“A different language is a different vision of life”- অর্থাৎ একটি ভিন্ন ভাষা, জীবনের একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। ফেদেরিকো ফেলিনির এই আপ্তবাক্যটি খুবই প্রামাণ্য এক বাঙালি ভাষাবিদের ক্ষেত্রে। তিনি হরিনাথ দে। যিনি তাঁর চৌত্রিশ বছরের স্বল্প জীবনকালের মধ্যে আয়ত্ব করেছিলেন চৌত্রিশটি ভাষা। যার মধ্যে কুড়িটি ভারতীয় ভাষা এবং চোদ্দটি বিদেশি।এই এতগুলো ভাষা বহতা নদীর মতো যোগ হয়েছে হরিনাথ দে’র জীবন প্রবাহে। তাঁর বোধে অনেক রত্নরাজি উপহার দিয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছেন সেসব সম্পদের জীবন্ত ভাণ্ডারি। আর হরিনাথ দে’র জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় সেই জমানো রত্নরাজির ঝাঁকিদর্শনে আমরা তাঁর বোধির বিচ্ছুরণে আলোকিত হয়েছি। বিশ্বের দরবারে তাঁর ভাষা বৈভবের বিভায় বাঙালি হিসেবে গর্বিত হয়েছি।
সেরকম কয়েকটা ঘটনার কথা জেনে নেওয়া যাক। সময়টা উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। হরিনাথ দে ইওরোপ ভ্রমণে গেছেন ইতালির ভাটিকান সিটিতে। ইতালি হল স্বয়ং পোপের দেশ। স্থাপত্য, ইতিহাস, শিল্পের ছড়াছড়ি। সেখানেই হরিনাথ কীসব আলোচনা করবেন পোপ দশম পিউস-এর সঙ্গে। কিন্তু পোপ তো ইংরেজি বলবেন না। তাই পোপের সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট লাতিন ভাষায় তাঁকে অভিবাদন জানালেন হরিনাথ। রীতিমতো হতবাক পোপ। একটু হাল্কাভাবেই বললেন, এবার ইতালিয় ভাষাটা শিখে নিলেই হয়। এবার পোপকে আরও অবাক করে দিয়ে চোস্ত ইতিলিয়ান ভাষাতেই কথা বলা আরম্ভ করলেন হরিনাথ দে।
আরও আছে। হরিনাথের লাতিন ভাষায় দক্ষতা চমকে দিয়েছিল লর্ড কার্জনকে। হরিনাথ আরবি ও পার্সিতে অনুবাদ করে কার্জন সাহেবকে একটি বই উপহার দেন। বইটির উৎসর্গপত্রটি ছিল লাতিনে লেখা। এই বই দেখে বিস্মিত লর্ড কার্জন ঢাকা থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। হরিনাথ তখন ঢাকা কলেজের অধ্যাপক।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের ভূমিপুত্র রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বিখ্যাত রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ কোরবাভস্কিও কলকাতায় এসে হরিনাথের সঙ্গে আলোচনায় মু্গ্ধ হয়ে হরিনাথকে সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাশিয়ান ও সংস্কৃত ভাষায় তাঁর গভীর বুৎপত্তি এবং বৌদ্ধ দর্শনে পাণ্ডিত্য কোরবাভস্কিকে বিস্মিত করেছিল।
জাপানি পণ্ডিত ওটানি কোজুই হরিনাথের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অনেক দুষ্প্রাপ্য পুঁথি উপহার দেন। জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ রিচার্ড ফন পিশেল হরিনাথের পাণ্ডিত্যের কথা শুনে কলকাতায় এক বক্তৃতা উপলক্ষে এসে হরিনাথের সঙ্গে দেখা করিছেলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সময়ে বিদেশিদের কাছে বাঙালির পরিচয় ছিল নেটিভ কিংবা কালা আদমি; যে সময়ে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালির আয়ত্তে ছিল ইংরেজি ভাষা; সেই সময়ে বিদেশিদের কাছে ভাষাপুরুষ হরিনাথ দে’র খ্যাতির এইসব চালচিত্র আঁকা হয়ে গিয়েছে, যা সত্যিই বিস্ময়ের। বিদেশি ভাষা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা নিয়েও পড়াশুনো করেছিলেন হরিনাথ দে। শিখেছিলেন তামিল ভাষা। বাংলা ভাষাকেও তিনি সমৃদ্ধ করেছেন নানাভাবে।

হরিনাথ দে’র এই বিস্ময় প্রতিভার আভাস মিলেছিল একেবারে ছোটবেলাতেই। ছোট্ট হরিনাথরা তখন থাকতেন রাইপুরে। রাইপুর সেন্ট্রালের ব্রিটিশ শাসনকালের পদস্থ অফিসার ভোলানাথ দে, ছেলে হরিনাথের অক্ষর পরিচয়ের জন্য বই এনে দিলেন। কিন্তু কে পড়াবে বই? মা এলোকেশী দেবী ব্যস্ত হেঁসেলে। তখন তো প্লাস্টিক কিংবা কাঠের বর্ণমালা দিয়ে অক্ষর পরিচয়ের চল ছিল না। বড়দেরই দায়িত্ব ছিল ছোটদের শেলেট-খড়িতে বুলিয়ে বর্ণমালার টান অভ্যেস করানো। কিন্তু মায়ের তখন সেই সময় কোথায়? এদিকে হরিনাথের অক্ষর পরিচয়ের জন্য আর তর সয় না। উপায়ান্তর না দেখে রান্নাঘরে থাকা তরকারির খোসা দিয়েই ছোট্ট হরিনাথকে বর্ণমালা চেনানো শুরু করলেন মা। একবেলার মধ্যেই হরিনাথ বাংলা অক্ষর পরিচয় আয়ত্ব করে ফেলে সারা ঘরে কাঠকয়লা দিয়ে তা লিখে ফেলল। অবাক করে দিল বাবাকে। হরিনাথ ছোটবেলাতেই স্থানীয় চার্চের ফাদারের কাছে বাইবেল পড়তেন। কয়েকদিন পরে সেই ফাদার দেখেন, গোটা বাইবেল হিন্দিতে অনুবাদ করে ফেলেছে হরিনাথ। তবে অঙ্ক ছিল তাঁর কাছে আতঙ্কের বিষয়। সেজন্য স্কুলের পরীক্ষাতে বকুনি খেতে হত বিস্তর, অঙ্কের মাস্টারমশাইদের কাছে।
কিন্তু ভাষাকে আয়ত্ত্ব করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল হরিনাথের। মিডল স্কুল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে বৃত্তি নিয়ে পাশ করার পরে কলকাতায় এসে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হলেন হরিনাথ। এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগে চোখে আঘাত পাওয়ায় পড়াশুনো বন্ধ রাখতে হল কিছুদিন। হরিনাথ ছিলেন শ্রুতিধর। বন্ধুরা এসে বাড়িতে যে পরীক্ষার পড়া শুনিয়ে যেত, তাতেই বৃত্তি নিয়ে এন্ট্রান্স উতরে গেলেন তিনি। স্কুলের পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন রাধানাথ। সেখানেও সহপাঠীদের ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর কৃতিত্ব।
প্রেসিডেন্সিতে ভাষাতত্ত্বের কাজ চলছে। অধ্যাপক এফ জে রো একটি জটিল বিষয় নিয়ে পাঠদান করছেন। একটি জটিল প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না। হরিনাথ ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর চক দিয়ে অনায়াসে লিখে ফেললেন সমাধান। অধ্যাপক আনন্দে বুকে টেনে নিলেন হরিনাথকে। তারপর থেকে তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রের নাম রাখলেন রোমের বিখ্যাত দার্শনিক ও গদ্যকারের নামে — সিসেরো।
ভাষার প্রতি হরিনাথের আবেগ ছিল এক্বেবারে সহজাত এবং অপ্রতিরোধ্য। একবার পালি নিয়ে এম এ পরীক্ষা দিতে বসেছেন হরিনাথ। প্রশ্নপত্রে পালির একটা জটিল পাঠ ‘ধনিয়সূত্ত’র কয়েকটি পংক্তি দেখে জেগে উঠল তাঁর ক্রিয়েটিভ ইন্সটিংক্ট। তাই ওই পরীক্ষার হলেই বসে পংক্তিগুলির ইংরেজি অনুবাদ করে ফেললেন। অধ্যাপনাকালেও তিনি সংস্কৃতের পরীক্ষার্থী হয়েছিলেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেছিলেন।
প্রেসিডেন্সিতে ভাষাতত্ত্বের কাজ চলছে। অধ্যাপক এফ জে রো একটি জটিল বিষয় নিয়ে পাঠদান করছেন। একটি জটিল প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না। হরিনাথ ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর চক দিয়ে অনায়াসে লিখে ফেললেন সমাধান। অধ্যাপক আনন্দে বুকে টেনে নিলেন হরিনাথকে। তারপর থেকে তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রের নাম রাখলেন রোমের বিখ্যাত দার্শনিক ও গদ্যকারের নামে — সিসেরো।
প্রতিভার জোরেই হরিনাথ দে প্রেসিডেন্সির ছাত্র হিসেবে একই বছরে লাতিন ও ইংরেজিতে–দুই বিষয়েই প্রথম শ্রেণিতে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি পান। ওই বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাতিন ভাষায়ও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সরকারি বৃত্তি পান। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন ভাষায় অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে একাধিক ডিগ্রি পান হরিনাথ দে। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রিক, লাতিন, হিব্রু, প্যরিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি, জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ, আধুনিক ভাষাশিক্ষাদান – হরিনাথ দের ভাষার ভাণ্ডার ক্রমশ পূর্ণ হতে থাকে। ১৯০০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন। আঠেরোটি ভাষায় এমএ ডিগ্রি পেয়েছিলেন তিনি। শুধু চিনা ভাষাতেই দাঁত ফোটাতে পারলাম না। এইটুকু আক্ষেপ ছিল তাঁর। অবশ্য শুধু ডিগ্রি পাওয়াই নয়, প্রতিটি ভাষায় তাঁর ছিল গভীর দখল। ভাষায় তাঁর বৈদগ্ধের সোনার ফসল ফলেছে কর্মজীবনে। যদিও সেই কর্মজীবন দশ-বারো বছরের বেশি ছিল না।
কর্মজীবনের শুরুতেই হরিনাথ দে-এর সম্পাদনায় ম্যাকুলাস এসে অন মিলটন –এর অভিনব সংস্করণ প্রকাশিত হল। এরপর পর্যটক ইবন বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘রিহলা’, জালালুদ্দিন আবু জাফর মুহাম্মদ-এর ‘আল ফকিরি’ গ্রন্থ দুটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ইংলিশ-পার্সিয়ান লেক্সিকন সংকলন, ফরাসি লেখক ঝাঁলর স্মৃতিকথা সম্পাদনা, মূলসহ ঋকবেদের অনেকগুলি শ্লোকের ইংরেজি ভাষান্তর, বৌদ্ধ ধর্মাশ্রয়ী লঙ্কাবকতার সূত্র এবং নির্বাণব্যাখ্যাশাস্ত্রম –এর সম্পাদন, কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এর ছন্দবদ্ধ ইংরেজি ভাষান্তর, ফার্সি ভাষায় লেখা ঢাকার ইতিহাস তারিখ-ই-নুসরাত জঙ্গি, বাদশাহ আলম-এর জীবনীগ্রন্থ শাহ আলমনামার সম্পাদনা ইত্যাদি বিভিন্ন গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর বিস্তারিত কাজের তালিকা দেখে অবাক হতে হয়। এক জীবনে একজন মানুষ কীভাবে এত গভীর জ্ঞান-তপস্যার কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।
হরিনাথ দে-এর শিক্ষাজীবনে পাওয়া পুরস্কার, পদক, বৃত্তিলাভের তালিকা বেশ দীর্ঘ। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যাতেই নিজের জীবনকে আটকে রাখেননি। শিক্ষাদান বিষয়েও তঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমস্ত ভাষা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রচয়িতা এবং পরীক্ষক ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয়, ব্রিটিশ সরকার যাঁকে শিক্ষাবিভাগের উচ্চপদে এডুকেশন অফিসারের পদে নিয়োগ দেয়। ব্রিটিশ আমলে তিনিই ছিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরি যা তখন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি নামে পরিচিত ছিল, তার দ্বিতীয় ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান। প্রথম লাইব্রেরিয়ান ছিলেন জন ম্যাকফরলেন।জ্ঞানের ভাণ্ডারের জন্যই তাঁকে প্রথম ভারতীয লাইব্রেরিয়ানের সম্মানজনক পদের মর্যাদা দিয়েছিল ব্রিটিশরা।
ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রিক, লাতিন, হিব্রু, প্যরিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি, জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ, আধুনিক ভাষাশিক্ষাদান – হরিনাথ দের ভাষার ভাণ্ডার ক্রমশ পূর্ণ হতে থাকে। ১৯০০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন। আঠেরোটি ভাষায় এমএ ডিগ্রি পেয়েছিলেন তিনি।
পুঁথি সংগ্রহের অদ্ভুত নেশা ছিল হরিনাথ দে-এর। অভিজ্ঞান শকুন্তলম-এর প্রাচীনতম পুঁথিটি সংগ্রহের জন্য সুদূর বাংলাদেশে ছুটে গিয়ে উদ্ধার করেছেন। পার্সি ও তুর্কি ভাষায় লেখা বৈরাম খানের পাণ্ডুলিপি থেকে ওয়ারেন হেস্টিংসের নিজের হাতে চিঠি, দারা শিকোর করা বেদের পার্সি অনুবাদ– ছিল হরিনাথের সংগ্রহে। তিনি শুধু নিজের জন্যই দুষ্প্রাপ্য বই/পুঁথি সংগ্রহ করতেন না। সেসব অন্যের গবেষণার কাজেও লাগত। একবার ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল সম্পর্কে গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করছিলেন। একটি পার্সি পুঁথির কয়েকটি শব্দের অর্থ কিছুতেই উদ্ধার করতে পারছিলেন না স্যর যদুনাথ সরকার। শেষ পর্যন্ত হরিনাথ দে-এর শরণাপন্ন হতে তিনি সেই শব্দের অর্থ বলে দিলেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশের ইতিহাস লিখছিলেন, সেই সময় হরিনাথ তাঁর সংগ্রহে থাকা হরিবর্মদেবের তাম্রলেখ দিয়ে এলেন রাখালদাসকে। এই বিষয়ে তিনি কোনও ভেদ করতেন না। প্রেসিডেন্সিতে পড়ানোর সময় সহকর্মী হেনরি অর্নেস্ট স্টেপলটনকেও নিজের সংগ্রহে থাকা একটা দুষ্প্রাপ্য বই দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এমনই উদারমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন হরিনাথ দে। জীবনভর শুধু সঞ্চয়ই করেননি বিলিয়েও দিয়েছেন অনেক। মৃত্যুর সময় হরিনাথ দে-এর সংগ্রহে ছিল হাজার সাতেক পুঁথি ও বই। অষ্টাশি খণ্ডে হরিনাথ ডিটেলস কালেকশন রয়েছে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। কিন্তু হরিনাথ দের এই সংগ্রহশালা সম্পূ্র্ণভাবে রক্ষা করা যায়নি।
এটাই বোধ হয় সরকারি অবহেলার একটা নজির। বাঙালি যে আত্মবিস্মৃত জাতি। তা না হলে ভাষা দিবসটি যখন মহা ধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হয়, সেখানে এই বহু ভাষাবিদ হরিনাথ দে-এর নাম স্মরণ করা হয় না কেন? যে মানুষটি সারা জীবন তাঁর জীবনকোষে নানান ভাষাকে সঞ্চিত করে রাখলেন, ভাষা দিবসে সেই মানুষটিকে আমরা যোগ্য সম্মান জানাতে পারি না? হরিনাথ দে-এর নামে একটি স্মারকও এই শহরে চোখে পড়ে না। শুধু উত্তর কলকাতার গড়পার অঞ্চলে তাঁর নামে একটি রাস্তা আছে মাত্র।
হরিনাথ দে ছিলেন এক চলমান গ্রন্থাগার। ক্ষণজন্মা এই বিস্ময় প্রতিভা মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে টাইফয়েডে মারা যান। শ্মশানের চিতায় হরিনাথ দে-এর নশ্বর শরীর পুড়ে যাওয়া দেখে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মনে হয়েছিল, একটি বিশাল গ্রন্থশালা যেন লেলিহান আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। এই ধরনের ভাবনার নেপথ্যে অবশ্য অন্য ইতিহাস আছে। প্রাচীন বিশ্বের সমৃদ্ধতম বিশাল গ্রন্থাগার ছিল আলেকজান্দ্রিয়ায়। অত্যাচারী চেঙ্গিস খাঁয়ের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল বাগদাদের সেকেন্দ্রিয়ার সেই গ্রন্থাগার। ইতিহাসের মর্মান্তিক সেই অনুসঙ্গই উঠে এসেছিল হরিনাথ দে-এর অন্তিম সংস্কারের সময়।তাই সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
যাচ্ছে পুড়ে দেশের গর্ব,/শ্মশান শুধুই হচ্ছে আলা।/যাচ্ছে পুড়ে নতুন করে সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থশালা।
তথ্যসূত্র:
ভাষাপথিক হরিনাথ দে- সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।