*আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২] [২৩] [২৪] [২৫] [২৬] [২৭]

মনখারাপ অনেকটাই কেটে গেল যখন মসুরি জাতীয় আকাদেমিতে ফাউন্ডেশন কোর্স শেষ করে ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের ট্রেনিং নিতে শিমলা পৌঁছলাম। উত্তরপ্রদেশের (এখন উত্তরাখণ্ড) মসুরি থেকে কলকাতা হয়ে হিমাচলের শিমলা। পাহাড় যেন নানাদিক থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে। কলকাতায় গিয়ে শীতের উপযুক্ত জামাকাপড় নিতে হবে। তাছাড়া ভ্রমণ কৌতূহলী মা যাবেন আমাকে পৌঁছতে, সঙ্গে বাবা। ফাউন্ডেশন কোর্স চলার সময়ই, পরের বছর সর্ব ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দেবার জন্য ফর্ম ভরেছি, প্রস্তুতি চালিয়ে গেছিতা ছিল ঝড়ের মুখে প্রদীপশিখাকে আগলে রাখার মতন কঠিন। ফাউন্ডেশন কোর্সের দৈনন্দিন পড়াশুনো আর পরীক্ষার চাপই অনেক, তা ছাড়া অজস্র এক্স্ট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি। সারাদিন হস্টেলের ঘরে অজস্র বন্ধুর আনাগোনা। তাদের জীবন নিশ্চিন্ত, মধুর, আমার মতো সংকট নেই কারও।

প্রয়াত অর্থনীতিবিদ অরুণ ঘোষের কন্যা অদিতি ঘোষ, জেএনইউ-এর উজ্জ্বল ছাত্রী, পরে বিদেশ সচিব জগত মেহতার ছেলেকে বিয়ে করেছিল, আমাকে নিজের ডানার তলায় নিল। সম্পূর্ণ অকারণ, পরিমাপহীন তার ভালোবাসা। অদিতি ছিল ডাকসাইটে সুন্দরী ও ফ্যাশনিস্টা। বেনারসির ঘোমটা মাথায় টেনে যখন সে সিগারেটে টান দিত, বহ্নি-উদ্বেল পতঙ্গের মতো পুরুষ প্রবেশনাররা তার চারপাশে ঘুরে মরত। সেই অদিতি আমার জন্য একটা খালি ঘরের ব্যবস্থা করল, তার অধিবাসিনী জানকী নায়ারকে অন্যত্র পাঠিয়ে। সন্ধের পর ডিনার পর্যন্ত সেই ঘরে আমি পড়াশুনো করব, কেউ আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। মাথার উপর দেবী অদিতি। সেবার ইকনমিক্স পেপার নেব অথচ বইপত্র তেমন হাতের কাছে নেই, সব কলকাতায়। অদিতি দিল্লির বাড়ি থেকে নিজের তাড়া তাড়া নোট এনে আমাকে দিতে থাকল। এটার উল্লেখ করছি, কারণ সিভিল সার্ভিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পৃথিবীতে এমন অনাবিল স্বার্থহীন স্নেহ একেবারেই বিরল। 

ফাউন্ডেশন কোর্স চলার সময়ই, পরের বছর সর্ব ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দেবার জন্য ফর্ম ভরেছি, প্রস্তুতি চালিয়ে গেছি। তা ছিল ঝড়ের মুখে প্রদীপশিখাকে আগলে রাখার মতন কঠিন। ফাউন্ডেশন কোর্সের দৈনন্দিন পড়াশুনো আর পরীক্ষার চাপই অনেক, তা ছাড়া অজস্র এক্স্ট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি। সারাদিন হস্টেলের ঘরে অজস্র বন্ধুর আনাগোনা। তাদের জীবন নিশ্চিন্ত, মধুর, আমার মতো সংকট নেই কারও।

আমার প্রতি অদিতির ভালোবাসা সম্ভবত তৈরি হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের এক গ্রামে ভিলেজ ভিজিট প্রোগ্রামে গিয়ে। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত গ্রাম। ছেলেরা এক আলাদা জায়গায়। আমরা চারজন মেয়ে একটি মাটির বাড়িতে। মাঝরাতে আরম্ভ হল বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানো আর পাথর ছোড়া। বিদ্যুৎ বিহীন লণ্ঠনের আধা-অন্ধকারে সবাই ভয় পেয়ে, চকিত হয়ে আছে। মনে পড়ে আমি বলেছিলাম, দরজা খোলা হবে না কোনও কারণেই। কয়েকটা সাইকেল ছিল দেওয়ালে ঠেস দেওয়া। সেগুলি টেনে এনে দরজা আটকালাম। সারারাত জেগে আমরা সবাই। পরেরদিন সকালে শুনলাম, ডাকাত দল এসেছিল গ্রামে। রোগাপটকা কলকাতার বাঙালি মেয়ের সাহস অদিতিকে কিছুটা মুগ্ধ করেছিল। মনে হয় স্নেহের সেটাও একটা কারণ। অদিতির ছোট বোন জয়তীও বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। দেশজোড়া তার নাম। 

যাইহোক, এতসব সত্ত্বেও ফাউন্ডেশন কোর্স চলাকালীন সিভিল সার্ভিসের প্রস্তুতি তেমন হল না। ওই কোর্স শেষ হলে জাতীয় আকাদেমিতে থেকে যাবে কেবল আইএএস অফিসাররা, অন্য সব কেন্দ্রীয় বা সর্বভারতীয় সার্ভিস, যেমন, পুলিশ, রেভিন্যু সার্ভিস, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস চলে যাবে নিজ নিজ আকাদেমিতে, বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে। আমাকে যেতে হবে শিমলা। ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস-এর ট্রেনিং হয় ওখানে। ‘ইয়ারোজ়’ বলে এক ছবির মতন সুইস ধাঁচের প্রাসাদোপম বাড়িতে। ১৯৫০ সাল থেকেই।

শিমলা রেলস্টেশনে নেমে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। কলকাতা থেকে কালকা গিয়ে ছোট ট্রেন ধরতে হয় শিমলার জন্য। সে ট্রেন তখন বেশ জমকালো, দীর্ঘ, আরামদায়ক। যে পথ দিয়ে ট্রেন কয়লার ধোঁওয়া উড়িয়ে চলে, তার দুপাশে পাইন ও অন্য চিরহরিৎ গাছের পর্দা। পাহাড়ের নীল-সবুজ বিস্তার তার পিছনে। সে সৌন্দর্যের ঘ্রাণ যে পেয়েছে, তার বুকের মধ্যে চিরকালের মতো ভরা হয়ে রইল বন পাহাড়ের মায়া। 

স্টেশনে নেমে দেখি, দু’জন ট্রেনি ব্যাচমেট এসেছেন আমাদের নিতে। একজন হিমাচলের, রাকেশ। অন্যজন পঞ্জাবের, পরমবীর। ডায়রেক্টর ভি কে সুব্রহ্মণ্যম ক্যাম্পাসেই থাকেন। তাঁরই নির্দেশ, নতুন কেউ এলে পুরনো যারা আগে এসে পৌঁছেচে, তারা গিয়ে নিয়ে আসবে। স্টেশনে ধূলিধূসরিত হয়ে নেমেই এমন অভ্যর্থনা পাব ভাবিনি। শিমলার ম্যাল-সংযুক্ত পথে কোনও গাড়ি চলে না। ‘ইয়ারোজ’ পৌঁছতে হবে পায়ে হেঁটে। শীতের আরম্ভ। পাহাড়ে ঈষৎ ঠান্ডা, নরম রোদ। চলায় কোনও কষ্ট নেই। ওরা শুনল না, জোর করে আমাদের জিনিসপত্র হাতে তুলে নিয়ে আগে আগে হাঁটতে লাগল।

Yarrows Heritage Building
পাখির চোখে ‘ইয়ারোজ়’

আমাদের ছোট্ট অথচ সুন্দর ট্রেনিং অ্যাকাডেমি ‘ইয়ারোজ’ (Yarrows) নামের হেরিটেজ বাড়িতে। কলেজের পাঠ্যবইতেই দেখা ও আবার দেখা ‘ইয়ারো’ এর কথা পড়েছি, ওয়র্ডসওয়ার্থের কবিতায়।  সেই ইয়ারো একটি নদী, ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকার নাম। ইয়ারো আবার একটি হালকা হলুদ ফুলেরও নাম। ১৯১৩ সালে স্থপতি হারবার্ট বেকারের তৈরি ‘ইয়ারোজ়’ একসময় ছিল ভাইসরয়ের এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য জর্জ রিভার লাউন্ডজ়-এর বাড়ি। পরে ভাইসরয়ের ফাইন্যান্স সেক্রেটারিও কিছুদিন ওখানে বাস করেছিলেন। 

সামনে সবুজ লন, ধারে ধারে ফুলের কেয়ারি, নীচে সিঁড়ি নেমে গেছে ধাপে ধাপে, পাহাড়ের ঢালে তৈরি করা সিঁড়ি। ভিতরের দিকে টেনিস কোর্ট। একটি ফুলে ছাওয়া তারজালি দিয়ে ঘেরা। নীচতলায় বিরাট লাউঞ্জ, যেখানে যখন তখন বসে গল্পগুজব করা যায়, রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে গান শোনা যায়। তার পিছনে ডাইনিং হল। একপাশে বিলিয়ার্ড রুম, সেখান থেকে কিউ দিয়ে বল স্ট্রাইক করার শব্দ অনেক রাত পর্যন্ত কানে আসে। ডায়রেক্টরের অফিস ও বাড়ি একেবারে নীচে, সিঁড়ি দিয়ে যেতে হয়। হাস্যমুখ সদাশিব মানুষ, আমাদের সন্তানতুল্য ভালোবাসেন, রবিবার দিন মস্ত ক্যানভ্যাসে তেলরঙে ছবি আঁকেন আর সেই আঁকার উপর আমরা বিজ্ঞ মতামত দিই।

Yarrows
সুইস ধাঁচে গড়া হেরিটেজ বাড়ি ‘ইয়ারোজ়’-এর কাঠের প্রবেশদ্বার

শ্রীমতী সুব্রহ্মণ্যম আধুনিকা বিদুষী মহিলা, রান্নাঘরে তাঁর দক্ষতা অসামান্য। ডিরেক্টরের বাড়িতে মাঝে মাঝেই আমাদের নেমন্তন্ন হয়। তাছাড়া ভালো কিছু রান্না হলেই মাঝে মাঝে চেখে দেখার জন্য ডাক পড়ে। শিমলায় অডিট ও অ্যাকাউন্টস এর কী তত্ত্ব পড়েছিলাম, কিছুই মনে নেই। মনে আছে সতেরো আঠেরো জন তরুণ তরুণী মিলে একসঙ্গে হৈ হুল্লোড় করে কয়েকমাস কাটানোর আনন্দ। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল শঙ্কাহীন, নির্মল। কেন যে আমরা অত হাসতাম, হেসে হেসে গড়িয়ে পড়তাম, ভেবে অবাক লাগে। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, হিমাচল, বাংলা মিলে যে রামধনুর ছটা তৈরি হত, তার মধ্যে দিয়েই হয়তো আমার দেশের সন্ধান আরম্ভ হয়েছিল।

ডিনারের পর লাউঞ্জে অনেকটা সময় কাটানো অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। তখন ABBA নতুন, সেই সব গানে মেতে উঠলাম। আরব সংগীতের এক লং প্লেয়িং রেকর্ড ছিল, সেটা বারবার শুনতাম। আর ছিল সদ্যপরিচিত হিন্দি রোম্যান্টিক গান, জগজিৎ সিংহের গজল। কলকাতায় এ সব শুনিনি। আমার গানের গলা তখন বেশ সুরেলা। লতা মঙ্গেশকরের হিন্দি গান নিজের গলায় তুলে নিয়ে গাইতে পারতাম। হিন্দি ছায়াছবির গান চালালে পরমবীর একটা পেটিকোট শার্টের নীচে পরে, হাতে রঙীন ছাতা নিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচত। এই ছিল আমাদের নিরীহ মজা। 

 

আরও পড়ুন: বাংলালাইভের বিশেষ ক্রোড়পত্র: সুরের সুরধুনী 

 

একদিন ডায়রেক্টর আমাদের নতুন রিলিজ় হওয়া ‘পাকীজ়া’ সিনেমা দেখাতে থিয়েটারে নিয়ে গেলেন দলবেঁধে। দুর্ভাগ্য, বসের পাশেই আমার সিট। দুজনের হিন্দি জ্ঞান তুলনীয়। একটা করে দৃশ্য যাচ্ছে, উনি আমাকে হিন্দি কথোপকথনের মানে জিজ্ঞাসা করছেন, আমি অন্ধকারে ফিসফিস করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। পরেরদিন বিকেলে ডাক পড়ল বসের অফিসে। সেখানে একগাল হাসি নিয়ে বসে আমাদের লখনৌয়ের ব্যাচমেট প্রভাত চন্দ্র। সুব্রহ্মণ্যম সাহেব বললেন, অনিতা, তুমি আমাকে যা বলেছিলে, ছবির গল্পটা তো তা নয়, প্রভাত বলছে। একেবারে আলাদা। আমতা আমতা করে স্বীকার করলাম, আমার হিন্দির জ্ঞান বিশেষ উৎকৃষ্ট নয়। মনে হল, প্রভাতের মাথায় একটা গাঁট্টা মারি, কিন্তু নরম হেসে চলে এলাম। 

সবারই একটা করে গল্প ছিল। আমাদের জামাকাপড় কেচে ইস্ত্রি করে দেবার ভার নিয়ে ছিল শীসরাম। সে একবার একসঙ্গে সব কাপড় গরম জলে দেওয়ায় প্রভাতের কুর্তার রং সাদা তোয়ালেতে লেগে গিয়েছিল। রাগ করায় শীসরাম হাত কচলে বলল, হুজুর যদি সস্তা জামাকাপড় কেনেন, তাহলে আমার দোষ কী? এতে আমরা খুব হেসেছিলাম, প্রভাতও কিছু মনে করেনি। নির্মল আনন্দ। ইয়ারোজ়ের বন্ধুদের কথা আলাদা করে মনে আছে, আমরা ছোট একটি পরিবার ছিলাম, তাই। মসুরি অ্যাকাডেমির জনারণ্যে বহু ঘটনা ঝাপসা হয়ে গেছে ক্যানভাস বড় ছিল বলে। এখানে, এই ইয়ারোজ়েই আমি জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখি। সে কথা পরের পর্বে।

 

*ছবি সৌজন্য: Youtube, Twitter, Worldorgs

কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *