২০১৩ সালে বাংলাদেশের সানজিদা এবং শ্রাবন্তী ফতোয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে যখন সোচ্চারে নিজেদের প্রেমের কথা স্বীকার করেছিলেন, অনেকেই তা মানতে পারেননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় কম সমালোচনা হয়নি তাঁদের। প্রাচীনপন্থীরা কটাক্ষ করেছিলেন, তথাকথিত আধুনিকরাও ভ্রু কুঁচকেছিলেন। সমকামী প্রেমের রাস্তাটা যে কোনও দিনই মসৃণ ছিল না। কিন্তু আজ ২০১৯ –এ কলকাতার দীপন আর তিস্তার প্রেম এবং বিয়ে কিন্তু আনন্দের। কলকাতার প্রথম রামধনু বিয়ে নিয়ে সবাই খুশি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্রুপের বদলে শুধুই আছে শুভেচ্ছা আর ভালবাসা। তা হলে কি এত দিনে আমরা সাবালক হলাম? পুরানো ধ্যানধারণা বর্জন করে পরিবর্তনকে খোলা মনে স্বাগত জানাতে শিখলাম? হয়তো তাই। এখন আইনত হয়তো অনেকটা রাস্তা চলা বাকি আছে, কিন্তু মনের জানলাটা আজ অনেকটা উন্মুক্ত। এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওনা। তাই না?

২০১৮-এ সমকামিতা অপরাধমুক্ত হওয়াটা যদি ভারতীয় আইনবিধির একটা বিরাট মাইলফলক হয়, তা হলে দীপন আর তিস্তার বিয়ে কিন্তু সামাজিক অগ্রগতিরই প্রতীক। ওঁরা দুজনেই রূপান্তরকামী। দীপন এক সময় ছিলেন দীপান্বিতা আর তিস্তা ছিলেন সুশান্ত। অনেক বাধা পেরিয়ে আজ তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। সমাজের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা করেননি কেউই। কারণ প্রেম যে সব সময় আগলে রেখেছিল তাঁদের। তাই তো আজ তাঁদের এই আজীবন একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতিতে তাঁরা আর একা নন, সামিল হয়েছে প্রেমের শহরের বাসিন্দারাও।

তবে দীপন আর তিস্তাই কিন্তু প্রথম নন। এই রাস্তা হেঁটেছেন আরও অনেকে। অঞ্জলি চক্র আর সুন্দাস মালিকের প্রেমকাহিনি তো ঠিক রূপকথার মতোই। অঞ্জলি ভারতীয়, সুন্দাস পাকিস্তানি। দু’জনেই নিউ ইয়র্কে থাকেন। একে অপরকে ভালবাসেন পাগলের মতো। সম্প্রতি তাঁদের সম্পর্কের এক বছর পূর্তিতে বিশেষ ছবি তোলেন তাঁরা। সনাতনী পোশাকে সেজে ওঠেন দু’জনেই। কখনও বৃষ্টিভেজা ছাতার নীচে তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি করছেন চিত্রগ্রাহক, তো কখনও দু’জনের হাসি-খুশি মেজাজ ধরা পড়েছে ক্য়ামেরায়। ‘আ নিউ ইয়র্ক লাভ স্টোরি’ নামে ছবিগুলো নেট দুনিয়ায় আসতেই ভাইরাল হয়ে যায়। তাঁদের প্রেমকে কুর্নিশ জানিয়েছেন অনেকেই। শুভেচ্ছা, শুভ কামনায় ভরে উঠেছে তাঁদের ইনস্টাগ্র্যাম অ্যাকাউন্ট। প্রেম যে সত্যি লিঙ্গ দেখে না তা প্রমাণ করেছেন অঞ্জলি আর সুন্দাস।

আর এক দম্পতি অমিত শাহ আর আদিত্য মদিরাজুর বিয়েও একই ভাবে ছুঁয়ে গেছে অনেকের মন। নিউ জার্সিতে থাকলেও দু’জনে মনে প্রাণে একেবারেই ভারতীয়। তাই তো সমস্ত রীতি-নীতি মেনে ভারতীয় মন্দিরে বিয়ে করেছেন তাঁরা। অমিত পেশায় কোরিওগ্রাফার, আদিত্য আবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করেন। দু’জনেই খুব রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে। অথচ তাঁদের এই বিয়েতে আপত্তি করেননি পরিবারের কেউই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন সবাইকে পাশে পেয়েছেন তাঁরা তাঁদের এই নতুন জীবনের শুভারম্ভে। তাঁদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষরা মুগ্ধ হয়ে যান। নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে ইতিবাচক কথায় ভরে গেছে তাঁদের ওয়াল। তাঁদের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন অনেকেই।

কিন্তু আজও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়, এখনও কি সমকামী প্রেম সম্পূর্ণভাবে মানতে পেরেছি আমরা? না হলে কেন অসমের গুলসারা আর আমিনাকে একসঙ্গে থাকার জন্য কোর্টে হলফনামা দিতে হয়? তাঁদের প্রেমকে কেন আইনের দ্বারস্থ হতে হয়? উত্তর প্রদেশে বাড়ি থেকে কেন জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় দু’ই বন্ধুকে? কেন তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধ স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে হয় দীর্ঘ ছ’বছর?  শুধু সমকামিতাকে অপরাধমুক্ত করাই যথেষ্ট নয় বোধহয়। সমকামী সম্পর্ক মান্যতা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিয়ে আইনত নথিভুক্ত করার সুযোগ এখনও নেই। ফলে তাঁদের লড়াইটা এখনও কঠিন।

দীপন-তিস্তা, আদিত্য-অমিত বা অঞ্জলি-সুন্দাস যে রাস্তাটা দেখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে সাহস জোগাবে অনেক সমকামী দম্পতিদের। তবে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। আমরা সত্যিকারে ভালবাসার রং তখনই চিনতে পারব, যখন আর রামধনু বিয়ে নিয়ে আলাদা আলোচনার প্রয়োজন পড়বে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *