“শ্রীমতি রাগলেখার বয়স ষোড়শ বৎসর। সে বড় সুন্দরী। মুখ চন্দ্রতুল্য, কেশ মেঘের ন্যায়, ওষ্ঠ রক্তিম বর্ণ, হস্তে পদ্মের মৃণাল, স্তন দাড়িম্ব ফল।’

এই অবধি পাঠ করে এতক্ষণ ধৈর্য ধরে চুষতে থাকা ডালিমের দানগুলি থু থু করে ছিটিয়ে দেয় শিখী। এর চেয়ে ঢের ভাল গতকালের আখড়ায় শোনা গোদা অণ্ডালের কাব্য! রাধা নয়, দেবী সত্যভামাই সেখানে নায়িকা। কবি অণ্ডাল নাকি আবার মেয়ে! মর্ত্য মানবী হয়েই সে কৃষ্ণকে প্রাণেশ আর নিজেকে দয়িতারূপে ভজনা করে। শিখী নিজেও তো তার স্বামীকে তেমন ভাবেই ভালবাসে। স্বামীর প্রতি প্রেম কি প্রেম নয়?

শিখীর পতিপ্রেম কি প্রেম নয়?

তবে শিখীর পতিপ্রেমকে রূপমঞ্জরীরা আদিখ্যেতা মনে করে কেন? রাগলেখার ওই নয়ন শোভন রূপ তার নেই বলে? তার ভারী বয়ে গেছে ওই মায়াবিনীর রূপ বর্ণনা শোনার!



এত কষ্টে গোপনে যে অক্ষর পরিচয় শিক্ষা করেছে তা কি এই ছাইভস্ম পড়ার জন্য? রূপেই কি একমাত্র শরীর থাকে? সে তো সুরূপা নয়। তবুও অণ্ডালের কাব্য শ্রবণ মাত্র আগুনে ঘি পড়ার মতো জ্বলে উঠেছিল তার শরীর। আহা কি মধুর সে বাণী!
গুন গুন করে গাওয়ার চেষ্টা করে শিখী।

কামনায় আর্ত আমি দুকূল ভাসালো মোর প্রেম বারিধার
তারে ঘেরি চরিতার্থ হল মোর ইন্দ্রিয় সকলি
রুদ্ধ স্বরে ডাকি তাকে ওগো প্রভু, কোথা তুমি প্রিয়?

যে যাই বলুক সুবাহুকে অবিশ্বাস করবে না সে। সুবাহু তো এখনো দ্বিতীয় বিবাহ করেনি। সতীন জ্বালার চেয়ে রক্ষিতা জ্বালা ঢের সহনীয়। ভাবতে ভাবতে ফের মাথায় আগুন ধরে গেল তার। যতই ভাবে ক্রোধী হবে না সে ততই রাগ চড়ে। সে বৈষ্ণব বাড়ির মেয়ে, বধূ। ক্রোধ নামে ইন্দ্রিয় জয়েই বৈষ্ণবের সমর্পণ। মনে-মনে শপথ করে আখড়ার লোক যতই উত্তেজিত করুক প্ররোচনায় পা দেবে না। সে উত্তরাপথের মেয়ে। সেখানে সত্যভামার অর্চনাই দেখে এসেছে। লক্ষ্মী রুক্মিনী সত্যভামা এরাই কৃষ্ণের প্রকৃত স্ত্রী, প্রকৃত সঙ্গিনী। কৃষ্ণের পাশে তার মাতুলানী রাধা, এ ধারণার বাহক এ বাংলার কতগুলো লক্ষ্মীছাড়া আচার-বিচার হীন ভক্ত! এই কাম প্রবণ সমাজতাচ্ছিল্যকারী লক্ষ্মছাড়া পণ্ডিত কবিগুলিকে দুই চোখে দেখতে পারে না সে। কেউ ভেক ধরেছে। কেউ তন্ত্র-মন্ত্রের শাক্ত আচার জুটিয়ে আনছে। যতসব স্বেচ্ছাচারী আর নাস্তিক প্রেমিকের দল রাজ্যের বেবুশ্যে আর বিধর্মী নেড়ানেড়িদের আখড়ায় ঢোকাচ্ছে। আসছেন পণ্ডিত ব্রজদেব! তিনি যৎপরোনাস্তি শায়েস্তা করবেন এই অবৈধ প্রণয়াকাঙ্ক্ষীগুলোকে। তাতে যদি সুবাহুর শিক্ষা হয় হোক। মূর্খের পদাঘাত শরীরেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু পণ্ডিতের অবহেলা! শিখী মর্মে মর্মে সুবাহুর ঔদাসীন্য অনুভব করেছে; তা শত সহস্র পদাঘাতের চেয়ে তীব্র ও মর্মভেদী।



কেঁদে ফেলে শিখী। আপন মনে বলে, শিগগির আসুন জ্যেঠামহাশয়, না হলে কিভাবে আমি রাগলেখার মুখোমুখি হব? কীভাবে শাস্তর মতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব? যতই তলে তলে নষ্টামি করো বিবাহিতার মান আলাদা। এই বাঙালি বৈষ্ণবগুলো রাধাকে মাথায় নিয়ে নাচছে! এ নিয়ে তক্ক আলোচনার এত দরকার কি বাপু? সমপক্কে মামিকেই যদি সমাজ মেনে নেয় তাহলে আর মাগ পুষবে কেন পুরুষগুলো?

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সহ মধুর কুঞ্জবন অবধি ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করে শিখীর। এই সময়টা তাকে পাশের গ্রামে দিদির বাড়ি যেতে হচ্ছে। শাশুড়ি ননদহীন সংসারে এই প্রথমবারের সন্তানসম্ভাবনায় আকুলভাবে খবর পাঠিয়েছে দিদি। না হলে ওই পণ্ডিতদের সামনে কুলটা মেয়েটাকে উচিত শিক্ষা দিত সে। দু’বছর পুরোয়নি তাদের দু ‘বোনের এক সঙ্গে পাশাপাশি গ্রামে বিয়ে হয়েছে । এর মধ্যেই কোত্থেকে এসে ওই অলক্ষুণে মেয়েছেলেটা সুবাহুকে ওর বশীকরণে ভুলিয়ে দিয়েছে। ‘কামরূপ কামিখ্যের বিদ্যে নিয়ে যত অজাত- কুজাত আমার সব্বনাশ করে দিল গো ‘ বলতে বলতে গলার তুলসীমালা প্রাণপণে চেপে ধরে শয্যায় একেবারে আছড়ে পড়ে শিখী।

লক্ষ্মী রুক্মিনী সত্যভামা এরাই কৃষ্ণের প্রকৃত স্ত্রী, প্রকৃত সঙ্গিনী। কৃষ্ণের পাশে তার মাতুলানী রাধা, এ ধারণার বাহক এ বাংলার কতগুলো লক্ষ্মীছাড়া আচার-বিচার হীন ভক্ত! এই কাম প্রবণ সমাজতাচ্ছিল্যকারী লক্ষ্মছাড়া পণ্ডিত কবিগুলিকে দুই চোখে দেখতে পারে না সে।

সুবাহু বেশ জোরের সঙ্গে বলে, এ ধরনের সালিশি সভায় যাওয়ার কি আছে বলুন শাস্ত্রী মশাই? বোঝেন না এসবে আমাদের প্রয়োজন নেই ? স্বাভাবিক আচারের বাধা এলে মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়। এমন সব লঘু ফারখতিপত্র আপনি গ্রহণ করেন কেন?
রঘুনাথ শাস্ত্রীর মেজাজের ও অহংবোধের তেমন সুনাম নেই কিন্তু সুবাহুর প্রতি স্নেহ আছে এবং সে স্নেহের কারণও আছে। সুবাহু ধনী ও শিক্ষিত বৈষ্ণব। যুবসমাজে তার অনুগামী বাড়ছে‌। উপরন্তু মালিহাটির খ্যাতনামা বৈষ্ণব গুরু রাধামোহন ঠাকুরের প্রিয় পাত্র সে।

শাস্ত্রী ঈষৎ হাসেন, বলেন, তুমি আজকাল অল্পেই উত্তেজিত হচ্ছ বাবা! ওরা আমার ভাষ্য জানতে চাইছে। আমি যদি অপরাধ পালনের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা না করি তবে করবেটা কে হে? প্রায়শ্চিত্তের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না করলে চাষারা স্বর্গে যাবে ভেবেছ?

এবারে ঠাট্টার সূক্ষ্ম হাসি খেলে যায় সুবাহুর মুখে। বলে,সে কি? শূদ্র আবার স্বর্গের অধিকারী হল কবে থেকে? আপনারা ওদের শোকপালনের ব্যবস্থা করেছেন এক মাস। ওদের জন্য আমাদের মাথাব্যথা আছে নাকি?
সুবাহুর ব্যঙ্গ গায়ে মাখেন না শাস্ত্রী। তাঁর কানে এসেছে সুবাহু পত্নীর প্রতি তেমন মনোযোগী নয়। শাস্ত্রীর অনূঢ়া কন্যা সংখ্যা পাঁচ।
শাস্ত্রী কথা ঘোরান। বলেন, ছোটলোকদের স্বর্গে যাওয়ার সাধ আছে বাপু, কর্ম নেই!
পাশে রাখা স্তূপাকার পত্র থেকে একটা পত্র তুলে ধরে বলেন, ” এই দেখো, পত্রের বিষয় দেখো হারামজাদাদের! কি না “অন্ধকারে প্রাতঃকৃত্যের সময় ডাইন হস্তের মধ্যম আঙ্গুলে , ইঁদুর কামড়ে দিলে বেটার হাত ও পায়ে দুষ্টক্ষত হইল! “
সুবাহু হেসে বলে, ইঁদুর কামড়েরও নিদান দেবেন আপনারা? আর কি বাকি থাকল তাহলে?
সুবাহুকে থামিয়ে শাস্ত্রী বলেন, আঃ! অত অধৈর্য হও কেন? পুরোটা তো শোনো। কি লিখেছে দেখ না এরপর? ” আমার কুল ব্যাধি হইয়াছে–ইহার প্রাচিত্তির করিব– আপনকারা সাস্ত অনুসারে বেবস্থা দিতে আজ্ঞা হইবে।” চোখ টিপে হাসেন শাস্ত্রী। বলেন, বুঝতেই পারছ কেমন রোগ? কথা থামিয়ে মুখ বিকৃত করে বলেন, বুঝলে বাবাজি, এ ব্যাটা তো কাল রোগে পচে গলে মরবেই, তার উপর আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলে প্রাচিত্তিরটুকুও হয় না!



সুবাহু নীরব থাকলেও তার মুখে কোনো সন্তোষজনক আস্থা দেখতে পান না শাস্ত্রী। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, তা শুনছি নাকি এক ভেকধারিণীতে মন গেছে?

ওই আমরা সমাজপতিরা, পাতি না দিলে, পাঁচ সিকের সাঙাও ওরা করতে পারত না! ভেক নিয়ে আখড়ার এক কোণে ঠাঁইও পেত না। দেখনি চাষাণী চন্দ্রার কি হল হল? গভভো বিনাশ করতে গিয়ে নরকে গেল!

মুহূর্তে যেন মুখে একরাশ কালি ঢেলে দিল কেউ সুবাহুর।শাস্ত্রী তাকে ইচ্ছা করে আঘাত করলেন একথা যেমন সত্য তেমনি সত্য বৈষ্ণব পণ্ডিতদের এইসব অধঃপতিত মেয়েদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু। সে এতক্ষণ ইচ্ছা করেই শাস্ত্রীকে উত্যক্ত করছিল। শাস্ত্রীও সুযোগ বুঝে তাকে আঘাত করলেন। শাস্ত্রীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে উঠে পড়ে। আসলে মনে মনে অস্থির আছে সে। স্বভাবেই সে এমন, তার উপর যুক্ত হয়েছে শ্রীমতি রাগলেখা। পত্নী শিখীর কোন দোষ এযাবৎ খুঁজে পায়নি, অন্যদিকে রাগলেখার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে অস্থির করে তুলেছে। গোদের ওপর বিষ্ফোট, উত্তরাপথের সর্বত্র পরকীয়া মতবাদকে তর্কে পরাভূত করে জয়পুরের মহারাজা সেওয়া মানসিংহের সভাপণ্ডিত ব্রজদেব উপাধ্যায় এই মালিহাটি গ্রামে আসছেন।
শ্রীনিবাস আচার্যের পৌত্র রাধামোহন ঠাকুরের শিষ্য সুবাহু, কি করে ব্রজদেবকে আতিথ্য দেবে? তারা চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবে পরকীয়া পন্থী। প্রেম শুদ্ধ ও অবিনশ্বর। তার মাঝে নৈতিকতার সন্ধান দুধের চোনা পড়ার মতো।সে মনে মনে যতবারই রাগলেখার মুখ স্মরণ করেছে ততবারই ভেসে উঠেছে যুক্তিতর্ক বোধহীন এক সদ্য দোহিত গো দুগ্ধের মতো শুভ্র ভাবোচ্ছ্বাস। ফেনায় ফেনায় তার হৃদয় উপচে উঠেছে। এই আবেগকে সে কখনোই দূষিত মনে করেনি। কিন্তু সমস্যা যে অন্যত্র। পণ্ডিত ব্রজদেব শিখীর পিতৃবন্ধু, পিতৃব্যপ্রায়। ব্যক্তিজীবনে বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীকে সম্মান স্বীকৃতি দেওয়া ব্রজদেবদের নিয়ম বহির্ভূত।

সুবাহু কর্ম ও জ্ঞানের সন্ধানী। তার যাত্রাপথে শিখী ছিল সঙ্গিনী মাত্র। প্রেমকে সে এ যাবৎ গুরুত্ত্ব দেয়নি কারণ মানবিক প্রেম ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের যাবতীয় কর্মপ্রচেষ্টা। এক ধু ধু বিরান ভূমির মাঝে আস্ত এক গর্দভের মতো প্রেমে নিমজ্জিত মানুষটিকে দাঁড় করিয়ে দেয়!

সুবাহুর আশঙ্কাই সত্য হল।তত্ত্ব ব্যাখ্যা, শাস্ত্র আলোচনা, সমাজ ও অনুচরবৃন্দ নিয়ে মাতোয়ারা সুবাহুর স্ত্রীযুক্ত অথচ প্রেমহীন জীবনে আবির্ভূত হল সদর্থেই পরকীয়া নায়িকা, ভেকধারিণী রাগলেখা। রাগলেখার যা হওয়ার তা হল, সুবাহুর সর্বনাশ হল!


পরবর্তী পর্ব: ১৪ জানুয়ারি, ২০২১, দুপুর ১২টা।

 

সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *