আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২]

ঘুরে আসতে আসতে আমার মনে হল জুড়ানের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করার দরকার নেই। জুড়ানের মাথা  খারাপ। সে এমন কিছু ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা বলাই ভয়ের। রাষ্ট্রনায়ক হত্যা, হত্যাকারী, লুটেরা এসব মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকে না। ওর কথা সত্য বলে মনে হয় না। ছবিটা দেখে কিছুই মনে হচ্ছে না। এমন লোক অনেক হয়। আমাদের ছেলেবেলায় ফ্রি ইন্ডিয়া স্টিম লন্ড্রিতে একজন কাজ করত। তাকে বাঙাল বলতাম। রোগা লম্বা আধময়লা রং। আমাদের চেয়ে বয়সে বেশ বড়। বেশি বয়সে বিয়ে করেছিল। তার বিয়ের নেমতন্ন খেতে বেলঘরিয়া গিয়েছিলাম। লন্ড্রি উঠে গেল। লোকটাও হারিয়ে গেল। তার মতো অনেকটা ওই ছবির মানুষটা। তাই কি চেনা মনে হল?

নাকি এই লোকটাকে সত্যিই আমি দেখেছি অন্য কোথাও? অথবা দেখিনি। গড়পড়তা মানুষ এমনি হয়।   নীলমাধবদের সম্পর্কে যা বলে জুড়ান, তার সবটাই বানানো। এমন হতে পারে না। কিন্তু কথাটা গুণেন সরকার মানল না। 

এক বিকেলে গুণেনের সঙ্গে দেখা। গুণেন বলল,
– জুড়ান রায়ের সব কথাই ঠিক। নীলমাধব যে কচি মেয়েদের টাকা দিয়ে বশ করে তা তো আমার মেয়েই দেখেছে শপিংমলে।
– তা বলে হত্যাকারীর সঙ্গে যোগ থাকবে? আমার কথায় গুণেন হাসল। বলল,
– পৃথিবীতে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়। একটা দেশের  রাষ্ট্রপতির ফ্যামিলিকে শেষ করে দেওয়া যায় যখন, তখন সব কিছু হতে পারে।
আমি চুপ করে থাকলাম। গুণেন বলল:
– হিটলারের আত্মহত্যার খবর মিথ্যে, তা জানো?
– আর্জেন্টিনায় পালিয়েছিল সাবমেরিনে করে, জানি।
আসলে কোন মানুষটা কোন মানুষ তা কি বুঝতে পারা যায়?  গুণেন বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল।
তা যায় না। মানুষের গোপনীয়তা তো থাকবেই। আমি বললাম।
তাহলেই বোঝো, মুজিব হত্যাকারী যে পার্ক স্ট্রিটে নতুন ফ্যামিলি নিয়ে…। গুণেন জুড়ানের গল্পই বলতে লাগল।
– কে কোথায় কী করছে আমরা কিছুই জানি না অনুতোষ! তোমার সম্পর্কে আমি কতটা জানি, বা আমার সম্পর্কে তুমি কতটা জান? ওদের অত টাকা হয় কী করে?

 

আরও পড়ুন: মহাকাশে বেড়াতে যাবার পথে প্রথম পদক্ষেপ

 

বুঝলাম গুণেনের প্রধান আপত্তি নীলমাধবের ধনসম্পত্তি নিয়ে। নীলমাধবের অর্থিক প্রতিপত্তি নিয়ে। জুড়ানেরও তাই। তাই বলে একটা লোক সম্পর্কে এমন বিপজ্জনক কথা বলা কি উচিত? টাকা কত লোকের আছে। এ পাড়ায় বনেদি বড়লোক কম নেই। বড় ব্যবসায়ী কম নেই। একটার বদলে দুটো গাড়ি, তিনটে গাড়ি। তাই বলে লোককে দাগিয়ে দিতে হবে এইভাবে? নীলমাধবের চেয়ে কি সাহাবাড়ি, কিংবা চৌধুরীবাড়ির সম্পদ বেশি নয়? সাহাদের তো জাহাজ আছে, মাছ ধরার ট্রলার আছে কয়েকটা।  শিল্পপতিরা বেশি বড়লোক নয়? ভারতে হাজার কোটির মালিক কত আছে, তা আয়কর দপ্তর জানে। 

নীলমাধবের সঙ্গে আমরা হাঁটি। নীলমাধব তার প্রতিপত্তি নিয়েই আছে। এখন অনেক খোলামেলা হয়ে গেছে। কার্তিক দত্ত বলল:
– হি ইজ আ জিনিয়াস! আরে ভাই তার কাছে কীসব ছবি আছে, ভাবতে পারবে না।
কী ছবি? আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। চাপা গলায় কার্তিক দত্ত বলল:
– ২০-২২ বছরের মেয়ের খোলামেলা ছবি।
ওসব নেটে পাওয়া যায়। আমি বিজ্ঞের মতো বললাম। আমার কথায় আমল না দিয়ে কার্তিক জিজ্ঞেস করল:
– এখন প্রায়ই হাবড়া যায়, কেন জানো? 

আমার বুকটা ধক করে উঠল। জুড়ানের কথা মিলে গেল যে। কিন্তু না। কার্তিক বলল, ওদের ফরিদপুরের একটি ফ্যামিলি আছে হাবড়ায়, খুবই দুঃস্থ। নীলমাধব সেখানে যায়, তাদের সাহায্য করে। টাকাপয়সা দেয়। ইলিশ নিয়ে ওদের বাড়িতে ঢোকে। বিনিময়ে তার মেয়ের বয়সী মেয়েকে নিয়ে শান্তিনিকেতন বকখালি ঘুরে আসে, বেড়াতে নিয়ে যায়। ওর বাবাও যায় অবশ্য। 
রোগা, লম্বা, চোখে চশমা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।  
তুমি জানলে কী করে? মেয়েটা লম্বা নিশ্চয় স্বাস্থ্যবতী। রোগা তো নয়। চশমাও নেই। চোখ দুটো খুব সুন্দর। 
মেয়েটা না লোকটা। মানে ধর মেয়েটার বাবা হতে পারে। আমি বললাম।
তোমাকে কে বলেছে? অবাক হয়ে কার্তিক জিজ্ঞেস করল।  সতর্ক হলাম। বললাম:
– কেউ বলেনি, এমনি বললাম। কার্তিক দত্ত বলল:
– হ্যাঁ, রোগা। মাঝে মাঝে আসে নীলমাধবের বাড়ি ধুতি পাঞ্জাবি পরে। রেশন দোকানে খাতা লেখে আর হোমিওপ্যাথি করে। অভাবী। তুমি বিরাম ঠাকুরের মোচ্ছবে দেখতে পার, মেয়েটাও এসেছিল বাবার সঙ্গে। অ্যাট্রাকটিভ, যাকে বলে সেক্সি।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম কেন চেনা কিংবা দেখেছি দেখেছি মনে হয়েছিল। মোচ্ছবেই দেখেছি মনে হয়। একটি কমবয়সী মেয়ে খুব খাটাখাটনি করছিল, সে তাহলে হাবড়ার মেয়ে। তবে এইটা বুঝতে পারছি  না, জুড়ান রায় ঠিক না কার্তিক দত্ত ঠিক। কার্তিক বলল, এই মেয়েটাকে নিয়েই শান্তিনিকেতনে যায়, ওদের বাড়ি গিয়ে কাটিয়ে আসে সমস্তদিন।

– বর্ধমানের না? আমি জিজ্ঞেস করলাম।   
কে বলল বর্ধমানের? কার্তিক জিজ্ঞেস করে।
আমি যেন তারের উপর দিয়ে হাঁটছি। গুণেন এবং জুড়ান রায় যা বলেছে, তার সঙ্গে মিলছে না। আবার মিলছেও। কার্তিক দত্ত বলছে  নীলমাধব মেয়েটাকে বশ করেছে, কিংবা মেয়েটা নীলমাধবকে। যাইহোক নীলমাধব এনজয় করছে লাইফ। 

আমার মনে হতে লাগল, জুড়ান রায়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু কী কথা? লম্বা ধুতি পরা লোক, যে কিনা শেখ মুজিব হত্যাকারীর শাগরেদ কিংবা হত্যাকারী বা রাজাকার, তাকে ভাল করে চেনা দরকার।  আমি ভাবছি অন্য কথা। একটা অভাবী লোককে এইভাবে দাগিয়ে দেওয়া যায়? হত্যাকারী! মার্ডারার? একবার কোর্টে মার্ডারার দেখেছি। এফিডেবিট করতে হয়েছিল কী একটা কারণে। এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে যাওয়ার পথেই দেখেছিলাম একটা নিরীহ চেহারার যুবকের হাতে হাতকড়া। বউয়ের প্রেমিক এবং বউ, দু’জনকে হত্যা করেছিল সে। বিশ্বাসই হয় না। সুতরাং হত্যাকারী যে কোনও চেহারার মানুষই হতে পারে। সিনেমার মতো হয় না।

 

আরও পড়ুন: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কলমে তাঁর নিজের কথা

 

সিনেমার হত্যাকারীরা খুবই ভয়ানক হয়। তাদের চেহারায় জিঘাংসা ফুটে ওঠে। লাল চোখ, হিংসায় ভরা, ক্রুরতায় ভরা মুখ। মস্ত চেহারা। শোলের আমজাদ খাঁর কথাই মনে পড়ে সব সময়। কিন্তু বাস্তব অন্য। বাস্তবের হত্যাকারী আপাতচক্ষে নিরীহ হয়। আমার তার মতো মানুষ। হত্যার সময়ই মানুষ হয়ে যায় অমানুষ। কিন্তু আমার এই চিন্তা ঠিক নয়। তাদের চোখেমুখে কি নিষ্ঠুরতার ছায়া থাকে না? হিটলার কিংবা তার গেস্টাপো বাহিনী কি নিরীহ মানুষ হিটলার, হিমলার, গোয়েবলস হয়ে থাকত? সিনেমায় কী দেখেছি আমি? ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ ছবি তো ভুলিনি। মানুষের অন্তরে একটা সাধু থাকে, একটা শয়তান থাকে। শয়তান সাধুকে হত্যা করে অন্তরেই। তখন সে রাষ্ট্রপতির ফ্যামিলি নিকেশ করে, ইহুদি নিকেশ করে আনন্দে।    

এসব কথা আমার মনের ভিতরের। বলছি না। চুপ করে আছি। কথা আর বাড়াই না। আসলে কথা একটা জালের মতো ঘিরেও নেয়। কথা থেকে কথা জন্ম নেয়। সেই কথা সত্য মিথ্যা যা খুশি হতে পারে।  জুড়ানের কাছে আমি যাব না। এই ব্যাপারে নিজেকে জড়াব না। জুড়ান যে পথে যাচ্ছে, তাতে ও নিজেই বিপদে পড়ে যেতে পারে। আমার কাছে হোয়াটস্যাপ নম্বর চেয়েছিল, আমি দিইনি। বলেছিলাম, মোবাইল আনিনি, নম্বর মুখস্থ নেই। হোয়াটস্যাপ নম্বর দিলে জুড়ান আরও অনেক কিছু পাঠাত আমাকে। আমি ভীতু মানুষ। আমি আরও কিছু চাই না। 

এমনিতে আমাদের ফ্ল্যাটে বড় কেউ একটা আসে না। আমরা স্বামী-স্ত্রী টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। সুজাতা মন দিয়ে দ্যাখে, আমার মন বসে না। কিন্তু একটাই তো টেলিভিশন। খবরের কাগজ সকাল বিকেল পড়ে শেষ হয়ে যায়।  যে কটি বই আছে তা পড়া হয়ে গেছে। ফ্ল্যাটে বসে এক এক সময়ে মনে হয়, কাজ ফিনিশ। আমার আর কিছু করার নেই একা একা অপেক্ষা করা ছাড়া । যদি হোয়াটস্যাপে জুড়ানের পাঠানো কিছু থাকত, তা দেখতে পারতাম। লিংক দিলে সেই লিংক থেকে নতুন তথ্য পেয়ে যেতাম, যা মাথা ঘামানোর জন্য যথেষ্ট হত। হোয়াটস্যাপে মেয়ে ছবি পাঠায় তার সংসারের, ঘরবাড়ির, রান্নার এবং নাতির। হোয়াটস্যাপেই দেখতে পাচ্ছি সে বড় হয়ে উঠছে।

লম্বা ধুতি পরা লোক, যে কিনা শেখ মুজিব হত্যাকারীর শাগরেদ কিংবা হত্যাকারী বা রাজাকার, তাকে ভাল করে চেনা দরকার।  আমি ভাবছি অন্য কথা। একটা অভাবী লোককে এইভাবে দাগিয়ে দেওয়া যায়? হত্যাকারী! মার্ডারার? একবার কোর্টে মার্ডারার দেখেছি।

একদিন সন্ধ্যায় ডোরবেল বাজল। কে আসবে? দরজা খুলতেই দেখি জুড়ান। হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। বলল:
– খবর আছে। তুমি তো রোববারে আর আস না?
– ঘুম ভাঙে না, তাই। আমি বললাম। 
– ঘুম ভাঙে না কেন? বয়স হলে তো ঘুম কমে যায়।
– রেস্ট নিই, আলিস্যির জন্য বেরোই না।
নীলমাধবের পার্টি তো বন্ধ কর না! আমারটার বেলায় আলিস্যি আসে?
বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হয় না। ভিতরে এস। আমি জুড়ানকে ভিতরে ডাকলাম। জুড়ান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল:
– কেউ ভেতরে আসতে বলে না। দরজা থেকেই বিদায় দেয়। আমার তো স্ট্যাটাস নেই।
জুড়ানের প্যান্ট কতদিন কাচা হয় না কে জানে। ঢলঢলে, ময়লা। টেরিকটনের রং জ্বলে গেছে। বিড়ি হাতেই ঢুকল সে। বলল:
– তুমি তো বিড়ি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছ অনুতোষ।
হ্যাঁ, ডাক্তারের বারণ  ছিল।

জুড়ান বলল, সে ডাক্তার দেখায় না। মরে যেতে পারে যে কোনওদিন। তবে মরবে না। নীলমাধব পালোধীর  ব্যবস্থা করার আগে সে যাচ্ছে না। সে জানে একদিন নীলমাধবের পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়ি রেড করে, ব্যাঙ্কের  অ্যাকাউন্ট সিজ় করে, লকার সিল করে দেবে সিআইডি কিংবা এনআইএ। বুঝবে নীলমাধব। সে দিনটি দেখেই সে গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে শুদ্ধ হবে। ভিখিরি হয়ে যাবে নীলমাধব। দেখ হয় কিনা। জুড়ানের কথা শুনতে আমার ভাল লাগছিল না। আমি অত পরিবর্তন চাই না। যে যেমন আছে তেমন থাকুক। শুনতে শুনতে জুড়ান বলল: তার মানে অপরাধীর শাস্তি হবে না? 

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *