একখানি কাঁসার রেকাবিতে দু’খানা সন্দেশ আর যত্ন করে কাটা কচি শশা দু’টি। সঙ্গে একটি ধামিতে কিছু মুড়ি… বাদামি লালচে রঙের মুড়ি… মুচমুচে। 
– সব ঘরে করা, বুঝলে হে… শশাটা এখুনি পেড়ে দিলাম, হ্যাঁ! আর সন্দেশ ওবেলা জ্বাল দেওয়া দুধের। বাড়ির গোরু। মা ছানা কেটে বিকেলে দুধটুকুনি সন্দেশ করে রাখেন। জানি না তোমাদের ভালো লাগবে কিনা। কই, নাও, নাও, অনিকেত। মিতুল… 
কী বলছ সুবাস, এসব তো আমাদের স্বপ্ন গো! ওহ, এ যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। যেন আদর্শ হিন্দু হোটেলের একটা পাতা, না বিকাশ? 
হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ, সত্যিই তাই রে…! এক টুকরো বিভূতিভূষণ মাইরি… গুরু,  ভাবা যায়? বাড়ির মুড়ি, বাড়ির ছানা, বাড়ির শশা। কী কোয়ালিটি অফ লাইফ তোমাদের গুরু! নে নে মিতুল, তুই আবার লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? দেখ তোর দিকে তাকিয়ে সুবাস কেমন লাল হয়ে উঠেছে।

ধ্যাত বিকাশ। তুমি না… পারোও বটে। গাঁয়ের ছেলে বলে আমাকে এতটা মুরগি না করলেও পারতে কিন্তু, হ্যাঁ। 

অনিকেত, বিকাশ, মিতুল, ওরা প্রথমবার আমার বাড়ি গিয়েছিল। সেটা আশি দশকের মাঝামাঝি। গাঁয়ে কিছুই ছিল না তখন, না মোবাইলের টাওয়ার, না গ্রামসড়ক যোজনার রাস্তা। এমেনরেগার একশো দিনের কাজ আসেনি। ছিল আমাদের বাড়ির ওই শশালতা, লাউমাচান, চালে ফলে থাকা চালকুমড়ো। গোবরের ঢিবি। গোল করে সাজানো ঘুঁটের পাহাড়। সেসব  দেখেই ওরা মুগ্ধ। অনিকেত বিকাশকে একটু ঠেলে দিল…
– এই ঘরের ছাতটা দেখ! কীরকম বাঁশের আড়াআড়ি প্যাটার্ন। পুরো মৃণাল সেনের সিনেমা মাইরি… কে করেছে এরকম ডিজাইন, সুবাস? মেসোমশাই? 
যাহ, বাবা কেন করতে যাবেন? ঘরামি ডাকা হয়। ওরা এসব কাজ খুব ভাল জানে। আমাদের চেনা ঘরামি আছে তো। পাকা বাড়ি, পাকা ছাত তো হল না। প্রতি বছর ছাইতে হয়… নইলে ঝড়েজলে ক্ষতি হয়ে যায় খুব। বাবা বলেছেন, ঢেউটিনের ছাউনি দেবেন পরের বছর। এ বছর পটল করেছেন, ওটা উঠলে কিছুটা লাভের মুখ দেখবেন… 
মাইরি, সুবাস তুমি আর গল্প শুনিও না ভাই। আমরা এসেছি দেখ… কলকাতার পার্টি… ঐ যে স্মিতা পাতিল বসে আছেন ঠোঁট টিপে, যেন আকালের সন্ধানে! 

 

আরও পড়ুন: মৈনাক পালের ছোটগল্প: উত্তরাধিকার

 

মিতুল ছদ্ম রাগে ঠোঁট ফোলায়। মুঠি পাকিয়ে ঘুঁষি দেখায়… ধ্যাত! বিকাশ হেসে বলে,
– সত্যিই এত ভাল বাড়ি তোমাদের… ফ্রেশ খড়ের গন্ধটা শোঁক একবার অনিকেত, উফফফ। মুগ্ধ! মুগ্ধ। তুমি এমন বাড়ি থাকতে কলকাতার বস্তিতে পড়ে থাকতে!  তাপ্পর তো আবার কলেজের পাশে মেসের ওই ছারপোকাওয়ালা বেডে!

আসলে মুগ্ধ না হাতি। ওর’ম বলতে হয়। নইলে কি চলে? শহর থেকে এসেছে সব। সবকিছু ওরা গল্প দিয়ে গান দিয়ে সিনেমা দিয়ে মাপে। অনিকেতের বাবা মাস্টার। মিতুল ওর মাসতুতো বোন, মিতুলের বাবা আঁকিয়ে। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ আঁকার এগজিবিশন হয় ওঁর। ওরা এসেছে আমার সঙ্গে আমাদের দেশের বাড়িতে। বর্ধমানে। ভাবা যায়! কোথায় শুতে দিই, কী খেতে দিই, ভেবে পাই না। সত্যি যদি মুগ্ধ হবার মতো কিছু থাকত, মিতুল, আজকে এত ঘেন্না করতে আমাকে? আমার বাবা মাকে?

সেই আমি, কত জল পেরোলাম। ঘেঁটে এলাম কাদা। কাদা পাঁক। বয়সের কত গাছ চারা থেকে মহীরূহ হয়ে বুড়ো হয়ে মরে মরে পাথর হয়ে গেল। হৃৎপিন্ডে চাপ বেঁধে গেছে এখন। আর দুঃখ হয় না, কষ্ট হয় না।    আমিও মাপতে শিখেছি এখন। এতদিনে। সবকিছু… গল্প দিয়ে গান দিয়ে বই দিয়ে ছবি দিয়ে সিনেমা দিয়ে। 

আমার বাবা কৃষক। আমার কাকা কলকাতায় কল মিস্তিরি। কাকার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলাম পড়তে। কপালজোরে ভালো সরকারি ইশকুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আর সেইভাবেই অনিকেতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আসল বন্ধুত্ব খেলার মাঠে। ফুটবল পেটাতাম আমরা…

অনিকেতের বাড়ি ইশকুলের কাছে। আমাদের খেলার মাঠ থেকে দু’পা। কর্পোরেশনের পার্কে বড় ঘাসের মাঠ। তা আমাদের দাপাদাপিতে ন্যাড়া হয়ে গেছিল। বর্ষায় তুমুল কাদায় গড়াগড়ি। নরম মাটি, ঘন কাদা। ভয়ংকর পেছল। সেই সব ফুটবল পেটানোর পর, চারবার কাদায় আছাড় খেয়ে, বিকেলের পর ফিরে পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কাদা ধুতে এক ঘণ্টা লাগত। তাও অনিকেত বাড়ি যেতে দিত না। আমাকে টেনে নিয়ে যেত। নিজেদের বাড়ির উঠোনে কলপাড় ছিল ওদের, আহা! প্রাইভেট কলপাড়। আমাদের তো বস্তির বারোয়ারি কল। তা সেখানে অনেকক্ষণ ধরে হাত পা ধুয়ে অনিকেতের মায়ের বানানো পরোটা আলুর তরকারি খেয়ে অনেক সন্ধে করে ফিরতাম। বিকেল বেলায় অনেক সময়ে অনিকেতই আমার পড়া করিয়ে দিত, নিজে কী পড়ত না পড়ত জানি না, তবে দুজনে একসঙ্গে পড়ার ফল… মাধ্যমিকে দুটো লেটার আমার, অনিকেতের একটা। 

মুগ্ধ না হাতি। ওর’ম বলতে হয়। নইলে কি চলে? শহর থেকে এসেছে সব। সবকিছু ওরা গল্প দিয়ে গান দিয়ে সিনেমা দিয়ে মাপে। অনিকেতের বাবা মাস্টার। মিতুল ওর মাসতুতো বোন, মিতুলের বাবা আঁকিয়ে। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ আঁকার এগজিবিশন হয় ওঁর। ওরা এসেছে আমার সঙ্গে আমাদের দেশের বাড়িতে। বর্ধমানে। ভাবা যায়!

অনিকেত পরেও আমাকে পাইয়ে দিয়েছে অনেক। অনিকেতদের বাড়িতেই তো প্রথম দেখা মিতুলের সঙ্গে। আমি টুয়েলভে। মিতুল এইটে। প্রেমে পড়ে গেলাম তক্ষুণি। মিতুল অবশ্য আমার প্রেমে পড়েছে অনেক পরে। অনেক তদবির তদারকির পর। এই বান্দা ততদিনে জীবনানন্দ দাশ মুখস্থ করেছে, সুনীল গাঙ্গুলির নীরা সিরিজ মুখস্থ করেছে। সব মিতুলকে পাবার আশায়। ট্রেন যখন স্টেশনে ঢোকে, সারা স্টেশন থরথর করে কাঁপে। মিতুলকে দেখলে আমার তেমনি হত। 

কিন্তু অনিকেত, শালা, মাল খেয়েছি ওর সঙ্গে একদিন, ফুলটুস মস্তিতে আছি, আর তখন ও আমাকে কী অপমানটাই না করল। শালা হতেই হবে ওকে। মিতুলকে যদি বিয়ে করি, ও শালা না হয়ে কোথায় যায়। অনিকেত মদের ঘোরে আমার পেট থেকে কথা বের করত। পাজি। নিজে মাতাল হত না। আমাকে মাতলামি করতে দিত।  মিতুলকে যে আমি ভালবাসি সে সব কথা বের করে নিল। আমারও শালা মাল খেলে কিছু ঠিক থাকে না। হড়হড় করে বলে দিলাম। মিতুলকে ছাড়া বাঁচব না, ব্যাস। 

 

আরও পড়ুন: সন্দীপ রায়ের গল্প: প্রেমদিবসের আগে

 

অনিকেত, বলে কি, ও বাঁ.., তুমি উঁচু ডালে মই বাঁধার মতলব করেছ বাঁ..! তুমি ভেবেছ আমার মেসো আর্টিস্ট হয়ে তোমার মত গাঁওয়ারের সঙ্গে মিতুলের বিয়ে দেবে? মিতুল একমাত্র মেয়ে মেসোর। মেসো কি গাধা? তুমি ভেবেছ কলকাতায় এসেছি, ইশকুলে পড়েছি, অনিকেতের মতো বন্ধু হয়েছে, এবার বিয়েটাও করি উঁচু ঘরে, তরতর করে উঠব তাহলে…! পরে, অনেকদিন পরে, অনিকেতের এই কথাটা ওকে মনে করিয়ে দিতে ও কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল তুই মাধ্যমিকে আমার চে’ ভালো রেজাল্ট করলি, উচ্চমাধ্যমিকেও টেক্কা দিলি… আমার হিংসে হয়েছিল রে সুবাস। জাস্ট প্লেইন হিং। 

আমার মনে থাকবে কথাটা। আমি তো ছাড়িনি। আমি তো চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্ট করেছিলাম। একহাতে কবিতা লিখে মিতুলকে ইমপ্রেস করেছিলাম। অন্যহাতে, এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অডিট অফিসে অডিটরের চাকরি জুটিয়েছিলাম। ফর্ম আনা করিয়েছিল অনিকেতই। আমাদের দু’জনেরই ফর্ম ভরার কথা। অনিকেত শেষে বেঁকে বসল। কী, না গায়ক হবে। নিজে গান লিখে সুমন চাটুজ্জের মতো তোমাকে চাই অ্যালবাম করবে। কর অ্যালবাম। চুলোয় যাক এসএসসি পরীক্ষা।

জেনারেল নলেজ, অংক, ইতিহাসে পাতিহাঁস… মাইরি মাইরি, চাকরিটা শেষে অনিকেতকে টেক্কা দিয়ে আমিই পেয়ে গেলাম… পাকা। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি বাঁ..। কম কথা না। বছরে দুবার ডিএ বৃদ্ধি। দশ বছরে অ্যাশিয়োর্ড উন্নতি। যদিও আমি দশ বছর অডিটর পদে থোড়ি ঘষটিয়েছিলাম? পাঁচ বছরের মধ্যে সেকশন অফিসার পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাশ করে সেকশন হেড… 

সোওজা চলে গেলাম মিতুলের বাড়ি। মিতুল তখন আমার প্রেমে পাখসাট খাচ্ছিল। আমার ফিগারটা তো তখন অমিতাবচ্চনের মত। অনিকেত ফনিকেতের শহরের ভেজাল তেল, ভেজাল জল খাওয়া না। তাগড়াই। গরুর দুধ খেয়েছি তো সাত-দশ বছর পর্যন্ত। কলকাতায় বস্তিবাড়িতে থেকেছি, কিন্তু গাঁয়ের বাড়ি থেকে আনা ঘি খেয়েছি ডালে, তরকারিতে।  আমার সবল শক্ত পেটাই চেহারা ওই তল্লাটে কারুর ছিল না। আবৃত্তির গলাটাও তো আমারই ছিল। লিখতাম খাতাভর্তি করে কবিতা। মিতুলকে বুকে পিষতে পারতাম যখন তখন। দু’চোখ ভরা আগুন আর আশা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। সাপে কামড়ালে আমাকে সাপ মারতে পারত না। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষে সাপটাই নেতিয়ে পড়ত নির্ঘাৎ।

– জগন্নাথ, বোল কেয়া হাল হ্যায়। 
নমস্তে স্যার। পরনাম। ঢালাই এর দিন ফিসক কিয়া স্যার?
তুমি বল জগন্নাথ? কবে পারবে ? তুমিই ত সেদিন বললে শাটারিংয়ের কাঠ পাচ্ছ না। কয়েকদিন লেগে যাবে। এভাবে আমারই তো কাজ পেছিয়ে যাচ্ছে জগন্নাথ।
লকড়ি মিল জায়গা স্যার। আউর এক দো-দিন মে হামি সুরু করিয়ে দিব। 
তারপর ক’দিন লাগবে?
ধরে নিন তিন থেকে চার দিন। আপনার ইলেকট্রি মিস্ত্রিকে বলিয়ে দিবেন। ও পাইপ আর তার ফেলবে কনসিলিং ওয়্যার কা।
ফোন নম্বর তোমাকে তো হোয়াটস্যাপ করলাম সেদিন জগন্নাথ। ডিরেক্ট কথা বলে নাও না, ইলেকট্রিশিয়ানকে। 
দেখছি স্যার। ডিলিট হয়ে গেছে মালুম। আর একবার ভেজিয়ে তো।
উফ পারো বটে জগন্নাথ। লোহা সেই কবে এসে গেছে। লোহার কাটিং, বেন্ডিং সব হয়ে গেছে? তার বাঁধা? 
কাজ চলছে স্যার। আপনি আপনার তিথি নক্ষত্র দেখে ঢালাইয়ের দিন ঠিক করবেন স্যার। লোকাল থানাকে বলতে হবে। মুনসিপাল্টি বলতে হবে স্যার। জল কিন্তু অনেক লাগবে। আপনার রিজার্ভার টেংকি ছোট আছে অনেক। আগের বারে তো গলতি করে ফেলে সেই মিস্কার এসে যাবার পর দেখা গেল জল নেই। কিতনা পবলেম হল।
আরে সেই প্রবলেম কি পাশের পাড়ার হরিদাস পাল এসে সলভ করেছিল? আমিই করেছিলাম। আমাকে শিখিও না জগন্নাথ। মনে রাখবে এটা আমার বানানো দ্বিতীয় বাড়ি। প্রথম বাড়ি করেছি আমার পয়ঁত্রিশ বছর বয়সে। এই যে দমদমে যে ঘরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, এর প্রতিটা টালি আমার নিজের কেনা, জানালা দরজা আমার সিলেক্ট করা। আমাকে শিখিও না। 
শিখাব কেন হুজুর। রাম রাম। আপনি ডেট বলবেন আমি কাজ করব।

 

আরও পড়ুন: অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: একটা ল্যান্ডস্কেপের অক্ষরমালা

 

আমরা কথায় কথায় তোমাদের মতো ওরকম পঞ্জিকা দেখি না জগন্নাথ। যে কোনও দিন ঢালাই করতে পার। 
নেক্সট উইকে পুনম আছে স্যার। পূর্ণিমা। ওটা ভাল দিন। করে দিই? 
দেখ দেখ কাজ সব তার আগে করে উঠতে পারলে তবে তো। মিউনিসিপালিটির এক কাউন্সিলর আমার পকেটে পোরা আছে। জলের গাড়ি চলে আসবে। আগেরবার ভিত ঢালাই করতে গিয়ে কী নাকানি চোবানি খেয়েছিলাম। আবার খাব? 
ঠিক স্যার। কাঁহাকা রুলস দিখা দিয়া। পানীয় জলে নাকি ঘরের ছাত ঢালাই করা যায় না। কাঠি করে দিল একদম। 
হ্যাঁ , কিন্তু  প্রবলেম সলভ কিসনে কিয়া জগন্নাথ! এই সুবাস স্যারই কিয়া, না? পাড়ার মাস্তানদের লাইন করে দাঁড় করালাম। রুল কেন, রুলের বাপ এসে পার পাবে না। 
সে কারণেই তো বলছিলাম স্যার। হেঁ হেঁ হেঁ। আপনার বাড়ি করার অভিজ্ঞতা আছে হামি কি জানে না!

ফোন রেখে দিলাম। মেজাজ খাট্টা হয়ে গেছে। এবার পাঁপড় লাগবে। চিকেন শিক কাবাবের ফ্রোজেন প্যাকেট আছে ফ্রিজে। “মঞ্জুউউউ”!

সন্ধে হয়ে আসছে। এটা আমার নিজের সঙ্গে বসার সময়। রোজ অফিস থেকে ফিরে আমি বসি। নিজের কাছাকাছি। বোতল খুলি। সোডা বার করি ফ্রিজ থেকে। বরফ নিজে নিতে পারি না। চেঁচিয়ে কাজের লোককে বলি বরফ দিতে। কাজের লোক মঞ্জু এসে দিয়ে যায়। চটপটে, তরতরে, নদীর মতো, খুব চালাক চতুর মেয়ে মঞ্জু। 

মিতুল আমার ড্রিংক করা পছন্দ করে না। প্রতিদিন ড্রিংক করা আরওই না। আর ড্রিংক করে বাওয়ালি করা, মাতলামি করা, এক্কেবারে না। আমি জানি কেউ আমাকে বুঝবে না। মিতুল তো না-ই। কালও রাতে অন্য ঘরে শুতে যাবার সময় দোর দিল। ছিটকিনি দেবার শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল। আর পরিষ্কার, মঞ্জুকে শুনিয়ে, এমনকী ছোটকিটাকেও শুনিয়ে, চিৎকার করে আমাকে বলল, তুই মরিস না কেন, মর, মর। 

এই মিতুল। একদা আমার প্রেমিকা ছিল। আগুনে দাঁড়িয়ে, ওর বাপ-মাকে অখুশি করে আমাদের প্রেম হয়েছিল। তোমার সঙ্গে ঘুমোবো আজ, আগুনে হোক, মাটিতে হোক, জলে… জয় গোস্বামী আওড়াতাম আমি তখন খুব। আমাদের বিয়ের সময়ে দুটো যুযুধান পক্ষ বাঁ হাতে জল দিয়ে কোনওমতে কার্য সেরেছিল। আমার মা বলেছিল, শহরের এত বড় ঘরের মেয়েকে বিয়ে না করলেই ভাল করতিস সুবাস।

কাজ চলছে স্যার। আপনি আপনার তিথি নক্ষত্র দেখে ঢালাইয়ের দিন ঠিক করবেন স্যার। লোকাল থানাকে বলতে হবে। মুনসিপাল্টি বলতে হবে স্যার। জল কিন্তু অনেক লাগবে। আপনার রিজার্ভার টেংকি ছোট আছে অনেক। আগের বারে তো গলতি করে ফেলে সেই মিস্কার এসে যাবার পর দেখা গেল জল নেই। কিতনা পবলেম হল।

ভয় পেয়েছিল মা। সে ভয় সত্যি হয়েছে। বিয়ের পর মিতুল আমার বাড়িকে পর করে দিয়েছে সেই থেকেই। আমার মা-বাবার সঙ্গে কোনওদিন ঘর করবে না, করেওনি। গেঁয়ো ভূত মা, গোড়ালির ওপরে শাড়ি পরে। একদিনই গেছিল মিতুলদের বাড়ি। ওদের ফ্ল্যাটবাড়ির ল্যান্ডিংয়ে, লিফটের সামনে সবার সামনে মা কুঁচি খসিয়ে আবার কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরেছিল। বোধহয় অসমান হয়ে পায়ে বেধেছিল বলেই। তাই নিয়ে কী তিলকে তালটা করেছিল মিতুলদের সারাবাড়ির লোক। মুখ টিপে হেসে অস্থির হয়েছিল সবাই।

অথচ মিতুলের বাবাটাই আসলে ছিল চামার। গরিবঘরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছে বলে কিছু দিল না আমাদের। আমাকে সব কিনতে হয়েছে, সব। অফিস থেকে লোন নিয়ে। তবু ভাঙি তো মচকাইনি আমি। আমার সেন্ট্রালের চাকরি। সেকশন অফিসার আমি। তক্তা তক্তা লোকের পে-রোল তখন আমি ফাইনাল করি। ক্যাশিয়ার আমার পকেটে। অ্যাডমিনের সিটে বসে কয়েক বছরে নিজের জায়গা শক্ত করে ফেলেছিলাম। যতরকমের লোন, যতরকমের অ্যাডভান্স আছে পৃথিবীতে, মানে সরকারে… ভারত সরকারে… সব আমার নেওয়া হয়ে গেছে আজ।  ভারত সরকারের অশোক চক্রের জোরে এই সুবাস আজ এইখানে। নিজে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছি মিতুলকে। যে মিতুলের বাবা-মা ফুটানি মারত, ওস্তাদি করত, কিন্তু দমদমের মতো জায়গায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাড়ি বানাতে কোনওদিন পারত না। থাকিস তো  টালিগঞ্জে সরকারের  আটশো স্কোয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্টে। তাও আবার ছাত দিয়ে জল পড়ে।  তাই আবার ফুটানি। কৃষকের ছেলে! হুঁঃ।

নড়বড়ে, দুর্বল ছিল মিতুল। ছোটবেলা থেকে মায়ের শাসনে ওর ব্যক্তিত্ব তৈরিই হয়নি। জানতাম আমি। তবু  ওকে ভালবেসেছিলাম। কীরকম ভাসাভাসা চোখ, কেমন উদাস গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইত… চেহারায় আলগা চটক। ঢিলে খোঁপা, হলুদ শাড়ি। বুকের মধ্যে শেল মারা চেহারা একদম। কোমরে লচক ছিল ওর। 

সেই মিতুল। খাতাভর্তি কবিতাও গেল ওকে বিয়ে করে। বাড়ি বানানো হয়ে গেল… কষ্ট করে। ধারদেনায়। যদিও সরকারি দেনা অনন্তকাল ধরে শোধ হয়। অল্প অল্প করেই। গায়ে লাগে না। সেই মিতুল এখন আমাকেই আঘাত করে। কীভাবে করতে পারে? ওকে সব দিয়েছি আমি। নিজের বাবা-মাকে যা করে দেবার ছিল, সব ওকে দিয়েছি। এখন তো বন্ধুরা বলে, আমি ওকে এতটা দিলাম বলেই ও আমাকে এই প্রতিদান দিল। বন্ধুই বা পেলাম কোথায় আর তেমন। কয়েকটা উৎপটাং প্রেম করেছি যদিও। অফিসে, এদিকে ওদিকে। গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে সবাই। এই সুবাস দাস কারুকে ডরায় না। মেয়েরা যদি আমাকে পছন্দ করে, কোন বান্দা ঘরে ঢুকে লেজ গুটিয়ে মিউ মিউ করবে আর বউয়ের লাথিঝাঁটা খাবে? চুটিয়ে দিঘা পুরী আউটিং করে এসেছি অফিসের ট্যুরের নাম করে।

 

আরও পড়ুন: ঋতা বসুর ছোটগল্প: রূপের আড়ালে

 

মিতুলের মতো যাকে নরম, নেটিপেটি  মেয়ে ভাবতাম, সে এখন আমাকে শাপশাপান্ত না করে ঘুমায় না। আঁচলে ঘাম মোছা, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি গাওয়া মিতুল। বাবা আঁকিয়ে, মা খান্ডারনি ইশকুল মিস্ট্রেস। শাসনে শাসনে জেরবার মিতুল গান প্র্যাকটিসের ফাঁকে আসলে আমার মতো ডাকাবুকোর প্রেমে পড়ে গেছিল, কিন্তু সাহস ছিল না ওর। আমি ওকে সাহস দিলাম। সব দিলাম।  আমি সুবাস দাস। বর্ধমানের ইন্টিরিয়ারের ছেলে। পিঠে আস্ত একটা শিরদাঁড়া আর মনে প্রচুর আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি শহরে এসেছিলাম। 

কাকার কাছে থেকে আমি কত কষ্ট করে লেখাপড়া শেষ করেছি। তারপর আমার দুটো ভাইকে লেখাপড়া করিয়েছি। চাকরি পেলাম সরকারি। সবটা নিজের চেষ্টায়।  ধরাধরি না। গত ত্রিশ বছর ধরে আমি মিতুলকে নিয়ে লড়ে যাচ্ছি। মিতুলের সঙ্গে আমার দুটো ছেলেমেয়ে। বড় ছেলেটার বিয়েও হয়ে গেল। বেঙ্গালুরু চলে গেল সস্ত্রীক। ছুটকিটা এখন আমার কাছে। বিয়ে করবে ও শিগগিরই। ওর বিয়েতে দেখিয়ে দেব আমি সুবাস দাস। আমি সব পারি।  

ভাঙি তো মচকাইনি আমি। আমার সেন্ট্রালের চাকরি। সেকশন অফিসার আমি। তক্তা তক্তা লোকের পে-রোল তখন আমি ফাইনাল করি। ক্যাশিয়ার আমার পকেটে। অ্যাডমিনের সিটে বসে কয়েক বছরে নিজের জায়গা শক্ত করে ফেলেছিলাম। যতরকমের লোন, যতরকমের অ্যাডভান্স আছে পৃথিবীতে, মানে সরকারে… ভারত সরকারে… সব আমার নেওয়া হয়ে গেছে আজ।

মিতুল একবার আমাকে ‘গোপনে মদ ছাড়ান’-এর ওষুধ খাইয়েছিল। লুকিয়ে। ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে। তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে। অসুস্থ হয়ে পড়লাম আমি। সাংঘাতিক পেটখারাপ। মিতুল আর আমি তখন ছোট ছোট বাচ্চাদুটোর বাবা-মায়ের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করে চলেছি। মেয়েকে ও রোজ গান শেখায়। ছেলেকে আমি অংক কষাই। অংক না পারলে ছেলেকে পেটাই। মিতুল মেয়েকে সুর ভুল করলে চুল ধরে টেনে শাস্তি দেয়। আসলে, আমাকেই শাস্তি দিতে চায়, আর আমি মিতুলকে।

বিশ্বাস করুন পাঠক, আমি এসব কিছু বলতে চাইনি। আমি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম। কবিতা। কবিতা লেখার জন্য মন লাগে। আমি রোজ বোতল খুলে বসে মনটা তৈরি করি। আমাকে কেউ বুঝল না। এই কথাটা কাগজে ইনিয়েবিনিয়ে লিখতে চাই। কিন্তু লিখতে পারিনি কখনও। কেননা আমি ভেসে গেছি এই সবে। মিতুলকে আমি ভুলতে পারি না। মিতুলের দুর্ব্যবহারকে আমি ভুলতে পারি না। আমি মহৎ হতে চাই। আমি উদার হতে চাই। আকাশের ময়দানে আমি ফুটবল খেলতে চাই। মরতে চাইনি কখনও, আত্মহত্যা করতে যাইনি কখনও। মিতুলও তো আত্মহত্যা করেনি। দিনের শেষে ম্যাচিং শাড়ি ব্লাউজ লিপস্টিক পরেছে। 

তার মানে কি আসলে আমরা ভালইবাসি পরস্পরকে?  তার মানে কি আমাদের এই দু’জনের একসঙ্গে থাকাটা, আর পরস্পরকে ক্রমাগতভাবে ছোবল মেরে যাওয়াটা, আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে? ভাল লেগে গেছে? আরাম, কমফর্ট জোন আছে এই বিয়ের? কে জানে! কত দম্পতি এই কলকাতার শহরে এভাবে থাকে কে জানে!    (চলবে)

কলকাতার বাসিন্দা | নব্বই দশকের কবি | কৃতি ছাত্রী | সরকারি আধিকারিক | একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত | উল্লেখ্যোগ্য গ্রন্থের নাম পিশাচিনী কাব্য (১৯৯৮)‚ আবার প্রথম থেকে পড়ো (২০০১)‚ মেয়েদের প্রজাতন্ত্র (২০০৫) | কবিতাগদ্যে মননশীল্‚ গল্পেও স্বচ্ছন্দ |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *