আরব সাগরের তীরে দাঁড়ালে লোনা হাওয়ায় মাছের গন্ধ ভেসে আসে ভার্সোভার জেলে পাড়া বরাবর। কেউ বসে বসে জাল বুনছে, কেউ বা নৌকা মেরামতির কাজ করছে খুব মন দিয়ে। সমুদ্রে এখন জেলে নৌকা একটিও নেই। সেই শ্রাবণ পূর্ণিমায় জল আর নৌকার দেবতাকে পুজো দিয়ে তারপর সাগর-যাত্রা। মানুষেরা এখন তাই নারালি পূর্ণিমার অপেক্ষায়। বাজারে এখন মাছের আকাল। সকাল সকাল মাছ-বাজারে ঢুকলে মনখারাপ হয়ে যেতে পারে আপনার। সে মনখারাপ হলেই বা কী! যাঁরা মাছ বেচছেন তাদের অমন মনখারাপ হতে বয়েই গেছে। তারা জানেন, মাছেদের জননকালে মাছ ধরতে নেই। এ তো সেই তাদের কবেকার অভ্যেস। তা বলে কি মাছ-শিকারিরা অতর্কিতে আক্রমণ শানায় না! সেসব অর্থ-পিশাচদের কথা মনেও আনতে চান না হর্ষাদিদি। হর্ষা রাজহংস টপকে (Harsha Rajhans Tapke)। জীবনের অভিজ্ঞতা ওর চোখে মুখে ছাপ ফেলে গেছে, সোনালি বালির উজ্জ্বলতায়। এখন এই সূর্য ডুবে আসা সন্ধ্যায় বেতাল মন্দিরের সামনে একমনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যারতি দেখছে ও। ওর মুখে কোন সে সূর্যালোক এসে থিতু হয়েছে কে জানে!
এই লোনা জলের সাগর, খাড়ি, মাছ-বাজার ওর ভারী ব্যক্তিগত। সকালবেলা পরিপাটি সাজে ও যখন মাছ বেচতে বসে, তখন মনে হয় কী আশ্চর্য দক্ষতা ওর! নিপুণ হাতে মাছ কাটছে। খদ্দের সামলাচ্ছে। বরফ দিয়ে মাছের প্যাকিং করছে কী অনায়াসে। করবে নাই বা কেন! সেই ইস্কুলবেলা থেকে মায়ের হাতে হাতে কাজ করছে ও, কাজ শিখছে। মাছবাজারের কাজ তো সহজ নয়! সবার আগে মাছ চিনতে হয়। সমুদ্দুরের মন বুঝতে হয়। সে নাহয় জেলে পরিবারে বেড়ে উঠতে উঠতে অনেকেই চিনে যায়, জেনে যায়। কিন্তু সেই চেনা-জানাটুকু নিয়ে এমন দক্ষতায় যারা মাছ বিক্রি করেন তারা কি তাঁদের কাজ নিয়ে এত শ্রদ্ধাশীল? তাঁরা কি এমন করে কোলি-রান্নার আশ্চর্য সব জাদু-মন্ত্রে বিশ্বাসী! যে জাদু-মন্ত্র শেখায় কখন কোন মাছ কেমন করে রাঁধতে হয়, কোন ঝোলে জেলে মানুষদের ইমিউনিটি বাড়ে। হর্ষা টপকে চাইলেই এসব ভুলে যেতে পারতেন। যে মানুষের হাতে অর্থ আছে, পুঁজিবাদ তাকে কিনে নিতে চায় বইকি। দেখেন না, সে কেমন করে অর্থহীন মানুষকে দিয়েও বিশ্ব-পণ্যের গুণমুগ্ধ হতে শেখায়! তাই আমার কেবলই মনে হয়েছে হর্ষা টপকেও চাইলেই বিবিধ পণ্যে ওর রান্নাঘর ভরিয়ে তুলতে পারতেন। ওর কোলিজীবনকে টেনেটুনে বের করে আনতে পারতেন কৌমের বাইরে। পৃথিবীতে সেই কবে থেকেই তো কৌমসমাজ কেবলই ভাঙছে!

এসব কথা হর্ষা টপকের সম্বন্ধে বললাম তার খানিক খানিক কারণ আছে। আমাদের দেশে বিশেষত, কাজের নানা শ্রেণিকরণ আছে। সেই বিভাজনে আছে অ-শ্রদ্ধা। যাঁরা নারী স্বাধীনতার কথা বলেন, তাঁদেরও অনেকেই কিন্তু কাজকে কেবল কাজ বলেই চিহ্নিত করেন না। বিশেষত যাঁর স্বামী এবং একমাত্র ছেলে ব্যাঙ্কের উচ্চ-পদস্থ কর্মচারী, সে কি আর সকাল সকাল সকাল পরিপাটি সজ্জায় মাছ-বেচতে বসেন খুব সহজে? আমরা যাকে বলি মাছওয়ালি, সেই মাছওয়ালি হওয়ার মধ্যে কী প্রবল গর্ব আছে সে কথা হর্ষাদিদিকে দেখলে বোঝা যায়। আমাদের ইস্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পেরনো মেয়েরা যদি একবার ওঁকে দেখতেন, তবে মুগ্ধ হতেন নিশ্চয়ই। বাবার বয়সকালে মেয়েরাই তো সেকাজ করবে! গুজরাটি জেলেদের কাজ বুঝিয়ে দেন তাই হর্ষা। সাতদিন-দশদিনের জন্য ওদের জেলে-নৌকাখানা সমুদ্দুরে চলে যায় মাছের খোঁজে। তাদের জন্য বরাদ্দ আটা, শুকনো খাবার মেপে-জুপে দিয়ে দেন দিদি। হিসেব বুঝিয়ে দেন টাকা-পয়সার। মাছ-ব্যবসার খুঁটিনাটি ওঁর মাথার মধ্যে ছবির মতো আঁকা আছে। এই সমস্তটাই ও করছে ঠাণ্ডা মাথায়, অনায়াস দক্ষতায়। ওর কোম্পানির ওই এখন চিফ, ওই এখন সি ই ও। বর এবং পুত্রের উপার্জিত অর্থে আরামের জীবন বেছে নিতে পারতই তো হর্ষা! সে জীবন ওকে তেমন করে টানেনি। বাপের ব্যবসায় বরং ওর অপার শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা। ওকে তাই বার বার বলতে শুনি, বাবা আর মাই আমার জীবনের সব। ওদের এমন করে গড়ে তোলা কাজটাকে কি নষ্ট হতে দেওয়া যায়!
সারা পৃথিবী জুড়ে কত কত মানুষেরা এখন ইণ্ডিজেনাস রান্না, ইণ্ডিজেনাস সংস্কৃতি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সেসব খুঁজতে কোনও বন-জঙ্গলে ঢাকা গাঁয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমেরিকা শহরে যেমন ‘ইণ্ডিয়ান’ শ্যেফদের আপনি খুঁজে পাবেন! তাঁরা কী অপূর্ব চেষ্টায় নেটিভ আমেরিকান রান্নার সুলুক সন্ধান দিচ্ছেন তাবড় বিশ্বের মানুষদের। হর্ষা টপকেও কিন্তু তেমনই আসলে। সেই কবে, গুজরাট বন্দর থেকে ভেসে আসা বড় বড় বেনে-নৌকা ঝড়ের হাত থেকে রেহাই পেতে আরব সাগরের খাড়িতে এসে দাঁড়াত। বিশ্রাম নিত দিন তিনেক দিন পাঁচেক। একখানা জেলেদের গাঁ তখন জীবনের বিবিধ শুশ্রূষা নিতে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। সেই থেকেই ভারসোভা কোলিওয়াড়ার এমন জমজামাট শুরু।
হর্ষার বাপ-ঠাকুর্দা এই মাটিতেই বেড়ে উঠেছেন। কোকাম দিয়ে পাপলেটের পাতলা ঝোল খেয়েছেন তারা রুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে। সে রুটির একেকটাই পূর্ণিমার চাঁদের মতো এই এত্ত বড়। হাতে টিপে টিপে এখনও অমন বড় বড় গোল গোল চালের রুটি বানান হর্ষাদিদি। পাশের পাতিলে মাছের ঝোল ফোটে। হাওয়ায় হাওয়ায় ঝোলের গন্ধ নাকে টেনে হর্ষা টের পায় নুন কম হয়েছে। ইন্দ্রিয়চেতনা দিয়ে এমন করে রান্না করতে শিখিয়েছে ওঁর মা। সেই কবে কোন সে ইস্কুলবেলায়। বাড়ির বড় মেয়ে। মায়ের হাতে হাতে ঘরের কাজ না করলে কে করবে! সেই কৈশোরবেলাতেই হর্ষা শিখেছিল কেমন করে চিংড়ি দিয়ে বেগুনের চচ্চড়ি রাঁধতে হয়, কেমন করে বাম্বুকে বোম্বিল রাঁধতে হয়। ছাদে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে মাছ শুকায় হর্ষাদিদি। শুখা বোম্বিল বানায় কোলি মশলার গন্ধ ছড়িয়ে। তিন চার রকম মাছ মিশিয়ে ও যে ইমিউনিটি বুস্টার ঝোল রাঁধে, তাকে কি আমরা ইণ্ডিজেনাস রান্না বলব না! বিশ্বগ্রামের কোন সে গলিপথ আলো করে আছেন হর্ষা রাজহংস টপকে। আমার আপনার অনেকেরই চেনা মাছওয়ালি। ওর হাতের অপূর্ব ঝোল খেতে দেশ-বিদেশের মানুষ ভিড় করেন ওর বাড়িতে। জেলেপাড়ার আশ্চর্ষ সব রান্না নিয়ে মানুষের পাতখানা ভরিয়ে দিতে জানেন হর্ষা।
সকালের আলোয় হর্ষাদিদি উলটানো ছুরি হাতে বাজার আলো করে মাছ বিক্রি করছেন– এই ছবিখানা কত কথাই যে বলছে! নারী স্বাধীনতার নামে জীবনে অনেক কিছুই জুটেছে আমাদের। শ্রম নির্বিশেষে খানিক খানিক শ্রদ্ধাও জুটে যাক না হয়! কে না জানে স্বেদ আর ক্লান্তির গন্ধে জীবনের শ্রমের গান গাঁথা হয়েছে সেই কবেই। সে গানে আম্বে মোহর চালের গন্ধ ভুরভুর করে। আর কেউ না জানুক হর্ষাদিদি জানে সে কথা।
ছবি সৌজন্য: অমৃতা ভট্টাচার্য
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।