তিন
রাগলেখার রাগ প্রবল। ক্ষণে ক্ষণে ঘরদোর জ্বালিয়ে পথে নামতে ইচ্ছে করে তার।
নামা হয় না। আসবাব ক’টা ছাড়া ঘরের অস্তিত্বই নেই তার! আখড়ার বৈষ্ণবরা তার দু’চক্ষের বিষ। ভবের ভাণ্ডীর বন আর চিরঘাট স্মরণে কেলিকদম্ব গাছের অনুকরণে সেখানে যে সব বৃন্দাবন লীলা চলে, সে সব তার একেবারেই পছন্দ নয়। ঘরে তার মন নেই, পথে তার জ্বালা। এতদিন তার বাঁচার আগ্রহ ছিল না, ইদানীং মরার সাধ গেছে। আগে তার বিষাদরোগ হত। হাত–পা এলিয়ে দিনের–পর–দিন বিছানায় শুয়ে থাকত। আখড়ার সখি রূপমঞ্জরী সেবা করত বটে, কিন্তু ভয়ও পেত খুব। সুবাহু তার জীবনে আসার পর সে শান্ত হয়ে গেছে। রাগলেখা জানে সাগরের অতলের মুক্তোর মতো তার হৃদয়টি দামি ও দুষ্প্রাপ্য। শুধু বিবাহের স্মৃতি আর সমাজের ভ্রূকুঞ্চনে এ রত্ন হারানো যায় না। মুক্তা যন্ত্রণার ফসল। প্রতিনিয়ত খোঁচা মেরে যায় সুপ্ত কণ্টক। রাগলেখার জীবন সেই ক্ষতের উপর আবরণ চড়ানো।
সে কৌতুকে লক্ষ্য করেছে, সুবাহু তাকে লুকিয়ে কাব্য লেখে! সুবাহুপত্নী শিখী সেসব পড়ার চেষ্টায় অক্ষরজ্ঞান সংগ্রহ করেছে। মনে মনে হাসে রাগলেখা। শিখী যদি জানত, রাগলেখা নিরক্ষর! কেবল শ্রুতিই তার সম্বল। অক্ষরের মুখে ছাই! অক্ষর পরিচয় নিয়ে কৃষ্ণরাধার কাব্য না লিখে কেউ মানবী রাগলেখার রূপ বর্ণনা করে? সুবাহুর পত্র রূপমঞ্জরী পড়ে শুনিয়েছে। পত্রের সম্বোধনে “পরম প্রণয়ার্ণব” আর সমাপ্তিতে ‘’নিজন্ত প্রণয়াশ্রিত দেবশর্মণ” শুনে হাসি চেপেছে! পুরুষের একনিষ্ঠতায় তার অন্তত বিশ্বাস নেই। তা সে রূপমঞ্জরী তাকে যতই বোঝাক যে সুবাহুর এই প্রেমিক রূপ এই গাঁয়ে কেউ কখনও দেখেনি!

রাগলেখা দ্বিপ্রাহরিক আহারের তোড়জোড় করে। আজ সে গুছিয়ে নানা পদ নিয়ে বসেছে। ক্ষীর-দুধ তার অত্যন্ত অপছন্দ। রকমারি নিরামিষ পদ সাজিয়ে শেষপাতে কুলের অম্বল খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। মোদ্দা কথা, স্বাধীন রাগলেখাকে কেউ ঘাঁটায় না। আখড়ার কেউ না। সুবাহু না। এমনকী রাধামোহন ঠাকুরও না।
চার
রাধামোহন বললেন, এই শ্লোকটি খেয়াল করুন, মাননীয় শীল ভট্টারিকা লিখিত “যে আমার কৌমার হর, সেই আজ আমার বর, আজও সেই চৈত্র নিশি, সেই বিকশিত মালতি সুরভি, সেই কদম্ববনের বর্ধিত বায়ু, আমিও শুয়েই আছি, তথাপি সেই রেবা নদীতটের বেতসী তরুতলে যেসব সুরত ব্যাপারের লীলাবিধি তাহাতেই আমার চিত্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছে…”
ব্রজদেব বাঁকা সুরে বললেন, এই উক্তি দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছেন তাই তো বোধগম্য হল না! আমরা কি সত্তসঈ বা অমরু শতকের আলোচনায় বসেছি? এমন উক্তি তো অমরু শতকের ছত্রে–ছত্রে। “নদীর জলের উদ্বেলতার মতো নারীর যৌবন, দিনগুলি চিরকালের জন্য চলিয়া যাইতেছে, রাত্রিও আর ফিরিবে না, এই অবস্থায় পোড়া মান দিয়া আর কী হইবে?”
কাব্য উদ্ধৃতি সম্পূর্ণ করে ব্রজদেব প্রফুল্লবদনে ভক্তদের দিকে তাকালেন। বাহবা পাওয়ার ইচ্ছা তাঁর সর্বাঙ্গে। পুনরায় বললেন, আমি যতদূর জানি আপনার উল্লিখিত শ্লোকটি কোনও ভক্তির শ্লোক নয়। সদুক্তিকর্ণামৃতে অসতীব্রজ্যায় অসতী রমণীদের অর্থাৎ সামান্য নায়িকাদের পর্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে। আর একটু ব্যঙ্গ খেলে গেল ব্রজদেবের কণ্ঠে, আপনাদেরই মাননীয় শ্রীজীব গোস্বামীর গোপালকে এই শ্লোক রাধার উক্তি বলে চালিত হয়েছে। তা রাধা যদি স্বকীয়া নায়িকা না হন, এ ধরনের আদিরসাত্মক শ্লোক বৈষ্ণব সমাজে স্থান পায় কী প্রকারে?
রাধামোহন শান্তস্বরে বললেন, নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করলে এমন উত্তরই পাওয়া যায়।
রাগলেখা দ্বিপ্রাহরিক আহারের তোড়জোড় করে। আজ সে গুছিয়ে নানা পদ নিয়ে বসেছে। ক্ষীর-দুধ তার অত্যন্ত অপছন্দ। রকমারি নিরামিষ পদ সাজিয়ে শেষপাতে কুলের অম্বল খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।
রাধামোহনের কথার মধ্যেই ব্রজদেব বলেন, বৈষ্ণব সাহিত্য ছাড়া নারদীয় ভক্তিসূত্রই বলুন, শাণ্ডিল্য সূত্রের শ্লোকেই বলুন, মর্ত্যজীবন কেন্দ্রিক কাব্যের আভাস থাকলেও ধর্মপালনই সেখানে প্রধান। সে ক্ষেত্রে যদি অসতী নারীর শ্লোক উদ্ধারযোগ্য বলে মনে হয়, তাহলে তো শ্রীমতি রাধারানির অসম্মানই করা হয়। রাধা স্বামীরূপে কৃষ্ণের ভজনা করবেন, ভক্ত ভগবানের উদ্দেশ্যে যে কামনা জানাবে, সমাজসিদ্ধ না হলে, নৈতিকতার পথে না চললে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে! এতে আমার নিজস্ব মতামত থাকবে কেন? পুঁথিই প্রামাণ্য়! এখানে দেখছি প্রকৃত বিদ্যাচর্চার বড় অভাব!
ব্রজদেবের পক্ষ থেকে উড়িষ্যার হর্ষরথ বলে ওঠে, আচার্যদেব যা বললেন যথার্থ। আমি তাঁর পাদপূরণ করছি মাত্র। নরনারীর সম্বন্ধমূলক দেব ভক্তিবাদ ঋগ্বেদেও ছিল। একথা তো আপনাদের অজানা থাকার কথা নয়। সেখানেও বৈধ স্ত্রীর উল্লেখ আছে। ওই ২ সূক্তে রচনাকার বলেছেন, স্ত্রী যেমন স্বামীকে আলিঙ্গন করে তিনিও তেমনি ইন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। হর্ষরথের কথার মাঝে ঈষৎ শ্লেষের হাসি হেসে রাধামোহন ঠাকুর বলেন, তাহলে তো ১০, ৪০, ২ সূক্তের প্রসঙ্গও উত্থাপিত করতে হয়। যেখানে, অশ্বিনীকুমারকে ভক্ত বলেছেন,” বিধবা যেমন দেবরকে শয্যায় আহবান করে, নারী যেমন পুরুষকে কামনা করে, সেইভাবে কে তোমাকে ডেকে নিয়েছে?” এসব কি বৈধ স্বামী-স্ত্রীর কথা?
সভামধ্যে হাসির রোল ওঠে। হর্ষরথ পুনরায় বলতে ওঠে, ব্রহ্ম-জীবের মিলনপ্রসঙ্গ বিস্মৃত হননি নিশ্চয়? ওই যেমন বলা হয়েছে, প্রেমিকা পত্নীর দ্বারা আলিঙ্গিত হয়ে মানুষ যেমন নিজেকে ভুলে যায়, জীবের মিলন ঠিক সে ধরনের। এ তো আমার কথা নয়। উপনিষদের কথা।
উত্তরে রাধামোহন বলেন, শাণ্ডিল্য, নারদ দু’জনেই বল্লবী যুবতীদের অর্থাৎ ব্রজগোপীদের ভক্তিকে শ্রেষ্ঠ ভক্তি বলেছেন। এই গোপীরা কবে থেকে কৃষ্ণ বাসুদেবের স্ত্রী হলেন?
ব্রজদেব তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান করেন। জোর গলায় উত্তর দিতে ওঠেন। রাধামোহনের লোকজনও উত্তেজিত হয়ে ওঠে অন্যদিকে। বজ্রদেব তাঁর নৈতিকতার নানা যুক্তিজাল বিস্তার করেন। শ্রীজীব গোস্বামীকে আক্রমণ ও ব্যঙ্গ রাধামোহনের কান এড়ায় না। ইতোমধ্যেই জীব গোস্বামীর সম্প্রদায় ব্রজদেবের কাছে পরাজয় স্বীকার করে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিয়েছে।
ব্রজদেবের পক্ষ থেকে উড়িষ্যার হর্ষরথ বলে ওঠে, আচার্যদেব যা বললেন যথার্থ। আমি তাঁর পাদপূরণ করছি মাত্র। নরনারীর সম্বন্ধমূলক দেব ভক্তিবাদ ঋগ্বেদেও ছিল। একথা তো আপনাদের অজানা থাকার কথা নয়।
রাধামোহন শুনলেন ব্রজদেব বলছেন, নীতি বিসর্জন দিলে মানুষের আর কী থাকল? এই মতো ভাবলে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে, বুঝলেন? একেই তো আপনাদের বঙ্গদেশে এখন অরাজক অবস্থা। ফিরিঙ্গি লালমুখো বেনেরা জলপথে আমাদের চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। রাধামোহন বিপদ আশঙ্কায়ও হাসলেন। তাহলে ব্রজদেবও মনে মনে ভীত? বাংলার তথা তাবৎ উত্তরাপথের হিন্দুকুলের একমাত্র বিপদ তাহলে ফিরিঙ্গি বণিকরা? তা ছাড়া ব্রজদেব বলবেনই বা কী! গত ছয় মাস ধরে চলা এই বৈষ্ণবদের মহাবিতর্ক সভার সহকারী ব্যবস্থাপক যে স্বয়ং বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খান!
* পরবর্তী পর্ব ২১ জানুয়ারি।
* ছবি সৌজন্য – Pinterest এবং artzolo
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।
অসম্ভব গভীর পড়াশোনা করে লেঝা