মাইক্রোআভেনের বোলবোলাও চালু হওয়ার পর থেকেই যে কোনও পরিচিত, অল্পপরিচিত বা অপরিচিত – সব ঘরেই, নেমন্তন্ন খাওয়াটি একেবারেই বন্ধ করেছি। কারণ ? বাসি খাবার ভয়। সাত বাসটে খাবারও মাইক্রোতে এক বার ঘুরিয়ে নিলেই যে একে বারে টাটকা, মানে স্বাদ এবং  তাজার গন্ধ সমেত! কিন্তু , ওই বসার ঘর থেকে রাস্তায় বের হতে না হতেই চাই ‘পটাশ জল ‘ বা সোডা পানীয়। আর ব্যাগে থাকলে ভাল, না হয়তো বাড়ি ফিরেই হজমের ওষুধ। অন্যথায় হাসি মুখে সহ্য করা গ্যাস অম্বলের হ্যাঁপা। তবে ঘর থেকে নেমে পথও কি নিরাপদ! ঝিনচ্যাক সব দোকানেও তো এখন  বিশিষ্ট ও বিশেষ পদের পাশাপাশি, নানা মোড়কে পাওয়া যায় রুটি-পরোটাও। তানে হেডফোন লাগিয়ে ছন্নছাড়ার দল সাত বাসটে সেই সব, টকাটক কিনে আরও বাসি করে গপাগপ ওড়াচ্ছে। আর ঘরে ঘরে যে রেফ্রিজারেটর , তা-ও তো ভয়াবহ । সমস্ত প্রিমিয়ম দেবার পর ইন্সুরেন্স বোনাসের মতো উপচে আছে বাসি খাবারেই।থরে বিথরে – কাঁচা , রান্না আর কেনা। আলমারির চেয়েও দামড়া ওই বরফকলে কোথায় যে কী সেঁধিয়ে আছে! কার হাতে কত সময় যে বেছে বুঝে এবং মেপে বার করে দেবে! নষ্ট,পচা এবং বাসি তাই চির আদরণীয়। এর হাত থেকে রেহাই ? সে যে এক মস্ত বালাই হে! কারণ যুগে যুগে বদলেছে তার রূপটুকু। হেঁশেল যেমন ওপেন কিচেন বা সে কালের কালাজ্বর এখন যেমন ডেঙ্গি! হা হা হা।

এই কিছু বছর আগেও, পচা ম্যানেজ ছিল এক চমৎকার শিল্প। রান্নাঘরের মস্তানি। তবে সেটা ঠিক পচা নয়। গত রাতের না ওঠা খাবার। মানে এক রাতের বাসি। যেমন তরকারি বা ডালনা। ক’টা বাড়িতেই বা ফ্রিজ ছিল! তাই বগি কাঁসিতে জল ঢেলে তাতেই ভাসিয়ে রাখা হতো ছোট একবাটি তরকারি। সকালে, সেটাকেই আবার সাঁতলে শুকিয়ে, গরম হাতরুটি বা মুড়ির সঙ্গে। টাটকা থেকে বেশি স্বাদ হতো সেই জ্বাল দেওয়া তরকারির। বাসি এড়ানোর জন্যই ধোঁকা বা কাঁচকলার কোপ্তা যতটুকু যা ভাজা হতো, তার সবটুকু যে কাইকাই ঝোলে ছাড়া হতো তা নয়। খাউন্তি বুঝে। সে এক নিপুণ আন্দাজি যা তীরন্দাজদেরও হার মানায়। তা সত্বেও বেশি হলে সেগুলি ঝোল কাঁচিয়ে বাটিতে তুল , থালার জলে ভাসিয়ে কাচা ধুতি ছেঁড়া বা গামছা বা ঝুড়ি চাপা দিয়েই শেষ হতো না। তার ওপর চড়ত নোড়া। ছুঁচো, ইঁদুর বা বেড়াল  – কার সাধ্য তা ঠোকরায়! আর থালার জলে তো আগেই জব্দ ওই নিকুচির আরশোলা, পিঁপড়ে আর টিকটিকি। খাসির কষা থেকে আলু সরিয়ে, কাই কমিয়ে কেউ কেউ আবার নিজের ভাগের থেকে আগাম তুলে রাখতে বলতো, বাসি খাবে বলে। খাসির সেই বাসি কষা, নিভু আঁচে পুটি পুটি গরম করে – আহ্! সে স্বাদের ভাগ হবেনি বাপু! 

ঠিক এ রকমই, বাসি লুচি দিয়ে সর-ধরা বাসি পায়েস। মরা আঁচে জলভরা চাটু বসিয়ে , তার ওপর একখানি জলভরা কাঁসার বাটি। তার মাথায় চিতেল কাঁসিতে  মাঝখানে পায়েসের বাটি। আর তার চারপাশে গোল করে ফুলের মতন সাজানো খান কয়েক বেঁচে যাওয়া লুচি। থালার জল তেতে উঠে বুড়বুড়ি কাটলেই, লুচি গরম এবং পায়েস পরম। এই লুচি ফুলকো নয় তবে জাদু মাখা নরম। আর ভাত! তারও ব্যবস্থা পাকা। হাঁড়িতেই জল ঢেলে ঝুড়ি, নোড়া বা মাঝারি শিল চাপা। বিশেষ করে গরম কালে, জলঢালা ভিজে ভাত খাওয়া হতো আমানি দিয়ে। দই এর জলে কাঁচা আম কোরা আর বিট নুন মিশিয়ে তৈরি হতো আমানি। ভিজে ভাতে আমানি মিশিয়ে, টক স্বাদে আয়েশ বাড়াতে,  গন্ধরাজ লেবু আর একটু নুন।।ব্যাস হাপুস হুপুস। উবু হয়ে বসে এক কাঁসিতেই আই ঢাই। আর গিন্নীদের কাছে জোরালো ঘ্যানঘ্যান জমাতে পারলেই সঙ্গে হয় একটু আলু পোড়া না হয়তো ‘ বেগনি – ফুলুরি ‘ ফাউ। আর গরম আলুর চপ জুটে গেল তো ‘ পোলোয়া কলিয়াও ‘ তুচ্ছ। তবে বাসি ডাল জব্দ করা, সে এক মহা ঝক্কি বটে! তা ছাড়াও বুুুুঝতে হবে যে, কী ডাল এবং কেমন করে তা রাঁধা সেটাও। অড়হর আর ছোলার ডাল হলে বাসি রেখে সকালে ফুটিয়ে খাওয়া যাবে, মানে ডাল ফ্রাই। কিন্তু অন্য ডাল, বিশেষত নাড়া ঘাঁটা ? ওপরের জল ফেলে রাখলেও তা গেঁজে যাবে। চারপাশ থেকে ঘিরে আসবে ফুটি ফুটি ফেনা। না শুঁকেই গিন্নীরা ফরমান জারি করবেন, ‘  টকসা ‘ লেগেছে। তবে ফেলা কিন্তু হবেনা। শুকনো লঙ্কা পোড়া আর থকথকে করে গোলা পাকা তেঁতুল আর একটু নুন মিষ্টি দিয়ে জম্পেশ ফুটিয়ে রাখা থাকবে উনুন পাড়ে। দুপুরের ভাতে শেষপাতে চাটুপুটু। আরও যে একপদ ক্যাদ্দানি দেখানোর যে মাঠ, তা হল বাসি খিচুড়ির তরিজুত। বেশ খানিক ঘি – গরম মশলা দিয়ে জলের ছিটে দিতে দিতে মরা আঁচে শুকনো দলা। না হলে ঘি ভাসানো ফুটে ওঠা গরম জলে একটু করে খিচুড়ি আর একবার করে নাড়া। গন্ধ ভুর ভুর হলেই বাটি বা কাঁসিতে নিয়ে ফুঁ দিতে দিতে জিব ঝলসে খাওয়া। সঙ্গে একফালি তেকোনা পাঁপড়, ভাজা নয় আঁচে সেঁকা। আর কপাল মন্দ না হলে একটু বাসি চাটনি বা এক চামচ আচার। তবে অম্বল বা চাটনি বেশি হলেও পরদিন তার আর হদিশ পাওয়া যেত না। ছুঁচো ইঁদুরে টেনেছে এই ছুতোয় কোন গর্তে যে লুকোনো থাকতো কে জানে! সবার খাওয়া শেষ হলে পরদিন এঁটো বাসনের গাদায়  চাঁচা পোঁচা খালি বাটিগুলো কিন্তু সার দিয়ে মাজতে বার হতো। ভূতে খেয়ে যেত নিশ্চয়ই।

এ তো গেল বাসি শোধন। কিন্তু টাটকাতেও তো পচা হয় । জ্বালে বসিয়েই দুধ কেটে ছানা ছানা। গয়লাকে গাল পাড়তে পাড়তেই সেই ছানাকাটা ফুটন্ত দুধে কাপ খানেক লেবুজল মিশিয়ে পচা ছানাকে টাটকা ছানা বানানো। সেই ছানাটাই জল ছেঁকে, ন্যাকড়ায় পুঁটলি পাকিয়ে শীল চাপা জাঁক। হেঁশেল খালি হলে একটা ঝকঝকে মাজা এবং তোলা কড়াইতে, মরা আঁচে নরম পাক আর বাতাসা বা মিছরি ঢালা। বানানো হবে  ‘নট ক্ষীর ‘। এই নট কিন্তু ইংরেজি নয়, তবে বাংলায় কোন বংশের জানা নেই। হতে পারে নটুয়া সেই কানাই এর তা প্রিয় এবং মা যশোদার হেঁশেলি রেসিপি। মুড়ি বা পারোটার সঙ্গে খেতে তো ভালোই লাগে।

                              ***

তবে হ্যাঁ, এসব মেরামতি খাবার কি সবাই খাবে? মোটেই না। কর্তা মশাইরা তো নয়ই নয়। নয় সমত্থ ছেলেরাও। গিন্নীরা অবরে সবরে, গ্যাস অম্বল বুঝে। খাবে, বাচ্চারা আর মেয়ে, বউ, কাজের মাসি।ভাগ্যিস সময় থেমে থাকেনা, আর তা প্রথমেই এগোয়  কাজের সুযোগ আর মেশিনের আমদানিতে! ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে যেই মেয়েদেরও ইস্কুল, কলেজ , আর আপিস যাওয়া শুরু হলো, বদলাতে লাগলো বাসি পচা শোধনের কারবার। টান পড়ল হেঁশেলে সাহায্যকারীর সংখ্যায়। তখন সামাল বেসামালে, ভোরের আঁচে হয় গরম গরম ঝোলভাত, না হলে আলুভাতে ভাত ঘি ছড়িয়ে। টিফিনে টাটকা রুটি বা লুচির সঙ্গে সাদা আলুর তরকারি। রাতদিনের কাজের লোক বদলে ‘ ঠিকে ‘ বা  ‘তোলা ‘ – সময় মেপে।দেখতে দেখতে হাওয়া পাতা উনুন, ভায়া ‘জনতা ‘, দাঁড়িয়ে রান্নার তাকে গ্যাস আভেন ও প্রেসার কুকার সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু। কাঁসা পেতল বদলে স্টেইনলেস স্টিল। আমার ঠাকুমা অবশ্য, তিন বাটির পেতলের ইকমিক কুকারে ভাত মাছ তরকারি রাতেই চড়িয়ে রাখতেন, যা আমার মা পরদিন সকাল ন’টায় খেয়ে বেরোনোর সময়তেও গরম থাকতো। তো রান্নার ঝকর ঝকর যেমন কমলো তেমনই ফুস করে উড়ে গেল তাকবাক। সকালের  সেই ঝড়ের গতিতে কেজো খাওয়া দেখে গিন্নিরা বলতেন, ‘আহা হা হা – খাওয়া তো নয়, যেন গত্ত বোজন’। অগত্যা সেই সব হেঁশেল জাগানো গিন্নির দল এ বার মন দিলেন বিকেলের জলখাবার আর বয়েম ভরা আচার, বড়ি আর খাস্তা খাবার বানানোয়।দুপুরের খাওয়া মানে তো কত্তা, গিন্নি আর টিমটিমস্য একটি পড়ে থাকা অ্যন্টিক কাজের মাসি বা হাত নুটকো রাখাল বা খয়রা। বেশির ভাগ দিনই তাই তাদের হয় খিদে নেই , না হলে পেট ভরা। রমরমা শুধু ওই সতীন কাঁটা নিকুচির গ্যাস আর প্রেসার কুকারের।

       *****

তবে পচা বিলাস যে ঝাড়ে বংশে নির্মূল হল এমন মোটেই নয়।ঘরে ঘরে এল নতুন অতিথি রেফ্রিজারেটর – ‘ ফ্রিজ ‘। আর এই ফ্রিজ হয়ে দাঁড়ালো  ‘মিটকেস ‘। প্রথম প্রথম আঁশ নিরামিষ তাকে ভাগাভাগি আর শুধু বরফ ও ঠান্ডা জল। ক্রমে একটাই বরফকলে নানা জনের মর্জি ঠাসতে মন কষাকষি। তবে সে খুবই অল্প সময়। তড়িঘড়ি টুকরো সংসারে মানুষ কমে এলেও নানা সাজের চকমকে ফ্রিজের ম্যাপ বড় হতে হতে এখন তো দেওয়াল জোড়া। কাঁচা আনাজ, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ছাড়াও নানা মোড়কের  ‘ইসি টু কুক’ বা ‘ইসি টু ফ্রাই’ – স্বদেশী বিদেশী সমেত। সময়মতো বার করে বরফ ছাড়াতে ভুলে গেলে, সেই শুদ্ধুই আঁচে। অগ্নিশুদ্ধ হয়ে যে পেটে যাচ্ছে, এই ঢের। আর মাইক্রোতে এক চক্কর মানেই তো টাটকা। তবে এর মাঝামাঝি এক পর্ব গেছে যখন বাসিভাতটুকু পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে ভেজে, প্লেট ভাত খাওয়া হতো। আর বাসি রুটি হয় তেলে ভাজা, না হয়তো জালের ওপর ধরে ঢাকাই পরোটার মতো ফুলিয়ে কুড়মুড়ে। কাজের লোকেদের  না গরম বাসি রুটি- তরকারি আর তিনফুটে একগজ – এক চুমুক চা।কখনও তেলচিটে চিঁড়েভাজা, ভেগনে ধরা আচার, জ্যাম, জেলি বা নেসকে পড়া আলুভাজা। তাই, তারাও ইদানিং ‘ বাবুদের ‘ বাড়ির জলখাবার বা ভাত একেবারেই ত্যাগ করেছে। এমনকি তত্বের দামি মিষ্টিও বাসি করে দিলেই সপাটে ‘না ‘। কলকাতায় হাউসিংবাস পর্বে এক মাসিমার বাড়ি গেলেই গরম চপ মিলত, তখন যা রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমন সহজ নয়। কিন্তু ওই মাসিমার বাড়ি চপ খেলেই থেকে থেকেই পেট মোচড়। তো দু ‘ বাড়িতে একই কাজের লোক কমলা থাকায় জানা গেল যে ‘ রসগোল্লায় ইঁদুর পড়েছে’ । বাসি তরকারির পুরে চপ বানান। অর্থাৎ তিনি  হলেন এক বজ্র-বাসির কারবারি ।

এখন, যে কোনও ঘনিষ্ঠ জমায়েতে গেলে আমার আর সাজন গোজনে মন থাকেনা। শুধু দুরন্ত তদারকি – সব যেন উঠে যায়। এখন কোথায় সেই নতুন মাসি বা ছোট পিসি, যারা বাড়ি খালি হলেই টুকটুক করে সব গরম করে রাখবে। সেই গঙ্গাদা বা চরণ মাসিরাই বা কোথায় যে নাড়া নাড়ির আগেই কিছুটা তুলে রাখবে ঘর বলে! সেই দিদি বৌদিগুলোই বা কোথায় গেল, যারা টিফিন ক্যারিয়ারের তল্পি সমেত নেমন্তন্ন খেতে না এলে ঠাকুমার কাছে বকুনি খেত! আর আমার সেই দিদিমা , যিনি পিছনের দরজায় সার বেঁধে বসিয়ে ‘ দুঃখী’ ভোজ করাতেন সবার আড়ালে! তাছাড়াও আগের দিনের শেষ না হওয়া  আড্ডার কারণে, বাসি খাওয়ার ছুতোয় থেকে যেত আরও কিছু প্রাণের প্রাণ। বাসির সঙ্গে টাটকা রান্না যোগ করে চলত বাসি ভোজ!

এখন তো কেটারিং এর লোকেরা  বাড়তি খাবার, পেল্লায় সব  গামলায় চুড় করে ঢেলে দিয়ে হওয়া কাটে। সুমনা ,মঙ্গলা, পুতুল এরাই বা কত খাবে! প্রতিবেশীর ঘরে ঘরেও তো সব মুখ  অচেনা । ফ্রিজও তো আগে থেকেই ঠাসা। ময়লা ফেলার লোককেও বাড়তি টাকা দিলে তবেই ফেলবে। ভিখারি ভোজনের জন্যেও বুকিং করতে হয়, সঙ্গে  ক্লিনিং ও সার্ভিং এর চার্জ। ভরসা শুধু সেই ফোন নম্বরগুলি যারা নাকি বাড়ি এসে উদ্বৃত্ত খাবার নিয়ে যায়। তবে আর একটা ব্যাপার চালু হয়েছে ইদানিং,বড় বড় খাবার দোকানে। রাত ন ‘ টার পর সব খাবার অর্ধেক দামে বিক্রি। মন্দের ভালো তো বটেই। কিন্তু জানি না সেগুলো কিনে এনে আবার ফ্রিজে ঢুকছে কিনা! ব্র্যান্ডেড পচার রিসাইকেলিং – সস্তা এবং  ডিসকাউন্ট রেটে।

আপাতত তাই Zero food ই  মনে হচ্ছে যে বাঁচবার একমাত্র উপায়।

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *