিজয়ী মুক্তিসেনাদের ছবি।
স্টেজের পিছনে ছায়াচিত্রের মত ক’রে বেবীআপা বসে আছে কোলে সন্তান নিয়ে। দেশমাতৃকার প্রতিচ্ছবি। আর আমরা গেয়ে চলেছি, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।’
সেদিন ঘেঁষাঘেঁষি ক’রে একশ জন বসেছিলাম পাশাপাশি। তারপর প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। মানুষের খুব কাছে বসবার উত্তাপটুকু মনে আছে আর সেই সাথে গানের সুর।
(২)
একবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা করেছিলাম ‘ঘুম ভাঙার গান’ নাটক। দর্শন বিভাগের উতসাহী নাট্যকার সুখেন কাকুর লেখা ও নির্দেশনায়। সুখেন কাকু হাসান আজিজুল হক চাচা, মমতাজ মাসী, মফিজ চাচা সকলের খুব প্রিয় পাত্র। সবাই দর্শন বিভাগের। আর হাসান আজিজুল হক চাচা এতবড় লেখক হলে কি হবে, আমাদের কাছে উনি ছিলেন হাসান চাচা। আমাদের নাটকে কিভাবে কি করতে হবে, আবৃতি করতে হ’লে কোন উচ্চারণটা কেমন হ’বে সব চাচার বলে দেওয়া চাই। আর আছেন নাজিম মাহমুদ চাচা। নাটক, আবৃতি সবকিছুতেই নাজিম মাহমুদ চাচার পথ নির্দেশনা। চাচার প্রতিষ্ঠিত আবৃতি সংগঠন ‘স্বনন’-এ আমি, সুস্মি, পিয়া গুটিগুটি গিয়ে যোগ দিয়েছিলাম যদিও তা ছিল মূলতঃ ইউনিভার্সিটির ছাত্র, ছাত্রীদের সংগঠন। আমরা তখন নাইন, টেন এ পড়ি। রী আ আপার গলায় পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন কিংবা রানা আপার কর্ণ কুন্তী সংবাদ – অত ভালো আবৃতি বুঝি আর শুনি নি।তারপর আঠারো বছর হতেই সুস্মিটা রাশিয়া চলে গেল পড়তে, আমি ইন্ডিয়া। তবু “যতো দূরেই যাই, আমরা সবাই স্বনন পরিবার।”
আমাদের নাটক ‘ঘুম ভাঙার গান’ হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। টিয়াজ, লিসা, শুভ বালক বালিকা। হাসান চাচার মেয়ে সুমন ফুলপরীর মত দেখতে বলেই কিনা জানিনা হয়েছিল ফুলপরী। আমি পাতা কুড়ানী গরীব মেয়ে। ছেঁড়া শাড়ি পড়েছি ঠিকই কিন্তু মামস আর একশ চার ডিগ্রী জ্বর নাটকের দিন। ঠান্ডা বাঁচাতে পায়ে সাদা মোজা পড়েই গরীব মেয়ের ভূমিকা করে ফেললাম। আমারটা তো অভিনয়, সত্যি সত্যি তো আর পাতা কুড়ানি মেয়ে নই আমি, আমার জুতা আছে।

প্লেটো হয়েছিল ‘হিং টিং ছট’ সন্ন্যাসী। বড় ভালো অভিনয় করেছিল প্লেটো। প্লেটো আমাদের মত ছিল, কিন্তু ছিল আমাদের থেকে আলাদা। খুব ছেলেবেলায় ওর মা মারা গিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য আমার অনেক বন্ধুর ছেলেবেলায় বাবা ছিল না। দিদা বলত বাবা ছাড়াও হয়ত দিন চলে যায়। কিন্তু মা ছাড়া? জেবুন্নেসা চাচী চলে গিয়েছিলেন রোজার ঈদের দিন। আনন্দের দিন মানুষ চলে গেলে প্রতি বছর সেই দিনটা এলে বুকের ভিতরটায় যেন আরো বেশি করে বাজে। রাস্তায় কার কাছে কি শুনে কষ্ট পাবে ভেবে হবিবুর রহমান চাচী ছোট প্লেটোকে বাড়ি নিয়ে এসে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঘুমে স্বপ্নের ভিতর দুঃস্বপ্নের মত মা চলে গেল? নাজিম মাহমুদ চাচা তারপর থেকে মায়ের যত্নে রী আ আপা আর প্লেটোকে বড় করেছেন। আগে যে গ্রামের বাড়িতে থাকতাম, সেখানে গাছপালা বেশী ছিল। অনেক পাখি বাসা করত। মা পাখি, বাবা পাখি দু’জনে মিলে বাচ্চাদের দেখাশোনা করত দেখেছি। কিন্তু মা পাখি না থাকলে একা বাবা পাখি বাচ্চাদের বড় করে উঠতে পারত না। নাজিম মাহমুদ চাচার অসীম স্নেহ দেখে মনটা ভিজে উঠত। স্বননের রিহারসাল দিতে প্লেটোদের বাসায় আমরা প্রায়ই যেতাম। দু’টো দেয়াল এসে যেখানে মিশেছে সেখানে চাচীর প্রায় লাইফ সাইজ একটা পোর্টেট ছিল। অসম্ভব জীবন্ত পেইন্টিং। মনে হ’ত চাচী বুঝি আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।

মৃত্যুর পর আমাদের স্কুলের মৌলবী স্যার জেবুন্নেসা চাচীর নামাজে জানাজা পড়তে রাজি হয় নি। চাচী নাটক করতেন, চাচী স্লিভলেস ব্লাউজ পড়তেন। পাপের শেষ নেই। ধর্ম জীবনের থেকে বড়? ধর্ম মৃত্যুর থেকে বড়? ধর্ম মানুষের থেকে বড়?
(৩)
শহীদ মিনারে আসলেই আমরা যেতাম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহ শালায়। সাথে প্রাণ প্রিয় বন্ধু সুস্মি, শাওন। আজ সকালেই সুস্মি আমায় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার নানা তথ্য দিল।
শহীদ মিনারের যে মুক্তমঞ্চ তার গ্রিনরুমেই প্রথম গড়ে উঠেছিল এই শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। মুক্তমঞ্চের সামনের ৪০/১২ ফিট ম্যুরালটা শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়ের করা। বিধস্ত গাছ। পাতা নেই। শকুনেরা চারপাশে। তারপর স্বাধীনতা এল। গাছে আবার ফুল, গাছে আবার পাতা। সাদা পায়রা উড়ছে। শান্তির কপোত। নাটক, আবৃতি, গান – কত অনুষ্ঠানই যে হ’ত এই মুক্তমঞ্চে।

খালি পায়ে আমরা সংগ্রহশালার ভিতরে ঘুরতে থাকি। সুস্মির চোখ ভর্তি জল। শাওন কোন কথা বলছে না। আমার গলার কাছে একটা শক্ত দলা মত আটকে আছে।
বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগ্রহশালা এই শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা । গড়ে উঠেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে। চোখের সামনে শহীদ জোহা চাচার বিভিন্ন ছবি, হবিবুর রহমান চাচা, সমাদ্দার কাকু, কাইয়ুম চাচার ব্যবহৃত জিনিস, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন পোশাক, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের আলোকচিত্র, নিহত শহীদ আসাদের কিছু দুর্লভ ছবি, বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি, রাজশাহীতে উত্তোলিত প্রথম জাতীয় পতাকা, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহৃত চশমা, ঘড়ি, একাত্তরের গণহত্যায় নিহত অসংখ্য শহীদের মাথার খুলি আর হাড়। বেশির ভাগ খুলি আর হাড় উদ্ধার করা হয়েছে জোহা হলের পাশের গণকবর থেকে।
বিস্ময়ে আমরা তাকিয়ে থাকতাম পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবির দিকে। পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী, ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার উপস্থিতিতে স্বাক্ষর করছে। অপলকে দাঁড়িয়ে দেখতাম বিজয়ী মুক্তিসেনাদের ছবি। গেঞ্জি, লুঙ্গি, কোমরে গামছা বাঁধা , পাজামা পড়া খুব সাধারণ চেহারার মানুষের হাতে রাইফেল। ওরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। নির্যাতন কতটা ভয়ঙ্কর হ’লে এরকম মানুষেরা একটা দেশ স্বাধীন করতে পারে!

ডিকশনারিতে পড়ছিলাম ‘জেনোসাইড’ মানে কি? কোন জাতির বিলোপসাধন, কোন সস্প্রদায়ের বিলোপসাধন, গণহত্যা, কোন জাতির পরিকল্পিত ধ্বংসসাধন হচ্ছে ‘জেনোসাইড’। ছোট্ট একটা দেশ বাংলাদেশের জেনোসাইডে ১৯৭১ সালে ৩ মিলিয়ন লোক হত্যা করা হয়েছিল। ৩,০০০,০০০ মানুষ হত্যা ; ৪০০,০০০ ধর্ষণ , এর বিনিময়ে আমার দেশ। পৃথিবীর অন্যান্য অসংখ্য ‘জেনোসাইডের’ মধ্যে কয়েকটা জেনোসাইডের কথাও পড়ছিলাম। হলোকস্ট-এ ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হত্যা করা হ’য় ১৭, ০০০,০০০ জন মানুষ। কম্বোডিয়ার জেনোসাইডে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে হত্যা ক’রা হয় ৩,০০০,০০০ জন মানুষ। আর্র্মেনিয়ার জেনোসাইডে ১৯১৫ সাল থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হত্যা ক’রা হয় ১,৫০০,০০০ জন মানুষ। বসনিয়ার জেনোসাইডে ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে হত্যা ক’রা হয় ৩৯,১৯৯ জন মানুষ।
মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা দেখে হাত পা অবশ হ’যে যায়। কী অপরিসীম কষ্টের ভিতর, কী নৃশংসতার ভিতর মৃত্যু হয়েছে এইসব নিরীহ মানুষদের তা ভাবতে পারি না। যারা হত্যা করেছে সেইসব দানবদের উল্লাস দু’হাত দিয়ে কান চাপা দিয়েও শুনতে পাই। নরপিশাচ পৃথিবীর মাটিতেই হেঁটে বেড়ায়।
(৪)
এক নদী রক্ত পেরিয়ে
বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা
তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না।
না না না শোধ হবে না।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাত কোটি মানুষের
জীবনের সন্ধান আনলে যারা
সে দানের মহিমা কোন দিন ম্লান হবে না
না না না ম্লান হবে না।।
হয়ত বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না
বড় বড় লোকেদের ভীড়ে
জ্ঞানী আর গুনীদের আসরে
তোমাদের কথা কেউ কবে না।
তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা
তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না।
না না না শোধ হবে না।।
থাক ওরা পড়ে থাক ইতিহাস নিয়ে
জীবনের দীনতা হীনতা নিয়ে।
তোমাদের কথা রবে সাধারণ মানুষের ভীড়ে
মাঠে মাঠে কিষাণের মুখে
ঘরে ঘরে কিষাণীর বুকে
স্মৃতি বেদনার আঁখি নীড়ে।
তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা
তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না।
না না না শোধ হবে না।।
গীতিকার ও সুরকার খান আতাউর রহমান । ‘আবার তোরা মানুষ হ’ । সামনের সারিতে বসে আছে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধারা। ক্যামেরা একজন একজন ক’রে তাঁদের মুখের উপর দিয়ে সরে যাচ্ছে। কারো গলায় ফুলের মালা, কারো কোলের উপর ফুলের মালা । বঙ্গবাণী মহাবিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে গান হচ্ছে। ‘তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না।’ উইস্কনসিনে বসে এই এতদূরে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে এই গানটা আমি শুনি । বারবার। দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ছলা-কলায় ব্যর্থ হয়ে গেছে শহীদের এত রক্ত। নিজেকে দোষারোপ করি। পড়ে আছি বিদেশ বিভুঁই–এ সেই আঠারো বছর বয়স থেকে। আজকের বসবাসের অযোগ্য বাংলাদেশে প্রতিদিন বেঁচে থাকবার যুদ্ধটুকু পর্যন্ত করিনি আমি।
ছেলেবেলায় প্রভাতফেরি সেরে ফিরবার পথে মনটা ভারি হ’য়ে থাকত। নানা কিছু চিন্তা করতাম। দশ বছর বয়সের নিষ্পাপ আর সব কিছুই করে ফেলা সম্ভব ধরণের মনটা নিয়ে ভাবতাম নিজের দেশটার জন্য কি করা যায়। ধীরে ধীরে দেশপ্রেমের থেকে উচ্চাকাংখাটা বড় হয়ে উঠল। নিজের কথা ভাবতে শিখলাম। এখন আমার চেনাশোনা বেশির ভাগ বন্ধুই বাংলাদেশে থাকে না। আমরা বিদেশে থাকি। শীতের পাখির মত ঠান্ডা পড়লে দেশে যাই। কিছুদিন ট্যাংড়া মাছ, বাঁশপাতা মাছ, কাজরী মাছ খেয়ে বিদেশে যার যার ঘরে ফিরে আসি। বিশ বছর, ত্রিশ বছর থাকবার পর নিজেদের বাংলাদেশি-আমেরিকান, বাংলাদেশি-ক্যানাডিয়ান হিসাবে ভাবতে শিখে যাই। রক্তের ভিতর শুধু একটা অস্বস্তি কাজ করে। বেঁচে থাকবার অস্বস্তি।
(‘দম বন্ধ’ বই থেকে অংশবিশেষ)
*বানান অপরিবর্তিত
কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি টেক করেছেন। বর্তমানে আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। পেশাগতভাবে অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে। প্রকাশিত বই 'আমার ঘরোয়া গল্প', 'হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা', 'রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন', 'রেশমগুটি', 'জলরঙ' 'দমবন্ধ' ও অন্যান্য।
Excellent write up.
It's a document 🇧🇩
চমৎকার প্রতিবেদন।