শেষ পর্যন্ত এল! দুপুর থেকেই আয়োজন ছিল পুরোদমে। শুধু দরজায় কড়া নাড়াটুকুই ছিল বাকি।

প্রথমে খানিক আহ্লাদী প্রেমিকার মতো ঠোঁটের কোণে আলতো হেসে, লজ্জাজড়ানো পায়ে। তারপর যেন বিয়ের কনের সাজ। উজ্জ্বল পোশাকে আর প্রসাধনে অহঙ্কারী রাজহংসী। আর সবশেষে পুরনো ঘরণীর দাপুটে মুখঝামটা।

কার কথা চলছে এতক্ষণ ধরে? কালবৈশাখী। আবার নতুন পেরিয়ে পুরনো দাম্পত্যকলহও হয়তো বা! আকাশ রাগী আর থমথমে। পিঠছাপানো কালো মেঘের চুল এলিয়ে কুচকুচে কালো শাড়ি পরে পথে নেমে পড়েছে। যেদিকে দু’চোখ যায়, চলে যাবে ঠিক! চুলের ফাঁকে ফাঁকে সোনালি-রুপোলি চিড়িক চিড়িক। হয়তো বিদ্যুৎ, হয়ত নামী পার্লারে গিয়ে শখের হাইলাইটিং বা পাকা চুলের ঝিলিক! কে নেমে এল পথে আজ? আকাশ, নাকি চেনা কোনও মুখ? দাম্পত্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস…

কালবৈশাখী ঝড় দেখতে হয় একতলার ঢাকা বারান্দার নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে। প্রথমে শুকনো পাতা আর কাঠকুটো সব উঠে আসে লাল মেঝের বারান্দায়। গাছগুলোর মাথা দুলিয়ে অন্তহীন অনুনয়-বিনয়, যাতে অশান্তি না হয়! নতুন-পুরনো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ধুলোগুলো এককাট্টা হয়ে জমির সমান্তরালে অন্য একটা রাস্তা বানিয়ে ফেলে নিজে নিজেই, যে রাস্তায় একাই চলতে হয় জীবনের নাজাই-হরজাইয়ের হিসেব মেলানোর সাধ হলে।

খুব মন দিয়ে ধাপে ধাপে ঝড় আর বৃষ্টি আসাটা নজর করলে বোঝা যায়, প্রথমে ঝড় বা প্রেম আসে লাজুক বরযাত্রীর মতো। ‘আরে, আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কী আছে’ গোছের হাবভাব। তারপরে বিয়ে হল যেই, অমনি শুরু হল কখনও হুল্লোড়, কখনও খুঁতখুঁত করা। কেউই কোনও সমঝোতায় রাজি নয়। তারপর বাজ পড়ল, বিদ্যুৎ চমকাল। এবং বৃষ্টি নামল ভুবন ভাসিয়ে। মেঘ এবং চোখ …দুই-ই সমান সংবেদনশীল। তারপর শুকনো মাটি ভিজে গিয়ে সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠে এল। জীবনের গন্ধ। যাতে সবুজের প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে আছে। সমঝোতা আর ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। চেনা হাতে হাত রাখার গল্প। নির্ভরতা আর বিশ্বাসের গল্প। সকলেরই বা হয়তো অনেকেরই গল্প এমন। কালবৈশাখী ঝড়ের পরে কাঙ্ক্ষিত বর্ষণের গল্প। দাম্পত্যের রংবাহার।

কালবৈশাখী আর দাম্পত্য কলহ। প্রকৃতিতে ঝড় ওঠে আর বৃষ্টি নামে যেমন, দাম্পত্যেও তাই। কেন? কারণ দু’টি মানুষ পাশাপাশি থাকলে যে দু’জন দুটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব! আর কাউকে পুরোপুরি দেখা, চেনা বা জানা… এবং তারপরেও তাকে শর্তহীন অন্ধত্ব অবলম্বন করে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালোবাসতে পারা… এ বোধহয় এমন এক প্রাপ্তির বোধ, যা প্রায় অলীক।

সাধারণভাবে দাম্পত্যে পরস্পরের ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে দিকটি সবচেয়ে উজ্জ্বল, তাকেই প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা থাকে। কিন্তু কতজন পারে পরস্পরের অন্ধকার দিকগুলো মেনে নিতে? অথবা খামতিগুলো? শেষ পর্যন্ত কি বলে উঠতে পারা যায়, সবকিছু মিলিয়েই ওকে ভালোবাসি… খারাপগুলো থেকে ভালোটুকু তৈরি করে নিতে জানি?’ বলা হয়ে ওঠে না, কারণ যতটুকু ভালো, তা আজীবন সেইভাবেই থেকে যায়। আর যাকিছু অন্ধকার, তাকে আলোয় নিয়ে আসার মতো ধৈর্য বা মন বেশিরভাগ মানুষের থাকে না বললেই চলে। সুখি বিবাহিত জীবন মাপার জন্য চাই স্বামী-স্ত্রীর না-বলা অভিযোগ-অনুযোগ, না-বলা দুঃখ আর না-বলা বিরক্তির অনিবার্য উপস্থিতি এবং তা যত দীর্ঘ, দাম্পত্য ততটাই সুখকর।

কাউকে আগ্রাসী তীব্রতায় আকাঙ্ক্ষা করা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। যে মুহূর্তে তাকে সত্যিই খুব নিজের করে পাওয়ার আর্তি জাগে মনে, সে অনুভব অনেকটা তীক্ষ্ণ সূচ দিয়ে ওই মানুষটির শরীরে আর মনে অত্যন্ত সচেতনভাবে সুখ আর অধিকারবোধের রেশমি বালাপোষ জোর করে সেলাই করে দেবার মতো। তখন বিচ্ছেদ মানেই ক্ষতমুখে রক্তপাত।

জীবন বড় কঠিন।

আসলে মানুষ সব সময়েই অসাড় হয়ে থাকে চাওয়া-পাওয়া এবং না-চাওয়া আর না-পাওয়ার এক  অস্থির দোলাচলে। ভাবে, যেটা পাচ্ছে, সেটাই বেঠিক। যেটা চাইছে, সেটাই নির্ভুল।

যদি অন্ত্যমিল না থাকে দু’জন মানুষের দাম্পত্যে, যদি বৃষ্টি নেমে সবকিছু স্নিগ্ধই না-হয়ে যায়, তখন তারা থাকবে কেমন করে পরস্পরের সঙ্গে? মাছ আর পাখির মতো? একজন জলে, অন্যজন আকাশে? সেইভাবে এক ছাদের নিচে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বসবাসে ভালোবাসা কি বেঁচে থাকে? সফল দাম্পত্যে ওই তীব্র অধিকারবোধের আকাঙ্ক্ষার থেকেও অনেক বেশি প্রয়োজন নির্ভরতা আর বিশ্বাস। যখন দু’টি মানুষের মনের মধ্যে যোজনবিস্তৃত ব্যবধান আলসেমির রোদ্দুর মেখে শুয়ে থাকে… দীঘল কালো চুলের সর্পিল বেণীটির মতো.. তাকেই বলা যেতে পারে বহুব্যবহারে জীর্ণ দাম্পত্য এবং তখনই কালবৈশাখী ঝড় ওঠে আচমকা।

প্রতিটি সুস্থ দাম্পত্যে দেওয়াল যেমন আছে, তেমনই জানলাও আছে। জানলা হল সেই মুক্তি, যেখানে পৃথিবীর অন্য সব মানুষজনের সঙ্গে বিভিন্ন সম্পর্কের ক্ষেত্র সেই খোলা মাঠ, সেই নীল আকাশ… যেখানে নিজের মতো দু’হাত ছড়িয়ে বলা যায়… ‘আমি আছি… তোমাদের সকলের সঙ্গে আছি, তোমাদের সবার কাছে আর সকলের জন্য আছি।’ আর দেওয়াল হল সংসারের সেই বেষ্টনী, সেই ঘেরাটোপ… যার ভেতরে সন্তর্পণে দম্পতি আড়াল করে রেখেছে তাদের দাম্পত্যের খুঁটিনাটি, যা নিতান্ত ব্যক্তিগত যৌথ যাপনকথা।

দাম্পত্যে কালবৈশাখী এসে মনকে অস্থির করে তোলে তখনই, যখন দু’জনের মধ্যে একজন জীবনের আশা-নিরাশা, স্বপ্নপূরণ, অসাফল্য এবং ইচ্ছে আর অনিচ্ছেগুলো অন্য একটি মানুষের কাঁধে অবহেলায় আর অক্লেশে চাপিয়ে দিয়ে নিজে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। তাই দাম্পত্যে বা এই সহ-বাসে কিছু খোলা আকাশ থাকুক। সেখানে থাকুক মুক্তছন্দ, মুক্ত বাতাস আর অজস্র বর্ণময়তার রোমাঞ্চ। ভালোবাসা কাম্য, কিন্তু ভালোবাসাকে বন্ধন করে না তোলাই শ্রেয়। ভালোবাসা হোক দু’টি মানুষের আত্মার বালুতটে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ফেনিল আর সুনীল অনন্ত জলরাশির মতোই। আর কিছুটা নিভৃতি, কিছুটা সময় আর কিছুটা অবসর রয়ে যাক একান্ত ব্যক্তিগত বৈভব হয়ে… সেতারের তার যেমন… আলাদা অস্তিত্ব সব, কিন্তু ঝঙ্কার তোলে একই সঙ্গে।  হৃদয় হোক বাধ্য মেয়ে… কিন্তু তাকে বিকিয়ে দেওয়ার আগে দু’বার ভাবা ভালো, কারণ জীবন অনেক বড়। দু’জনে পাশাপাশি থাকা জরুরি, কিন্তু আগ্রাসী দমবন্ধ করা ঘনিষ্ঠতা অস্বস্তিকর, কারণ খেয়াল করলে দেখতে পাওয়া যায় মন্দিরের স্তম্ভগুলিও একাই দাঁড়িয়ে থাকে। আর সোনাঝুরি গাছে জড়িয়ে থাকে যে অর্কিড, তারা দু’টিতেও পরস্পরের ছায়ায় বাঁচে না। একটি অন্যটির থেকে প্রাণরস আহরণ করে ঠিকই, কিন্তু রোদে, জলে, ঝড়ে, বৃষ্টিতে নিজেদের নিজস্বতাটুকু নিয়েই বাঁচে।

ভেবে দেখা প্রয়োজন, দু’জন দু’জনের জন্য ঠিক কতটুকু সময় দেওয়া জরুরি। এমনও তো দিনের পর দিন হয়, যে আর পরস্পরের সঙ্গে নেহাত ক’টা কাজের কথা ছাড়া অন্য কথা আদৌ বলা হয়ে ওঠে না, শরীর নিয়মিত বিনিময় বন্ধ করে দেয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অথবা বহু-ব্যবহারের একঘেয়েমি আর বিরক্তিতে, অন্ধকারের আড়ালে মুখ লুকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উদাসীন অনাগ্রহ… মানুষের মন ঠিক কোথায় বসত করে তখন? সে চুপটি করে শুয়ে থাকে অভিমানে, অবহেলায় আর অবসন্নতায়। আর তখনই কারণে অকারণে আকাশ থমথমে হয়ে ওঠে, ঈশান কোণে জলভরা মেঘ জমে খুব, ঝড় ধেয়ে আসে।

আর তখন অবচেতনে অপেক্ষা থাকে বৃষ্টির।

মুখ তুলে আকাশকে পড়ে নিতে, বুঝে নিতে জানতে হয়। যে আকাশ প্রকৃতিতে আছে এবং যে আকাশ দাম্পত্যে। দাম্পত্যের প্রথমদিকে ভোরের আলো… নরম, মায়াবী… রোদ বাড়ছে… ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা দুপুর গড়িয়ে যায় বিকেলবেলার কবিতায়… কিছু কিছু মায়াময় মুহূর্ত পড়ে থাকে অভ্যস্ততা আর অভ্যাসের গোধূলিতে আর তারপর রাত্রি আসে। ঝড় বৃষ্টির পরে অন্ধকার আকাশে যেমন চাঁদ ওঠে, তারা ফোটে একটি দুটি করে… তেমনই দাম্পত্যের আকাশে আলো জ্বালানোর দায়িত্ব যৌথ; সে উথালপাথাল ঝড়-বৃষ্টির পরে ঝলমলে রোদ্দুরই হোক, বা স্নিগ্ধ জোছনা।

ইলেকট্রনিক্সের ছাত্রী ঈশানী রায়চৌধুরী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত। নিজস্ব লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে পছন্দ রম্য গদ্য আর ছোট গল্প | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ফ্রিডা কাহলো, খলিল জিব্রান, আর কে নারায়ণ প্রমুখ লেখকদের কাজ ভাষান্তর করেছেন। 'কৃষ্ণচূড়া আর পুটুস ফুল', 'আবছা অ্য়ালবাম', 'বাবু-টাবুর মা', ওঁর কয়েকটি প্রকাশিত বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *