The grave site of Jack Daniel with the two chairs

দিনের শেষে ফিরতি পথে আমাদের ছোট সাদা বাসটা মনে হল একটা কবরখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছেকিছু ভাববার আগেই বুঝলাম বাসটা বাঁক নিচ্ছে, তারপরেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি অনুমান ঠিকই, বাসের জানালা দিয়ে কবরখানার গেটটা দেখতে পেলাম। তিরিশ সিটের বাসটা পুরো ভর্তি, মনে হল আমার মতো অবাক অনেকেইজানালা দিয়ে সবাই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কোথায় চলেছিদিনের শেষে তো শহরে হোটেলের বিছানায় আরাম করার কথা, হঠাৎ করে এ কী উৎপাত, এ যে একেবারে শেষ শয্যার আয়োজন!

মনে পড়ল, দিনের শুরুতেই আমাদের বাসচালক বলেছিলেন, তিনি আমাদের একটা সারপ্রাইজ দেবেন। এবং এটাই তাঁর সেই প্রমিস করা সারপ্রাইজ। আমাদের চালকের নাম টমিএকটু গাঁট্টাগোট্টাএক সাইজ ছোট টিশার্ট পরেছে মনে হল, সেই জন্য ভাবটা আরও কিছুটা প্রকট। গলাটা সেই তুলনায় সরু কিন্তু বেশ উচ্চগ্রামের। উত্তেজিত হলে আরও সরু হয়ে যায়। সিটে বসেই একটা হাত স্টিয়ারিংয়ের উপর রেখে, শরীরটাকে আমাদের দিকে ঘুরিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, “কী… লিঞ্চবার্গ থেকে বেরনোর সময় কী বলেছিলাম আপনাদের? একটা সারপ্রাইজ দেব! তাই তো? এই দেখুন এসে গেছেএখানে একটু নামতে হবে কিন্তু।” এক্কেবারে পাকা গল্প বলিয়ের মতো বলতে লাগলেন, “দেখুন নেমে কী কাণ্ড!”

দেখি পুরনো ছাই রঙের পাথরের ফলক লাগানো, অল্প শ্যাওলা ধরা একটা কবর, পাশে দু’টো চেয়ার। এর মধ্যেই লোকজন ফোন, ক্যামেরা সব বের করে ফটাফট ছবি তুলতে শুরু করেছে। যে বয়স্ক ভদ্রলোক বাসে ঘুম দিচ্ছিলেন, আর তাঁর গিন্নিকেও দিনের শেষে বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাঁরা দু’জনেও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন, ব্যস্ত হয়ে ছবি তুলছেন। কিছু যেন মিস না হয়! সব ছবি তুলে ধরে রাখতে হবে৷ টমি শুরু করল আবার, একটু টেনে, সাদার্ন অ্যাকসেন্টে,”ইয়ায় অল, এই যে এখানে শুয়ে আছেন যিনি, ইনি সারা জীবন বিয়ে করেননি, এক্কেবারে নির্ভেজাল ব্যাচেলর। কিন্তু পুরো এলেমদার মানুষ ছিলেন, বুঝলেন না! আমরা একটা সামলাতেই হিমশিম আর ইনি গুরুদেব! দু’টি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে থাকতেন, এক্কেবারে জীবনের শেষ দিনটি অবধি সঙ্গী ছিলেন তাঁরা, একসঙ্গে, এক সংসারে। এই দেখুন দু’টো চেয়ার, ওঁদের দু’জনের জন্য। এর ব্যবস্থা কিন্তু উনি নিজেই করে গেছেন, ওঁর দুই বান্ধবীর জন্য। উনি মারা যাওয়ার পরেও যদি ওঁর বান্ধবীরা একসঙ্গে তাঁদের প্রাণের মানুষটার কাছে আসেন, যেন পাশাপাশি বসবার কোনও অসুবিধা না হয়, সেই ভেবে।”

                                                     ২


আমি এসেছি ন্যাশভিলে, আমারিকার টেনেসি প্রদেশের অন্যতম বড় শহর ও রাজধানীও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাজেই এসেছি। উইকেন্ড পড়ে যাওয়াতে মনে হল এই সুযোগে টুরিস্ট হয়ে একবার ঘুরে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সবসময় তো মিড-ওয়েস্টে আসা হয় না সে ভাবে, সেই মতো সকালে ‘চল পানসি ঘুরে আসি!’ বলে হোটেলের লবি থেকেই টিকিট কেটে বেরিয়ে  পড়েছি এই বাসে করে। সঙ্গী জনা তিরিশেক টুরিস্ট, আমারই মতো। কিন্তু বেশির ভাগেরই কেউ না কেউ সঙ্গী আছে, কেবল আমিই এখানে একা। যেখানে যাওয়ার জন্য রওনা হলাম সেটি হল ন্যাশভিলের শহরতলি লিঞ্চবার্গ৷ মাইল সত্তর দূর, মানে ঘণ্টা দেড় থেকে দুইয়ের মধ্যেই পৌঁছনো যায়।

লিঞ্চবার্গের মেইন স্ট্রিটে বাসটা প্রথমে থামল। যে যার মতো অল্প কিছু লাঞ্চ খেয়ে নেওয়ার অনুরোধ৷ আমি খুঁজে পেতে লিঞ্চবার্গ ফিক্সিন্স রেস্তরাঁ থেকে একটা স্যান্ডউইচ টেক আউট নিয়ে খেতে খেতে এদিক ওদিক দেখে নিলাম৷ কিছু স্যুভেনিরের দোকান আর টুকটাক খাবারদাবারের। মেইন স্ট্রিট থেকে দশ বারো মিনিটের হাঁটা পথ। আমরা বাসেই এসে পৌঁছলাম৷

Along the main street at Lynchburg
লিঞ্চবার্গের মেইন স্ট্রিটে। ছবি লেখকের তোলা।

এতক্ষণ ধরে যে মানুটির কথা শুনছিলাম, আসলে সারাদিন ধরে তাঁকে ঘিরেই সময়টা কেটেছে। তাঁর নাম জ্যাক ড্যানিয়েল! কী, সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললেন তো? তা, ঠিকই ধরেছেন, আমাদের খুব কাছের মানুষ, যাঁর চেহারা বা ছবির সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও তাঁর তৈরি পানীয় আমাদের সুখদুঃখ হরষবিষাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে প্রায় সময়েই।

১৮৭৫ সালে তৈরি হয় জ্যাক ড্যানিয়েলসের এই জনপ্রিয় হুইস্কি ডিস্টিলারি। জ্যাক ড্যানিয়েল নিজেই তৈরি করেছিলেন৷ সেই ডিস্টিলারির সামনে বাসটা থামল, আমরা একে একে নেমে পড়লাম। ভেতরে ঢোকার মুখেই একটা সাদা দরজা আর পাশে খুব সুন্দর ম্যানিকিওর করা বাগানহলুদ গোলাপি নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছেদেখেই মনটা ভাল হয়ে গেল৷ সবাই মিলে লাইন করে দাঁড়ালাম ভেতরে ঢোকার জন্য। “টেনেসি হুইস্কি”র তকমা পেতে সাধারণত হুইস্কিকে ৫১% কর্ন থেকে তৈরি করে কাঠ-কয়লার ভেতর দিয়ে মেলোয়িংকরে, নতুন কিন্তু পোড়ানো হোয়াইট ওক ব্যারেলে পুরতে হয়। আমাদের জ্যাক ড্যানিয়েল এটিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান৷ সে কথায় একটু পরে আসছি। আপাতত আমাদের সব্বাইকে ডিস্টিল্ড অ্যালকোহল চাখতে দেওয়া হল। 

Basic ingredients of Whiskey
হুইস্কির প্রধান উপকরণ। ছবি লেখকের তোলা।

তারপর ট্যুর শুরু হলসিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ উঁচু সিলিং আর চারিদিকে কাঠ ঘেরা অদ্ভুত একটা ছাতাপড়া বাসি বাসি গন্ধ, এর নামই মাদকতা পুরনো কাঠের নেশা ধরানো মাতাল করা গন্ধ। এখানে আমাদের ‘মেলোয়িং’ পদ্ধতিটা দেখানো হবে। ভুট্টা, মল্ট বার্লি এবং রাই আগেই মাখা হয়ে মণ্ড হয়ে গেছে। এখানে বলে রাখি, এরা  বহু বছর ধরে মজানোর বা ফারমেন্টিংয়ের জন্য নিজেদের পরীক্ষাগারে লাইভ ইস্ট তৈরি করে। আর বার্লির ‘মলটিং’ পদ্ধতিটাও একদমই প্রাকৃতিক। যে পাইপগুলোতে মণ্ড পাঠানো হচ্ছে, সেগুলো সবই তামার। এই প্রত্যেকটা যন্ত্র, মানুষ, জল, কাঠ, আগুন, সবকিছুর মাপ ও মান সর্বোৎকৃষ্ট বলেই আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম হুইস্কির শিরোপার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পেরেছে জ্যাক ড্যানিয়েলস ওল্ড নং টেনেসি হুইস্কি। 


আমরা যেখানে উঠে দাঁড়ালাম, সেখানে তিন ফুট ব্যাসার্ধের বড় বড় মুখওয়ালা ভ্যাট পরপর সাজানোবিশাল লম্বা। এক একটা প্রায় ফুট দশেক। বারান্দার মতো জায়গাটা থেকে নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম বেশির ভাগ অংশটাই আমরা যে পাটাতনের উপরে দাঁড়িয়েছি, তার নীচে। তিনফুটি মুখে ঢাকনা লাগানো, উপরে কালো লোহার হাতল, পাশে ছোট একটা তালাচাবি৷ কাচের ঢাকনার ভেতর দিয়ে সেই পরম বস্তু দেখা যাচ্ছে। নিচু হয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, একটা বড় কালো পাথরের মতো কী রাখা রয়েছে। জানলাম, এই পদ্ধতিটাই, জ্যাক ড্যানিয়েলসের ইউএসপিএই অভিনব পদ্ধতিটার জন্যই এই হুইস্কি গলায় ঢাললে এত মোলায়েম। এছাড়া এখানে সুগার ম্যাপল কাঠ থেকে নিজস্ব কাঠকয়লা তৈরি হয়। সেই কাঠকয়লা পরপর সাজিয়ে ১৪০-প্রুফ হুইস্কিতে চুবিয়ে রাখা হয় এবং সপ্তাহে তিন দিন দিনে দুবার করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। 

মধ্যবয়স্ক, চোখে রিমলেশ চশমা পরা ট্যুর গাইড ন্যাথান আমাদের আগে আগে চলেছে। তার নীল রঙা জামা আর টুপি টুপিতে ডিস্টিলারির লোগো৷ কথা বলতে বলতে আমি ঠিক যে ভ্যাটের পাশে দাঁড়িয়ে, সেখানে এগিয়ে এল। আমি একটু সরে দাঁড়ালাম নিজে থেকেইন্যাথান বোঝাতে লাগল, “এখানেই আমরা হুইস্কিকে কাঠকয়লার আগুনে মেলো করি, আর এই পদ্ধতিটা আমাদের ডিস্টিলারির পেটেন্ট। এর জন্যই জ্যাক ড্যানিয়েলস অন্যদের থেকে আলাদা ও অনন্য। ফোঁটা ফোঁটা করে অ্যালকোহল এই কাঠকয়লার ভেতর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে জমা হয়। ওই যে কালো পাথরের মতো, ওটা আসলে কাঠকয়লার গুঁড়ো দিয়ে বানানো এক একটা বিশাল কাঠকয়লার চাঁই।” এই বলে ন্যাথান একটু জিরিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বললেন, “আর ওই যে আমাদের সিগনেচার জেন্টলমেন জ্যাক, সেটা এই ভাবে দু’বার কাঠকয়লার মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয়।” 

Street sign
লিঞ্চবার্গের রাস্তায় স্ট্রিট সাইন। ছবি লেখকের তোলা।

এরপর সে ওই লোহার কালো হাতল ধরে দিল হ্যাঁচকা টান৷ আমি অন্যদের মতো গভীর আগ্রহে শুনছি, দেখছি, একদম ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মতো মনোযোগে। আগেই তো দেখে নিয়েছি হাতলে তালা দেওয়া, তাই জানি ওটা আটকে যাবে৷ কিন্তু হাতল একটু ঘোরাতেই ঘরটা গন্ধে ম ম করে উঠল। ন্যাথান বলল, “একে একে সবাই এভাবে হাতল তুলে দেখে নাও৷” আমরাও যেন ডাক্তারি পড়তে আসা ফার্স্ট ইয়ারের আনকোরা ছাত্র, প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তেমন ভাব করে সবাই একবার করে ঢাকনা খুললাম আর ধপাস করে বন্ধ করলাম। এক ছন্দে পরপর ঢাকনা খুলল আর বন্ধ হল। 

সারা ঘর তখন যেন মদের নেশায় দুলছে৷ আসলে খুব স্ট্রং স্পিরিটের গন্ধ রেশিক্ষণ সহ্য করাও বেশ কঠিন। অনেকেই রুমাল বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যে পাইপগুলো দেখা যাচ্ছিল ভ্যাটের গায়ের কাচের প্যানেল দিয়ে, সেখান দিয়েই জারানো অ্যালকোহল এসে ওই কাঠকয়লার উপরে পড়ছিল৷ কোমরে দু’হাত রেখে, পিঠটা একটু পিছনে হেলিয়ে এক্কেবারে রাজার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ন্যাথান জানাল, এই পদ্ধতি খোদ ড্যানিয়েলবাবুর উদ্ভাবিত। এটাকেই উনি নাম দিয়েছিলেন মেলোয়িং৷ হুইস্কি পুরো চব্বিশ ঘণ্টা নেয় কাঠকয়লার ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে নীচে নামতে। আর কাঠকয়লাগুলো এই ডিস্টিলারির স্পেশাল কাঠকয়লা, যেগুলো বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখে মজুত রাখা আছে৷


এরপর ন্যাথানের পিছুপিছু আমরা পাশের বাড়িটায় ঢুকলাম। ঠিক বাড়ি না, একটা অন্ধকার শেড, চারতলা সমান উঁচুপরপর সারি দেওয়া ব্যারেল সাজানো সেখানে। অগুন্তি। ব্যারেলের গায়ে তারিখের স্ট্যাম্প বসান। ঠিক তখুনি গ্রুপের একজন জিজ্ঞেস করল, “কতদিন এভাবে ব্যারেলে থাকে বোতলে যাওয়ার আগে?” ন্যাথান জানাল, সে রকম কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই ওয়াইনের মতো। মাঝে মাঝে অবশ্যই চেক করা হয়যখন মাস্টার ডিস্টেলার  পরখ করে সবুজ সিগন্যাল দিয়ে জানায় যে “ইট ইজ জ্যাক ড্যানিয়েল রেডি!” তবেই বোতলে ভরার পালা শুরু হয়। তবে হুইস্কি মোটামুটি চার থেকে বারো বছর পর্যন্ত ব্যারেলে রেখে এজিংকরা হয়৷ এক একটা ব্যারেল থেকে মোটামুটি ২৪০টা মহার্ঘ্য বোতল পাওয়া যায়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, এখনও পর্যন্ত ছ’জন মাস্টার ডিস্টেলার হয়েছেন, ড্যানিয়েলের পর৷ বর্তমান মাস্টার ডিস্টিলার জেফ আরনেট ২০০৯ থেকে আছেন এই পদে। এখানে চাকরি পাওয়া মুশকিলএকবার যারা কাজ করতে ঢোকে তারা একেবারে রিটায়ার করেই বেরোয়আরও মজার কথা হল, বংশপরম্পরায় দাদু, ছেলে, নাতির হাত ধরে এই শিল্প বেঁচে আছে এখানে৷” হাসিহাসি মুখে জানাল ন্যাথান৷ 

সব থেকে ভাল ব্যারেল, মোটামুটি দু’শতাংশের বেশি নয়, আলাদা করে দাগ দেওয়া থাকেসেগুলো স্পেশাল বোতলে ভরা হয়৷ আবার এখন নতুন ট্রেন্ড হয়েছে বড় বড় সংস্থাও অনেকে নিজেদের জন্য ব্যারেল অর্ডার দেয়৷ সেগুলো পার্সোনালাইজ় করে, যত্ন করে আলাদা লেবেল লাগিয়ে পাঠানো হয় কাস্টমারদের, “This has been specially made for you.” লিখে। এক ব্যারেলের দাম শুরু দশহাজার ডলার থেকে৷ আর বোতল পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ ডলার। 


জ্যাক ড্যানিয়েলের গল্প সত্যিই যাকে বলে rags to riches-এর গল্প । খুর সামান্য থেকে শুরু করে সারা দুনিয়ায় খ্যাতির চূড়ায় ওঠার কাহিনি। এখানকার উৎপাদনের অর্ধেক আমেরিকার বাইরে রপ্তানি করা হয়। সেই সাদা শেডটা এখনও আছে, যেখানে শুরু হয়েছিল ডিস্টিলারি। আজও সেই একই রেসিপি মেনে একইভাবে হুইস্কি তৈরি হয়ে চলেছে৷ আর একটা মজা বা অদ্ভুত তথ্য, এই টাউন পুরোপুরি ড্রাইমানে এখানে মদ কিনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়া যায়, কিন্তু দোকানবাজার-পাব-রেস্তরাঁয় বসে? নৈব নৈব চ।

আমরা যেখানে উঠে দাঁড়ালাম, সেখানে তিন ফুট ব্যাসার্ধের বড় বড় মুখওয়ালা ভ্যাট পরপর সাজানোবিশাল লম্বা। এক একটা প্রায় ফুট দশেক। বারান্দার মতো জায়গাটা থেকে নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম বেশির ভাগ অংশটাই আমরা যে পাটাতনের উপরে দাঁড়িয়েছি, তার নীচে। তিনফুটি মুখে ঢাকনা লাগানো, উপরে কালো লোহার হাতল, পাশে ছোট একটা তালাচাবি৷ কাচের ঢাকনার ভেতর দিয়ে সেই পরম বস্তু দেখা যাচ্ছে।

ডিস্টিলারির এই জায়গাটাও জ্যাক নিজে বেছেছিলেনছোট্ট একটা নদীর ধারে আজও সেই নদীর জলই ব্যবহার করা হয়। একটা ছোট্ট গুহা, আর তার মধ্যে ঝরঝর করে ঝরনার জল পড়ছে—  ‘স্প্রিং হলো ফলস অ্যান্ড কেভ৷’ লাইমস্টোন বা চুনাপাথর বেয়ে জল আসছে, তাই জলের একটা স্বাভাবিক পরিশোধন হয়ে যাচ্ছে। জলে আয়রন খুব কম, তাই এই মিঠে জলের হুইস্কি এত মোলায়েম৷ এখানেই গুহার মুখে জ্যাকের একটা মূর্তিও আছে, একটা পা উঁচু করে ব্যারেলের উপর রাখা। ঠিক যেন মহারাজ তার শিকার নিয়ে দাঁড়িয়ে!

Statue of Jack Daniel
জ্যাক ড্যানিয়েলের মূর্তি, রাজার ভঙ্গিতে। ছবি লেখকের তোলা।

খেয়াল করে দেখবেন, জ্যাক ড্যানিয়েলের প্রত্যেকটা বোতলের গলার কাছে “Old Number 7″ কথাটা লেখা থাকেন্যাথানকে জিজ্ঞেস করাতে বলল, এটা সত্যিই একটা রহস্যআর ড্যানিয়েলও কখনও এর উত্তর দিয়ে যাননি। নানারকম প্রচলিত গল্প ঘুরে বেড়ায় ব্যাখ্যা হিসেবে। ন্যাথান বলল “আমার কাছে অনেক গল্প এবং মিথ রয়েছে যা এখানে চারপাশে চালু আছে। কিন্তু সত্যিই এটা কোনও লাকি নম্বর কিনা, নাকি এটা সাত নম্বর রেসিপি, নাকি ওঁর সাতজন বান্ধবী ছিলেন; নাকি ১৯০৪-এর ওয়র্ল্ড ফেয়ারে সাত নম্বর ব্যারেল পুরস্কার পেয়েছিল, কেউ সঠিক জানে না ৷ তবে সব থেকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হল, জ্যাককে প্রথমে জেলা ট্যাক্স মূল্যায়ন নম্বর সাত দেওয়া হয়েছিলপরে টেনেসির জেলাগুলি একসঙ্গে করার সময় সেই নম্বর বদলে ১৬ করে দেওয়া হয়। যাতে পুরনো গ্রাহক হারাতে না হয়, তাই জ্যাক তাঁর বোতলগুলোর গলায় Old No. 7 লেবেল ঝোলাতে শুরু করেন৷”  

হুইস্কি মোটামুটি চার থেকে বারো বছর পর্যন্ত ব্যারেলে রেখে এজিংকরা হয়৷ এক একটা ব্যারেল থেকে মোটামুটি ২৪০টা মহার্ঘ্য বোতল পাওয়া যায়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, এখনও পর্যন্ত ছ’জন মাস্টার ডিস্টেলার হয়েছেন, ড্যানিয়েলের পর৷ বর্তমান মাস্টার ডিস্টিলার জেফ আরনেট ২০০৯ থেকে আছেন এই পদে।

আমাদের ট্যুর টেস্টিং রুমে এসে শেষ হল। আমরা পাঁচটি আইকনিক হুইস্কি — জেন্টলম্যান জ্যাক, জ্যাক ড্যানিয়েলস ওল্ড নং 7, জ্যাক ড্যানিয়েল রাই, টেনেসি হানি এবং টেনেসি ফায়ারের প্রত্যেকটির নমুনা পরখ করলাম। প্রত্যেকটির মূল উপাদান বা বা বেস হল সেই ওল্ড নং ৭। তারপরে অতিরিক্ত স্বাদ যুক্ত করা হয়। 


ইতিমধ্যে প্রায় দু’ঘণ্টা কেটে গেছে। এবার একটু ক্লান্তই লাগছিল। ট্যুরের শেষে লিঞ্চবার্গ টাউনের স্কোয়্যারে এসে বাসের অপেক্ষায় বসেছি। ন্যাশভিল ফিরব একই পথে। নজরে পড়ল একটা ছোট লাল গির্জাসাদা চুড়োজায়গাটাও বেশ ছোট, শ’খানেক বর্গমিটারের বেশি হবে না। ছোট ছোট একতলা, বড়জোর দোতলা বাড়ি স্কোয়ারের চারপাশে৷ লাল হলুদ রঙের বাড়িগুলো নীল-সাদা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে বেশ পোস্টকার্ডের ছবির মতো দাঁড়িয়ে। হাতে এক কাপ গরম কফি নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিতে দিতে কাছের একটা রেঞ্চিতে বসলাম, সারাদিনের সব কিছু মনে মনে রিওয়াইন্ড করার জন্য। 

Souvenirs
লিঞ্চবার্গে স্যুভেনিরের দোকানে। ছবি লেখকের তোলা।

বাসে ওঠার পর টমি ফের গল্প শুরু করল৷ এক পরিচ্ছেদের সূত্র ধরে উপন্যাসের আর এক পরিচ্ছেদে ঢুকে পড়া। ন্যাথান শুনিয়েছে এক ব্যবসায়ীর গল্প, খুব সামান্য থেকে শুরু করে সে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে সেই ব্যবসা৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা হয়নি আসল মানুষটার গল্প, রক্তমাংসের মানুষটার দিনযাপনের গল্প, মানুষটার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে যাওয়া নদীর গল্প।

টমি ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই শুরুর গল্পে। বাবা আর মায়ের কোলে সদ্যোজাত জ্যাসপার নিউটন ড্যানিয়েলের কাছে। অনেক ভাইবোনদের একজন জ্যাসপার, ডাকনাম জ্যাক। মা মারা গেলেন, জ্যাক তখন খুবই ছোট৷ বাবা অল্পদিনের মধ্যেই আবার বিয়ে করলেন৷ খুবই স্বাভাবিক সে সব ঘটনা। আর গল্পে যেমন হয়ে থাকে বেশির ভাগ সময়, ঠিক তাই হল। সৎমায়ের সঙ্গে জ্যাকের বনিবনা হল না মোটেই৷ বারো- তেরো বছরের মতো বালাই আর নেই। অবাধ্য জ্যাক বাড়ি ছাড়ল৷ এদিক- ওদিক ঘুরতে ঘুরতে, কেমন করে সেও জানে না, এক পাদ্রির আশ্রয় পেলড্যান কল, ফাদার ড্যান কল৷ ড্যান কলের ছিল ক্রীতদাস। সময়টাই তো সেরকম ছিল। আর সেই ক্রীতদাসের নাম ছিল ন্যাথান গ্রিনরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে, তখনই গির্জার পেছনের জমিতে “মুনশাইনিং”-এ হাতেখড়ি জ্যাকের৷ শিক্ষক ফাদার কল আর তাঁর ক্রীতদাস গ্রিন – “থ্রি অ্যামিগোস”।

Souvenir shop in Lynchburg
লিঞ্চবার্গে স্যুভেনিরের দোকান। ছবি লেখকের তোলা।

এক নিশ্বাসে এতদূর বলে টমি যেন দম নেওয়ার জন্য থামল৷ তারপর ক্যুইজ়ের মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিল, বলুন তো, যখন জ্যাক ডিস্টিলারি শুরু করল, মাস্টার ডিস্টিলর-এর পদ কে পেল?” আমরা যাত্রীরা সবাই গপ্পে মগ্ন। এক ঘর-পালানো ছেলে, এক ক্রীতদাস আর ক্রীতদাস-মালিকের গল্পের গলিঘুঁজিতে। 

টমি বলতে লাগল, “আরও কিছু অবাক করা গল্প বাকি।” আর আমিও যেন তখন নতুন করে ইতিহাসের পাতা থেকে বর্তমানের রাস্তায় ঘুরপাক খেতে খেতে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলামভাবছিলাম, এখনও লিঞ্চবার্গ নাম নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই শহর। শুধু এই একটা লিঞ্চবার্গ না। খুঁজলে প্রত্যেক রাজ্যেই হয়তো একটা করে লিঞ্চবার্গ দাঁড়িয়ে আছে! মানুষ মানুষকে কিনে রাখত, এমনকী গির্জার পাদ্রিও নিষিদ্ধ মাদক তৈরি করত গির্জার জমিতেই৷ অবাক হচ্ছি কেন? আজও কি একই কাজ হচ্ছে না! ধর্মের বর্ম পরে ধর্মকে সাক্ষী রেখেই তো বারে বারে অধর্মের কাজ হয়! 

টমির গলাও খাদে নামে এবার৷ “এ দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে উত্তর আর দক্ষিণেভাই ভাইকে মারছেবড় উত্তাল সে সময়। ১৮৬১ – ১৮৬৫ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, আর ১৮৭৫ সালে জ্যাক ড্যানিয়েল ডিস্টিলারি তৈরি হয়। যুদ্ধ শেষে ইম্যানসিপেশন বিল পাশ হয় অ্যাব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে৷ ক্রীতদাসপ্রথা বেআইনি ঘোষণা করা হয়। তার মানে, ন্যাথান গ্রিনও স্বাধীন তখনআর জ্যাক যেন সেই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। পাদ্রি আশ্রয় দিয়েছিলেন আর ন্যাথান দিয়েছিল বন্ধুত্ববাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেটিকে দিয়েছিল ভালবাসা৷ তাই জ্যাক ড্যানিয়েল ডিস্টিলারির প্রথম প্রধানের পদটি আর কাকেই বা দিতে পারেন ! ন্যাথান গ্রিন, একদা ক্রীতদাস, সেই তকমা মুছে দিয়ে জ্যাক ড্যানিয়েলের ইতিহাসে, পরম্পরায় প্রথম প্রধান ডিস্টিলার। 

বাবা আর মায়ের কোলে সদ্যোজাত জ্যাসপার নিউটন ড্যানিয়েলের কাছে। অনেক ভাইবোনদের একজন জ্যাসপার, ডাকনাম জ্যাক। মা মারা গেলেন, জ্যাক তখন খুবই ছোট৷ বাবা অল্পদিনের মধ্যেই আবার বিয়ে করলেন৷ খুবই স্বাভাবিক সে সব ঘটনা। আর গল্পে যেমন হয়ে থাকে বেশির ভাগ সময়, ঠিক তাই হল। সৎমায়ের সঙ্গে জ্যাকের বনিবনা হল না মোটেই৷

বাস এগিয়ে চলে, টমিও এবার অল্প থামেসবাইকে সময় দেয় ইতিহাস থেকে বর্তমানের রাস্তায় একটু একলা চলার জন্য। আমি জানালার কাচে মাথা রাখি, চোখ চলে যায় দূরে রাস্তা ধরে অনেক পিছিয়েমন যায় এগিয়েকতটা পথ হাঁটার পর মানুষ হওয়া যায়? দুপুরের চড়া রোদের তেজ তখন পড়ন্তবেশ পাকা, কিন্তু নরম হয়ে আসা আলো।

সন্ধ্যেবেলা হোটেলের বারে জ্যাক ড্যানিয়েলের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে কান্ট্রি সং শোনায় কাউবুট পরা, বাঁ-হাত জুড়ে বিশাল ট্যাটু, বছর বিশেকের একটি ছেলে৷ কালো জিন্স, টি শার্ট আর হাতে গিটার৷ কান্ট্রি মিউজিক নিয়েই তো ন্যাশভিলে জন্মায়। আর কান্ট্রি মিউজিকের পীঠস্থানও এখানেই। সে গল্প তোলা থাক আরেক উইকেন্ডের জন্য৷ পুরো একটা বেড়ানোর গল্প সেদিন তাকে নিয়েই হবে৷ আজকের নেশাটুকু থাক জ্যাক ডানিয়েলসকে সম্মান জানিয়ে৷

দীর্ঘদিনের প্রবাসী বিশ্ব প্রতীম ভৌমিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। কলকাতার ডন বসকো স্কুল ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনার পর উচ্চশিক্ষার জন্য় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি। বর্তমানে ফর্ডহ্য়াম ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত। ভালবাসেন ঘুরে বেড়াতে ও ছবি তুলতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *