রান্নার প্রধান চার মশলাকে ‘শিষ্ট চতুষ্টয়’ বলা যেতে পারে। হলুদ/হলদি, লঙ্কা/মরিচ (চিলি), জিরে/জিরকা ও ধনে/ধনিয়া। এদের বলা হয় The Big Four।

এ যেন অনেকটা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের মতো ব্যাপার। হলুদ হলেন ব্রাহ্মণ। সাত্ত্বিক মশলা—ব্যঞ্জনের মস্তিষ্ক সচল রাখেন। লঙ্কা রাজসিক ক্ষত্রিয়। তিনি মাইনাস বিশ ডিগ্রি ঠান্ডায় ‘রাষ্ট্র’ নামক ব্যঞ্জনকে পাহারা দেন। তাঁর উগ্রতা ও Hot-তা বিভিন্ন ডিগ্রির। জিরকা হলেন বৈশ্য মানুষ। তরকারিতে ভাল মতো তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি টের পাওয়া যায়। আর ধনিয়ার কাজ ওই তিন মশলার সেবা করা। ওই তিন মশলার সেবা মানেই ব্যঞ্জন-রাষ্ট্রের সেবা। ‘শিষ্ট চতুষ্টয়ে’র বাইরে যাঁরা বাস করেন, যেমন কলৌঞ্জি, এলাচ, জায়ফল, গোলমরিচ, লবঙ্গ, জয়িত্রী, দারুচিনি, তেজপাতা প্রমুখ সব হয় ম্লেচ্ছ, নয়তো বহিরাগত কিংবা তা ধিন-ধিনা।

লঙ্কাকান্ড

ধর্মসাহিত্যে ‘লঙ্কা’ শব্দটা থাকলেও ‘চিলি’ ছিল না। শাস্ত্রের বাইরে ছিল লঙ্কা ধান; বহু পুরনো। তবে সেটা ধানই, ‘ধানি লঙ্কা’ নয়। ‘লঙ্কা’ শব্দের ধাতু যে ‘রম’ তার অর্থ হল আসক্তি। আসক্তির দহন হল লঙ্কাদহন। তবে লঙ্কাকে অনেকে ‘মরিচ’ও বলে থাকেন। মির্চ মসালা। লাল মরিচ, হরা মরিচ। মরিশাস দ্বীপ থেকে এই নাম কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। মরিচের ঝোলের কথা পাওয়া যায় বহু লেখায়। চৈতন্য চরিতামৃতে চই-মরিচের কথা আছে। চই/ চৈ হল লতা ও তার মূল। চৈতন্য-চরিতামৃতের লেখক চই-মরিচ সুক্তার কথা বলেছেন। চই বা চৈ ছিল তরকারিতে ঝাল দেওয়ার অন্যতম উপকরণ। অন্তত অবিভক্ত বাংলায়। কটু বা ঝাল ছাড়া রান্নার কথা তো ইদানীং কালে ভাবাই যায় না! লঙ্কা মানে চিলি কিন্তু এক কালে ছিল না ভারতে! অথচ এখন এ দেশে লঙ্কা ছাড়া ব্যঞ্জন তৈরিই হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যে কোনও দশ জন পর্যটককে ভারতীয় খাবার সম্পর্কে জিগ্যেস করলে ন’জন বলবেন একটিই শব্দ – চিলিজ়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারতীয় খাবার ও লঙ্কার বিয়ে হয়েছে এই সে দিন, মানে গত হপ্তায়। তাহলে ঝাল-স্বাদের জন্য কী ব্যবহার করা হত? একটি তো চৈ। আরও বহু কিছু ছিল, আছে—গোলমরিচ, পিপ্পল/পিপ্পলি ইত্যাদি।

pippali
মহাভারতে পিপলি বা পিপ্পল মরিচের উল্লেখ রয়েছে।

পৃথিবীতে লঙ্কার ব্যবহার বেশ পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার সালে মেক্সিকোতে লঙ্কাবাবুর জন্ম বলে পণ্ডিতরা জানিয়েছেন। ভারতে এসেছে এই সে দিন। এখন থেকে মাত্র ৪৫০ বছর পূর্বে। না, ইউরোপ থেকে আসেনি। গোয়ায় প্রথম লঙ্কা এনেছিলেন পর্তুগিজরা। সেই ভারতে এখন সব থেকে বেশি লঙ্কা উৎপাদন হয়। ভারতীয়রা সবচেয়ে বেশি লঙ্কা খান। লঙ্কা-রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে ভারত এখন শীর্ষস্থান দখল করেছে।

প্রাচীন নথি বলছে, ভাস্কো ডা গামা গোয়ায় অন্তত তিন ধরনের ‘মরিচ’ (চিলি নয়) দেখেছিলেন—পেরনামবুকো মরিচ, কালো গোলমরিচ এবং লম্বা ‘পিপলি’ মরিচ। পিপ্পলি বা পিপ্পলের কথা মহাভারতে পাওয়া যায়। নলের পাকদর্পণে এই মশলা দিয়ে মাংস রান্নার কথা আছে।দেশের মোট লঙ্কার ৭৫ ভাগ হয় অন্ধ্রে। ঝাল তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারতীয় লঙ্কার অন্তত ২০০ রকম প্রজাতি আছে, তাদের মধ্যে ৩৬-টি প্রজাতি উৎপন্ন হয় অন্ধ্রপ্রদেশে। সব যে খুব ঝাল বা ঝালবিহীন, এমন নয়। ঝালের রন্ধ্রভেদ আছে। ধানি লঙ্কা যেমন বেশ ঝাল তেমনি কাশ্মীরি লঙ্কায় ঝাল প্রায় নেই। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরকে লঙ্কার পীঠস্থান বলা হয়। যাঁরা লঙ্কা ভালবাসেন তাঁদের তীর্থক্ষেত্র হতে পারে গুন্টুর। কালো তুলোট মাটিতে স্বর্গীয় লঙ্কা ফলান অন্ধ্রের চাষীরা। সোনার লঙ্কা।

bhoot jalokia
ঝালের রাজা ভূত জলোকিয়া লঙ্কা

ব্যঞ্জনে দেওয়া ছাড়াও লঙ্কার নানা রকমের পদ হয়, বানানো হয় আচার। ভূত ঝালোকিয়া বোধ হয় লঙ্কার রণতুঙ্গে। বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন। অন্যান্য খেলোয়াড়দের নানা রকম নাম আছে, সে সব পরে বলা যাবে কখনও। যে কথাটা বলছিলাম, পর্তুগিজরা ভারতে লঙ্কা এনেছিলেন ব্রাজিল থেকে। সবই কিন্তু কালো মানুষদের দেশ (বর্ণবিদ্বেষী বলে না দাগালেই হল)। প্রাচীন নথি বলছে, ভাস্কো ডা গামা গোয়ায় অন্তত তিন ধরনের ‘মরিচ’ (চিলি নয়) দেখেছিলেন—পেরনামবুকো মরিচ, কালো গোলমরিচ এবং লম্বা ‘পিপলি’ মরিচ। পিপ্পলি বা পিপ্পলের কথা মহাভারতে পাওয়া যায়। নলের পাকদর্পণে এই মশলা দিয়ে মাংস রান্নার কথা আছে। পর্তুগিজরা ভারতে লঙ্কা আনার পরে উত্তর ভারতে লঙ্কা প্রচার হতে প্রায় ২৫০ বছর সময় লেগে গেছে। মারাঠাদের হাত ধরে দিল্লি ও আগ্রায় লঙ্কার ব্যবহার হয় এই সেদিন, মুঘল যুগের শেষ দিকে। ততদিন লঙ্কাহীন ছিল উত্তর ভারত অর্থাৎ হিন্দুস্তান। তবে দক্ষিণে ছিল তার রমরমা। লঙ্কার ধাতু হল ‘রম্’ যার অর্থ রতি, রমণ, আসক্তি। রামের ধাতুও ‘রম্’। রামচন্দ্র লঙ্কা জয় করেছিলেন। তখন ছিল তাঁর বনবাসকাল।

হলুদ বনের কলুদ ফুল

হলুদ আম জনগণের মশলা। কিছু নিরামিষ রান্না বাদ দিলে হলুদ পড়ে না এমন ব্যঞ্জন বিরল। অভিধান বলছে, হরিদ্রা জনগণেশের একটি নাম। গণপতি। সে কথা তন্ত্রসারে পাওয়া যায়। আমরা যে হলুদ খাই তা আসলে হরিদ্রামূল।

হলুদের নানা ব্যবহার। তা গায়ে মাখে, খায়, এমনকি তা দিয়ে কাপড়ও রাঙায়। কেটে গেলে ক্ষতস্থানে চুন-হলুদ লাগানো পুরনো প্রথা। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে হরিদ্রার নানাবিধ গুণের কথা আছে। মুরগির ঝিমুনি রোগে মা-মাসিরা হলুদ ভাত খাওয়ান। এক কালে এই দেশের সাধুরা মাটির বদলে হরিদ্রামূল দিয়ে কাপড় রঙাতেন। অঞ্চলভেদে হলুদের নানা রকম শেড। গেরুয়া হলুদও আছে, দক্ষিণ ভারতে। হরিদ্রয়া পীতবর্ণং বস্ত্রম্–নৈষধচরিতের কথা।
আমাদের দেশে সাধারণত বৈশাখ মাসে হলুদ লাগানো হয়। তোলা হয় পৌষ মাসে। সব জায়গাতে হয়। তবে মাটি দোঁয়াশ হলে ভাল। বেশ লাভজনক। আজকাল বাংলার লোকজন হলুদ চাষ খুব কম করে, তাই হলুদের এত দাম! অভিজ্ঞরা বলেন, হলুদ চাষে ধানের তিন গুণ লাভ। এক কাঠায় কয়েক মণ হলুদ ফলে। হলুদ ভারতের নিজস্ব মশলা। বাইরে থেকে আসেনি। তবে বাইরে গেছে বিদেশি বণিকদের হাত ধরে।

turmeric
বাঙালির হেঁসেলে এর জুড়ি মেলা ভার

আরববাসীরা তাঁদের জিরাকে বলেন হাব্বাত-উল-বারকাহ। প্রচলিত কথা, মক্কার বিখ্যাত কূপ ‘আব-এ-জমজম’-এর জল আর হাব্বাত-উল-বারকাহ খেলে সব রোগ নাকি সেরে যায়; জিরা, মরিচ প্রভৃতি দিয়ে বানানো হারিসা ভক্ষণ করলে যৌবন ধরে রাখা যায়।
এই সব যৌবনরক্ষাকারী মশলাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে অনেক বড় বড় যুদ্ধ হয়ে গেছে। কালিকটের রাজার সঙ্গে পর্তুগিজদের মশলার যুদ্ধ সকলেই জানি। এখনও পাড়ায় পাড়ায় বারুদ মশলা নিয়ে লড়াই হয়।

ক্ষমতা দখলের মাল-মশলা

পর্তুগিজদের পরে ‘ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া’ এবং ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ মশলা ও রাজনীতির অঙ্গনে গভীর ক্ষত রেখে চলে গিয়েছে। পর্তুগিজদের ভারতে আসার আগে অবশ্য ভারতীয় মশলার বাজার একচেটিয়া ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন আরব বণিকরা। আরব-বণিকদের হাত ধরে কেরালার রাজা চেরামান পেরুমল নবি মহম্মদের কাছে যান ও তাঁর কাছে অদ্বৈতে দীক্ষা নিয়ে নতুন নাম নেন তাজউদ্দিন। তাজের আদেশে কোচির কাছাকাছি মসজিদ নির্মাণ করা হয় ৬২৯ সালে, চেরামান পেরুমল মসজিদ। ১৬০ বছর পরে মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে জন্ম নেন অদ্বৈত প্রাণপুরুষ শঙ্করাচার্য। চেরামান পেরুমল মসজিদ ভারতের প্রথম মসজিদ, যার রেপ্লিকা কিছুদিন আগে সৌদি যুবরাজকে উপহার দেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী।

arab traders
পর্তুগিজদের আগে ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন আরব বণিকেরা

বাইবেলে আছে, রাজা সলোমনের সঙ্গে মালাবার উপকূলের যোগাযোগ ছিল গাঢ়। সেটিও মশলার সুবাদে। জিরা বা জিরকম্ কেরলে এনেছিলেন আরব বণিকরা। কেরলের জলজিরা বা কিউমিন -ওয়াটার বেশ বিখ্যাত। পাদিমুগম ওয়াটার ভিন্ন। সেটি গাছের বাকল দিয়ে বানানো এবং এর রঙ খানিকটা চায়ের মতো। গরম গরম খেতে হয়। আমরা ছেলেবেলায় জিরে-গুলি বা চুরান খেয়েছি।

আরবের মশলা-বণিকরা কেরলে আসতেন সমুদ্রপথে। আর একদল বণিক পারস্য থেকে সড়কপথে ভারতে আসতেন। আদমের বিখ্যাত ‘পবিত্র পথ’ ধরে। পুরাণ বলে, আদম ইডেন থেকে স্বর্গচ্যুত হয়ে শ্রীলঙ্কা (সেরেন দ্বীপ)-য় নেমেছিলেন, ইভ বা হবা বিবি জেড্ডায়। জিব্রাইলের বানানো ‘আদম সেতু’ ধরে আদম প্রথমে ঢোকেন বর্তমান তামিলনাড়ুতে, তার পর উপকূল বরাবর হেঁটে বর্তমান গুজরাত হয়ে এখনকার পাকিস্তান; অতঃপর ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ পেরিয়ে পারস্য, তার পর ইরাক হয়ে জেড্ডা। দীর্ঘ বিরহের পর আদম ও ইভের মিলন হয়।

ভারতে প্রবেশ করে জিরার সঙ্গে মিলন হয়েছিল গোলমরিচের। ‘জিরা’ শব্দটি ফারসি। জীরা বা জিরার শাব্দিক অর্থ হল বেষ্টন করে রাখা, নিয়ন্ত্রণে রাখা। মশলার জগতে The Big Four-এর মধ্যে জিরা হল বৈশ্য, লঙ্কা ক্ষত্রিয়, হলুদ ব্রাহ্মণ আর শূদ্র ধনিয়া। বাজারের শস্তা জিরা গুঁড়োতে আজকাল ধনিয়া ভেজাল দেওয়া হয়। জিরের বেশি দাম, ধনের কম।

 

জিরা-চরিত

জিরার জন্ম লেভান্তে। এখনকার সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, ইজ়রায়েল, প্যালেস্টাইন ও তুরস্কের কিছু কিছু অংশ নিয়ে লেভান্ত অঞ্চল। আরব বণিকরা গ্রিসেও জিরা নিয়ে গিয়েছেন। বদলে নিয়ে এসেছিলেন প্লেটোর দর্শন, প্লেটোকে আরবরা বলেন ‘আফলাতুন’ (প্লেটো>প্লাতুন>আফ্লাতুন)। ভারতকে তাঁরা ডাকতেন ‘ইস্তাখরিয়া’। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। মশলায় ঢোকা যাক।

কথা হচ্ছিল জিরা নিয়ে। বৈশ্য মশলাই বটে। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছরে নাকি এর জন্ম। সিরিয়ার নথি দু হাজার খ্রিস্টপূর্বে জিরার সন্ধান পেয়েছে, মিশর পেয়েছে এক হাজার খ্রিস্টপূর্বের। বাইবেলে জিরের কথা উল্লেখ আছে সর্ষে দানা ও বেচারা ধনিয়ার সঙ্গে। হরেক রকমের জিরে পাওয়া যায়। কালো জিরে ও সাধারণ জিরের মধ্যে অনেক তফাৎ, যদিও তারা একই প্রজাতির মধ্যে বলে মনে করা হয়। বড় দানা, মাঝারি দানা, গোল দানা হরেক চেহারা তাদের। উজবেক-জিরে জোয়ানের মতো দেখতে, মরক্কোর সামান্য ব্যাঁকা ও গাঢ় রঙের। পারসীয় জীরা গাঢ় ও অসম্ভব সুগন্ধী। ভারতীয় জিরার তীব্র গন্ধ, রঙ সাদামাটা; চিনের জিরে ফ্যাকাশে। তাহলে বুঝব কী করে, কোনটা আসল? জোয়ান, কালো জিরে বা কলৌঞ্জি, মৌরি, সাধারণ জিরের তফাৎ করব কী করে? গন্ধে।

ভারতে প্রবেশ করে জিরার সঙ্গে মিলন হয়েছিল গোলমরিচের। ‘জিরা’ শব্দটি ফারসি। জীরা বা জিরার শাব্দিক অর্থ হল বেষ্টন করে রাখা, নিয়ন্ত্রণে রাখা।

গন্ধ ছাড়াও জিরাকে আকৃতি দেখে চেনা যায়। যাঁদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর (না হলে আতস কাচ বা মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতে হবে) তাঁরা আসল একক জিরের গায়ে স্বল্প রোঁয়া দেখতে পাবেন। আমাদের দেশেও নানা ধরনের জিরে পাওয়া যায়। লাদাখ, গুজরাত ও রাজস্থানের জিরা গোল ও গাঢ় রঙের, কিন্তু তাকে অনেকে জিরে বলতে রাজি নন—বলা হয়, caraway। কাশ্মীরি জিরকা সুগন্ধী, হাতে নিয়ে খৈনির মতো ডললে পাশের বাড়ির লোক নাকি সুগন্ধ পাবেন। তার অনেক গুণ, সে খাবার হজম করতে যেমন সাহায্য করে, তেমনি আয়রনের জোগান দেয়, ব্লাড শুগার নিয়ন্ত্রণ করে; এমন অনেক কিছু। এক কথায়, যৌবন ধরে রাখে।

জিরের শত্রু ধনিয়া 

The Big Four-এ ধনিয়া হল শূদ্র মশলা। সে সর্বহারা, শোষিত, নির্যাতিত, উৎপীড়িত। কেন? বলছি। বহু জায়গায় দেখবেন পেঁয়াজ ভেজে তাতে টম্যাটো দিয়ে একটা রান্না হয়। মশলা হিসাবে দেওয়া হয় জিরে, ধনে, হলুদ, লঙ্কা। রান্নার শরিয়তে এটাকে ব্লাসফেমি বলে। জিরে ও ধনে এক জায়গায় থাকতে পারে না। জিরে হল বৈশ্য। জিরে ধনেকে গ্রাস করে নেয়, ধনেও মরার আগে বৈশ্যকে খতম করে। They kill each other। তাই তাদের একত্রবাস সম্ভব নয়। অতএব যে রান্নায় ধনে দেওয়া হবে সেখানে জিরে বাদ, কিন্তু লঙ্কা থাকবে। সে বীর সেনানী। তবে তাকেও কায়দা করে রাখতে হবে এই রান্নায়। লঙ্কাকে সশরীরে নেওয়া যাবে না। শুধু তার বলবীর্য নির্যাসটুকু নিতে হবে, রক্ষা করতে হবে ব্যঞ্জন নামক রাষ্ট্রকে। জিরে দিয়ে নিরামিশ বা আমিষ রান্নায় কট্টরপন্থী পাচক ব্রাহ্মণ-হলুদকেও ব্রাত্য করেছেন। সে বুদ্ধিজীবী, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়ের বশীভূত। তার সঙ্গে ধনিয়ার কোনও পিরিত নেই।

জিরে ও ধনে এক জায়গায় থাকতে পারে না। জিরে হল বৈশ্য। জিরে ধনেকে গ্রাস করে নেয়, ধনেও মরার আগে বৈশ্যকে খতম করে। They kill each other। তাই তাদের একত্রবাস সম্ভব নয়।

ধনিয়া বা ধনের ইতিহাস বহু পুরনো । প্রি-পটারি যুগের ফিলিস্তিনে একটি নিওলেথিক সাইটে ধনের সন্ধান মিলেছে। সাত হাজার বছর খ্রিস্টপূর্বের। গ্রিক কমেডি The Knights (by Aristophanes)-এ ধনিয়ার উল্লেখ আছে। কমেডি ছাড়া ধর্মসাহিত্যে (Book of Exodus)-ও শূদ্র ধনিয়া বহাল তবিয়তে রয়েছে। ধনিয়া নাকি স্বর্গীয়! তাই মিশরে এই মশলার কদর ছিল খুব। বালক রাজা তুতানখামেনের কবরে পনেরোটি (১৪-টি বা ১৬-টি নয়) ধনিয়া পাওয়া যায়। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই ধনের দৌড়ে। কালা ধন বাইরে থেকে না আনতে পারলেও ধনিয়া আমদানি করেছে প্রাচীন ভারত। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী-তে ধনেকে ‘কুস্তুম্বুরু’ বলেছেন। মনিয়ের উইলিয়মসের অভিধানেও এই শব্দ আছে। চরক বলছেন, জ্বরের চিকিৎসায় কুস্তুম্বুরু ব্যবহারের কথা।

বালক রাজা তুতানখামেনের কবরে পনেরোটি (১৪-টি বা ১৬-টি নয়) ধনিয়া পাওয়া যায়। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই ধনের দৌড়ে। কালা ধন বাইরে থেকে না আনতে পারলেও ধনিয়া আমদানি করেছে প্রাচীন ভারত। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী-তে ধনেকে ‘কুস্তুম্বুরু’ বলেছেন।

মহাভারতের সভাপর্বে (অধ্যায় ১০) কুস্তুম্বুরুর কথা আছে। সেখানে অবশ্য সে কুবেরের ভৃত্য। কুবের হলেন কুৎসিত দর্শন—ধনসম্পদের দেবতা (লক্ষ্মী সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের দেবী)। কুবেরের বাহন ‘মানুষ’, যেমন কুম্ভকার বা ধোপার গাধা। কুবের ‘মানুষ’-কে দিয়ে তাঁর সম্পদ বহন করান, যে সম্পদে ‘মানুষ’-এর অধিকার নেই। ‘ধনিয়া’-র অর্থ হল ধন্য। আর ‘কুস্তুম্বুরু’-র উপসর্গ ‘কু’ হল খারাপ, নীচ। এর ধাতু ‘তুবি’ মানে বহু হওয়া, বলশালী হওয়া। প্রত্যয় ‘উরু’ হল জোড়া বা নিবদ্ধ, সঙ্ঘবদ্ধ। নীচ ছোটলোকেরা বহু ও বলশালী, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ কর।

cinnamon island
দারুচিনির দেশে

গন্ধমাতন

এর পরে আসে সুগন্ধী মশলার কথা। সেগুলির ভেষজ গুণ নেহাত কম নয়। সুগন্ধী মশলা খাদ্য সংরক্ষণেও ব্যবহার হয়। প্রথমেই যে সুগন্ধী মশলার মাথায় আসে, তা হল দারুচিনি। জীবনানন্দর কবিতা মনে পড়ে, কিন্তু সত্যি সত্যিই বাংলাদেশে দারুচিনি দ্বীপ আছে—সেন্ট মার্টিন’স আইল্যান্ড। এই দ্বীপ প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন আরব বণিকরা। বহু কাল আগে কোনও এক দুর্যোগে পড়ে আরব বণিকদের দারুচিনি ভর্তি জাহাজ এই দ্বীপের কাছে উলটে যায় এবং দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে জাহাজ ভর্তি দারুচিনি। দারুচিনি ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও মায়নমারে উৎপন্ন হলেও এক কালে এর একচেটিয়া ব্যবসা করতেন আরব বণিকরা। মিশর ও গ্রিসে তারাই সরবরাহ করতেন এই সুগন্ধী। রান্না ছাড়াও মমি সংরক্ষণে কাজে লাগত দারুচিনি। ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এলাচের কথা আছে। গুয়াতেমালা, মালয়েশিয়া, কেরল ও তানজানিয়ার এই মশলাটি রাজা সলোমনের আমল থেকে জনপ্রিয়। শোনা যায়, এক কালে সলোমন এলাচের জন্য বিভিন্ন দেশে বণিক পাঠাতেন। জাফরান, লবঙ্গ, গোলমরিচ, হিং, কাল্পাসি ইত্যাদি মশলা নিয়েও ব্যবসার ইতিহাস বহু পুরনো। সে সব প্রসঙ্গ আর এক দিন।

শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *