হ্যারি বেলাফন্টের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা উজাড় করে দিচ্ছেন ভক্তরা। সাত দশক আগে গাওয়া ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল,’ ‘বানানা বোট সং’ আজও তাঁদের কাছে তরতাজা। কথা হচ্ছিল রঞ্জন প্রসাদের সঙ্গে। প্রবাদপ্রতিম মার্কিন গায়ককে বাঙালি শ্রোতার সঙ্গে পরিচিত করার কৃতিত্ব তিনিই দাবি করতে পারেন। ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ তাঁর কথার জাদুতে রূপান্তরিত হয় কালজয়ী গানে:
‘আহা পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়ে
যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়ে।’
কী ভাবে তৈরি হল এই গান? রঞ্জন বললেন, ‘সময়টা ১৯৬৯। আমি শিবপুর বি ই কলেজের ছাত্র। বাতাসে বারুদের গন্ধ। অথচ বঙ্গ সংস্কৃতি তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে বেলোয়ারি ঝাড় আর গোলাপেরই বাগে। তার সঙ্গে আমাদের ‘আঠারো বছর বয়স’ মিলছিল না। গিটার হাতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে তো এলাম কিন্তু কী গাইব? তখনই পেলাম পল রোবসন, হ্যারি বেলাফন্টে, পিট সিগারকে। এঁদের কাছে নিলাম বিশ্বমানবতার পাঠ। বিশেষ করে বেলাফন্টে, যাঁর একদিকে ছিলেন পল রোবসন, অন্য দিকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মানবাধিকার আন্দোলনের দুই পুরোধা।’
এ রাজ্যে ইংরেজি গানের শ্রোতা সব সময়ই কম আর রঞ্জন মঞ্চে উঠতেই রব উঠত, ‘বাংলা চাই, বাংলা চাই। রঞ্জন তাই ঠিক করলেন, কাজটা কঠিন হলেও এই সব গান বাংলায় ভাঙতে হবে। বাংলার মানুষও জানাল, তারা তৈরি। ১৯৭৮-এ এইচএমভি ব্যানারে বেরোল রঞ্জনের ইপি রেকর্ড, ‘ঘরে ফেরার সুর’, যার চার নম্বর গান ‘আহা পথের প্রান্তে’ মাতিয়ে দিল আমজনতাকে। রঞ্জনের কথায়, ‘খুব মন দিয়ে করেছিলাম কাজটা। তাই অনেকেই ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ তরজমা করলেও, শুধু আমারটাই টিকে গেল।’ শুধু টিকে গেল না, এই গান এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে কলেজ ফেস্টে, ক্যান্টিনে, আড্ডায়, পিকনিকে। ডবল ভার্সনের এই গানকে অনায়াসে ইয়ুথ অ্যান্থেমের তকমা দেওয়া যায়।
মধ্য-নব্বই থেকে টানা দু’দশক বাংলা গানের জগৎ শাসন করেছে বাংলা ব্যান্ড। তাদের অনেকের মধ্যেই ইংরেজি গানের প্রভাব ছিল ব্যাপক। এই নিয়েই প্রশ্ন ছিল চন্দ্রবিন্দুর গায়ক-সুরকার উপল সেনগুপ্তর কাছে।
উপল বললেন, ‘১৯৮৩ সালে বাড়িতে প্রথম ক্যাসেট আসে। সেই সময় ইংরেজি গানের ক্যাসেটের দাম বেশি থাকায়, বন্ধুরা ভাগাভাগি করে শুনতাম। পাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম ইংরেজি গান শুনি। সেখানেই চেনাশোনা হয় বেলাফন্টে, জিম রিভস, সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেলের সঙ্গে। বেলাফন্টের মিউজিক ভীষণ পছন্দ হওয়ায় তাঁকে আরও বেশি করে শুনতে থাকি।’
উপলের সৌভাগ্য, ২০০৩ সালে নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্সে (এনএবিসি) অংশ নেওয়ার ফাঁকে তিনি এক প্রবাসী বাঙ্গালি পরিবারের সঙ্গে সান হোসে থেকে লস এঞ্জেলেস গিয়ে বেলাফন্টের লাইভ কনসার্ট দেখে আসেন।
কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? উপল বললেন, ‘আমরা সাধারণত দেখি, কেউ ভাল গায় কিন্ত সুবক্তা নয়। আবার কেউ ভাল গায়, বলেও, অথচ ভাল শোম্যান নয়। আবার কেউ ভাল শোম্যান, রাজনৈতিক চেতনাও আছে কিন্তু অ্যাকটিভিস্ট নয়। বেলাফন্টে কিন্তু সব কিছুর এক দুর্দান্ত মিশেল। এক কথায়, মাস্টার অফ অল ট্রেডস।’
বেলাফন্টের একটি গুণ উপলকে ভীষণ টানে। সেটা হল বার বার তাঁর গানের মিউজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট বদলানো। তাই ১৯৫৬ সালের ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’এর রেকর্ড আর ২০০৩ সালে একই গানের লাইভ শোর অ্যারেঞ্জমেন্ট অনেকটাই আলাদা। উপলের মতে এই নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাঙাভাঙি বেলাফন্টের গানের উপস্থাপনাকে আরও আধুনিক করেছে।
আফ্রিকান আর ক্যালিপসো গানের পলি-রিদমিক কাঠামোও উপলের খুব পছন্দের। তাঁর কথায়, ‘ধরুন, বাংলা গানে যদি তিনটি তবলা থাকে, সেগুলি একই ছন্দে বাজে। পলি-রিদমিক কাঠামোয় কিন্তু তিনটি কঙ্গা একই ভাবে না বাজলেও, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে।’
বাংলা ব্যান্ডে বেলাফন্টের প্রভাবের ক্ষেত্রে উপল বলেন, ‘যেহেতু আমি বেলাফন্টেকে ভালবাসি, তাই চেয়েছি আমাদের ব্যান্ডের কিছু গানে তাঁর প্রভাব থাকুক। কোথাও গানের একটা অংশ নিয়েছি, কোথাও নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি আবার কোথাও শুধুই একটা ইন্টারলিউড। উদাহরণ হিসাবে রাখব ‘জুজু’, ‘বাথরুম’ আর ‘দুধ না খেলে’কে।
১৯৮৫ সালে আফ্রিকার সাহায্যে ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড’ কনসার্ট এবং অ্যালবামে বেলাফন্টের বিরাট অবদান প্রসঙ্গে উপল বলেন, ‘এই ভাবেই বেলাফন্টে আর আমরা মিলেমিশে এক হয়ে যাই।’
বাংলা আধুনিক গানেও বেলাফন্টের প্রভাব দেখা যায়। উদাহরণ, ‘মাটিল্ডা’ অবলম্বনে বাসবী নন্দীর গাওয়া ‘সঙ্গীতা, না ডেকো না’ আর ‘আইলান্ড ইন দ্য সান’-এর ছায়ায় মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের ‘ওই যে সবুজ বনবীথিকা।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শুধু সেরা ফাস্ট বোলারই দেয়নি, সৃষ্টি করেছে ইংরেজি গানের নানা ধারাও, যেমন ক্যালিপসো, মেন্টো, স্কা এবং রেগে। শেষ ধারার সেরা প্রতিনিধি বব মার্লে। বাংলা ব্যান্ডে রেগের উদাহরণ হিসাবে উপল তুলে ধরলেন ক্যাকটাসের ‘তুমিও বোঝো, আমিও বুঝি, বুঝেও বুঝি না’ গানটিকে। পুরনো দিনের ক্রিকেট বোদ্ধারা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন ত্রিনিদাদের ক্যালিপসো গায়ক লর্ড রিলেটরের ১৯৭১ সালের সেই অমর গান, ‘উই কুডন্ট আউট গাভাসকর অ্যাট অল।’
পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি গান শোনার অভ্যাস তৈরি করায় আকাশবাণী কলকাতার অবদান ভোলার নয়। এই কেন্দ্রের কলকাতা খ প্রচারতরঙ্গে দুপুরে ও রাতে শোনা যেত নানা ধারার গান। এই সকল গানের কাণ্ডারি ছিলেন বুলবুল সরকার। রেকর্ড কেনা থেকে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, স্ক্রিপ্টের মান পরীক্ষা করা থেকে উপস্থাপকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকত তাঁর যত্নের ছাপ। তাঁর টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন রত্না সেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন বেলাফন্টের ওয়ার্ক সং বা শ্রমগীতির কথা। এই সব গান রেডিয়োয় বাজানো হত মে দিবসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বানানা বোট সং, কোকোনাট উয়োমান, কটন ফিল্ডস।’ এই বিষয়ে পরে আমেরিকান সেন্টারেও একটি অনুষ্ঠান করেন তিনি, যার শীর্ষনাম ছিল ‘হাউ ওয়ার্ক সঙস ওয়ার্ক।’

রত্নার কথায়, ‘বেলাফন্টের যে কোনও গানেই এমন স্বকীয়তা ছিল যে তা অন্যের পক্ষে অনুসরণ করা কঠিন।’ তিনি মনে করালেন হলার্স গানের কথা, যেখানে তুলোর খেতে কর্মরত শ্রমিকরা বা কলার কাঁদি পাড়ার দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে হাঁক পাড়তেন। এই ধরনের গানের উদাহরণ ‘বানানা বোট সং, কটন ফিল্ডস।’ আবার ব্যালাডেও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। এই ধারার গানের মধ্যে রয়েছে জন হেনরি, মাটিল্ডা, স্কার্লেট রিবনস এবং কাম ব্যাক লাইজা। আবার কিছুটা তির্যক আঙ্গিকে গাওয়া ‘ম্যান স্মার্ট, উয়োম্যান স্মার্টার’ও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়।
রত্না বললেন, ‘সাতের দশকে, বাঙালি শ্রোতার কাছে পাশ্চাত্যসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করতে এক অভিনব উদ্যোগ নেন বুলবুলদি। মাসে একবার করে প্রচারিত হত বাংলা অনুষ্ঠান ‘পশ্চিমের জানালা।’ এটির স্ক্রিপ্ট এবং উপস্থাপনা, দুইয়েরই দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত লাহা। অনুষ্ঠানে সঙ্গীতের এক একটি ধারা উপস্থাপিত হত, কখনও জ্যাজ, কখনও রক, কখনও পপ। এত জনপ্রিয় হয় এই অনুষ্ঠান যে শ্রোতাদের চিঠি বাছাই করা মুশকিল হত।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যালিপসো কিং বেলাফন্টের গান শুনছেন মিডিয়াকর্মী ও সম্পাদক ইন্দিরা কাঞ্জিলাল। স্কুলে থাকতে এক দিদিমণির কাছ থেকে উপহার পান বেলাফন্টের কার্নেগি হল লাইভ কনসার্টের ক্যাসেট। মুগ্ধতার সেই শুরু। ফোনালাপে ইন্দিরা বললেন, ‘সারাদিন বেলাফন্টে শুনতাম। এতটাই যে বাড়ির লোক অতিষ্ঠ হয়ে যেত। এর পরেও বাবার কাছ থেকে উপহার পেলাম বেলাফন্টেরই অ্যালবাম।’
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়ে গেল সেই আনন্দ আবেশ। প্রেসিডেন্সির প্রমোদদা আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাখালদার ক্যান্টিনে বসত জমাটি গানের আসর। ইন্দিরার সহপাঠী নন্দিনী বসু হতেন মূল গায়েন। হারমোনিকায় সঙ্গত করতেন আর এক সহপাঠী সন্দীপ চক্রবর্তী, যাঁর অভিনেতা-লেখক হিসাবেই এখন বেশি পরিচিতি। ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল-আহা পথের প্রান্তে’র পাশাপাশি তাঁরা গাইতেন আর এক ডবল ভার্সন হিট মালাইকা-বলাকা। এই গানেও, কিছুটা হলেও, রয়েছে বেলাফন্টে-রঞ্জন প্রসাদ যোগ। মূল গান ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত গায়িকা মিরিয়াম মাকেবার, যিনি ১৯৬৫ সালে বেলাফন্টের সঙ্গে যৌথ অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি পান। আর বাংলা অনুবাদ, অবশ্যই রঞ্জনের।

পেশাগত জীবন আর সাংসারিক জীবন প্রায় একই সঙ্গে শুরু ইন্দিরার। খবরের কাগজ মানেই নাইট শিফট, তাই স্কুল-ফেরত দুই শিশুকন্যার সঙ্গে তাঁর খোশগল্প হত দুপুরে। গল্প শেষ হলে ঘুমপাড়ানি গান। কার আবার? সেই বেলাফন্টে। কখনও ‘মাটিল্ডা’, কখনও বা ‘কটন ফিল্ডস।’
ইন্দিরার দুই কন্যা এখন বড় হয়েছে। একজনের চাকরি কলকাতার বাইরে, অন্য জন দিল্লিতে এমএ ক্লাসের ছাত্রী। তাও কোয়ালিটি টাইম কাটাতে তিনজন যখন জ্যাম-ইন করেন, তখন সেখানেও বেলাফন্টে হাজির।
অলংকরণ: উপল সেনগুপ্ত।
দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।
This is an excellent write up , Abhijit ! A wonderful tribute to Calypso King Harry Belafonte and his tremendous influence on the singers and bangla bands . They’ve made the legend, their own , by incorporating the unmistakable Calypso rhythm into their songs and transcreating them for the enjoyment of bangla audiences ! Thank u again for a wonderful piece !
My pleasure.