
সবাই গৃহবন্দি। সকলের সব রুটিন একেবারে চৌপাট। তবুও তারই মধ্যে ভালো থাকা যায়। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ডলি বসু-র ভালো থাকার পথের খোঁজ নিলেন শর্মিলা বসুঠাকুর।
দক্ষিণ কলকাতায় ছিমছাম ছোট্ট ফ্ল্যাট তাঁর। মা-কে নিয়ে একাই থাকেন। একা হলেও আত্মজনে ভরা। পিস লিলি, ঝুমকো জবা থেকে শুরু করে চিরচেনা লাউডগা – সবাই ঘিরে আছে তাঁকে। এরাই তাঁর আত্মীয়স্বজন, একান্ত আপন। আদ্যন্ত শিল্পী মানুষ ডলি বসু। তাঁর শিল্পী সত্ত্বার প্রতিফলন তাঁর আবাসেও। জনবহুল এলাকায় ছোট্ট ফ্ল্যাটে একঝলক দখিনা বাতাস বয়ে আনে পরম যত্নে লালিত তাঁর নানা রকমের গাছপালা। দুঃখ-আনন্দ, সুসময়-দুঃসময় নির্বিশেষে এরা তাঁর সঙ্গী। পরিপাটি করে সাজানো ছোট্ট গৃহকোণেই স্থান করে নিয়েছে ছোট ছোট প্লান্টারে সবুজের দল। সেই প্লান্টারও অনেকক্ষেত্রেই তাঁর নিজেরই হাতে নকশা করা, রাঙিয়ে তোলা। হোক না নীড় ছোট, ক্ষতি তো নেই! প্রকৃতি যে অবিরাম আকাশ মেলে রেখেছে আমাদের জন্য। তার কয়েক টুকরো না হয় নিয়েই আসা যাক অন্দরসজ্জায়!

ডলি বসু জানালেন, তাঁর বাড়িতে এমন অনেক গাছ আছে যেগুলি এয়ার পিউরিফাইং প্লান্ট, অর্থাৎ কিনা এরা বাতাস পরিশুদ্ধ করে। নাসার গবেষণাও রয়েছে এদের নিয়ে। ছোট বাড়িতে অনেক সময়ই যে দমবন্ধ করা একটা পরিবেশ তৈরি হয়, এই গাছের উপস্থিতিতে সেটা অনেকটাই কাটে বলে তাঁর মত। আর কম আলোতেও এই জাতীয় ইন্ডোর প্ল্যান্টের বেড়ে উঠতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। ফলে অন্দরে সাজিয়ে রাখতে বাধা নেই। তবে মাঝে মাঝে রোদ খাওয়াতে হয় বৈকি… তার নিয়মকানুনও রয়েছে। ডলির সবুজ সঙ্গীরা এই বিশ্বব্যাপী নেগেটিভিটির দিনেও তাঁর বাড়িকে একটা পজ়িটিভ ভাইব দেয়।
শর্মিলা – গাছপালার শখ কি এই লকডাউনেই শুরু?
ডলি – না। এই শখ চিরকালই ছিল, সেই ছেলেবেলা থেকে। আমার বাবার থেকে পেয়েছি গাছপালার প্রতি এই ভালোবাসা। কিন্তু লকডাউনে যেটা হল, গাছপালার সঙ্গে একটা আত্মিক যোগাযোগ ঘটল। অনেক নিবিড় বন্ধন তৈরি হল।
শর্মিলা – অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, হাতেকলমে গাছপালার পরিচর্যায় অনেক বেশি পারদর্শী হয়ে উঠলেন?
ডলি – একেবারে ঠিক। আগে মালির উপর নির্ভর করতাম। সল্টলেকের বাড়িতেও বাগান ছিল। মালিরা কাজ করত। গাছে ফুল ফুটত। দেখতাম, আনন্দ পেতাম। বড়োজোর গাছে ঠিকমতো জল না-দিলে বা অযত্ন করলে বকাঝকা করতাম। লকডাউনে আমি এই ব্যাপারে স্বনির্ভর হতে শিখলাম। কারণ গাছপালা ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।

শর্মিলা – তার মানে এই কঠিন সময়ে আপনার এই এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির সঙ্গে সাক্ষাৎ-বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
ডলি – খুব সুন্দর বলেছেন। সত্যিই এরা আমার বৃহত্তর পরিবার। যদিও আমার বাড়িতে জায়গা কম, তবুও সবাই মিলেমিশে বেশ আছে। এই যে দেখছেন পিস লিলি, সাইগোনিয়াম, স্নেক প্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট… এদের নিয়েই এখন আমার সময় কাটে। দিনের পর দিন একা বাড়িতে থেকে, আমার ভালোবাসার কাজ, নাটকের কাজ সবকিছুই যখন বন্ধ, যখন একটা ‘ভালো না-লাগা’ পেয়ে বসে, তখন এরাই আমার সহায়। কী যে ভালো লাগে দেখতে, একটা নিষ্প্রাণ ডালে যখন কচি সবুজ পাতার আগমন ঘটে!
শর্মিলা – হ্যাঁ। গাছপালার যত্ন মানে তো শুধুই জল দেওয়া নয়। এটা একটা বিশদ বিষয়…
ডলি – ঠিকই বলেছেন। অনেক পড়াশোনা করলাম এই বিষয়ে। গাছের ‘প্রপাগেশন’ শিখলাম। নতুন প্রাণের জন্ম দেওয়া – কী যে আনন্দ! কে ছায়া ছায়া ভেজা ভাব ভালোবাসে, কার আবার সূর্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশি, কে ঘন ঘন তৃষ্ণার্ত হয়… এমন নানা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়। ঠিক বাচ্চাদের মতো গাছেদের যত্ন নিতে হয়, জানেন তো? একেবারে নেশা ধরে যায়।
শর্মিলা – আপনি নিজে তো অনেক প্লান্টারও বানিয়েছেন।
ডলি – কী করব? এই সময়ে কিনতে তো যেতে পারছি না। আর যেমন তেমন ভাবে কোনও জিনিস রাখতে ভালোবাসি না। তাই নিজেই লেগে পড়লাম। ডিজাইন করলাম, রং করলাম।

শর্মিলা – আপনি কি কখনও আঁকা শিখেছেন?
ডলি – আমি তো ফাইন আর্টসেরই ছাত্রী ছিলাম। বহুদিন পর আবার তুলি ধরলাম।
শর্মিলা – ফাইন আর্টস নিয়ে আর চর্চা করলেন না কেন?
ডলি – সে এক দুঃখের কাহিনি। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। জে জে স্কুল অফ আর্টসে আমার ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। আমার দাদা জাহাজে চাকরি নিলেন। মাকে দেখার কেউ নেই। নকশাল আন্দোলনের সময় সেটা। রাজনৈতিক পরিবেশ একেবারেই ভালো নয়। দাদা কিছুতেই রাজি হলেন না আমার বাইরে গিয়ে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনায়। তারপর থেকে আর হল না।

শর্মিলা – তাহলে বলতে হয়, এই চরম দুর্দিনেও আপনার বরাবরের ভালোবাসাকে আপনি ফিরে পেলেন, রংতুলিতে হাত পড়ল।
ডলি – আসলে জীবনে কী ভাবে কোন পথ দিয়ে যে আশার আলো উঁকি মারবে, এগিয়ে চলার রসদ খুঁজে পাওয়া যাবে, সেটা বলা কঠিন। বাট পজিটিভিটি কিপস আস গোইং ইনস্পাইট অফ এভরিথিং। সুতরাং থেমে থাকলে তো চলবে না! এই দুর্যোগের সময়, কিছুই যখন ভালো লাগছে না, প্রকৃতি যেন যেচে আমার বাড়িতে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, প্রকৃতিকে ভালোবাসো।
সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।