দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ‘ঠান্ডা মেরে’ গেছে বলে অনেকেই তখন হাফ ছেঁড়ে বেঁচেছেন। সেই সর ঠাণ্ডা হয়ে জমতে না জমতেই একদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রশক্তিরা পরস্পরের দিকে শিকারি বেড়ালের মতো ফুঁসতে শুরু করেছে। বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, অলবেনিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ডকে পকেটস্থ করা শুরু করেছে কমিউনিজ়ম ইংল্যান্ড, আমেরিকা জুড়ে নতুন হিস্টিরিয়ায় কেজিবি এজেন্ট সন্দেহে একের পর এক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে চার্লি চ্যাপলিন, ল্যাংস্টন হিউজ, আর্থার মিলার, পিট সিগার, লেনার্ড বার্নস্টাইনরাও রয়েছেন সন্দেহভাজনের তালিকায় এরকম গুপ্তচরবৃত্তির চিরুনি তল্লাশির মাঝেই সবার মনে নতুন এক আতঙ্ক – এই বুঝি আর একবার পরমাণু বোমা পড়ে! 

১৯৫১ সালে দুই ব্রিটিশ কূটনীতিক ডন ম্যাকলিন এবং গাই বার্জেস বেমালুম গায়েব হয়ে যান তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ে। দেখা যায় তাঁরা আসলে গুপ্তচর ছিলেন এই বিশ্বাসঘাতকতা ইংল্যান্ডের মর্মে আঘাত করেছিল। ঘটনাটা প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল ইয়ান ফ্লেমিং নামক এক ব্রিটিশ ভদ্রলোককে। এই ফ্লেমিং ছিলেন একজন সাংবাদিক এবং শেয়ারবাজারের দালাল, তবে তারও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেছিলেন। 

Ian Fleming
ফ্লেমিংয়ের জন্ম লন্ডনের এক ধনী পরিবারে

নিজের সেই অভিজ্ঞতা দিয়েই ‘জেমস বন্ড’ নামে যে গুপ্তচর চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং, তা শুধুই  থ্রিলার সিরিজ় হিসেবে সফল হয়নি, তাকে নিয়ে পরবর্তীকালে তৈরি হওয়া সিনেমাগুলো কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। ফ্লেমিং বলেছিলেন,
– জেমস বন্ডের চরিত্র সৃষ্টি আমি করেছিলাম ঠিকই, তবে তার সঙ্গে আমার খুব বেশি মিল নেই। বন্ডের মতোই আমি স্ক্র্যাম্বলড এগ খেতে ভালোবাসি না, হাফহাতা শার্ট পছন্দ করি না। তবে জেমস বন্ডের মতো খিদে বা সাহস আমার নেই।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইয়ান ফ্লেমিং নিজেও কম কিছু বন্ড নন!

ফ্লেমিংয়ের জন্ম লন্ডনে, ১৯০৮ সালে এক ধনী পরিবারে। বাবা ছিলেন পার্লামেন্টের সদস্য; তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন এবং ১৯১৭ সালের ২০ মে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান শেলের আঘাতে মারা যান। ১৯১৪ সালে ইয়ান ডর্সেটের ডার্নফোর্ড স্কুলে ভর্তি হন। স্বাদহীন খাবার, শারীরিক পরিশ্রম আর অন্য ছেলেদের হাতে উত্যক্ত হওয়া- সব মিলিয়ে এখানে তাঁর দিনগুলো ভালো কাটেনি। ১৯২১ সালে তাঁকে ভর্তি করা হয় ইটন কলেজে। শুরু হয় তাঁর অগোছালো জীবনযাপন। প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্ট বরাবর খারাপ হতে থাকলেও, অ্যাথলেটিক্সে তিনি দারুণ পারদর্শী ছিলেন। শেষমেষ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবস্থা দেখে পরিবারের দুর্নামের ভয়ে মা তাঁকে ছাড়িয়ে অভিজাত মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্যান্ডহার্স্ট-এ এনে আর্মি অফিসারের ট্রেনিং শুরু করান। 

কিন্তু হল কী, কিছুদিনের মধ্যেই এক পতিতার সাহচর্যে এসে ইয়ান গনোরিয়া বাধিয়ে ফেললেন। জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে এবার মা ইভলিন ইয়ানকে অস্ট্রিয়ার ‘কিযবেলের টেনেরফ’ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন। টেনেরফ ছিল ধনীর বিগড়ে যাওয়া দুলালদের জন্যে বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চালাতেন সাবেক ব্রিটিশ গোয়েন্দা ইরনান ফোর্বস ডেনিস এবং তাঁর সাহিত্যিক স্ত্রী ফিলিস বটম। এঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ইয়ানের ভেতরে এসেছিল গোয়েন্দাবৃত্তি এবং সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। অস্ট্রিয়া এবং সুইৎজারল্যান্ডে দিন কাটানোর সময় সেখানে পর্বতারোহণ এবং স্কি ছিল তাঁর নেশা। ফ্লেমিংয়ের বড় ভাই পিটার ছিলেন একজন অভিযাত্রী এবং ভ্রমণকাহিনি লেখক। তাঁর প্রভাবে ইয়ানও প্রথম দিকে ভ্রমণ-বিষয়ক একখানা নন-ফিকশন বই ‘থ্রিলিং সিটিস’ লিখে ফেলেন। 

১৯২১ সালে তাঁকে ভর্তি করা হয় ইটন কলেজে। শুরু হয় তাঁর অগোছালো জীবনযাপন। প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্ট বরাবর খারাপ হতে থাকলেও, অ্যাথলেটিক্সে তিনি দারুণ পারদর্শী ছিলেন। শেষমেষ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবস্থা দেখে পরিবারের দুর্নামের ভয়ে মা তাঁকে ছাড়িয়ে অভিজাত মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্যান্ডহার্স্ট-এ এনে আর্মি অফিসারের ট্রেনিং শুরু করান। 

এরপর ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রকে কাজ করতে চেয়েও সুযোগ মিলল না। কিছুদিনের জন্য তিনি রয়টার্সে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন সোভিয়েত রাশিয়ায়ও ছিলেন। পরে লন্ডনে শেয়ারবাজারে দালালির কাজ করতে শুরু করেনদীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন ইয়ান ফ্লেমিংও ছিলেন মেয়েদের নয়নমণি। কিন্তু আদতে ব্রিটেনের উচ্চশ্রেণির জীবনে হাঁপিয়ে উঠছিলেন ফ্লেমিং। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে তাঁর জীবনটাই গেল বদলেএকত্রিশ বছর বয়সে ফ্লেমিং যোগ দিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ইনটেলিজেন্স বিভাগের প্রধানের ব্যক্তিগত সহকারী পদে। সেখানে তাঁর একজন সহকর্মী ছিলেন অ্যাডমিরাল ডেনিং। তিনি জানিয়েছিলেন,
– আমাদের যা যা প্রাত্যহিক রুটিনমাফিক কাজ ছিল, সেসবে ফ্লেমিং একেবারেই পারদর্শী ছিলেন না। তবে তাঁর কাছ থেকে হয়তো কিছু আইডিয়া পাওয়া যেত, কিংবা তিনি কিছু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারতেন। মনে হত তাঁর যেন দ্বৈত জীবন আছে। একটা তাঁর দিনেরবেলার জীবন- যখন তিনি এখানে কাজ করতেন, আর একটা তাঁর রাতের জীবন- সেখানে তিনি তাঁর সামাজিক মেলামেশার জগতে ঘুরে বেড়াতেন, তাতে ছিল তাসের আড্ডা আর আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যাপারগুলো। 

Fleming in Jamaica
জামাইকায় গোল্ডেন আই ভিলা সংলগ্ন সৈকতে

যুদ্ধের সময় ফ্লেমিংয়ের জীবন মোটেও জেমস বন্ডের মতন ছিল না। তিনি তখন নৌবাহিনীর সদর দফতরের কর্মচারি। তবে যুদ্ধের সময় আমেরিকা এবং কানাডা সফরে গিয়ে সিক্রেট সার্ভিসগুলো কীভাবে কাজ করে, তা ভেতর থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। গুপ্তচরদের প্রশিক্ষণের জন্য তখন একটা কোর্স হচ্ছিল। ফ্লেমিং ভাবলেন, একবার চেষ্টা করে দেখলে মন্দ কী! সুযোগ পাওয়ামাত্র সেখানে ঢুকে পড়লেন তিনি। দেখা গেল, ঘটনাচক্রে সেই কোর্সে ফ্লেমিংই বনে গেলেন সর্বোত্তম শিক্ষানবিশদের একজন। সাগরে ডুবে থাকা জাহাজ থেকে লিম্পেট মাইন অপসারণের কাজও করেছিলেন তিনি।

ফ্লেমিং মন দিয়ে লিখতে শুরু করেন ১৯৫২ সালে। শীতের লম্বা ছুটিতে জমিয়ে লিখতে লাগলেন তিনিতখন একটা সংবাদপত্রে কাজ করছেন। থাকছেন জামাইকার একটা বাড়িতে। সে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন  ‘গোল্ডেন আই।’ এ নামখানা তিনি নিয়েছিলেন নৌ ইন্টেলিজেন্সে তার একটি অপারেশনের কোড নেম থেকে। ইয়ান একমাত্র ব্রিটিশ লেখক, যাঁর নামে জামাইকাতে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর আছে।

Daniel Craig as James Bond
ক্যাসিনো রয়াল ছবিতে বন্ডের ভূমিকায় ড্যানিয়েল ক্রেগ।

বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই বন্ধুদের জানিয়েছিলেন, গুপ্তচরদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন এর মধ্যে ইয়ানের দাদা পিটার লিখে ফেললেন একটা স্পাই থ্রিলার এক ভোরে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে ইয়ান ভাবলেন, অনেক হয়েছে, তিনিও উপন্যাস লিখবেন টাইপরাইটার টেনে বসতেই মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল সেই অমোঘ ওপেনিং লাইন— “The scent and smoke and sweat of a casino are nauseating at three in the morning … “ ব্যস, টর্নেডোর সেই শুরুয়াৎ! এদিকে লিখতে লিখতে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন, এ লেখা পড়ে বন্ধুরা কী ভাববে ! মাসখানেক এভাবে চলার পর অবশেষে একদিন টাইপরাইটার ধ্বনি তুলল ” … The bitch is dead now : রচিত হ’ল ’দ্য ভেসপার’, পরবর্তীতে যাকে আমরা চিনব ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ নামে সেই বইয়ের প্রধান চরিত্র এক ব্রিটিশ স্পাই- জেমস বন্ড।

সেসময় এক বিখ্যাত আমেরিকান পক্ষী বিশারদের নাম ছিল জেমস বন্ড। তাঁর লেখা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাখিদের ওপর একটা বই ইয়ান ফ্লেমিংয়ের প্রিয় ছিল। সেই পাখি বিশেষজ্ঞের নামই তাঁর স্পাইয়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ফ্লেমিং। কারণ হিসেবে জেমস বন্ডের স্ত্রীকে ফ্লেমিং বলেছিলেন,
– আমার মনে হয়েছিল এই ছোট্ট, অ-রোম্যান্টিক, অ্যাংলো-স্যাক্সন এবং ভারী পুরুষালি নামটাই আমার চাই।

সব মিলিয়ে বন্ড সিরিজে ১১টি উপন্যাস ও ২টি ছোটগল্প লিখেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং। বিশ্বজুড়ে একশো মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বন্ডের এই  সিরিজ। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ফিকশনগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জেমস বন্ড। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইমস’ ১৯৪৫ সাল থেকে নিয়ে ৫০ জন সেরা ব্রিটিশ লেখকের তালিকায় ১৪তম স্থানে রেখেছে ইয়ান ফ্লেমিংকে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিও ছিলেন ইয়ানের ভক্তদের তালিকায়। ফ্লেমিং বলেছেন:
– আমি কখনও জেমস বন্ডকে নায়ক হিসেবে দেখাতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সে হবে একটা ভোঁতা অস্ত্রের মতো তাকে পাঠাবে একটা সরকারি বিভাগ এবং নানারকম বিচিত্র অকল্পনীয় সব পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হবে আর গুলি ছুড়তে ছুড়তে সেসবের মধ্যে থেকে সে বেরিয়ে আসবে।…  আমি আসলে তখন বিয়ে করতে যাচ্ছি, তার ঠিক আগে আগে জীবনের এক নতুন পর্বে প্রবেশ করার যে উৎকণ্ঠা – তা থেকে মনটাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই  ঠিক করেছিলাম যে একটা বই লিখব।

আমি কখনও জেমস বন্ডকে নায়ক হিসেবে দেখাতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সে হবে একটা ভোঁতা অস্ত্রের মতো তাকে পাঠাবে একটা সরকারি বিভাগ এবং নানারকম বিচিত্র অকল্পনীয় সব পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হবে আর গুলি ছুড়তে ছুড়তে সেসবের মধ্যে থেকে সে বেরিয়ে আসবে।

এরকম বিপুল জনপ্রিয় চরিত্র কি কোনও বিশেষ ব্যক্তির আদলে তৈরি হয়েছে, নাকি অনেকের চরিত্র মিলিয়ে তৈরি? এ প্রশ্নের জবাবে ফ্লেমিং বলেছিলেন,
– যেসব কমান্ডার এবং সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের আমি যুদ্ধের সময় দেখেছি, তাঁদের একটা কাল্পনিক মিশ্রণ এই বন্ড। কিন্তু সে সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এতে আমার নিজের চরিত্রের ছায়া পড়েছে কিনা তা যদি জিগ্যেস করেন তাহলে বলব, না, আমি আশা করি পড়েনি।
বাস্তবের অনেক গুপ্তচরের সঙ্গেও বন্ডের মিল পেয়েছেন গবেষকরা তাঁরা মনে করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা শার্পশ্যুটার প্যাট্রিক ডালজ়েল, জব ও দুসকো পোপভ ছিলেন বন্ডের সম্ভাব্য উৎসকিন্তু নাট্যকার ফ্লেমিংয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নোয়েল কাওয়ার্ড আবার বলছেন ঠিক উল্টো কথা:
– আমার মনে হয় জেমস বন্ড ইয়ানেরই ফ্যান্টাসি। সে হয়তো যা হবার স্বপ্ন দেখত তারই প্রতিমূর্তি। বন্ডের মধ্যে যে নির্দয়, ড্যাশিং ব্যাপারটা আছে তা ইয়ানেরও ছিল। বলতে পারেন, অনেকটা স্কুলপড়ুয়া ছেলের মতো।

Pierce Brosnan
পিয়ার্স ব্রসনানের জেমস বন্ড খুন করেন ১৩৫ জনকে।

ঠান্ডাযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা বন্ডের প্রথম উপন্যাসে সোভিয়েত গুপ্তচর, তাস, নির্যাতন, প্রেম, প্রতারণা, সবই আছে। উইলিয়াম প্লুমার বলেছেন, তাঁর মনে হয়েছিল বইটার মধ্যে সম্ভাবনা আছে। তিনিই পাণ্ডুলিপিটা প্রকাশক জোনাথন কেপের কাছে নিয়ে গেছিলেন। মজার কথা হল, ফ্লেমিংয়ের সাবেক দুই প্রেমিকা লিজেল পপার এবং কেট ব্ল্যানচার্ড বইটা পড়ে তত উৎসাহিত হননি। লিজেল  বলেছিলেন,
– ইয়ান আমার কাছে এসে বলল, তুমি কি এটা একবার পড়ে দেখবে? আমি পড়লাম। পড়ে বললাম, এ একেবারেই আবর্জনা, ঈশ্বরের দোহাই–  তুমি ছাপাতে দিও না।
আর কেট ব্ল্যানচার্ড বললেন,
– মেয়ে চরিত্রগুলো তো অসহ্য। একেবারেই কার্ডবোর্ডের চরিত্র। তাদের কাজকর্মও অস্বাভাবিক।
কিন্তু ক্যাসিনো রয়্যাল দিব্যি প্রকাশিত হল ১৯৫৩ সালে, যুক্তরাজ্যে। সমালোচকদের প্রশংসা-সহ বইটা দারুণ বিক্রিও হল।

bond women
এসব বইতে যে পরিমাণ যৌনতা এবং ভায়োলেন্স রয়েছে, তাতে ১৯৫০ দশকের ব্রিটেনের অনেকেই ভ্রু কুঁচকোলেন।

এরপর বন্ড সিরিজের আরও কয়েকটা পর্ব বেরলে দেখা গেল এসব বইতে যে পরিমাণ যৌনতা এবং ভায়োলেন্স রয়েছে, তাতে ১৯৫০ দশকের ব্রিটেনের অনেকেই ভ্রু কুঁচকোলেন। পল জনসন নামে এক সমালোচক এক কড়া নিবন্ধ লিখলেন পত্রিকায়। লিখলেন:
– আমি বন্ডের প্রথম যে বইটা পড়েছিলাম তা হ’ল ‘ডক্টর নো।’ আমার মনে হয়েছিল এ এক দানবিক লেখা। এতে শুধু  অমার্জিত ধর্ষকামিতা, জঘন্য যৌনতা, নিম্নস্তরের নাক-উঁচু ভাব। আমার পড়ে জঘন্য লেগেছিল। সে সময় আলজেরিয়ান যুদ্ধ চলছিল। তখন প্রতিদিন খবর বেরোত কীভাবে ফরাসিদের হাতে আলজেরিয়ানরা নির্যাতিত হয়ে মারা যাচ্ছে। আমি খুবই ক্রুদ্ধ একটা সমালোচনা লিখলাম, তাতে বললাম, এ ধরনের বই যদি লোকে কেনে এবং প্রশংসা করে, তাহলে সভ্য দেশের সরকারগুলো যে অন্য দেশে গিয়ে এরকম কাজ করছে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই।

Sean connery and ian fleming
প্রথম বন্ড শন কনেরির সঙ্গে

সাংবাদিকরা ফ্লেমিংকে প্রশ্ন করেছিলেন,
– আপনার বইয়ে যেসব নির্যাতনের বর্ণনা আছে তা খুবই পাশবিক।
ফ্লেমিং পালটা জবাব দেন:
– আপনি কতগুলো পড়েছেন আমি জানি না, কিন্তু বাস্তব জীবনে যা হচ্ছে তার তুলনায় এগুলো কিছুই নয়। গত বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের বোধবুদ্ধি অনেক বেড়েছে। তবে এটা ঠিকই যে সমালোচকদের পক্ষে বইয়ের অনেক কিছুই হজম করা কঠিন হবে।
আর একটা প্রশ্ন অবধারিত ছিল।
– জেমস বন্ডের কাছে মনে হয় সেক্স জিনিসটা এক গ্লাস জল গড়িয়ে খাওয়ার মতোই সহজ?
ফ্লেমিংয়ের জবাব:
– তা বলতে পারেন। তবে বন্ডের প্রতিটি বইতে একটা করে নতুন মেয়ে থাকে, তার মানে বছরে একটা। সে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জায়গায় যায়। সে যে সব জায়গাতেই সুন্দরী মেয়েদের পেয়ে যায় সেটা আমি খুব খারাপ কিছু মনে করি না বরং সেজন্য আমি তাকে হিংসেই করি।

ফ্লেমিং প্রতি বছর একখানা করে বন্ড সিরিজের বই লিখে ১৯৬৪ সালে ৫৬ বছর বয়েসে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছু দিন আগে বন্ড সিরিজ নিয়ে সিনেমা বানানো শুরু হয়। তাঁর বান্ধবী লেজলি বলেছেন,
– প্রথম বইটা জনপ্রিয় হয়ে এত অর্থ ইয়ান উপার্জন করেছিল, তা তাকে অবাক করেছিল। তখন ও লেখাটা উপভোগ করত। কিন্তু পরে যেটা হল, এত অর্থ আসছিল বলেই ও ছাড়তেও পারছিল না। শেষদিকে তো ও বন্ডকে রীতিমতো ঘৃণা করত। জানত যে এটা ওকে  চালিয়ে যেতেই হবে। তবে সিনেমাটা ওর ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমার মনে হয় এই বন্ড ওকে নিঃশেষ করে ফেলছিল।
ফ্লেমিংয়ের সাহিত্যিক বন্ধু প্লুমার বলেন,
– যে জেমস বন্ডকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তা এক বিশাল চরিত্র হয়ে দাঁড়াল। একটা ফ্র‍্যাঙ্কেনস্টাইন বলতে পারেন। লোকে জেমস বন্ডকে নিয়ে হইহই করতে লাগল কিন্তু ইয়ান ফ্লেমিংকে তারা ভুলে গেল। ফ্লেমিং অবশ্য একবার বলেছিলেন:
– আমি মনে করি না যে বন্ডের জন্য আমি কোনও সিরিয়াস লেখা লিখতে পারছি না। আমি শেক্সপিয়র হতে চাই না। আমার সেরকম কোনও উচ্চাভিলাষ নেই। 

জেমস বন্ড মানেই মনোমুগ্ধকর পৌরুষ আর প্রত্যেক কাহিনিতে তার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া হৃদয়হরণকারী সব নারী, এই দিয়ে যুগ যুগ ধরে সাহিত্য, সিনেমা এবং পপুলার কালচারে তুফান তুলে এসেছেন। ব্রিটিশ সিক্রেট ইনটেলিজেন্স সার্ভিস MI6 এর সদস্য জেমস বন্ড। ০০৭ কোড নাম্বারের ধারক তিনি। ডাবল ‘ও’ বা ডাবল জিরো বোঝায়, কর্তব্যকর্মে যে কোনও কাউকে হত্যা করার অনুমতি তাঁর আছে। ব্যতিক্রম শুধু ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’ উপন্যাস। সেখানে অস্থায়ীভাবে বন্ডকে ৭৭৭৭ নাম্বার দেওয়া হয়েছে। জেমস বন্ডের সহজাত এবং স্বাভাবিক পোষাক হল ডিনার স্যুট। সাধারণত রোলেক্স সাবমেরিনার ঘড়ি পরতেই পছন্দ করেন তিনি, পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁকে ওমেগা পরতেও দেখা যায়। শোনা যায়, ‘ডঃ নো’ সিনেমার কাজ চলার সময় শন কনেরির ঘড়ি কেনার টাকা না থাকায় প্রযোজক  কাবি ব্রকোলি নিজের হাতের রোলেক্স খুলে তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিলেন।

নারীদের প্রতি, বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ আছে বন্ডের। তবে আবেগের বশবর্তী হয়ে কর্তব্যকর্মে কখনওই নারীকে বাধা হিসেবে দাঁড় করান না তিনি। চূড়ান্ত যৌনতা করেন, কিন্তু বাঁধা পড়েন না। ইয়ানের আদি বন্ড নির্লিপ্ত, নির্ভয়, যান্ত্রিক, অমানবিক, বজ্রকঠিন, ধারালো– আদৌ প্রেমিক নন। তবে ড্যানিয়েল ক্রেইগকে কোনওভাবেই আদিযুগের ধূর্ত জেমস বন্ড বলা যায় না। তাঁর বন্ড প্রেমিক, বন্ধুর লাশ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে সে কান্না চাপে, সে ভঙ্গুর, অত্যন্ত সিরিয়াস। 

১৯৩৯ সালের মে মাসে ব্রিটিশ নৌ-ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল জন গডফ্রে ইয়ানকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ করলে তাঁর কোডনেম হয় ‘17F’।  বলা হয়, এই গডফ্রের আদলেই ইয়ান জেমস বন্ডের ‘M’ চরিত্রের চিত্রায়ন করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইয়ান কমান্ডার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। বন্ডকেও কিন্তু তিনি এই পদে বসান। ইয়ানের তুখোড় ধূমপানের অভ্যেস ছিল। দিনে প্রায় ৮০টার বেশি সিগারেট খেতেন তিনি। এছাড়া ছিল অতিরিক্ত মদ্যপানের বদভ্যাস। ডাক্তার তাঁকে জিন খাওয়া ছাড়তে বললে তিনি নির্লিপ্তভাবে বোরবনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মদ নিয়ে বিলাসিতা জেমস বন্ডের মধ্যেও দেখা যায়। লেবু মিশিয়ে মার্টিনি আর ভদকার ককটেল, ‘শেকেন, নট স্টার্ড’, এই ছিল জেমসের পছন্দ। বিবাহিত নারীদের প্রতি জেমসের আলাদা আকর্ষণের ব্যাপারটাও  ইয়ানের জীবনেও ছিল বটে! অ্যান চ্যারটেরিস নামক এক বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরকীয়ার কারণে অ্যানের স্বামী তাঁকে ডিভোর্স দিলে তাঁরা দু’জন বিয়ে করে নেন। 

Ian and Ann Fleming
ইয়ান ফ্লেমিং, অ্যান ফ্লেমিং, আইভার ব্রাইস ও রবার্ট হার্টলিং।

ষাটের দশক থেকে শুরু হয় জেমস বন্ডের চলচ্চিত্রায়ণ। সব মিলিয়ে ২৫টা সিনেমায় ছ’জন অভিনেতা জেমস বন্ড হয়েছেন এ পর্যন্ত। এক একজন অভিনেতা নিজের মতো করে এনেছেন অভিনব ডাইমেনশন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ‘ভয়ঙ্কর’ বন্ড বলা হয় পিয়ার্স ব্রসনানকে। ‘স্কাইফল’ মুক্তির আগে অবধি সব মিলিয়ে ৩৫৪ জনকে খুন করে জেমস বন্ড। এর মধ্যে পিয়ার্স ব্রসনান একাই খুন করেন ১৩৫ জনকে। জেমস বন্ডের লুক বা চেহারার পেছনে বলা হয়  মার্কিন গায়ক হাওয়ার্ড কারমাইকেলের অনুপ্রেরণা আছে। 

অতিরিক্ত ধুমপান ও মদ্যপানের কারণে ১৯৬১ সালে ইয়ান ফ্লেমিং একবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। তবে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও ১৯৬৪ সালের ১১ আগস্ট ক্যান্টারবেরিতে ফের হার্ট অ্যাটাক হয়ে   ১২ আগস্ট সকালবেলায় মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সেদিন ছিল তাঁর ছেলে ক্যাস্পারের ১২তম জন্মদিন। তাঁর শেষ কথা ছিল অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারদের উদ্দেশে, “তোমাদের ঝামেলায় ফেলার জন্য দুঃখিত, আজকাল এই রাস্তাগুলোতে কী করে যে তোমরা এত দ্রুত ট্রাফিক কেটে এগোও আমি বুঝি না।” তাঁর মৃত্যুর পরে বন্ড সিরিজের দুটো ছোটগল্প ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান’ এবং ‘অক্টোপুসি অ্যান্ড দ্য লিভিং ডেলাইটস’ প্রকাশিত হয়।

six actors played Bond
সব মিলিয়ে ২৫টা সিনেমায় ছ’জন অভিনেতা জেমস বন্ড হয়েছেন এ পর্যন্ত।

জীবদ্দশায় ইয়ান জেমস বন্ডের শুধু দুটো সিনেমা বড় পর্দায় দেখে যেতে পেরেছিলেন- ‘ডঃ নো’ আর ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’। আজ তাঁর মৃত্যুর পাঁচ যুগ পেরিয়ে গেলেও, সেই সমান আবেদন নিয়ে পাঠক সমাজ ও সিনেমাপ্রেমীদের মনোহরণ করে চলেছে জেমস বন্ড। দিয়ে যাচ্ছে নতুন স্পাইভিত্তিক সিনেমাগুলোর পাঠ। টেলিভিশন সিরিজ, সিনেমা, কমিক্স, ভিডিও গেমস সর্বত্র দৃপ্ত পদচারণা দেখিয়েছে জেমস বন্ড। এখন ঠান্ডা লড়াই শেষ হয়ে গেছে তবুও সাইবার ক্রাইম থেকে রোবোটিক কোডিং করা মারণ ভাইরাসের মতো একবিংশ শতাব্দীর নিত্যনতুন ভয়ংকর সমস্যা থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে মিশনে নেমে চলেছেন বন্ড। এখনকার বদলে যাওয়া কনসেপ্টের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শ্বেতাঙ্গ বন্ডের পরিবর্তে কৃষ্ণাঙ্গ এমনকি নারী বন্ড আনার মতো নিত্যনতুন পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।

তথ্যসূত্র –

১) জেমস বন্ড জমজমাট – কৌশিক মজুমদার, বুকফার্ম 
২) দ্য নেম ইজ – সাগ্নিক রক্ষিত, বইয়ের দেশ
৩) ইতিহাসের সাক্ষী: কীভাবে জেমস বন্ডকে সৃষ্টি করেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং, BBC NEWS

ছবি সৌজন্য: Pixabay, Blogger, Pinterest

অন্বয় গুপ্তের জন্ম ও বসবাস বারাসতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি তাঁর ঝুলিতে আছে। সাহিত্য ও মহাকাব্যের আগ্রহী পাঠক অন্বয় লিখতে ভালোবাসেন। সংবাদ প্রতিদিন, এই সময়, নানা ছোট পত্রিকা ও পোর্টালে নিয়মিত লেখালেখি করেন। পেশায় আকাশবাণীর ঘোষক অন্বয়ের 'নেশা' মহাভারত। তাঁর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, 'শিবরামচূর্ণ', 'কৃষ্ণ-অর্জুন যাঁদের কাছে হেরেছিলেন' প্রভৃতি। বহু সংকলনেও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে থাকেন অণ্বয়। খুঁটিয়ে মানুষ দেখা এবং তাদের মন বিশ্লেষণ করা অন্বয়ের প্রিয় অবসরযাপন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *