নতুন দিল্লির রেল স্টেশন! চারি দিকে লোকে লোকারণ্য| একে অপরকে ঠেলে গন্তব্য পৌঁছানোর তাড়া সবার| এই বিশৃঙ্খলার মাঝে দিশেহারা এক এগারো বছরের কিশোর কী করবে ভেবে পাচ্ছে না| তার সঙ্গে কেউ নেই| চোখে জল নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল সে| হঠাৎ তার বোধদয় হয় সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে এবং ফিরে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই আর| সে ভয়ে এক কোণায় লুকিয়ে পড়ে|
সেই কিশোরকে দেখে কেউ তখন কিন্তু এক বারের জন্যেও চিন্তা করতে পারেনি এক দিন ওই কিশোরের নাম প্রকাশিত হবে ফোর্বস এবং ভোগ ইন্ডিয়ার মত সম্মানিত পত্রিকায়| এ ছাড়াও বাকিংহ্যাম রাজপ্রাসাদে রাজকুমার এডওয়ার্ডের সঙ্গে নৈশ্য ভোজের আমত্রণ ও আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ|
‘আমার মনে আছে এত বড় শহরে একা কী করে থাকব সেই প্রশ্ন যখন আমার মনে আসে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম| কী করব? কোথায় যাব? কিছুই জানতাম না তখন| ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম|’ স্মৃতিরোমন্থন করে বলেন ভিকি | উনি ঘর থেকে পালিয়ে এসেছিলেন সিনেমার নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে|
কিন্তু সেই ভীত কিশোর থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফটোগ্রাফার‚ ভিকি রায়ের গল্প কোনও অংশে একটা হিট ছবির চিত্রনাট্যের থেকে কম নয়|
পুরুলিয়ার একটা ছোট গ্রামে ভিকির জন্ম| ওঁর বাবা এক জন দর্জি ছিলেন| রোজ ২৫ টাকা রোজগার ছিল তাঁর| যা ভিকি, ওঁর মা এবং ছ’ভাই বোনের জন্য যথেষ্ট ছিল না| ওঁর বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানোর| কিন্তু সেই ইচ্ছা তাঁর কোনও দিনই পূরণ হয়নি| অভাবের তাড়ণায় ভিকিকে তাঁর দাদু ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ওঁর মা বাবা|
‘আমার দাদু ঠাকুমা খুব কড়া ধরনের মানুষ ছিলেন| অল্পতেই আমাকে শাস্তি দেওয়া হত| আমার ভাল লাগত না| কিছু দিন পরে আর সহ্য করতে না পেরে আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম| ‘ দিল্লিতে গিয়ে প্রথমে অন্য ছেলেদের সঙ্গে কাগজ কুড়ানির কাজ করতো ভিকি| প্রথম কদিন এই কাজ করতে ভালই লেগেছিল ভিকির| কিন্তু ক্রমশ তা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠল| ভিকির কথায় ‘প্রথমটায় ঠিক ছিল কিন্তু তার র পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়ে গেল| আমাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই এলাকার গুন্ডাদের মারামারি হত| অনেকেই গুরুতর আহত হয়| ছ’মাস কাগজ কুড়ানির কাজ করার পর আমি পাহাড়গঞ্জের একটা ছোট হোটেলে বাসন ধোয়ার কাজ পেলাম| সেখানেই আমার আলাপ হয় সঞ্জয় শ্রীবাস্তবের সঙ্গে| ওঁর কারণেই আমার জীবন পাল্টে যায়|’
সঞ্জয়ের সাহায্যে ‘সলাম বালক ট্রাস্ট’ নামের এক এনজিও-র সঙ্গে পরিচয় হয় ভিকির| তাদের সাহায্যে ছোট্ট ভিকি একটা অনাথ আশ্রমে থাকার সুযোগ পান| পাহাড়গঞ্জের সরকারি স্কুলে ভর্তি ও করে দেওয়া হয় ভিকিকে| পড়াশোনায় কোনওদিনই ভাল ছিলেন না ভিকি| কিন্তু তা-ও উনি দশম শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করেন| ‘সেখানকার শিক্ষকেরা আমাকে এমন কিছুর প্রশিক্ষণ নিতে বলেন যাতে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি| রান্না শেখা‚ জামাকাপড় সেলাই এবং বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল| কিন্তু আমি কী শিখলে একটা ঠিকঠাক রোজগারের পথে যেতে পারব, তা বুঝতে পারছিলাম না|’ জানিয়েছেন ভিকি|
২০০০ সালে ভিকির দুই বন্ধু ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পান ফটোগ্রাফি কোর্সের জন্য| তাদের দেখে ভিকির ফটোগ্রাফির প্রতি উৎসাহ তৈরি হয়| ওঁকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, সংস্থা থেকে ভিকিকে একটা ৪৯৯ টাকার ক্যামেরা ও তিনটে ক্যামেরা রোল দেওয়া হয়| ভিকি বলেন ‘হাতে ক্যামেরা উঠে আসা মাত্র আমার গুরুত্ব বেড়ে গেল| বন্ধুরা আমাকে ঘুষ দিত তাদের ছবি তুলে দেওয়ার জন্য| আমি জানতেও পারলাম না কী করে আমি এটা ভালবেসে ফেললাম|’ পরে ভিকিকে দিল্লির ত্রিবেনি কলা সঙ্গম-এ পাঠানো হয় এই বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য|
এর কয়েক বছর বাদে সতেরো বছরের ভিকি দিল্লি নিবাসী ফটোগ্রাফার অনয় মানকে সহায়তা করার সুযোগ পান| ‘উনি আমাকে মাসে তিন হাজার টাকা‚ একটা মোবাইল ফোন ও একটা বাইক দিয়েছিলেন| উনি হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করেন| ফলে আমি ওঁর সঙ্গে সারা দেশে ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলাম| উনি কাজের ক্ষেত্রে খুব কড়া ছিলেন| কিন্তু উনি আমাকে নিজের ছেলের মত স্নেহ করতেন| এক বার মনে আছে একই জামা দু’দিন পরপর পরেছিলাম বলে ওঁর কাছে বকুনি খেয়েছিলাম| ফটোগ্রাফির পাশাপাশি আমাকে আদব কায়দা‚ কার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হবে তাও শিখিয়েছেন উনি|’ বলেন ভিকি| ইতিমধ্যে উনি লোন নিয়ে একটা দামি ক্যামেরা কিনেছিলেন| তাই লোনের টাকা মেটাতে ছোটখাটো কাজ ও করতেন| এইভাবে জীবন কাটছিল ভিকির|

হঠাৎ ২০০৭ সালে বড় ব্রেক পান| দিল্লির ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে ভিকির ছবি প্রদর্শন করা হয়| বাড়ি ছাড়ার পর থেকে রাস্তায় থাকাকালীন ভিকির যে সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাই ছবিতে তুলে ধরেছিলেন উনি | প্রদর্শনী খুব সফল হয়| অনেক বড় ফটোগ্রাফাররা প্রসংসা করেন ভিকির|
এর এক বছর বাদে আমেরিকার মেবাক ফাউন্ডেশন ভিকিকে নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার-এর পুনর্গঠনের ফটো ডকুমেন্ট করার দায়িত্ব দেয়| একই সঙ্গে উনি সেখানে একটা ফটোগ্রাফি নিয়ে কোর্স করার ও সুযোগ পান| এর ফলে বিভিন্ন দেশে ভিকি ছবি প্রদর্শনের সুযোগ পান|

ভিকি জানিয়েছেন ওঁর ব্যক্তিগত সংগ্রাম ওঁকে ছবি তোলার রসদ জোগায়| ওঁর কথায় ‘আমি এই কাজটা করতে ভালবাসি তাই করি| এ ছাড়াও আমার ছবি সামাজিক প্রভাব ফেলেছে অনেক বার| এক বার আমার একটা ছবি একটা পরিবারের জীবন বদলে দিয়েছিল| আমি একটা এনজিও-র সঙ্গে কাজ করছিলাম| সেই সময় জামা- মসজিদের বাইরে আমি একটা পরিবারের ছবি তুলেছিলাম যারা একটা রিক্সাতে থাকতো| আমি ছবিটা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম| ছবিটা দেখে আমেরিকার এক নাগরিক এতটাই প্রভাবিত হন যে উনি সেই পরিবারকে একটা ইলেকট্রনিক রিক্সা কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন| ‘
আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া সত্ত্বেও ভিকি রায় এখনও নিজেকে সফল ফ্যাটোগ্রাফার মনে করেন না| উনি জানিয়েছেন রোজই উনি নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন| এর মাঝেই ২০১৬ সালে বহু বছর পর আবার নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন উনি| মাকে একটা বড় বাড়ি কিনে দিয়েছেন ভিকি|
একুশ বছর বাদে বহু চড়াই উত্তরাইয়ের পর ভিকি অবশেষে এক জন ‘হিরো’তে পরিণত হয়েছেন| তবে রিল লাইফের নন সত্যিকারের জীবনের|