ইউ তিরথ সিং তরতাজা যুবক। খাসি পাহাড়ের খাদস্বফরা এলাকার নংক্ষল-এর (Nongkhlaw) সিয়েম, ইউ তিরথ সিং মাতৃভক্ত ও দেশপ্রেমিক। শান্ত, সাহসি, সরল, হাসিখুশি বছর বিশেকের এই যুবক সকলের প্রিয়। তাঁর মা কাকসান সিয়েমকেও সিয়েমের সকলে শ্রদ্ধা করে। কাকসান সিয়েম আবার পাহাড়ের বদলে সমভূমিতে বাস করতে পছন্দ করেন তাই মাতৃভক্ত তিরথ মাঝেমধ্যেই নংক্ষল থেকে মায়ের কাছে গুয়াহাটিতে চলে আসেন। সুযোগ বুঝে ডেভিড স্কট গুয়াহাটিতে তিরথ সিং আর কাকসান সিয়েমের সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ শুরু করলেন।

মায়ের সুবাদে হোক অথবা অন্য কোনও কারণে, ইউ তিরথ সিংকে অন্যান্য সিয়েমও বেশ সমীহ করে। ডেভিড স্কট বুঝতে পারলেন যে তিনি সঠিক পথেই এগোচ্ছেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি ইউ তিরথ সিং আর তাঁর মাকে বোঝাতে থাকলেন গুয়াহাটি থেকে সিলেট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরি করলে পাহাড়ের জনজীবনে কী কী পরিবর্তন আসবে। শেষ পর্যন্ত বরফ গলল। বুঝে বা না বুঝে ডেভিড স্কটকে একদিন ইউ তিরথ সিং জানিয়ে দিলেন যে তাঁর পক্ষে একা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। সমস্ত সিয়েমের মতামত নেওয়া দরকার। ডেভিড স্কটও রাজি হলেন।
ইউ তিরথ সিংয়ের সিয়েম নংক্ষল-এ খাসি, জয়ন্তিয়া, গারো পাহাড়ের সমস্ত সিয়েমের একটা সাধারণ অধিবেশনের আয়োজন হল। ডেভিড স্কট চতুর মানুষ। তিনি এই দরবারে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার প্রস্তাব দিলেন। ইউ তিরথ সিং আপত্তি করেননি। ব্যক্তিগত রক্ষীদের নিয়ে ডেভিড স্কট নংক্ষল-এর দিকে রওনা হলেন। দুর্গম পথ, তার ওপর কনকনে ঠান্ডা। কিন্তু তাঁকে পৌঁছতেই হবে। টানা তিনদিনের পথ পরিক্রমায় ক্লান্ত শরীরে নংক্ষল-এ পৌঁছলেন ডেভিড স্কট। তারিখটা ছিল ৩রা নভেম্বর, ১৮২৬।

দরবারে উপস্থিত হয়ে ডেভিড স্কট রীতিমতো বিস্মিত। স্কটল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ডেভিড স্কট ধারণা করা তো বহুদূর, কল্পনাই করতে পারেননি সিয়েমের দরবার কত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সিয়েমের পাঁচ-ছশো প্রতিনিধি দরবারে সমবেত হয়েছেন। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। কাঁধে তীর-ধনুক। হাতে খোলা তলোয়ার। আসলে যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে এইসব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উপস্থিত হওয়াই এখানকার সংস্কৃতি। দরবারের বিদেশি দর্শক এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, নাকি সন্ত্রস্ত হয়ে সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিলেন সে বিষয়ে তিনি পরে কোনও মন্তব্য নথিভুক্ত না করলেও লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এত সুশৃঙ্খল সভায় তিনি আগে কখনও উপস্থিত থাকেননি। কোনও চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। প্রত্যেক বক্তার বক্তব্য গোটা দরবার মন দিয়ে শুনছে। অনেকেই রাস্তা নির্মাণের বিরোধী। অনেকে আবার নিজের মাটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কথা বলছেন। অনেকের বক্তব্য রাস্তা তৈরি হলে ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে তাঁদের নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি। বিঘ্নিত হতে পারে জনজীবন। একজন ভাষণ দেওয়ার সময় অন্য কেউ তাঁকে বাধা দিচ্ছেন না। কোনও তর্কাতর্কি নেই। সবমিলিয়ে ডেভিড স্কট দরবারের কঠোর অনুশাসনের মানসিকতা দেখে মুগ্ধ।
স্কটল্যান্ড থেকে বীজ আনিয়ে এখানে মিষ্টি আলু, নাশপাতি, বিট আর গাজরের চাষ করালেন। নিজেদের জমিতে রংবেরঙের নতুন ফসল উৎপাদন করে স্থানীয় জনজাতির মানুষ যারপরনাই খুশি।
দরবারের অধিবেশন নিয়মমাফিক শুরু হলেও শেষ হওয়ার কোনও লক্ষ্মণ নেই। শুরু হওয়ার পর থেকে কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়াকে এতটুকু গুরুত্ব না দিয়ে একটানা দু’দিন ধরে অবিরাম চলছে আলোচনা। ডেভিড স্কট নীরব দর্শক হিসেবে ধৈর্য ধরে সমস্ত আলোচনা শুনছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। অথচ বহু কষ্টে সংগ্ৰহ করে আনা সুরার সদ্ব্যবহারও করা যাচ্ছে না। সমবেত প্রতিনিধিদের মধ্যে একমাত্র ইউ তিরথ সিংয়ের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় আছে। ধৈর্যচ্যুত হয়ে তাঁর কাছেই সুরাপানের প্রস্তাব করলেন। অনুরোধ অস্বীকার করে ইউ তিরথ সিং স্পষ্ট করে বলে দিলেন অধিবেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নেশা করা যাবে না। অবশেষে তৃতীয় দিন মাঝরাতে রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ হল অধিবেশন। ডেভিড স্কট তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয় হল।

ডেভিড স্কট আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নন। তড়িঘড়ি সমতল থেকে শুরু হল জমি জরিপের কাজ। আঁকা হল রাস্তার নীলনকশা। রানি কুদাম সিয়েমসিপ থেকে রাস্তা পশ্চিম দিকে জিরাঙ পর্যন্ত যাবে। তারপর পূর্বমুখী হয়ে প্রস্তাবিত রাস্তা নংক্ষল পৌঁছবে। এবার পাহাড়, মালভূমি, সমতলের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে সোহিঅং, সোহিরাম, সোহরা হয়ে চলে যাবে সিলেট জেলার ছাতক।

রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হল। নংক্ষল-এ ইউ তিরথ সিংয়ের বাড়ির কাছাকাছি স্থাপিত হল রাস্তা নির্মাণ সংক্রান্ত একটি ছোট্ট দপ্তর। ইউ তিরথ সিং নিজে রাস্তা তৈরির কাজে নিয়মিত তদারকি করছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে মাঝেমধ্যেই ইউ তিরথ সিংয়ের কাছে উপহার পাঠানো হচ্ছে। স্থানীয় ভাষ্যে রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের নাম হয়ে গেল ইস্কট সাহেবের রাস্তা। ডেভিড স্কটের ধারণা ছিল যে তাঁর দেশের মাটির সঙ্গে এখানকার কৃষিজমির বেশ মিল আছে। দেশে পাঠিয়ে দিলেন এখানকার মাটির নমুনা। পরীক্ষার পর জানা গেল যে তাঁর ধারণা সঠিক। কাজেই আর সময় অপচয় না করে স্কটল্যান্ড থেকে বীজ আনিয়ে এখানে মিষ্টি আলু, নাশপাতি, বিট আর গাজরের চাষ করালেন। নিজেদের জমিতে রংবেরঙের নতুন ফসল উৎপাদন করে স্থানীয় জনজাতির মানুষ যারপরনাই খুশি। পাহাড়ের অন্দরে-কন্দরে ছড়িয়ে পড়ল ইস্কট সাহেবের নামে জয়ধ্বনি।
কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য খুশির আবহে ছড়াতে শুরু করল অবিশ্বাসের বিষ। নংক্ষল-এ বসেই রাস্তার জন্য পাহাড় ভাঙা, জঙ্গল কাটার খবর নিয়মিত পাচ্ছেন ইউ তিরথ সিং। স্থানীয় মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার খবর আসছে। পাশাপাশি রাস্তার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মফলং থেকে লাডম্বাফল্যাং নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। মূল রাস্তার ষোল কিলোমিটার দীর্ঘ এই অংশটুকু এখনও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। ডেভিড স্কট ট্রেইল নামে পরিচিত পাহাড়-গিরিখাত-ঝর্না-নদীর সমাহার আজও পর্যটকদের কাছে ট্রেকিং-এর জন্য উপযোগী এবং আকর্ষণীয়। ডেভিড স্কটের তৈরি রাস্তার বাদবাকি অংশের খোঁজ এখন আর পাওয়া যায় না।

ইস্কট সাহেবের রাস্তার পড়ে থাকা অংশবিশেষ প্রত্যক্ষ করতে হলে শিলং আসতে হবে। শিলংয়ের পুলিশ বাজার মোটর স্ট্যান্ড থেকে ভাড়ার গাড়িতে যেতে হবে মফলং। মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার। এখান থেকেই শুরু হয়েছে সেই ঐতিহাসিক রাস্তার সবচেয়ে দুর্গম অংশ। কাঁধের ঝোলায় খাবারদাবার ভরে নিয়ে শুরু হোক ট্রেকিং। সঙ্গে কিন্তু এক বোতল জল রাখতেই হবে। স্থানীয় গাইডকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া গেলে সফর বেশ উপভোগ্য হয়। এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ। চড়াই উতরাই চলছে তো চলছেই। অবশ্য এইরকম না হলে ট্রেকিংয়ের মজা পথেই হারিয়ে যাবে। পাহাড় নদী ঝরণা সবসময়ই সঙ্গ দিচ্ছে। রাস্তার পাশের প্রকৃতির অপরূপ রূপে যখন আপনি বিভোর ঠিক সেই মুহূর্তে সামনে হাজির এক ঝুলন্ত সেতু। নীচে বহে চলেছে উমিয়াম নদী। এই নদীই এতক্ষণ কখনও পাশে পাশে চলছিল। কখনও আবার চকিতগতিতে পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়ে পথিকের কপালে ফেলছিল চিন্তার ভাঁজ।

সঙ্গী গাইড এখানে শোনাবেন উমিয়াম নদীর জন্মবৃত্তান্ত। আকাশ থেকে ধরাধামে বেড়াতে এসেছিল দুই বোন। পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ এক বোন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বোনকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে গেল অন্যজন। তার চোখের জলের বাঁধভাঙা বন্যা গিরিকন্দরের ভেতরে বইতে শুরু করে শেষমেশ একটা নদীই হয়ে গেল। সেই নদীর নাম উমিয়াম। অর্থাৎ চোখের জলের বন্যা। গাইড আরও জানাবেন যে, মেঘালয়ের প্রতিটি পাথর পাহাড় ঝরণা নদীর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এইরকম এক একটি লোককথা।

এইখানে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়া যায়। অর্ধেক পথ পাড়ি দেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় আট কিলোমিটার চলতে হবে। এবার কিন্তু চড়াই উতরাই বেশ কম। পথের পাশে এখন শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য আর সুন্দর সব গ্রামের দেখা পাওয়া যাবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চোখ জুড়িয়ে যাওয়া পাহাড়ি গ্রাম। এইভাবেই ফুরিয়ে যায় চার পাঁচঘন্টার ট্রেক। অথবা প্রায় দুশো বছরের পুরনো পথে পরিক্রমা। এই জায়গার নাম লাডম্বাফল্যাং। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে সেই বিখ্যাত জনপদ, – সোহরা। অর্থাৎ চেরাপুঞ্জি।
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।