বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর, পৌষ মাস, এর মধ্যেই রৌদ্র ম্লান হয়ে এসেছে। পথে লোকজন তেমন নাই, মাঝে মাঝে দু একটি কেরাঞ্চি গাড়ি চোখে পড়ছে, ছোট ও নিচু খাঁচার মতো দেখতে এই গাড়িগুলো টেনে নিয়ে যায় একজোড়া অস্থিচর্মসার বেতো ঘোড়া, কলিকাতার বাবুরা অবশ্য কেউ এই কেরাঞ্চি চড়েন না, তাঁদের জন্য রয়েছে রাজকীয় ল্যান্ডো বা ব্রুহাম। আজ শীত একটু বেশিই পড়েছে, উত্তুরে হিম বাতাসের বেশ দাপট, সন্ধ্যায় মনে হয় ঠাণ্ডা আরও বাড়বে। পথের ধারে একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দু-একখানি শুকনো পাতা উড়ছে বাতাসে, নির্মেঘ আকাশে কী এক উদাসী সুর যেন লেগে আছে। সামনের বাজারটি বেশ বড় তবে এই দ্বিপ্রহরে খরিদ্দারের ভিড় নাই বললেই চলে, সারি সারি দোকানগুলি অলস পড়ে রয়েছে, দোকানিরা এ-ওর সঙ্গে গল্পগুজবেই ব্যস্ত। অদূরে বাবু বিশ্বনাথ মতিলালের প্রাসাদপম বাড়ি। আজ কয়েক বৎসর হল এই বাজারটিও তিনিই বসিয়েছেন, কিছুদিন পূর্বে সেটি অবশ্য তাঁর বড় ছেলের বউয়ের নামে লিখে দিয়েছেন, সেই থেকে লোকে মতিলাল বাবুর বাজারের নাম দিয়েছে ‘বহুরাণির বাজার’ বা বউ বাজার!
বাড়ির একতলার বৈঠকখানায় একটি আরাম-কেদারায় বসে আছেন বাবু বিশ্বনাথ মতিলাল, বয়স আন্দাজ চল্লিশ হবে, পরনে একখানি সাদা কেমব্রিকের বেনিয়ায় আর মিহি পাড়ের চুনোট করা ফিনিফিনে শান্তিপুরী ধুতি, গায়ের উপর একটি কাশ্মীরী শাল আলগোছে ফেলা রয়েছে। পায়ে তালতলার চটি, একমাথা বাবড়ি চুল, পরিস্কার করে কামানো মুখে সরু গোঁফখানির জন্য একঝলক দেখলে তাঁকে এখনও যুবক বলেই ভ্রম হয়। কেদারার পাশে দাঁড়িয়ে একজন ভৃত্য শ্রেণীর লোক বিশ্বনাথ বাবুর ডান হাতখানি নিজের হাতে নিয়ে দলাই মলাই করছে, বিশ্বনাথ মতিলালের চোখদুটি আধো তন্দ্রাচ্ছন্ন, সামনে সাদা ফরাস পাতা নিচু জলচৌকির উপর বসে থাকা একজন যুবককে উদ্দেশ্যে করে ইষৎ জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
-রাদামোহন, এবার বুলবুলির লড়াইয়ের খপর কী ?
-এবার ছাতুবাবুর মাটে শুনচি জোর লড়াই!
লড়ায়ের কথা শুনে চোখদুটি খুলে রাধামোহনের দিকে তাকিয়ে সাগ্রহে বিশ্বনাথ বললেন,
-বলো কী হে! তা পাকি নিয়ে কে আসচে ?
-মল্লিকদের
-কে ? হরনাথ মল্লিক ?
-তাই তো শুনচি! তিনমাস নাকি খলিফা রেকে সেপাই বুলবুলি পুষচে!
-বটে ?
সামান্য একটু হেসে রাধামোহন বললেন,
-শুনচি এবার লড়াইয়ে ছাতুবাবু নাকি আপনাকে সালিশী মানবে!
-আমাকে ?!
-লোকে তো তাই বলাবলি করচে!
সালিশীর কথা শুনে এবার উঠে বসলেন বিশ্বনাথ। ভৃত্যটির দিকে তাকিয়ে বললেন, যা! আর টিপতে হবে না, হুঁকো সেজে আন দেকি! তামাকুতে ম্যাককে সায়েবের গন্ধ যেন দিবি!
এই পালা নিয়ে তাঁর অনেক আশা, কলিকাতায় এর পূর্বে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা কখনও হয়নি। রাধামোহন সরকার বয়সে যুবক, পিতামহ এককালে নুনের ব্যবসায় বিস্তর পয়সা করেছিলেন, শোনা যায় গোকুল মিত্রের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা ছিল। সুতানুটির চিৎপুরে সরকারদের বসতবাড়িটি সেই সাক্ষ্য এখনও বহন করে চলেছে।
বিশ্বনাথ মতিলালের তামাক, হুঁকো আর গড়গড়ার সংগ্রহ দেখার মতো, কয়েকদিন আগেই সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে কোম্পানির তৈরি করা একটি বাদশাহী গড়গড়া কিনেছেন! রুপোর গড়গড়াটি মরকত মণি দিয়ে সাজানো, সোনা বাঁধানো লম্বা নল, ভাগলপুরি তামাক আর ম্যাককে কোম্পানির তামাক-গন্ধ দিয়ে সেই গড়গড়া সাজলে এক দেখবার মতো জিনিস হয়! তামাক ছাড়াও তাঁর আরেকটি দুর্বলতা রয়েছে, সেটি হল সখের যাত্রপালা। রাধামোহনের পরামর্শে বছর দুয়েক আগে নিজেই একটি যাত্রার দল খুলেছেন, বেছে বেছে অভিনেতা জোগাড় করা হয়েছে, তার সঙ্গে গান-বাজনার দলও রয়েছে, তবলা হারমোনিয়াম জোগাড়দার, পরিশ্রম কম হয় না। প্রতি সন্ধেবেলায় বৈঠকখানায় বসে আখড়া অর্থাৎ মহড়ার আসর। যাত্রাপালা অভিনীত হয় বাড়ির উঠানে, তবে এই পালা গাঁ-গঞ্জের কেষ্টপালা বা রামগান নয়, এ হল নগর কলিকাতার বাবুদের বিলাস! রতি বিলাস! বাবুর দল রসিয়ে রসিয়ে এর স্বাদ নেন, বাড়ির উঠানেই নেমে আসে মধুঋতু! রসের গানের কলি ঠোঁটে নিয়ে উড়ে বেড়ায় মধুবাতাস!
হপ্তায় একদিন করে একেক বাবুর বাড়ির উঠানে বসে যাত্রাপালা, সাদা ফরাস পাতা হয়, অসলারের ঝাড়বাতির আলোয় সেজে ওঠে গৃহ আঙিনা, রঙ করা টিনের বাক্স থেকে বের হয় সাজগোজ, বিলাতি সুরা আর খাঁটি তামাকের সুবাসে ভরে যায় চারপাশ। রাধামোহন নিজেই অনেক সময় পালা লেখেন, আবার কখনও পুরাতন কোনও প্রণয় কাব্যও বেছে নেন, যেমন এবার ঠিক করেছেন বিদ্যাসুন্দর পালা অভিনীত হবে। একটা কমবয়সী ছোকরা ক’দিন আগে জোগাড় হয়েছে, সে বিদ্যা সাজবে। এই পালা নিয়ে তাঁর অনেক আশা, কলিকাতায় এর পূর্বে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা কখনও হয়নি। রাধামোহন সরকার বয়সে যুবক, পিতামহ এককালে নুনের ব্যবসায় বিস্তর পয়সা করেছিলেন, শোনা যায় গোকুল মিত্রের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা ছিল। সুতানুটির চিৎপুরে সরকারদের বসতবাড়িটি সেই সাক্ষ্য এখনও বহন করে চলেছে। তবে রাধামোহন বড় বাড়ির নিয়ম মেনে পয়সা রোজগারের জন্য কিছুই করেন না, গানবাজনা, যাত্রাপালা, সুরা নিয়েই তাঁর দিন কেটে যায়। তাছাড়া জানবাজারে একটি বাঁধা মেয়েমানুষও রয়েছে, লক্ষ্মীমণি, প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় রাধামোহনের ব্রুহাম গাড়িটিকে চিৎপুর থেকে জানবাজারের পথে যেতে দেখা যায়!
ভাগলপুরি তামাকে দুটি টান দিয়ে রাধামোহনের দিকে চেয়ে বিশ্বনাথ জিজ্ঞাসা করলেন,
-পালার গান লেকা হয়ে গেচে নাকি ?
-একটা হইচে তবে কাল নতুন গানকানি যা শুনলুম, আহা! কানে লেগে রইচে!
-তাই নাকি ? তা কার কাচে শুনলে ?
রাধামোহনের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। খড়খড়ি দেওয়া জানলায় মতিলাল বাড়ির পোষা বেড়াল চন্দ্রনাথের মতো রোদ্দুর এসে শুয়ে রয়েছে, বাইরে নিমগাছের পাতাগুলি শুকনো বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে, জলচৌকির উপর তাকিয়া ছেড়ে উঠে বসলেন রাধামোহন। সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন,
“মদন-আগুন জ্বলচে দ্বিগুণ, কি গুণ কল্লে ঐ বিদেশি/ ইচ্চে করে উহার করে প্রাণ সোঁপে সই হইগে দাসী।” অনেকটা টপ্পার মতো তাল, রাধামোহনের রীতিমতো সাধা গলা, গাইছেন আর জলচৌকির কাঠের উপর আঙুল দিয়ে ঠেকা দিচ্ছেন, চোখ দুখানি ভাবে ঢলোঢলো! বিশ্বনাথও নিজের আরাম কেদারার হাতলে তাল দিচ্ছেন, মনে মনে ভাবছেন, বেড়ে গান বেঁধেচে তো রাদামোহন!
দু কলি গেয়ে গান থামিয়ে রাধামোহন জিজ্ঞাসা করলেন,
-কী ভায়া, কেমন বুজচো ?!
-বেশ গান, বেশ গান! তা কে শোনালে ?
বামচোখ মটকে একটু ফিচেল হেসে রাধামোহন বললেন,
-লক্ষ্মী! বুজলে কিনা তার কাচেই শুনলুম!
-ও! লক্ষ্মীমণি! তা সে মাগী জানবাজার না কোতায় একটা থাকে শুনচিলুম!
প্রচ্ছন্ন গর্বের সঙ্গে রাধামোহন উত্তর দিলেন,
-ঠিকই শুনচো! জানবাজার! এককান বাড়িও তাকে কিনে দেইচি!
-বলো কী হে! রাঁঢ়ের জন্য বাড়ি অবদি কিনে ফেলেচো! তাহলে তো একদিন যেতে হচ্চে!
-চলো! চলো! বুজলে কিনা গঙ্গার জোয়ারের মতো লক্ষ্মীর ভরা যৈবন!
অপরাহ্নের দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বিপ্রহর, অদূরে চূণাপোড়া জমির উপর কয়েকটি গাঙ শালিখ নিজেদের ভাষায় কী যেন কথা কইছে, কয়েকজন বেহারা পালকি কাঁধে হনহন করে উত্তরে শ্যামবাজারের দিকে চলেছে, তাদের মুখে বিচিত্র ধ্বনি-হৈ-আরে হোঃ, হৈ আরে হোঃ, সামনে বাড়ি হৈ আরে, দোকান রে ভাই, বাবুর বাড়ি হৈ আরে!
নির্জন রাস্তা পড়ন্ত রৌদ্রের আলোয় সন্ধ্যা-যুবতির মতো হয়ে উঠেছে, আরও একটি দিন শেষ হয়ে আসছে কলিকাতায়, দূর আকাশে দু-একটি চিল পাখা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন নীল কাগজের গায়ে কালো কালির বিন্দু এঁকে রেখেছে কেউ। অপরাহ্নের দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বিপ্রহর, অদূরে চূণাপোড়া জমির উপর কয়েকটি গাঙ শালিখ নিজেদের ভাষায় কী যেন কথা কইছে, কয়েকজন বেহারা পালকি কাঁধে হনহন করে উত্তরে শ্যামবাজারের দিকে চলেছে, তাদের মুখে বিচিত্র ধ্বনি-হৈ-আরে হোঃ, হৈ আরে হোঃ, সামনে বাড়ি হৈ আরে, দোকান রে ভাই, বাবুর বাড়ি হৈ আরে! হয়তো কোনও বড় ঘরের বউ কি কোনও বাবুর বাঁধা রাঁঢ় চলেছে। বাবুদের বাড়িগুলি রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি ভুলতে যেন ঘুমিয়েই পড়েছে, মাঝে মাঝে ছায়াচ্ছন্ন বাগান থেকে ভেসে আসছে একটানা ঘুঘুপাখির ডাক। পথে একটি অল্পবয়সী ছেলে মাথায় বেতের ধামা নিয়ে সুর করে হাঁকছে, কলা চাই, চাঁপাকলা, কলা চাই গো, কলা!
কলাওয়ালার ডাক শুনে হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন বিশ্বনাথ, একটু কান করে শুনলেন ফিরিওয়ালার ডাক, বাহ, বেশ সুর আছে তো গলায়! রাধামোহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ভায়া শুনচো! গলায় কেমন সুর খেলচে! মনে হচ্চে গান্ধার!
-কী শুনব ?!
-ওই যে কলা,কলা বলে হাঁকচে! শুনতে পাচ্চো না ?!
রাধামোহনও মন দিয়ে দু-এক মুহূর্ত শুনলেন, তারপর সামান্য অবাক হয়ে বললেন,
-তাই তো! আজব ব্যাপার দেকচি, কলাওয়ালার গলায় গান্ধার!
বিশ্বনাথ গলা তুলে হেঁকে উঠলেন,
-দারোয়ান! এই দারোয়ান!
বাড়ির সদর দরজা থেকে বাবুর গলা শুনে দৌড়ে এল বিহারি দারোয়ান, মাথায় পাগড়ি, গালপাট্টা, পরনে হাঁটু অবধি সাদা ধুতি আর ফতুয়া, হাতে একখানি তেল চুকচুকে বাঁশের গিঁটে লাঠি। বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়িয়ে সেলাম করে বলল,
-জী হুজুর!
জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে আঙুল তুলে বিশ্বনাথ বললেন,
-শিগগির যা, ওই কলাওয়ালাকে ধরে আন দেকি!
বাবুর আদেশ শুনে কলাওয়ালাকে ধরতে তীরবেগে সদর দরজার দিকে দৌড়ে গেল দারোয়ান।
কলার ধামা বাইরে রেখে হাত জোড় করে ছেলেটি বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সাতাশ আঠাশ বছর হবে বয়স, একমাথা কোঁকড়া চুল, পরনে একখানি মলিন ফতুয়া আর খেটো ধুতি, এই শীতেও গায়ে কোনও গরম জামাকাপড় নাই। বড় বড় দুটি চোখ, সরল চাউনি, সেদিকে তাকালেই ধুলামাখা কোনও মেঠো পথের কথা মনে পড়ে যায়। একটু হেসে বিশ্বনাথ নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
-কলা বিককিরি করচিলি ?
ভয়ে ভয়ে ছেলেটি উত্তর দেয়,
-আঁইজ্ঞা!
-কী নাম তোর ? একেনে থাকিস কোতায় ?
-গোপাল। একেনে ঘর নাই।
পাশ থেকে রাধামোহন বলেন,
-কোতায় তোর ঘর ?
দু এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে গোপাল, তারপর রাধামোহনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আঁইজ্ঞা, জাজপুর।
-জাজপুর ?! সে তো ম্যালা দূরের পথ, পুরীর কাচে!
-আঁইজ্ঞা।
বিশ্বনাথ আরাম কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শালটা গায়ে জড়াতে জড়াতে শুধোন,
-তা বাবা গোপাল উড়ে, তুমি গান টান কিচু জানো নাকি ?
প্রশ্ন শুনে ফ্যলাফ্যাল করে বিশ্বনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে গোপাল। পাশবালিশটা কোলের উপর নিয়ে রাধামোহন বলে ওঠেন,
-কী রে ? পারিস গাইতে ?
কী বলবে বুঝতে না পেরে দুদিকে মাথা নাড়ে গোপাল।
বিশ্বনাথ পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন,
-গান কিচুই জানিস না ?
উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে গোপাল। বিশ্বনাথ কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হাতের ইশারায় তাঁকে চুপ করতে বলে রাধামোহন নরম গলায় বলেন,
-গোপাল! হেঁকে হেঁকে কলা বিককিরি করচিলি, ওইটে একবার কর দেকি একন!
রাধামোহনের কথা শুনে মুখ তুলে তাকায় গোপাল, এখানে আসার আগেই সে শুনেছিল শহরের বহু মানুষ নাকি বদ্ধ পাগল, আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিল, ঘরে ডেকে কলা ফিরির ডাক শুনতে চাইছে! খানিকটা নিরুপায় হয়েই দুবার সুর করে বলল, কলা চাই গো-কলা!
গলা শুনেই রাধামোহনের চোখ মুখ সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন,
-বাঃ বাঃ, এই তো, বেশ হইচে, তা এমনপারা কোনও গান তুই জানিসনি ?
গানের কথা শুনে একবার কী যেন ভাবে গোপাল, নিচু গলায় বলে,
-গাঁয়ে গান শুনচি!
-শুনচিস? তা সেইখান একবার গা দেকি!
দু এক মুহূর্ত পর খানিকটা ভয়ে ভয়ে গোপাল ঈষৎ আড়ষ্ঠ কিন্তু অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে ওঠে,
-মহাযোগী বেশঅ ধরি তিশুলোঅ হস্তে ধরিছঅ, পিন্ধিয়াছো চর্মবস্তোঅ প্রাণনাথঅ, কুহায়ে হারঅ চরিথঅ প্রাণনাথঅ!
গানের সঙ্গে মেঝেয় পা ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছে আর মুখ চোখেও বেশ নাটকীয় ভাব। ধুয়ার মতো ঘুরে ফিরে গাইছে, পিন্ধিয়াছো চর্মবস্তোঅ প্রাণনাথ!
রাধামোহন আর বিশ্বনাথ দুজনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে যুবকের দিকে চেয়ে আছেন। সুর যেন পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে বৈঠকখানায়, জানলা বেয়ে অপরাহ্নের ম্লান আলো এসে পড়েছে গোপালের মুখে, উদাস চোখদুটি নদী তীরের শূন্য বালুচর হয়ে উঠেছে, আশুতোষের বন্দনারত পার্বতীর মতোই এখন তাকে দেখাচ্ছে। দেখছেন আর মনে মনে একটি নূতন দৃশ্যের কথা ভাবছেন রাধামোহন, বিদ্যাসুন্দর পালায় এই উড়িষ্যার যুবক হীরা মালিনী সেজেছে, আহা! যেমন গানের গলা তেমন টানা টানা চোখ, কী সুন্দরই না মানাবে! গোপাল উড়ে হবে হীরা মালিনী! তামাম কলিকাতার বাবুরা দেখে চমকে উঠবে!
জন্ম পৌষ মাসে, রাঢ়বাংলার এক অখ্যাত মফস্সলে। মূলত গদ্য লেখেন। ২০১৬-তে প্রথম বই 'অক্ষরকলোনি' প্রকাশিত হয় নাটমন্দির থেকে। প্রথম উপন্যাসের নাম 'নয়নপথগামী'। কাব্যগ্রন্থ 'আমি শুধু পাঁচ বছর চেয়েছিলাম।' দুটিই প্রকাশিত হয় ২০১৮-তে। ২০২০-তে বেরোয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'বাসাংসি জীর্ণানি'। এই বইগুলি সবই ধানসিঁড়ি থেকে প্রকাশিত।
শ্রী সায়ন্তন ঠাকুর, শ্রী শুভ্রনীল ঘোষ-কে আমার হার্দিক ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর একটি লেখা আর উপযুক্ত চিত্রের জন্য। সায়ন্তবাবুর লেখা পড়ে পুরনো কোলকাতার একটি বিশেষ ধারণা পেলাম যা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দাবি রাখে। লেখক মহাশয় খুব সূক্ষ্মভাবে চলিত ভাষায় ‘সাধুভাব’-কে যেন প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়, সফলও হয়েছেন।
কথাপ্রসঙ্গে বলি, শ্রী বিশ্বনাথ মতিলাল মহাশয়-এর পৌত্রী শ্রীমতী করুণাময়ী মতিলাল-এর বিবাহ হয়েছিল তৎকালীন বারাসাতের অভিজাত ধনী শ্রী অন্নদাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। করুণাময়ী আমার দাদুর (শ্রী অমর নারায়ণ মুখোপাধ্যায়) ন’কাকিমা ছিলেন। আমার দাদু কোলকাতায় বৌবাজারে মোতিলাল-দের বাড়িতে থেকে St. Paul’s কলেজে পড়তেন।
সায়ন্তনবাবুর লেখার মধ্যে একটা spontaneous ecstasy আছে যা মুগ্ধ করে রেখে দেয়। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করবার কোনো উপায় আছে কি? ধন্যবাদ জানাই banglalive.todayকে।
সাগরনীল বন্দ্যোপাধ্যায়।
কোলকাতা—৭০০০৫৯
(৬২৯১৪৬৩১০৫)
২২.১২.২০২১