আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] []

মহৎ রাত্রির  জিমনাশিয়াম 

আমাদের টেলিফোন নেই, ফ্রিজ নেই,
আমাদের ফিক্সড্‌ ডিপোজিট নেই, ভালোবাসায় উচ্ছ্বাস নেই,
তবু যে জলতরঙ্গটা আছে, সেই জন্যেই,
হ্যাঁ, সেই জন্যেই, জানো, আমরা এখনো টিকে আছি।

–অরণি বসু 

কফিহাউসে আমি প্রথম ঢুকি এক কাপ ইনফিউশন পাঁচ টাকার সময়কালে, সেটা ২০০৩। যদিও এই ভবনকে কেন্দ্র করে বহু ঘটনার উত্থান ও পতনের মহাকাব্য রচিত হয়েছে, এবং অবরে সবরে জায়ান্টদের ছেঁড়া জাঙিয়ার একঝলকও দেখে নিয়েছি আমরা সে হুল্লোড়ের ছিদ্রকাঁথায় চোখ রেখে, তবু কফিহাউসের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার হৃদ্যতা যে ‘কী ভাল-হো তো? আসি তবে?’-তেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, তার একটা বড় কারণ কর্ম ও মননে দক্ষিণ-কলকাতা-লগ্নতাও হতে পারে। নাছোড় স্মৃতি তবু অমনোযোগের মুঠি গলে চুঁইয়ে পড়বে, মনে করাবে, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় ও কিন্নর রায়ের সাহচর্য প্রথম দিনটায়, শাহজাদ ফিরদাউসকে দেখা, কবিতীর্থর সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্য, বাইরে বেরিয়ে পার্থদার সঙ্গে শেয়ালদার দিকে হাঁটার সময়ে দুম করে আফসার আমেদ, আমার কিশোরচোখে এঁরা তখন টাইটানতুল্য। পার্থদা র‍্যাডিকালের ছোট্ট দোকানঘরে গিয়ে বসতেন, সেখান থেকে তাঁকে তুলে এনে কফিহাউস। মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাচ্ছেন ‘দিবারাত্রির কাব্য’র সম্পাদক আফিফ ফুয়াদ, তখন তাঁর মাথার সব চুল কালো ছিল। একদিন এলেন ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, লাজুক মানুষটিকে দেখে গম্ভীর লাগত, কম কথা বলতেন। সুবল সামন্ত ‘এবং মুশায়েরা’র লেখা সংক্রান্ত বিষয়ে পার্থদার সঙ্গে গম্ভীর শলা করছেন আর একপাশে জড়োসড়ো বসে আমি জানালা দিয়ে দেখে যাচ্ছি ট্রামলাইনের প্রলয়বিষাণ, উজ্জ্বল যুবতীদের। তবু এসব কারণে কফিহাউস স্পেশাল ছিল না। অন্তত আমার কাছে সে বিশেষত্বের দাবিদার, কিছুমাত্র থাকে যদি, তার কারণ অসংখ্য ছোটপত্রিকার জন্ম নেওয়া ও মরে যাওয়া, বেশিটাই কলেজবালকবালিকাদের হাত ধরে, আমরা এই কফিহাউসে দেখেছি।

Coffee House entrance
কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে প্রথম ঢুকি…

অন্তত চারটে কাগজের কথা মনে করতে পারি যারা আমার কলেজজীবনের তিন বছরের মধ্যে কফিহাউসে জন্ম নিয়েছিল। জন্ম নেওয়া মানে, টেবিলে বসেই প্ল্যান করে ফেলা, ছকে ফেলা প্রথম সংখ্যাতে কী থাকবে, তখনও মোবাইলের যুগ নয় বলে সবাইকে ধরতে পারা গেল না, তাই উপস্থিতদের মধ্যেই বেছে নেওয়া হল লেখকসূচি, বাকিদের রাত্রে ফোনে জানালেও হবে— চার ফর্মার মধ্যেই রাখা উচিত, যদিও বাইন্ডারের কাছে টাকা বাকি থাকবে, সে ম্যানেজ করে দেওয়া যাবে চা সিগারেট খাইয়ে, আর প্রুফ দেখবে কে? কেন আমরাই, এই টেবিলে বসেই দেখে নেব একটার পর এক। সেই প্রাণোৎসব ভোলার নয়, যখন হেরে যাবে জেনেও দাঁতে দাঁত চিপে পরবর্তী ও শেষ সংখ্যা বার করবার জন্য লড়ে গিয়েছে যুবক-যুবতীরা। সেসবের সাক্ষী আছে টেবিল ও ওয়েটারের দল, যারা দুই কাপ ইনফিউশন নিয়ে চারজনের দলকে তিন ঘণ্টা বসে থাকতে দিয়েছে দিনের পর দিন, সামনে তাদের ছড়ানো প্রুফ, কাঁচুমাচু ভাষাবিন্যাস, অকুলান অর্থের। স্বল্পতার সঙ্গে প্রাচুর্য্যের অমন মিলন আর কোথায় দেখব, মিলনে যদি পাপ হয় তো ওই মহৎ পাপ রাখব, তেমন আধার কই! সেই চারটের মধ্যে দুটো ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের নকশালপন্থী ছাত্রছাত্রীদের বার করা। একটা বার করত উত্তরপাড়ার তরুণ কবি রামেশ্বর মণ্ডল, যে প্রেসিডেন্সি বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্র ছিল না, সত্যি বলতে কী কলকাতার সঙ্গে তেমন সংযোগ থাকার কথাও নয় তার, তবু অপ্রবেশ্য যুক্তিতে সে ঠিক করেছিল কফিহাউসই হবে তার অফিস, কলকাতার কবি লেখক কাউকেই তেমন না চিনলেও। চতুর্থটার স্মৃতি আবছা, সে বিষয়ে আর কিছু বলছি না।

মনে আছে শুধু, কোনও কাগজই দুটো সংখ্যার বেশি টেকেনি। অর্থাভাব মূল কারণ হলেও, নিজেদের ভেতরকার দলাদলি, হিংসে ইত্যাদিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। দুই কিস্তিতে সঙ্ঘ ভেঙে যায়, দলবদল হয় চুপিসাড়ে, রাইভাল পত্রিকা, যার রাইভাল হবার কারণই ছিল না যদি না কোনও এক সান্ধ্য আড্ডায় দুই সম্পাদকের মধ্যে মহিলাঘটিত ঝামেলা হত, সেই পত্রিকায় লেখা ছাপানো নিয়ে কিষকিষে মনোমালিন্য, এসব থাকে। কফিহাউসের লম্বা ফ্যানগুলো, বাথরুমের ইঁদুর আর অবেলার কবিরাজি জানে সেসবের ইতিহাস। কিন্তু সেসব মলিন করে দেয় না শুরুর দিনগুলো। আমরা জানি এসব কাগজের প্রিম্যাচিওর মৃত্যু ভবিতব্য, হননবিলাসই মুখ্য ইতিহাস ছিল না তবু। সেই সময়টায় বাম শিবিরগুলোর ভেতর বিভাজন তীব্র ছিল, এমনকী এক শিবিরের মধ্যেও বিভিন্ন বাঁক পড়া যেত অনায়াসে। 

Coffee House
অন্তত চারটে কাগজ কলেজজীবনের তিন বছরে কফিহাউসে জন্ম নিয়েছিল।

বেশ মনে আছে, এক দুপুরবেলা টেবিলে বসে পত্রিকার কাজ করতে করতেই নীচে মিছিলের ডাক পড়েছিল, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের খাতা রিভিউ করার দাবিতে আন্দোলন। চারজনের তিনজন নেমে গেল, একটি মেয়ে গেল না, উদ্ধত স্পর্ধায় বসে থাকল একা। আমি পাশের টেবিলে বসে বাকি তিনজনের ইতস্ততা স্পষ্ট ছুঁলাম, এক স্পেসের সহযোদ্ধা কীভাবে অপর স্পেসে ব্যারিকেডের ওপারে চলে যায়, সে নিয়ে তাদের অস্বস্তি ও বিভ্রম সেদিন ঘেমো দুপুরের মতো ভেপে উঠছিল কফিহাউসে। কিন্তু গোল চশমা পরা ফর্সা সেই মেয়েটি, বেগুনি সালোয়ার কামিজ পরেছিল মনে আছে, ঘাড়টা সামান্য বেঁকিয়ে রাখল জানালার থেকে, যেন দেখতে চায় না। মিছিল শেষে আবার ফিরে এল তিনজন, দোনোমোনো করছিল, ফেলে রাখা কাজ আবার কি হাতে নেওয়া যাবে? ঘাড় ঘোরানো মেয়েটি না তাকিয়ে সটান বাড়িয়ে দিল একতাড়া কাগজ, এই সময়টায় প্রুফ দেখে ফেলেছে। একে একে তিনজন বসল, চেষ্টা করছিল কিছুই হয়নি ভাব করার, তবু টুকরো কথার জাল তাদের মধ্যবর্তী শূন্যতাকে বুনতে পারছিল না। নানা অছিলায় একে একে তারা উঠে পড়ে, নেমে যায় সিঁড়ি ভেঙে, কেউ কারওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল কিনা, বুঝিনি। 

উপস্থিতদের মধ্যেই বেছে নেওয়া হল লেখকসূচি, বাকিদের রাত্রে ফোনে জানালেও হবে— চার ফর্মার মধ্যেই রাখা উচিত, যদিও বাইন্ডারের কাছে টাকা বাকি থাকবে, সে ম্যানেজ করে দেওয়া যাবে চা সিগারেট খাইয়ে, আর প্রুফ দেখবে কে? কেন আমরাই, এই টেবিলে বসেই দেখে নেব একটার পর এক। সেই প্রাণোৎসব ভোলার নয়, যখন হেরে যাবে জেনেও দাঁতে দাঁত চিপে পরবর্তী ও শেষ সংখ্যা বার করবার জন্য লড়ে গিয়েছে যুবক-যুবতীরা। 

এই একটা দৃশ্য তৎকালীন বহু কাগজের ইতিহাস লহমার অঞ্জলিতে ধরে, জানিয়ে দেয় কোন রহস্যে জন্মমুহূর্তের কনুই ধরে ঝুলতে পারে বিনাশকাল। কাগজ বেরতে ব্যাখ্যাহীন দেরি হয়, বার করার পরে টাকা বাকি থাকে, বিক্রি করানোর জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, পাতিরামের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় জুলজুল চোখে, সেসব তো ছিলই। কিন্তু বন্ধুবিচ্ছেদ, নিটিপিটি অভিমান, মতবিরোধ ও তার থেকেও বেশি ব্যক্তিগত সমস্যা, জীবনের প্রায়োরিটি পালটে যাওয়া। রাজনীতি ছেড়ে দিলে পত্রিকাও বন্ধ হয়ে যায়, কেউ হয়তো উজ্জ্বল কেরিয়ারের হাতছানিতে উড়াল জমায় অন্য আকাশে, সেসবের গল্প লিখতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। কফিহাউস সেসবের সাক্ষী ছিল। রামেশ্বরের কাগজে এসব সমস্যা ছিল না, কারণ প্রত্যক্ষ কোনও রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল না তার। কিন্তু স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল, সেটা মানকুণ্ডুতে, আস্তে আস্তে কফিহাউসে আসা কমে গেল তার। ভেবেছিল, উজ্জ্বল অনুজের কাঁধে ভর দিয়ে গড়িয়ে যাবে আরও কিছুদূর, তবু তাদেরও নিজস্ব জীবন তো থাকে, দাবিদাওয়া থাকে। রামেশ্বরের কোনও বই বেরয়নি, কাগজ বার করাতেই সার্থকতা ভেবেছিল, ভেবেছিল বেঁচে থাকবে আজীবন। কিন্তু যা হয়, হতাশ হয়ে, অথবা হয়তো জীবনের চাপে, সেও কবিতা লেখা ছেড়ে দিল। কাগজটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই, এবার লেখাও গেল। শুনেছি বহুবছর আর কফিহাউসে আসে না।

coffee-house
স্বল্পতার সঙ্গে প্রাচুর্য্যের অমন মিলন আর কোথায় দেখব!

তো এভাবেই, কেউ নিরলস, কেউ নির্লিপ্ত, কেউ ছেড়ে দিল, কেউ অভিমানে সরিয়ে নিল নিজেকে, আবার এলোমেলো চলতে চলতেই টিকেও গেল মুষ্টিমেয় স্বজন, এগুলোই সেই সময়ের ইতিহাস, কফিহাউসের রামধনু হরফে আখর লেখার অন্য দিক। এভাবে আমাদের মাকন্দো তৈরি হয়েছিল, মরেও গিয়েছিল একসময়ে। সকলেই মহীরূহদের ইতিকথা লেখে, কফিহাউসে সুনীল শক্তি যা আলেখ্য রেখে গিয়েছেন সেসব, তবু মহীরূহদের নিচেই ছিল অসংখ্য ঝোপঝাড়, যারা কিছুকাল বেঁচে শুকিয়ে গেল, আর মাটির গভীরে চারিয়ে দিল দুর্বল শেকড়, সেসবের আখ্যান কে লিখবে! টেবিলে টেবিলে উজ্জ্বল চোখের ছেলেমেয়েরা শুধুমাত্র ভালো কাগজ করবার জন্য যেরকম শ্রম দিত, অবহেলায় অপচয় করত সোনালি সময়, প্রতিষ্ঠানধন্য সেলেব্রিটি লেখকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে যেরকম জেদে অনামী অর্জুনদের বিজয়রথ ছোটাবার ভূমি তৈরি করে যেত নীরবে, সেসব স্বার্থহীন বা সঙ্কীর্ণতাশূন্য ছিল না, কিন্তু কার কী এসে যায় তাতে! কোনও সম্পাদক নিজের নাম পাকাপোক্ত করবার উদ্দেশ্যে, অথবা গোষ্ঠী বানাবার জন্য, পকেটের টাকা দিয়ে একটা কাগজ করল, শেষমেষ সেই প্রয়াসই তার উদ্দেশ্যকে অন্তর্ঘাত করে বারবার, এবং সেই কাগজ মুছে যাবার পরে সবাই তাকে ভুলে গেলেও যে অখ্যাত লেখকদের বাসভূমি হিসেবে কিছুকাল থেকেছিল, তারাও তো এক হিসেবে বাংলা লেখালেখিকে ভগ্নাংশের মিলিমিটার হলেও এগিয়ে দেয়, সাগরবন্ধনের নুড়িবালি সরবরাহে তাদের ভূমিকা কম কী! শেষমেষ কেউ আর সম্পাদকের উদ্দেশ্য মনে রাখে না, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় ভাঙনের কারণ, থেকে যায় শুধু লেখাগুলো, কাগজটার কথা কারওর স্মৃতিতে। 

২০০৮ সালে এক প্রবল বৃষ্টিতে সন্ধ্যেবেলায় আমরা অনেকে কফিহাউসের ভেতর আটকে ছিলাম। কারেন্ট ছিল না, অন্ধকারে মোমবাতিও রাখেনি কেউ। কলকাতা ভেসে গিয়েছিল সেদিন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কিন্তু আমি তখন ভীত মুখগুলো দেখছিলাম না। দেখছিলাম, দমকা বাতাসে বহু কাগজ উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরময়। মৃত লেখাদের আত্মা, যারা অব্যার্থ লয়ালটি গচ্ছিত রেখেছিল এই ঘরটার প্রতি, তারা যেন জেগে উঠেছে সে ভৌতিক রাতে, এবং দিগন্তময় ডানা বিস্তারের আকাঙ্ক্ষায়, পরম ভালোবাসা ও বিশীর্ণ আকুতিতে ঢেকে দিতে চাইছে নিজেদের কবরখানাকে। পাণ্ডুলিপি পোড়ে না। ইনফিউশনের গন্ধ মেখে ঘুমিয়ে থাকে। পুনরুত্থানের অপেক্ষায়।   (চলবে)

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৭ নভেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Getty Images, Flickr

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *