প্রিয়নাথ অনেকদিন আসেনি। ওর জন্যে আমি যে অপেক্ষা করি সেটা কি ও জানে? মনে হয় না। জানলে নিশ্চয়ই আসত। খুবই ভালো লোক। অফিসের সবাই খুব ভালোবাসে ওকে। পঞ্চান্নর বড়বাবু থেকে সেদিন জয়েন করা বছর বাইশের মেয়েটা, সারাদিনই ওকে সবাই ডাকতে থাকে একটা না একটা কারণে। মেজবাবু একদিন বললেন,
– প্রিয়নাথ, কাল সকালে এসেই আগে মশার স্প্রে করবে। যা মশার উৎপাত! দিনের বেলায় এত মশা! বুঝি না এটা অফিস না জঙ্গল! তা বলে আবার সকাল ন’টায় যেন স্প্রে কোরো না। অফিসে ঢুকলে গন্ধে টেকা যাবে না। 

প্রিয়নাথ ঘাড় নাড়ে, যদিও এ কাজটা ওর করার কথা নয়। করে সুমিতা আর লক্ষ্মীকান্ত। ওরা দু’জন দূরে থাকে, সকালের শিফটে আসে। প্রিয়নাথ আসে বেলায়, থাকে সন্ধ্যে পেরিয়ে প্রায় রাত অবধি। তবুও ওকে বললেই কাজ হয়ে যায়। না, যা ভাবছেন তা নয়। ও সুপারভাইজারকে এদের নামে নালিশ করে না। বরঞ্চ সুমিতা আর লক্ষ্মীকান্তকে বুঝিয়ে বলে। ভুলে যাতে না যায়, সকালবেলায় ওদের ফোন করে মনে করিয়ে দেয় নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে। আমার খারাপ লাগে প্রিয়নাথের কথা ভেবে। ওদের মাইনে অফিসের বাকিদের মতন ভালো নয়। আসলে ওরা এই অফিসের নিজস্ব কর্মচারী নয়। এজেন্সির লোক। এই অফিসে দশ বছর কাজ করছে। গালভরা নাম ‘ফেসিলিটি ম্যানেজমেন্ট স্টাফ’। 

একটা কমবয়সী মেয়েকে একবার বলতে শুনলাম,
– প্রিয়দা, লেডিজ টয়লেটের উইন্ডোর কাচটা ভেঙে গেছে; একটু দেখবে প্লিজ?
প্রিয়নাথ আবারও ঘাড় নাড়ে। রাতারাতি কাচ পাল্টানো হয়ে যায়। 

আপনারা ভাবছেন একে তো এমনিতেই ভালোবাসবে সবাই। তা বটে। তবে ওর প্রতি আমার টানটা আরও কিছু অতিরিক্ত কারণে। বলছি। চার বছর আগে ওর সুপারভাইজার অনন্তবাবু ঝোলায় ভরে ছোট ছোট টবে বসানো আমাদের পাঁচজনকে একটা নার্সারি থেকে নিয়ে আসে। মানিপ্লান্ট, পিস লিলি, লাকি ব্যাম্বু, অ্যালোভেরা আর আমি– স্পাইডার প্লাণ্ট। অফিসের বদ্ধ পরিবেশে অল্প যত্নেই আমরা দিব্যি বেঁচে থাকি, ঘরের বাতাসকেও শুদ্ধ করি। দেখতেও খারাপ নই, জায়গাও কম নিই। অনন্তবাবু আমাদের নিয়ে একদিন সন্ধ্যেবেলায় এই অফিসে হাজির হল। সবাই তখন চলে গেছে। এমনকী সবশেষে যিনি যান– বড়বাবুও। নাইলনের ব্যাগটা ঠকাস করে রিসেপশনের দামি টালির মেঝেতে রেখে এসি-র হাওয়া খেতে খেতে প্রিয়নাথকে বলেছিল,
– শালা, পাচঁটা ছোট গাছেরও ওজন আছে মাইরি!
– টব আর মাটির জন্যে ভারী হয়েছে। এই পুঁচকে গাছেদের আর ওজন কতটুকু…
প্রিয়নাথ গোলগাল, বেঁটে, মাঝারি গায়ের রঙ, গাঢ় নীল রঙের ইউনিফর্ম। আমাদের যত্ন করে বসাল নতুন সেরামিক পটে। আমার ভাগ্যে জুটল একটা সাদা পট, গায়ে বাদামি আর হলুদ রঙের কল্কা করা। এই আপিসে চার মেজবাবু আর এক বড়বাবু। বড়বাবুর ঘরে গেল মানিপ্লান্ট। আমি যে মেজবাবুর চেম্বারে গেলাম সেটাতে জানলা পশ্চিমে। বেশ মিষ্টি একটা রোদ আসে। দোআঁশলা মাটির সঙ্গে একটু বালি, পিট আর কম্পোস্ট মিশিয়ে প্রিয়নাথ আমার বাড়ি তৈরি করে দিল। 

Money Plant
বড়বাবুর ঘরে গেল মানিপ্লান্ট

আমার ঘরের মেজবাবু জাঁদরেল লোক। লোকজনের ভিড়েও উনি সবসময় চিৎকার করেন। হয় কোনও লোকের উদ্দেশে, নয়তো ফোনে বা ল্যাপটপে! আমি তো প্রথমে ভয়ে কাঁপতাম থরথর করে। আমাকেই না কোনদিন টবশুদ্ধু তুলে আছাড় মারে। গরমকালে সপ্তাহে একদিন আর বর্ষা বা শীতে দু’সপ্তাহে একবার করে জল খাওয়াত প্রিয়নাথ। শনিবার অফিস ছুটি থাকলেও ওরা আসত। মেশিন চালিয়ে কার্পেট, জানলা, দরজা সব পরিষ্কার করত। আমারও সেদিন তরিবতের দিন। কোনও পাতার ডগা বাদামি হলে কাঁচি দিয়ে আলতো করে কেটে দিত। মাটিটাও একটু খুঁড়ে দিত। 

চলছিল ভালোই। একদিন হঠাৎ অফিস বন্ধ হয়ে গেল! কেউই আসেনা! প্রিয়নাথ, লক্ষ্মীকান্ত, সুমিতা, অনুপ এমনকী চব্বিশ ঘণ্টা যে ইলেকট্রিশিয়ান, সিকিউরিটি গার্ড থাকে, তাদেরও টিকি দেখতে পেলাম না। গরমে ফুটিফাটা হয়ে গেল আমার পটের মাটি। শেষদিন মেজবাবু একটা কাগজের কাপে জল নিয়ে টেবিলে রেখেছিলেন। খাওয়া হয়নি। সেই জলও আস্তে আস্তে বাষ্প হয়ে গেল। সপ্তাহ পেরিয়ে, মাস পেরিয়ে তেষ্টায় যখন ছাতি শুকনো, তখন একদিন হৈ হৈ করে ফেসিলিটির সবাই এল। সবারই মুখে মাস্ক। প্রিয়নাথ আমায় জল দিল, দেওয়ালের কোণ থেকে মাকড়সা জাল বুনেছিল আমার গায়ে, সেসব সরিয়ে মাটি ঠিক করে, শুকনো পাতাগুলো ছেঁটে আমাকে চাঙ্গা করে তুলল। ওদের মুখেই শুনলাম কোথাকার এক ভাইরাস সব মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে, মেরে ফেলছে। মানুষরাও যে অসহায়, ওদের চোখমুখ আর কথাবার্তায় প্রথম বুঝলাম। সপ্তাহে দু’দিন ওরা আসত, সব পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখত। মাঝেমধ্যে নেটওয়র্ক ডিপার্টমেন্টের লোকেরাও আসত। বাকিরা সবাই ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম। খালি ল্যাপটপ খারাপ হলে আসত পাল্টে নিতে বা সারাতে। এটাই রুটিন হয়ে গেল পরের ছ’মাস।  

বর্ষার শেষদিকে প্রিয়নাথ কয়েকদিন গরহাজির। পরে শুনলাম ওর মেয়ে হয়েছে। শুনে ভালো লাগল। তারপর একদিন এল মিষ্টি নিয়ে, সবাই হৈহৈ করল। বলাবলি করছিল যে অফিস আবার খুলবে। খুললও। মেজবাবু একদিন এসে চারদিক স্যানিটাইজ করে চেয়ারে বসলেন। প্রিয়নাথ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
– স্যর ভাল আছেন তো?
– হ্যাঁ ভালোই। আপনি?
– ভালো। একটা সুখবরও আছে স্যর।
– কী?
– মেয়ে হয়েছে।
– দারুণ খবর! ফ্যামিলি কমপ্লিট তাহলে, এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে যেন কত বড়?
– সাত বছর। স্যর, একটা কথা বলব?
– নিশ্চয়ই।
– এই গাছটা বাড়ি নিয়ে যান স্যর। ঘরের হাওয়া বিশুদ্ধ থাকবে…
মেজবাবু একটু হেসে বললেন,
– আপনি নেবেন? আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
– নিতাম স্যর, তবে আজ মেয়ের বেবিফুড কিনতে হবে তো। পরে…

ait purifying spider plant
আমাকে কেন নিয়ে গেলে না প্রিয়নাথ?

তার ক’দিন বাদেই অফিস আবার আগের মতন বন্ধ হয়ে গেল। এই একটু আগে অনন্ত এসে মেজবাবুর ঘরে ঢুকে এসি-টা চালিয়ে বসল। ফোন করল, মনে হয় অ্যাডমিনের কাউকে।
– স্যর, প্রিয়নাথের ফ্যামিলিটাকে একটু যদি দেখেন। মা, বউ, দুটো কচি ছেলেমেয়ে… একেবারে পথে বসবে যে…
ওদিকের কথা শুনতে পেলাম না। অনন্ত এবার বলল,
– মাত্র তেতাল্লিশ হয়েছিল স্যর। পরশুই কথা হল– শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু রাতারাতি এমন হবে, ভাবিনি।
আবার একটু থামল,
– ওর বউয়ের তো প্যানকার্ড নেই, অ্যাকাউন্ট খুলতে টাইম লাগবে। ততদিনে দেখুন যতটা টাকা আপনারা তুলে দিতে পারেন। আমি পিএফ আর এই মাসের মাইনেটার ব্যবস্থা করছি যতটা তাড়াতাড়ি হয়… 

আমার নিজেরই নিশ্বাস আটকে এল। প্রিয়নাথ? কোথায় গেল? প্রাণবায়ুর অভাব ঘটছিল ওর? আমার গালভরা নাম এয়ার পিউরিফাইং প্লান্ট! আমাকে কেন নিয়ে গেলে না প্রিয়নাথ? আমি গেলে হয়তো তোমার ঘরের হাওয়া একটু বিশুদ্ধ রাখতে পারতাম? হয়তো আরও একটু ভরসা দিতে পারতাম! আরও কিছুদিনের জন্য…

 

*ছবি সৌজন্য: Saatchi art, Fineart America

Prantik Biswas

প্রান্তিক বিশ্বাসের জন্ম কলকাতায়। স্কুলে থাকতে লেখা শুরু। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কালান্তর সংবাদপত্র, সময় ও গ্রন্থন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও রম্যরচনা। তারপর ২০০০ সাল থেকে দীর্ঘ পনেরো বছরের বিরতি লেখায়। ফিরে আসা ছোটগল্প, অণুগল্প, নিবন্ধ ও উপন্যাসে। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, বর্তমানে কর্মরত কলকাতায়। লেখা ছাড়া ঘুরতে, ছবি তুলতে আর আঁকতে ভালোবাসেন।

10 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *