পাঁচজনের ছোট্ট একটা দল এগিয়ে চলেছিল পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে। ট্রানসিলভানিয়া আল্পসের এই অংশটা সবচেয়ে খাড়াই। দুই দিকে সোজা প্রায় হাজার ফুট নীচে কোন চ্যাটালো পাথর অবধি নেই। নেই এবড়ো খেবড়ো পাথরের গায়ে পা রাখার জায়গা। যেন কোন অমানুষিক, আসুরিক চাপে এক বিশাল পাথরকে কেউ গোটা পুঁতে দিয়েছে পৃথিবীর গর্ভে। পা পিছলালেই নিশ্চিত মৃত্যু। কালো আগ্নেয় শিলায় ভরা গোটা পথ। মাঝে মাঝে অজানা পশুপাখির হাড়গোড়। সামনে তাকালে দেখা যাচ্ছে চকচকে আরজেস নদীর রূপালি রেখা। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডেটাসের লেখায় প্রথম এই নদীর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই নদী নয়, এমনকী নদী থেকে আরও দূরে দিগন্তবিস্তারী বরফে ঢাকা আলপাইন বনভূমির চোখ জুড়ানো শোভাও নয়, পাঁচজনের এই দলের গন্তব্য সেই দুর্গম পর্বতশিখরের কালো পাথরের সঙ্গে মিশে থাকা এক ভগ্নপ্রায়, ধ্বংস হয়ে যাওয়া অভিশপ্ত দুর্গ। না জানা থাকলে যার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। যাকে এতকাল মিথ ভেবে ইতিহাসের চোরাগলিতে ঘুরেছেন কত গবেষক, তার ইয়ত্তা নেই।
দলের পাঁচজনের দুই জন মার্কিন নাগরিক। বাকি তিনজন রোমানিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা। তখনও তাঁরা কেউ বুঝতে পারেননি এই অভিযান আসলে এক লম্বা যাত্রার শেষ অনুচ্ছেদ। ১৯৬৯-এর শেষ শরতে প্রায় বেদম সেই পাঁচ অভিযাত্রী যখন ভাঙা দুর্গপ্রাকার পেরিয়ে ধ্বসে যাওয়া সিংহদুয়ারের সামনে দাঁড়ালেন, তখন নিজের অজান্তেই সেই মার্কিন গবেষক রেমন্ড ম্যাকনেলির শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল এক হিমেল স্রোত। এই দুর্গ আর পাঁচটা চেনা দুর্গের মতো নয়। শত বছরের আদিম নিঃসঙ্গতা একে গ্রাস করেছে কতকাল আগে। যে প্রাচীরের গায়ে গেঁথে থাকা বল্লমে শোভা পেত কাটা মুণ্ডুর সারি, তারা আজ নখদন্তহীন। বড় বড় থাম, খিলান ধুলোয় লুটাচ্ছে চাঁদের আলো মেখে। সিঁড়ির কোনে কোনে জমে উঠেছে বাদামি শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। দুর্গ প্রাঙ্গণে বুনো গোলাপের ঝাড়। ফুল নেই। কালচে কাঁটা দাঁত বের করে আছে। তবু এরই মধ্যে দুর্গের ভাঙা দরজাটা খুঁজে পেলেন ম্যাকনেলি। এই তো সেই দরজা! এখানে দাঁড়িয়েই দুর্গের মালিক ১৮৯০ সালের ৫ মে স্বাগত জানিয়েছিলেন জোনাথন হার্কার নামে এক রিয়েল এস্টেট ফার্মের কেরানিকে। ম্যাকনেলি শুনতে পেলেন তাঁর সঙ্গী রাদু ফ্লরেস্কু বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছেন ঠিক সেই লাইনগুলোই “Welcome to my house! Enter freely and of your own free will!’ ….. Welcome to my house! Enter freely. Go safely, and leave something of the happiness you bring!”

সেই অতিবৃদ্ধ কাউন্টের দুর্গের সামনে উপস্থিত হয়ে এক সুদীর্ঘ নিশ্বাস নিজেদের অজান্তেই বেরিয়ে এল ম্যাকনেলি আর ফ্লরেস্কুর… বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে খুব হালকা চালে যে খোঁজ শুরু হয়েছিল, সেই অনুসন্ধান অবশেষে শেষ হল। শেষ হল বিংশ শতকের অন্যতম সেরা রহস্যের, যার সন্ধানে বহু গবেষক তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন গোটা ট্রানসিলভ্যানিয়া। তাঁরা সন্ধান পেয়েছেন কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গের…
১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ। গোটা পৃথিবী থরথর করে কাঁপছে আসন্ন যুদ্ধের ইঙ্গিতে। পুব দেশ থেকে মুসলমানরা এগিয়ে আসছে পবিত্র ভূমির দখলে। খ্রিস্টধর্ম এবার বোধহয় আর থাকল না। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট অটোমান তুর্কিদের হাত থেকে সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য সামন্তদের হাতে তুলে দিচ্ছেন অনেক বেশি দায়িত্ব। অসীম ক্ষমতা। তাঁরাই তৈরি করছেন ধর্মের পতাকাতলে সামরিক সংগঠন। এক এক সংগঠনের এক এক নাম। রোমানিয়ার সামন্ত ভ্লাদ পেলেন রোমানিয়া, ট্রানসিলভানিয়া রক্ষার দায়িত্ব। সম্রাট সিসিগমুণ্ড নিজে তাঁর হাতে তুলে দিলেন বিজয়পতাকা। সে পতাকায় এক ভয়াল ড্রাগনের ছবি আঁকা। ‘অর্ডার অফ দ্য ড্রাগন’ উপাধি পেলেন ভ্লাদ। দেশে ফিরে যে নতুন মুদ্রা চালু করলেন, তাতে রইল সে ড্রাগনের চিহ্ন। ড্রাগনকে রোমানিয়ায় বলে “ড্রাকুল”। ভ্লাদ দ্য রুলার তাই নতুন উপাধি পেলেন “ড্রাকুলা”।
কিন্তু কে এই ড্রাকুলা?
আসুন, সে সন্ধান শুরু করা যাক….
রোমানিয়া: ১৪৩১-১৪৪২
ম্যাকনেলি আর ফ্লরেস্কু তাঁদের ঐতিহাসিক যাত্রার জন্য তৈরি হতে থাকুন, আমরা বরং এই ফাঁকে সত্যিকারের ড্রাকুলাকে একটু ভালভাবে জেনে নিই। দেখে নিই ঠিক কেন বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধূসর পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন এই দুই গবেষক। যে আশ্চর্য কাহিনি এখন বলব, তার বয়স প্রায় ছ’শো বছর পেরিয়েছে। শুনে রূপকথার মতো লাগলেও এই ইতিহাসের গোটাটাই নির্ভেজাল সত্যি।
রোমানিয়ার এক প্রাচীন শহর সিঘিসোরা। স্থানীয় রোমানিয়ার বাসিন্দাদের চেয়ে জার্মানরাই সংখ্যায় বেশি এখানে। তাঁরা এই শহরকে ডাকেন সাসবার্গ নামে। একাদশ শতকে জার্মান কারিগর, ছুতোর, আর ব্যবসায়ীরা এখানে বাসা বেঁধেছিলেন। হাঙ্গেরির রাজা নিজের সীমান্তকে মজবুত করতে ১১৯১ সালে এক সনদের মাধ্যমে এদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। মধ্য ইউরোপের সীমায় থাকা এই শহর ধীরে ধীরে ট্রানসিলভানিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। গোটা জার্মানির সেরা কারিগররা ভিড় জমাতে থাকেন। হাঙ্গেরির জমজমাট শহর বিস্ট্রিৎস থেকে পঁয়ষট্টি মাইল দক্ষিণে টিরনাভা নদীর তীরে খাড়া এক পাহাড়ের উপর বিরাট এক কেল্লা। চারিদিকে বল্লমখচিত উঁচু পাথরের দেওয়াল প্রায় তিন হাজার ফুট লম্বা। সৈনিকদের লড়াই করার জন্য চৌদ্দটা ঢাকা গম্বুজ। প্রতিটা আলাদা আলাদা নামে— ছুতোর, মণিকার, কসাই, উলবিক্রেতা, স্বর্ণকার, কামার, কুমোর, নাপিত এমনি সব। নামেই প্রকাশ কোন কোন গম্বুজ তৈরির টাকা কোন কারিগররা দিয়েছে। তাঁদেরও নিজেদের স্বার্থ ছিল। পুব দেশ থেকে মুসলিমরা আক্রমণ করলে বাঁচাবে এই দুর্গ আর তার অধিপতি, হাঙ্গেরির রাজা, এই বিশ্বাস তাঁদের ছিল। শহরের সরু সরু পাথরে ঢাকা পথ, এদিক ওদিক পাহাড়ি রাস্তায় প্রচুর সিঁড়ি আর শহরের মাঝে ঘড়িঘর। তবু পশ্চিমে জার্মানির নুরেমবার্গ, ওদিকে কনস্টান্টিনোপল সঙ্গে পোল্যান্ড আর বাল্টিক সাগরের বাণিজ্য চালানোর জন্য একমাত্র পথ ছিল এই সিঘিসোরা।
দুর্গ থেকে কিছু দূরেই সামন্ত ভ্লাদের বাড়ি। ১৪৩১ সালে, যখন আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে, তখন সেই বাড়িতে দুটো খুব জরুরি ঘটনা ঘটল। সেই বছর রোমানিয়ার সামন্ত ভ্লাদ পেলেন রোমানিয়া, ট্রানসিলভানিয়া রক্ষার দায়িত্ব। সম্রাট সিসিগমুণ্ড নিজে তাঁর হাতে তুলে দিলেন বিজয়পতাকা। সে পতাকায় এক ভয়াল ড্রাগনের ছবি আঁকা। ‘অর্ডার অফ দ্য ড্রাগন’ উপাধি পেলেন ভ্লাদ। দেশে ফিরেই হাঙ্গেরির রাজাকে অস্বীকার করে নিজের যে নতুন মুদ্রা চালু করলেন, তাতে রইল সেই ড্রাগনের চিহ্ন। নাম নিলেন ভ্লাদ দ্য ড্রাকুলা। আর এই বছরই জন্ম নিল ভ্লাদের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তানের জন্মও এই বাড়িতে হয়েছিল। সে ছেলের নাম মিরসিয়া। দ্বিতীয় ছেলের নাম নিজের নামে মিলিয়ে রাখলেন ভ্লাদ। আরও বছর তিনেক পরে জন্ম হল ছোট ছেলে রাদুর। তিন তলা গাঢ় হলুদ পাথরে তৈরি সেই বাড়ির মাথায় টালির চাল, ছোট জানালা আর সঙ্গে আস্তাবল। বাড়ির তৃতীয় তলায় খাবার ঘর। দেওয়ালে এক ম্যুরালে তিন পুরুষ আর এক নারী বসে আছেন টেবিল জুড়ে। মাঝের পুরুষটির ছবি আজও প্রায় অক্ষত। গোলগাল মুখ, জোড়া থুতনি, লম্বা মোম মাজা গোঁফ, ধনুকের মতো বাঁকানো ভুরু, খাঁড়া নাক। তাঁর বিখ্যাত মেজ ছেলের সঙ্গে তাঁর মিল ওই ভুরু আর চোখে। ভ্লাদ ড্রাকুল…
ড্রাকুলের স্ত্রী নেজনা মোলদাভিয়ার মুসাতিন নামের অভিজাত বংশের মেয়ে। ড্রাকুলের এক রক্ষিতাও ছিলেন। নাম কালতুনা। কালতুনার গর্ভেও এক সন্তান হয়েছিল ড্রাকুলের। তাঁর নামও ভ্লাদ। পরে কালতুনা সন্ন্যাসিনী হয়ে গেলেন। অনেকে বলেন প্রাণ বাঁচাতে। নতুন নাম নিলেন ইউপ্রাক্সিয়া। তাঁর ছেলেও মায়ের দেখাদেখি সাধু হয়ে যান। ইতিহাসে তিনি ভ্লাদ দ্য মঙ্ক নামে বিখ্যাত। কিন্তু এদের কেউ না, ১৪৩১ থেকে যে কাহিনি শুরু হবে, তাঁর নায়ক কিংবা প্রতিনায়ক একজনই। ড্রাকুলের মেজ ছেলে ভ্লাদ, যাকে এখন থেকে আমরা ড্রাকুলা বলেই ডাকব।
তথ্যঋণ-
১। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্য়ান্ড ম্য়াকনালি, রেমন্ড টি, ইন সার্চ অফ ড্রাকুলা: দ্য় হিস্ট্রি অফ ড্রাকুলা অ্য়ান্ড ভ্য়ামপায়ারস (১৯৯৪), হটন মিলিফিন কোং
২। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্য়ান্ড ম্য়াকনালি, রেমন্ড টি, ড্রাকুলা: আ বায়োগ্রাফি অফ ভ্লাড দ্য় ইমপেলর (১৯৭৩), হথর্ন
৩। লেদারডেল, ক্লাইভ, ড্রাকুলা, দ্য় নভেল অ্য়ান্ড দ্য় লেজেন্ড: আ স্টাডি অফ ব্র্য়াম স্টোকার্স গথিক মাস্টারপিস (১৯৮৫), উইলিংবরো নর্থহ্য়ামপ্টনশায়ার, ইউকে
৪। রিকার্ডো, মার্টিন, ভ্যাম্পায়ার্স আনআর্থড (১৯৮৩), গারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
৫। ট্রেপ্টো, কার্ট এডিটেড ড্রাকুলা এসেজ অন দ্য লাইফ অ্য়ান্ড টাইমস অফ ভ্লাড টেপেস (১৯৯১), কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস
জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।