লাল মাটির রাস্তার চারদিকে এখন আগুন রাঙা পলাশ, কোনও এককালে পলাশ কুড়োনো ছিল নেশার মতো। ঝুড়ি ভরে পলাশ এনে শুকিয়ে নিয়ে ফুটিয়ে আর গুঁড়ো করে বানানো রং নিয়ে খেলা হত দোলপলাশের রং মিশত আবির আর পিচকারির রঙের সঙ্গে, সারা পাড়া মেতে উঠত আনন্দে আর রঙের নেশায়। বড়দের প্রণাম আর রং মাখাতে গেলেই আবির-মাখা মুখে একটু আধটু আবির গুঁড়োর সঙ্গেই খাওয়া হত রকমারি মিষ্টি। নানার বাড়ির দোলের মিষ্টির স্বাদও আলাদা আলাদা। রকমফেরও কম নাকখনও মিষ্টি, কখনও ঠান্ডা শরবত, কখনও বা কুলফি।

বাঙালির জীবনে যে উৎসবই হোক না কেন, তা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় খাদ্য উৎসবে। আগের দিন রাতে পুরনো ঝরা পাতা, পুরনো জঞ্জাল আর পুরনো সব মলিনতা জ্বালিয়ে হোলিকা দহন দিয়ে উৎসবের সূচনা। আর পরদিন আবিরখেলা, দোল উৎসবের শেষের রেশ থাকে মিষ্টি মুখে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের দোল হোক, বা শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি উদযাপন, বা নিছক খুশির রং খেলা সর্বত্রই মিষ্টি মুখ… মঠ, খাজা, গজা, জিলিপি, মালপোয়া, শরবত, প্যাঁড়া, ইত্যাদি কী নেই সেই লিস্টে!

আবির আর রঙের সঙ্গে মিষ্টিমুখের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মাথায় রেখেই এবার শুরু করা যাক রঙের উৎসবের প্রস্তুতি। এই পর্বে আপনাদের জন্য রইল হোলি স্পেশাল চাররকম মিষ্টি 

১. ঘি পোয়া
২. লবঙ্গলতিকা
৩. গুজিয়া 
৪. ঠান্ডাই শরবত
Ghi poya
ঘি পোয়া

ঘি পোয়া

 
দোলের সময়ে মধ্য কলকাতার কিছু বহু পুরনো ঐতিহ্যবাহী দোকানে কয়েকটা দিন পাওয়া যায় এই ঘি পোয়া। এই ঘি পোয়া ছাড়া মধ্য কলকাতা এবং বনেদি বাড়ির দোল আজও অসম্পূর্ণ। কেমন হয় এই ঘি পোয়া, আর কী করে বানানো যায়? আসুন জেনে নিই
 
উপকরণ—
চাল গুঁড়ো (ভালো হয় গোবিন্দভোগ চালের গুঁড়ো হলে): ১ কাপ
আটা: ১ কাপ
আখের গুড়: ১/২ কাপ
মৌরি: ১ চা চামচ (একটু হামানদিস্তার সাহায্যে থেঁতো করা)
কালো জিরে: ১/২ চা চামচ
পোস্ত:  ১ চা চামচ
ঘি: ২ বড় চামচ আর ভাজার জন্যে আলাদা
 
আখের গুড় আধ কাপ হালকা গরম জলে ভিজিয়ে নিয়ে গুলে নিতে হবে। তারপর, তাতে চাল গুঁড়ো মিশিয়ে নিতে হবে, খুব ভালো করে, তখনও মিশ্রণটা একটু ব্যাটারের মতো থাকবে, তারপর তাতে আটা আর বাকি সব কিছু ভালো করে মিশিয়ে ঠেসে নিতে হবে। ঠেসে নিলেই শেষ অবধি সেটা লুচির ময়দা মাখার মতো হয়ে যাবে। তারপর সেটা থেকে ছোট ছোট লেচি কেটে হাত দিয়ে চেপে, আনুমানিক আধ সেন্টিমিটার পুরু আর চার সেন্টিমিটার ব্যাসের গোল গোল করে নিয়ে ঘি-তে ডুবিয়ে ভেজে নিতে হবে। ঘি গরম করে আঁচ কমিয়ে অল্প আঁচে বেশি সময় নিয়ে ভাজতে হবে। ব্যাস রেডি ঘি পোয়া…
Labanga Latika
লবঙ্গ লতিকা

লবঙ্গ লতিকা

 
দোলের দিনের মিষ্টিমুখ, আর লবঙ্গ লতিকা থাকবে না, এও কি হয়? আসুন দেখে নিই, এলাচ আর জায়ফলের গন্ধ মেশানো হোলি-স্পেশাল লবঙ্গ লতিকা করতে কী কী লাগবে…
 
পুরের জন্যে—
খোয়া: ২ বাটি
নারকেল কোরা: ৪ বড়ো চামচ
চিনি: বড় ৫ চামচ
জায়ফল গুঁড়ো: ১ চা চামচ
ছোট এলাচ গুঁড়ো: ৭-৮ টা গুঁড়ো করা
 
ময়দা মাখার জন্যে—
ময়দা: ২৫০ গ্রাম
ময়ান দেওয়ার তেল
এক চিমটে কেশর দুধে ভেজানো
 
চিনির রসের জন্যে এক বাটি চিনি, আধ বাটি জল।
 
পুরের সব কিছু ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে, আর হাত দিয়ে ঠেসে নিতে হবে। তারপর চাপা দিয়ে রেখে দিতে হবে কম করে ১৫ মিনিট। এতে চিনি গলে মিশে যাবে।
ময়দাতে প্রথমে ময়ান-এর তেল দিতে হবে, এমন পরিমাণে যাতে শুকনো অবস্থাতেই হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা পেকে যায়। তারপর পরিমাণ মতো গরম জল আর কেশর দুধ দিয়ে মাখতে হবে। মাখাটা ঢেকে রেখে দিতে হবে ১৫ মিনিট। তারপর লুচির মতো লেচি কেটে মাঝখানে পুর ভরে, চারপাশে জল বুলিয়ে, ভালো করে ভাঁজ করে পুরটা ঢেকে দিতে হবে। ভাঁজ করার নানান কায়দা, সেটা নিজের ইচ্ছে মতো, তবে পুর যেন না বেরোয় এরকম করে সিল করতে হবে। সবশেষে একটি লবঙ্গ দিয়ে আটকে দিতে হবে, ছবিতে যে রকম দেখানো, সেরকমভাবে।
তেল গরম করে আঁচ কমিয়ে, অল্প আঁচে ভাজতে হবে। মুচমুচে হলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে।
একটা পাত্রে চিনি আর জল দিয়ে তাতে এলাচ, দারচিনি মিশিয়ে এক শিরার মতো চিনির রস করে, প্রতিটা লতিকা ডুবিয়ে ভালো করে মাখিয়ে তুলে নিয়ে, তেল বোলানো থালায় রেখে ঠান্ডা করলেই তৈরি দারুণ স্বাদের লবঙ্গ লতিকা। সঞ্চয়ের চিন্তাও নেই, এয়ার টাইট কৌটোতে রেখে দিলেই হল, দীর্ঘদিন থাকবে। 
Gujiya
গুজিয়া

গুজিয়া 

উপকরণ—
ময়দা: ১/২ কাপ
আটা: ১/২ কাপ
ঘি বড় দুই চামচ
নুন এক চিমটে
 
পুরের জন্যে—
খোয়া কুরিয়ে নেওয়া: এক কাপ
কাজু, পেস্তা, আমন্ড, কিশমিশ মিহি কুচি: আধ কাপ
গোলাপ পাপড়ি শুকনো দু চামচ
চিনি গুঁড়ো: ২ বড় চামচ (তবে সেটা স্বাদ মতো হওয়াই ভালো) 
 
পুরের জন্যে যে খোয়াটা, সেটা অনেকে নরম আঁচে নেড়ে নেন। তবে এখানে মিহি করে গ্রেটারে কুরিয়ে নেওয়া বলে, আর আঁচে দিইনি। পুরের সব কিছু ভালো করে মিশিয়ে ঝুরঝুরে পুর তৈরি করে রাখতে হবে আগে।
তারপর আটা ময়দাতে ভালো করে ময়ান দিয়ে মেখে রেখে দিতে হবে কিছুক্ষণ।
ছোট ছোট লেচি কেটে লুচির মতো বেলে একদিকে অল্প পুর দিয়ে চারপাশ জল দিয়ে অর্ধ চন্দ্রের মতো ভাঁজ করে ভালোভাবে সিল করে মুড়ে মুড়ে দিতে হবে।
এবারে তেল গরম করে আঁচ কমিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভেজে নিতে হবে। 
এটা চিনির রসে ডুবিয়েও রাখা যায়, কিংবা এমনি মুচমুচে ভাজাও। তবে ভেজে ঠান্ডা করে এয়ারটাইট কৌটোতে রেখে দিলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
Thandai

ঠান্ডাই শরবত

 
উপকরণ
৪ + ১/২ কাপ দুধ
২০টা আমন্ড
১০টা কাজু
১৫টা পেস্তা
১ + ১/২ টেবিল চামচ মগজ বীজ
১ + ১/২ টেবিল চামচ মৌরি
১ + ১/২ টেবিল চামচ পোস্ত 
১২ ছোট এলাচ
১” দারচিনি
৪-৫টা গোলমরিচ
৫-৬ টেবিল চামচ চিনি
১ চিমটে জাফরান
৪ টেবিল চামচ গোলাপ পাপড়ি শুকনো, কিংবা টাটকা পাপড়ি ২০ টা
 
ড্রাই ফ্রুট আর মগজ কম করে ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে তবেই মিক্সিতে পেস্ট করতে হবে। তারপর তাতে চিনি ছাড়া সব উপকরণ দিয়ে আবার ভালো করে পেস্ট করে নিতে হবে। মিহি পেস্ট করতে অল্প অল্প দুধ দিয়ে আবার মিক্সার চালাতে হবে।
ওদিকে চার লিটার দুধ ফুটিয়ে নিয়ে চিনি মেশাতে হবে, তারপর ওই পেস্টটা মিশিয়ে খুব ভালো করে গুলিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। ঠান্ডা করে নিয়ে ফ্রিজে রাখতে হবে সারা রাত, কিংবা ৫-৬ ঘণ্টা। ফ্রিজ থেকে বের করে ছেঁকে নিয়ে, বাদাম কুচি, গোলাপ পাপড়ি, জাফরান দিয়ে ঠান্ডা পরিবেশন করবেন। শীত শেষে এই সদ্য গরম শুরু হওয়া দিনে এই শরবত যেন পরম শান্তি!
 
বাংলার দোলের দুটো মিষ্টি, আর উত্তর ভারতের হোলির দুটো মিষ্টি দিয়ে জমে যাক এবারের দোল বা হোলি, ছোট বড় সবার মাঝে মিশে যাক ভালবাসার রং আর মিষ্টির স্বাদ…
শুভ দোলযাত্রা সবাইকে!
 
 
 
*ছবি সৌজন্য: লেখক
Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *