বাড়ির কাছেই ভালোবাসার আরশিনগরের পড়শি নবনীতাদির ভালো বাসা। কিন্তু লিখতে এসে কোনও দিনও মনে হয়নি, যাই তাঁর কাছে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বইখানি দিয়ে আসি। কী জানি? দূর থেকেই যেন প্রণাম করে এসেছি । তদগত চিত্তে লেখা পড়ে চির চেনা প্রিয় মানুষটিকে দেখার জন্য বিহ্বল হয়েছি । তার পর নিরন্তর সাহিত্যকর্মী হিসেবে কেমন যেন পাপবোধ হত। এত কাছে থাকেন। এক বার দেখা করে আসব না? অভিধানে বলে সাহিত্য শব্দের অর্থ হল সহিতের ভাব, মিলন, যোগ অর্থাত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সহৃদয়ভাবে কাছাকাছি আসা। সেটা ২০১৬ সাল। আমার প্রথম উপন্যাস “কলাবতী কথা’ বেরিয়েছে সদ্য। ফোনে জিগ্যেস করে নিলাম পরের সই বৈঠকে যাব কিনা।
প্রথম দেখা হতেই আমার নাম ইন্দিরা শুনে বললেন,
“আমার রাস নাম ইন্দিরা। আমার প্রিয় নাম। বোসো ‘
আমি তখন আর থাকতে না পেরে সেই আদ্যন্ত রসিক মানুষটিকে বলেই ফেললাম, জানেন দিদি? আমার বাবার নামও নরেন্দ্র।
বললেন “সেকি?”
বললাম দিদি অব তো বাকি হ্যায়।
বললেন, “যেমন?”
বললাম, আমার জন্মও আপনার মত পৌষমাসে।
উনি বললেন, “তাহলে আর কী, সই ক্রিয়েটিভ অর্গানাইজেশনে জয়েন কর তবে ‘
আজ ঝুপ করে আলো নিবে যাওয়া সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চের নটী নবনীতা একাই সেখানে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরী হয়ে। আমরা শুনছি নিস্তব্ধ কোলাহল। তাঁর ঐহিক থেকে পারলৌকিক জীবনপথের যাত্রাগান শুনতে পাচ্ছি। প্রচুর লড়াই, স্বাধীনচেতা তবুও ঠোঁটের কোণা থেকে হাসি কোনোদিনো মেলায়নি যার, যিনি জীবনেও মনখারাপের বারান্দায় দাঁড়াননি। অপর্যাপ্ত প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে ভালোবাসার বারান্দায় নুয়ে পড়া ভরন্ত কদমের ডালের সঙ্গে নিজস্বী পোস্ট করে স্ট্যেটাস দিয়েছেন, বাদলদিনের প্রথম কদমফুল, এই বলে। উনি বলতেন পুরুষ কে বাদ দিয়ে নারীবাদ নয়। ওনার মত ছিল নারী-বাদ-নয়।
কার্তিকের অকাল শ্রাবণে হিম হিম টুপটাপ বৃষ্টির আশীর্বাদ যেন পুষ্পবৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল তাঁর শেষযাত্রায়।
এই নবনীতা দি সইয়ের বৈঠকে উচ্চৈঃস্বরে আড্ডা শুনে ধমক দিতেন আবার পরক্ষণেই হেসে কুটিপাটি খেতেন। সবাই কেবল তাঁর সঙ্গে ছবি তুলছে দেখলেই রাগ করতেন। “আমাকে না দেখিয়ে যেন পোস্ট করে দিওনা” তখন মনে হত, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।
বাংলা একাডেমীতে দ্যা পি.ই.এন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার দায়িত্ত্ব এক বার। যাবার পথে শ্রীহরিতে দাঁড়িয়ে বললাম, দিদি চল, আমরা কচুরি আর ছোলার ডাল খাই। কী আনন্দ তাঁর সেই শুনে। বললেন, উত্তম প্রস্তাব। তবে আমি বাপু নামতে পারব না গাড়ি থেকে। আমাকে এখানেই এনে দে। আমি আর গার্গী রায়চৌধুরী ছিলাম। পরিতৃপ্তিতে ভরপুর আমাদের বিকেল সে দিন সেই বিখ্যাত অথচ ঘরোয়া মানুষের সান্নিধ্যে। গাড়িতে আচমকা আমার মায়ের ফোন। বললাম এই নাও কথা বল, তোমার প্রিয় সাহিত্যিকের সঙ্গে। মা প্রণাম জানাতেই মা কে বললেন, কী ভালো মেয়ে মানুষ করেছেন আপনি! কী ভালো গান শোনায় আমাকে আর লিখছেও তো অনেক। মা বললেন, আপনার আশীর্বাদে। সেটুকুনিই আমার পরম পাওয়া।
হোয়াটস্যাপে নীল ডবল অপরাজিতার ছবি দেখেই দানা চেয়েছিলেন। সেই দানা আর দেওয়া হল না আমার। কৈলাস-মানস সরোবর গেছি শুনেই বলেছিলেন, আমার খুব যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। তুই কিন্তু মানস সরোবরের জল আমার মাথায় ছুঁইয়ে যাস। আমি এক দুপুরেই ছুটেছিলাম। সোজা বেডরুমে ডেকে নিয়েছিলেন। কৈলাস ভ্রমণের কত গল্প হয়েছিল সে দিন। টুকটুকে লাল তিব্বতী পাথরের হার নিয়ে দিয়েছিলাম হাতে। খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, লাল মালা? মেরুণ আর লাল খুব পছন্দের ছিল তাঁর।
সংবাদ প্রতিদিনের রোববার শুরু হল ঋতুপর্ণ ঘোষের সম্পাদনায় । বিনামূল্যে বিতরিত ক্রোড়পত্রটি লেকে হাঁটতে গিয়ে প্রথমদিনেই পেলাম হাতে । প্রথম রোববার খানা হাতে পেয়েই দেখলাম ল্যাপটপে বাংলায় লিখছেন প্রিয় সাহিত্যিক? এই যুগে? সেই বয়সে? সেই শুরু ভালোবাসার বারান্দার। অভিভূত হয়েছিলাম তাঁর স্পিরিট দেখে। তারপর নিয়মিত ই-ম্যাগাজিন, বাংলালাইভ ডট কমে গোগ্রাসে পড়তাম আর ভাবতাম আমরা যখন চল্লিশে ইউনিকোডে বাংলা লিখতে শিখছি তখন অশীতিপর এই লেখিকা দাপটে বাংলায় লিখছেন ল্যাপটপে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজীবন নিজেকে বদলেছেন তিনি। শ্রদ্ধায় টুপি খুলে রাখার মত।
সংবাদ প্রতিদিনের পুরনো কলম “ঘুলঘুলি” থেকে আবার ঘুলঘুলি” না “নটী নবনীতার নোটবুক” না কি “নবনীতার নামচা” কিম্বা “তাই সই” অথবা “নবনীতার বারান্দা” হবে সেই নিয়ে কত গবেষণা ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে, কত মত বিনিময় নতুন কলমের নাম নিয়ে। শেষমেশ নিজস্ব স্পেস নিয়ে একান্তে নিজের সঙ্গে যাপনের সেই ভালো মন্দ, সুখদুঃখ, টানাপোড়েন ভাগ করে নেবার লেখার শিরোনাম হয়ে গেল “ভালো বাসার বারান্দা”। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে নিজের জীবনের রূপ রস, বর্ণ, গন্ধ নিয়ে যিনি হাসিমুখে বাঁচতে চেয়েছিলেন শেষ দিন অবধি তিনি তো এমনি হবেন।
আমি কৃতজ্ঞ শিলাদিত্য পত্রিকার কাছে। তাঁদের সুপরিচিত একটি কলাম কিংবদন্তীর হেঁশেলের জন্য সেলিব্রিটিদের রান্নাঘরের বৃত্তান্ত নিয়ে যখন লেখার ভার পেলাম সেখানে প্রথম আলপচারিতা হবে নবনীতা দেব সেনের হেঁশেল নিয়ে। সেখানে এক দিকে যেমন দেব বাড়ি অন্য দিকে সেন বাড়ির রান্নাবাটি প্রসঙ্গ এল। দিদির কাছ থেকে সময় চেয়ে পাওয়া বিশাল ব্যাপার। উনি রাজি হলেন। এক বিকেলে যেতে বললেন। সে দিন তাঁর মুখনিঃসৃত কিছু হেঁশেল বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করে ফিরে এলাম। দিদি বললেন, কয়েকটা রেসিপি লিখে রাখবেন। আমাকে জানাবেন। আমি গিয়ে নিয়ে আসব। এবার ডাক পড়ল একদিন দুপুরে। বললেন খেতে খেতে কথা হবে। আরও কিছু মনে পড়বে। সে দিন ভাবলাম আহা! সই বৈঠকে এত যত্ন করে খাওয়ান আমাদের ভালোবেসে, আমি একটু নিজের হাতে রান্না করে নিয়ে যাব না? তাই আম-মৌরলা আর রুইমাছের ক্রোকে বানিয়ে নিয়ে গেছিলাম ঠিক তাঁর খেতে বসার সময়। নিজের বাড়ির খাবার গুলি সরিয়ে রেখে সে দিন আমার হাতের রান্না তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছিলেন। নিজের হাতে তাঁর পাতে তুলে দিয়ে আমার খুব শান্তি সে দিন। কিন্তু আমার দেয়াথোয়া ওইটুকুনিই। তত্ত্বতালাশ সাজিয়ে কোনও দিনও কিছু দিইনি তাঁকে। বেশি দূর এগোইনি লক্ষণরেখা অতিক্রম করে। তাই বুঝি নতুন বই দিতে গেলেই এযাবত সোজা বেডরুমে ডেকে নিতেন সাদরে।
আমার ভ্রমণ কাহিনী লেখার পেছনে যে অদৃশ্য একলব্য-দ্রোণাচার্য রসায়ন কাজ করে চলে তার জন্য সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেনের কাছে আমি চিরঋণী। কৈশোরে ভাবতাম ভ্রমণ সাহিত্য বুঝি সাহিত্যের মূলস্রোতের আওতায় পড়ে না কিন্তু যৌবনে নবনীতাদির ভ্রমণ কাহিনী পড়তে শুরু করে মনে হয়েছে এভাবেও প্রকৃতির আনাচকানাচ মাড়িয়ে, পৃথিবীর মানচিত্র প্রদক্ষিণ করতে করতে সাহিত্য সৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লেখা যায়। বর্ণনা করা যায় ভ্রমণের রূপ, রস, গন্ধ এবং রং । যখন ভ্রমণ কথা ছাপিয়ে উপছে পড়ে রসবোধ, উথলে ওঠে নতুন নতুন স্থান পরিদর্শনের একাত্ম অনুভূতিমালা।
ওঁর রম্যরচনাতেও ভ্রমণের অনুষঙ্গ এবং ভ্রমণেও রসনুভূতির কথা বারে বারে এসে পড়েছে। ” বুঝি কালান্তরে যাবে” রম্যরচনা (মিত্র ও ঘোষ) পড়তে পড়তে আবিষ্কার করেছি আবারও। নবনীতা দি বলেছেন হক কথার এককথা।
“ভ্রমণ মানে কি পালানো? না, ভ্রমণ মানে ফিরে আসা। আমার কাছে ভ্রমণ মানেই ঘরবসত। শেকড় খোঁজা। ভ্রমণ চলে যাওয়া নয়। ফিরে আসা। প্রতি দিন প্রতি দিন এই যে চলে যাওয়া, এই যে হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া, প্রতিদিনকার এই খরচ হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে একটু বাঁচানো। জমার ঘরে একটুখানি তোলা। দু’ চামচে আমি। ভ্রমণ মানে নিজের সঙ্গে দেখা। নিজের হাতটি ধরে নিজের মুখোমুখি বসা।
জগতের আনন্দযজ্ঞে কি সবারই নিমন্ত্রণ থাকে? মহাকবি মহত্ত্ব করে যাই বলুন না কেন। সর্বস্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে আঁট গাঁট ছিঁড়ে। জীবনই যদি দয়া করে আঁটো গাঁটগুলো খুলে দেয় তবেই না বেরিয়ে পড়া সম্ভব। আর সেইটেই হল জগতের মহাযজ্ঞে যোগ দেবার আমন্ত্রণ। আনন্দযজ্ঞে চিরন্তন গেস্ট কন্ট্রোল। শর্ট লিস্টেড হতে হয়। আর যজ্ঞ মানেই আগুন আর আহুতি। হবি চাই। আনন্দযজ্ঞ অত সোজা ব্যাপার নয়”। এই কারণেই উনি শুধু নিজের কাঁধে হাত রেখেই বলেছিলেন ” চিয়ার আপ ওল্ড গার্ল। বুঝি কালান্তরে যাবে? ছাড়পত্র চাই? ”
ভ্রমণ ছিল তাঁর কাছে বৃষ্টির মতো।
“মানুষ না হয়ে সাপ হলুম না কেন রে? বছর বছর দিব্যি খোলস পালটানো যেত। এ খোলসটা আর সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু ছাড়ি না কেন? প্রতিটি ভ্রমণে খোলসটা ছাড়ার চেষ্টা। একটু মুছে যাওয়া, একটু ফিরে যাওয়া। কিছু রিফু কর্ম। একটা নবজন্মের প্রয়াস। এক একটি মৃত্যুর পরিবর্ত। আমার কাছে ভ্রমণ একটা যৌগ। কিছুটা ভ্রম, বাদবাকিটুকু রমণ। দুইয়ে মিলে আমার ভ্রমণ। ”
সাহেবদের জন্য নবনীতাদির মায়া হয়। ওরা আমাদের মত ভ্রমণ করে না। করে ট্র্যাভেল। ওদের কাছে ভ্রমণ শ্রমণীয়। আমাদের কাছে রমণীয়। নয়তো কেউ ঝটিতি প্ল্যান করে অসমের সাহিত্যসভা থেকে ট্রাকে করে তাওয়াং পৌঁছে যান?
সাহিত্যসভা, আমন্ত্রিত নৈশভোজে দেশবিদেশের মানুষের সঙ্গে অহোরাত্র ওঠাবসা করেছেন তিনি। কিন্তু যেইমাত্র প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়েছেন তখনই নিজস্ব আবেগগুলিকে ধরে রাখতে পারেননি। আবার অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে তাঁর সূক্ষ রসবোধ যেন ইনজেক্ট করেছেন ভ্রমণবেত্তান্তের মধ্যে। তাই নবনীতা দেব সেনের ভ্রমণ কাহিনী পড়তে কখনও একঘেয়ে লাগেনা। এক বার শুরু করলে থামা যায় না ।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
ইন্দিরার সুখপাঠ্য এই শ্রদ্ধঞ্জলি পড়ে নিজের যৌবনে নবনীতার ”বিদেশে দৈব বশে”, ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে(?)-র মতো ভ্রমণসাহিত্য এবং কমলকুমারের গদ্য নিয়ে কঠোর সমালোচনামূলক “ পিঞ্জরে বসিয়া শুক” নিবন্ধ পড়ে আলোকপ্রাপ্তির কথা মনে পড়ে গেল। টরন্টোতে তাঁর সাক্ষাত পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছি।
ইকবাল করিম হাসনু
সম্পাদক/প্রকাশক
বাংলা জর্নাল
টরন্টো, কানাডা
কি সুন্দর লিখেছ ইন্দিরা,ভারী ভাল লাগল