কিছুদিন আগে রাত এগারোটায় ফোন এল এক উৎকণ্ঠিত ভদ্রমহিলার। “প্লিজ কাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিন!” ভদ্রমহিলা বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে ওঁর অনুরোধ ফেলতে পারলাম না! ওঁর একমাত্র সন্তান রশ্মিতা ১২ ক্লাসে পড়ে। কলকাতার একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী।  

চেম্বারে আসতেই, জিজ্ঞেস করলাম, “কী রশ্মিতা বল তোমাকে আমি কীভাবে হেল্প করতে পারি!” কিছুই বলতে পারল না রশ্মিতা। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। ওর মা বললেন, পরীক্ষার দিন যত এগিয়ে আসছে, রশ্মিতা তত অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বমি করছে, পেটে ব্যথা হচ্ছে, সব ভুলে যাচ্ছে। ওদের বাড়িতে নাকি কান্নাকাটি, হল্লাহাটি, এক হুলুস্থুল অবস্থা চলছে। বুঝলাম রশ্মিতা এক্সাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত। শুধু রশ্মিতা নয়, পরীক্ষার আগে অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যেই এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। অতিমারীর পর প্রবলভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে এই ‘এক্সাম ফোবিয়া’।

এবার আসি, এক্সাম ফোবিয়া বলতে কী বোঝায় সেই প্রসঙ্গে। খুব সহজভাবে বলতে গেলে এক্সাম ফোবিয়া হল, পরীক্ষার ভীতি। এই বিশেষ অসুস্থতায় কিছু শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা যায়।

শারীরিক উপসর্গ

১. পড়তে বসলে মাথা ব্যথা
২. ঘাম
৩. হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া 
৪. পেটে ব্যথা
৫. বারবার জল তেষ্টা পাওয়া

মানসিক উপসর্গ

১. ভয়
২. উৎকণ্ঠা
৩. রাগ
৪. হতাশা 

Exam Fear

এক্সাম ফোবিয়ার কারণ

১. ব্যর্থতার ভয়
২. অভিভাবকদের চাপ
৩. সামাজিক চাপ
৪. খারাপ প্রিপারেশান
৫. আগের পরীক্ষার খারাপ ফল
৬. সর্বোপরি নিজের ওপর নিজের চাপ 

শেষমেশ কিছু সাজেশন দিলাম রশ্মিতাকে। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। কী করে এই ক’দিনে নিজেকে তৈরি করবে পরীক্ষার জন্য—

১. প্রথমে আগের তিন কি পাঁচ বছরের প্রশ্ন দেখতে হবে। এতে প্রশ্নের প্যাটার্ন বোঝা যায়, কোন কোন চ্যাপ্টার গুরুত্বপূর্ণ বোঝা যায়।

২. এবার আসি পরীক্ষার একটা সিডিউল প্রসঙ্গে। এটা যে যার মতো বানাতে পারে। আমি একটা নমুনা দিচ্ছি। যত দিন বাকি আছে, তার সঙ্গে আট অথবা দশ ঘণ্টা গুণ করে মোট ঘণ্টার হিসেব বের করে, টোটাল চ্যাপ্টার দিয়ে ভাগ করে রিভিশন শুরু করতে হবে।

৩. প্রতিদিন রাতে শোবার আগে সারাদিনের পড়াটা একবার ওপর ওপর দেখে নিলে সেটা আমাদের সাব কনসিয়াস মাইন্ডে চলে যায়।

৪. ‘পমোডোরো’ পদ্ধতি ব্যবহার করে পড়া যেতে পারে। এতে পঁচিশ মিনিট পড়ে পাঁচ মিনিট ব্রেক নিতে হবে। এভাবে  চারবার করে একটা কুড়ি পঁচিশ মিনিটের ব্রেক নিয়ে আবার পড়তে বসতে হবে। এই সাইকেল দিনে চার বার করতে হবে।

৫. ব্রেকের সময় জল খেতে হবে। মোবাইল দেখা যাবে না।

৬. পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখতে হবে।

৭. প্রতিদিন নিয়ম করে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য গতকাল রশ্মিতার মা ফোন করে জানালেন, রশ্মিতা এখন অনেকটাই ভালো আছে। এক্সাম ফোবিয়াটা প্রায় নেই বললেই চলে।

***

গতকাল গিয়েছিলাম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, আসন্ন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কিছু টিপস দিতে। একজন অভিভাবক বলে উঠলেন, “ম্যাডাম, পরীক্ষা এসে গেছে কিন্তু আমার ছেলে কিছুতেই মোবাইল দেখা বন্ধ করতে পারছে না। কিছু বলুন!”

আমি বললাম, “বাড়িতে আর কেউ মোবাইল দেখেন?”

—“ইয়ে… ম্যাডাম, আমি আর মিসেস দু’জনই টুকটাক দেখে থাকি”

—“কী দেখেন?”

—”ওই… সিনেমা আর কী!”

আমি হেসে বললাম, ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে দেখেই সবকিছু শেখে জানেন তো? পরীক্ষার আগে আপনারা মোবাইল দেখাটা একেবারে ছেড়ে দিন। ও যদি পড়াশোনা বিষয়ক কিছু দেখতে চায়, আপনাদের সামনে দেখতে বলুন। আর অন্য সময় আপনার বাচ্চার মোবাইলটা আপনার কাছে রাখুন।

—“ঠিক আছে ম্যাডাম”

“ম্যাডাম, আমার পরীক্ষার দিন খুব ভয় করে।”— এক পরীক্ষার্থী ভীত-সন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠল…

—“এই ভয়টাকে ‘ইউস্ট্রেস’ বলে। এই ভয়টা স্বভাবিক। এটাই আমাদের গোলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর কিছু কথা বলছি শোনো:

১. পরীক্ষার জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের আগে পৌঁছবে।
২. পরীক্ষার আগে ডিপ ব্রিদিং করতে পারো, এতে টেনশন কম হয়।
৩. প্রতিটা প্রশ্ন ভালো করে পড়ে, সময় ভাগ করে উত্তর দেবে।
৪. সহজ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলে ভাল হয়।
৫. রিভিসনের জন্য দশ মিনিট সময় রাখবে ও সেই সময় প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়ছে কিনা দেখে নেবে।

আর পরীক্ষার পর চাপ কমানোর জন্য: 

১. পরীক্ষার পর কারও সঙ্গে পরীক্ষার উত্তর নিয়ে আলোচনা করবে না।
২. পরীক্ষার পর একটা ব্রেক নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে পারো।

আশাকরি ওপরের টিপসগুলো তোমার ও তোমার বন্ধুদের কাজে লাগবে।।”

Parents Duty

অভিভাবকদের উদ্দেশে

১. ভালো এবং খারাপ পরিস্থিতিতে ওদের পাশে থাকুন।
২. ওদের পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে কিনা দেখুন ও হালকা খাবার দিন।
৩. অন্য বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করবেন না।
৪. দরকার ছাড়া ওদের হাতে মোবাইল দেবেন না।
৫. বাড়ির পরিবেশ শান্ত রাখবেন।

উপরোক্ত ঘটনাগুলো সবই সত্যি ঘটনা। আমি সমাধানের কিছু উপায় বললাম। আশা করি কিছুটা উপকার হবে।

সবশেষে সকল পরীক্ষার্থীদের একটাই কথা বলব, আমাদের জীবনে নানা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই একটা পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হলে, জীবন থেমে থাকে না। প্রতিটা দিন নতুন করে, নতুনভাবে শুরু করা যায়।

স্কুল ও বিভিন্ন বোর্ড পর্যায়ের পরীক্ষার্থীদের আন্তরিক শুভকামনা জানিয়ে আজ আসি।

***

সৌমী চক্রবর্তীর সঙ্গে ফোনে কনসাল্ট করতে চাইলে যোগাযোগ করুন +৯১৭৯৮০১৮২৭৬৩ নম্বরে

ছবি সৌজন্য: Flickr, Public domain

Soumi Chakraborty

কনসালট্যান্ট সাইকোলজিস্ট ও স্টুডেন্ট কাউন্সিলর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *