ইন্টারনেট বন্ধ। হলের ভেতরও ম্যান মার্কিংটা তুখোড় চলছে। প্রধান শিক্ষক, ভেন্যু সুপারভাইজার সবাই বলে দিয়েছেন, পরীক্ষার প্রথম দিনেই নকলবাজদের বুঝিয়ে দিয়ে দিতে হবে, যে এখানে খাপ খুলবে না। প্রথম ঘণ্টাটা সেই মতো বেশ ভালোই চলল, যদিও পরীক্ষার্থীদের অনেকেই উশখুশ শুরু করে দিয়েছিল, কলম চলছিল না অনেকের। হঠাৎ বন্ধ দরজা-জানালা ভেদ করে ঘরের ভেতর শব্দ আছড়ে পড়তে লাগল – ১-এর খ, ২-এর ক, ৫ -এর গ! হলে যেন প্রাণের সঞ্চার হল! থেমে থাকা কলমগুলোও দ্রুত চলতে শুরু করল। মাস্টারমশাইরা একগাল মাছি হয়ে বসে রইলেন!
এ কি গল্প? নাহ। এ চিত্র ঘোর বাস্তব। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া জেলা মালদহে (উত্তর দিনাজপুরের কিয়দংশে) এমতাবস্থা দেখা যায় প্রায় প্রতিটি বোর্ডের পরীক্ষাতেই। প্রশাসন থেকে শুরু করে বিরোধী – গেল গেল রব তোলে সকলে। ব্যবস্থাও নেওয়া হয় কিছু কিছু। কিন্তু টুকলি অপ্রতিরোধ্য। বছরের পর বছর এই একই ছবি দেখে যাচ্ছে পড়ুয়া-অভিভাবক-প্রশাসন। আগে পাঁচিল টপকে, লোকের পিঠে চড়ে টুকলি সাপ্লাই হত। এখন প্রযুক্তির রমরমা। কাজেই কাজ সহজ হয়ে গিয়েছে। সহজ কাজ কঠিন করতে ইন্টারনেট বন্ধ করা হল চলতি বছরে। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই?
কিন্তু কেন এই প্রবণতা? মালদহ আর উত্তর দিনাজপুর – এই দুই জেলা টুকলিডমের একচ্ছত্র শাহরুখ খান হয়ে বসল কেন? এর জবাব পেতে গেলে আমাদের ঢুকে পড়তে হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুল ব্যবস্থার এক গোলকধাঁধাঁর মধ্যে… অভিমন্যুর মতো ধরে নিতে হবে এখানে ঢুকবার পথ প্রশস্ত কিন্তু বেরোবার রাস্তা অজানা। ইংরেজিতে যাকে বলে ভিশিয়াস সাইকল! তাহলে দুগগা বলে এগনো যাক –
বেশ কয়েক বছর ধরেই মালদায় বোর্ডের পরীক্ষা দু’রকমের। কারণ এখানে স্কুলও দুই রকমের। সরকারি ও বেসরকারি। এ বার চোখ কপালে উঠবে আপনার, কারণ এ তো তামাম ভারতে সর্বত্রই রয়েছে! তার সঙ্গে টুকলির কী? ব্যাপার হল, উত্তর দিনাজপুর-মালদহের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সরকারি স্কুলের সংখ্যা বেশ অপ্রতুল। কিছু কিছু এলাকায় যাতায়াত এমনই দুর্গম যে, বাচ্চাদের সরকারি ইশকুলে পড়তে গেলে নৌকো করে, বাসে চেপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাতায়াত করতে হবে। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে নানা বেসরকারি সংস্থা আগাছার মতো গাদা গাদা স্কুল বানিয়ে রেখেছে যাদের বোর্ডের কোনও অনুমোদন তো নেইই, এমনকি স্কুল চালানোর কোনও বৈধ নথিও নেই! যা হোক একটা নামের সঙ্গে ‘মিশন’ জুড়ে দিলেই হল! গাঁয়ের লোক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফ্যালে। যাক ছেলেমেয়েকে আর নৌকোয় চেপে পড়তে যেতে হবে না। ফলে সরকারি ইশকুল ছেড়ে এখানেই ভর্তি হয় দলে দলে ছেলেমেয়ে।
এখন প্রশ্ন হল, এসব স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করেন না কেন? কারণ সেটা করতে গেলে একটি মোটা অঙ্কের টাকা বোর্ডে জমা করতে হয়, নির্দিষ্ট পরিকাঠামো দেখাতে হয়, শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখাতে হয়, এমনকি তাঁদের বেতনও সরকার নির্ধারিত স্কেলে দিতে হয়। তাহলে ব্যবসা হবে কী করে? তার চেয়ে অনেক সহজ এক পন্থা এখানে চালু। সেটা কী?
‘মিশন’-মার্কা ইশকুলের ছেলেমেয়েরা ক্লাস নাইনে উঠলেই স্থানীয় কোনও সরকারি হাইস্কুলের হয়ে তাদের নাম নথিভুক্ত করা হয়। সেই সরকারি স্কুলের ছাত্র সেজেই তারা বোর্ডের পরীক্ষা দেয়, অথচ আদতে তারা সে স্কুলের ছাত্রই নয়। কিন্তু ‘মিশন’-এর ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এদের ভালো রেজাল্ট করাটা জরুরি! কী করে হবে ভালো রেজাল্ট? উত্তর অমোঘ! টুকলিইইইইইইই!!!
যে পরীক্ষাকেন্দ্রে এই ছেলেমেয়েদের সিট পড়বে, সেখানে পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে শুরু করে পরীক্ষার হলে টুকলিতে সাহায্য করার মতো পরিবেশ তৈরি করা– সবই হয়ে যায় আগাম সেটিংয়ের কল্যাণে। তার জন্য কোথাও স্কুল পরিচালন কমিটির সভাপতিকেও দেখা যায় কোনও জাদুবলে পরীক্ষা পরিচালনার সদস্য হিসেবে পরিচয়পত্র পেয়ে দিব্বি ডিউটি করছেন! ফলে টুকলিতে কোনও অসুবিধেই নেই।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি কোনও পরীক্ষা কেন্দ্র ঠিকঠাক ম্যানেজ না হয়? কোনও ভাবে টুকলিতে বাধা পড়ে? এ বছরে যেমনটা হল কালিয়াচকের গোলাপগঞ্জ হাইস্কুলে! পরীক্ষা শুরু হতে না হতে রব উঠল, টুকলি ধরার নামে নাকি পরীক্ষার্থীদের শান্তিতে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হচ্ছে না! এই অভিযোগে পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে শুরু হল তুলকালাম, ভাঙচুর! আর সেই সুযোগে তিনটে পরীক্ষার খাতা নিয়ে উধাও হয়ে গেল তিন পরীক্ষার্থী। পুলিশ ডাকা হল। পুলিশ এসে দু’জনকে খাতাসমেত ধরল। কিন্তু তিন নম্বরকে পাওয়া গেল না। মিডিয়াতে খবরও হল।
অথচ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর জানা গেল, সব খাতাই বোর্ডে চলে গেছে ঠিক ভাবে। কোনও পরীক্ষার্থীর বিরুদ্ধেই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রেও নিন্দুকদের দেওয়া খবর হল, হারানো খাতা উদ্ধারের প্রয়োজনই নেই! শীর্ষ স্তরের নির্দেশে সেই ভাগলবা ছাত্রকে দিয়ে নতুন করে উত্তর লিখিয়ে হিসাব মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে! খেল খতম, পয়সা হজম!
উদাহরণ আরও আছে!
পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন, রতুয়ার একটি স্কুলে পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রশ্নপত্রের ছবি তুলতে গিয়ে মোবাইল সহ হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেল এক পরীক্ষার্থী। তাকে গ্রেপ্তার করা হল। কিন্তু পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতর সেই পরীক্ষার্থী এবং বাইরে তার পরম সুহৃদরা তুলকালাম বাধিয়ে দিল! শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামলে সেই পরীক্ষার্থীকে থানায় নিয়ে গেল। পরদিন তাকে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে তোলাও হল। কিন্তু তার পর কী হল? এর উত্তর কোথাও পাওয়া গেল না। তবে, এটা জানা গেল যে নকলনবিশ ছাত্রটি রতুয়ার এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ পরিবারের সন্তান। ফলে যারা তাঁকে কট বিহাইন্ড করেছিলেন, তাঁরাই এখন উল্টে আশঙ্কায়! বদলি না হতে হয়! আর এই ঘটনার জেরে, দ্বিতীয় দিনের পর থেকে জেলার কোত্থাও কোনও পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল ধরা পড়ার খবরই বাইরে এল না!
তবে প্রশাসন কি একেবারেই চেষ্টা করে না? করে। নিশ্চয়ই করে। এ বারই তো দেখা গেল প্রত্যেক পরীক্ষাকেন্দ্রের গেটের বাইরে ফ্লেক্স ঝুলিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের কথা বড় বড় অক্ষরে লেখা। কিন্তু নিন্দুকেরা বলছেন সেটা আসলে বজ্র আটুনির পেছনে ফস্কা গেরোর ব্যবস্থা করে রাখা আর কী। লেখা তো রয়েছে, মোবাইল নিয়ে হলে ঢোকা যাবে না। ধরা পড়লে পরীক্ষা তো গেলই, মোবাইলটাও বাজেয়াপ্ত করা হবে। কিন্তু মোবাইল সঙ্গে আছে কিনা সেটা দেখবে কে? আর কী ভাবে? সেটা কেবল পরীক্ষার্থীদের মৌখিক জবাবের উপরেই ছেড়ে দিতে হয়েছে। কারণ গায়ে হাত দিয়ে তল্লাশি চালাবার নির্দেশ ছিল না! মেটাল ডিটেক্টরের তো প্রশ্নই নেই। ফলে হলের ভেতর যখন হাতে হাতে বেরিয়ে আসছে মোবাইল, তখন ইনভিজিলেটরদের হল মহা বিপদ। কেউ চুপ করে থাকলেন, আবার কেউ কেউ মনে জোর এনে মোবাইলধারীকে পাকড়াও করলেও ‘উপর মহলের অদৃশ্য পরামর্শ‘ মেনে সেটা নথিভুক্তই করা হল না। বিদ্যা-ব্যবসা যুগ যুগ জিও! সৌজন্য়ে টুকলি।
আশ্চর্যের বিষয় হল, সদাজাগ্রত সর্বশক্তিমান মিডিয়ারও এ ব্যাপারে হাত-পা বাঁধা! তাদের কাছে খবর আছে যে, পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক সংগঠনের এক মহামহিম কর্মকর্তা পরীক্ষা চলাকালীন জনৈক মিশন মালিককে একাধিকবার ফোন করেছেন। কথোপকথনের বিষয় ছিল ইন্টারনেট যখন বন্ধ, তখন মিডিয়াকে আড়াল করে এই সুযোগটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার কী ভাবে করতে হবে! কাজেই টুকলিই যখন “ওয়ে অফ লাইফ”, তখন কেয়া করেগা মিডিয়া আর কেয়া বা করেগা শিক্ষক! এক শিক্ষক তো হতাশ হয়ে বলেই ফেললেন, ‘পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যে পরীক্ষার্থীর মেরিট যাচাইয়ের কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা এ লাইনে এসে অনেক দিন আগেই বুঝে গিয়েছি। তাই এখন পরীক্ষার হলে টোকাটুকি দেখলে হয় চোখ বুজে থাকি, নয় গল্পের বই পড়ি। ছেলেমেয়েদের কেবল অনুরোধ করি বেশি হৈচৈ কোরও না বাপু তোমরা।‘
মানস আজন্ম মালদহের বাসিন্দা। জেলাকে চেনেন হাতের তালুর মতো। পেশায় সাংবাদিক। নেশায় মানবাধিকার কর্মী। মালদহেই ‘রূপান্তরের পথে’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িত। অবসরে পরোপকার করে বেড়াতে সবচেয়ে ভালোবাসেন।