বাঙালি বাড়িতে শিউলি ফোটা ভোরে ঘরের মেয়ে গৌরীর আগমনের এখনও কিছুটা দেরি আছে। আর সেই অপেক্ষার মধ্যেই বিদায় নিলেন বাংলা সংস্কৃতি জগতের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব গৌরী ঘোষ। পরিণত বয়স আর বয়সজনিত অসুস্থতা। তার সঙ্গে শরীরে বাসা বেঁধেছিল স্নায়ুর সমস্যা, জীবনের প্রান্তসীমায় যেটা খুবই স্বাভাবিক। সব মানি, মেনে নিতে বাধ্য আমরা। তবুও স্বজন গৌরীদিকে হারানোর ব্যথা মনকে অবশ করে। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অন্যতম রত্ন ছিলেন তিনি। ঘোষিকা, বাচিকশিল্পী এবং হাতে গোনা কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রের সার্থক অভিনেত্রীও বটে।

তিনি আমার গৌরীদি, আমার বাবা-মায়েরও গৌরীদি। আসলে তিনি এক সর্বজনীন গৌরীদি। মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে, তারাশঙ্কর রচিত এবং দেবকীকুমার বসু পরিচালত ‘কবি’-খ্যাত অতীত দিনের জনপ্রিয় নায়ক-গায়ক রবীন মজুমদারের ছোটবোন গৌরী ঘোষ, তাঁর স্বামী তথা প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী পার্থ ঘোষের সঙ্গে রেকর্ড করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’। শুরু হল জয়যাত্রা। ক্রমে বাচিকশিল্পের এই জুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল বাংলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে। গৌরী ঘোষের কণ্ঠের নান্দনিকতা মুগ্ধ করল শ্রোতাদের। সহজ উচ্চারণ, স্বাভাবিক উপস্থাপন আর অসাধারণ বাচনভঙ্গিতে প্রাণ পেত কবিতা এবং শ্রুতি অভিনয়গুলি। তাঁর অনায়াস নিবেদনের মধ্যে কোনওরকম আরোপিত শৈলী ছিল না। 

Gouri Ghosh and Partho Ghosh
একান্তে দুজনে: পার্থ ও গৌরী ঘোষ

রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ শরৎবাবুর কাছে আর্তি জানাচ্ছেন তাঁকে নিয়ে গল্প লেখার জন্য। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা বিকাশ রায় নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’-য় তিনি সূত্রধরের ভূমিকা নেন। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্রের মতো মহীরুহদের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন। মঞ্চের বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সঙ্গে মিষ্টি হাসি আর মিষ্টি ব্যবহার। রবীন্দ্রনাথের গীতরচনার শতবর্ষে গ্রামোফোন কোম্পানির সশ্রদ্ধ নিবেদন ‘ভানু সিংহের পদাবলী’-তেও তিনি অন্যন্যা। রবীন্দ্রকবিতার সঙ্গে পাঠ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত কবিতাও। পাঠ করেছেন শুভ দাশগুপ্তর মতো আধুনিক কবিদের কবিতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য অ্যালবামগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দেবব্রত বিশ্বাসের গান আর তাঁর সঙ্গে ঘরোয়া নিবিড় আড্ডা’, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও নাটক চোরাই ধন’, ‘এই তো জীবন’, ‘নেতাজীর পথ মুক্তির পথ’, ‘স্বর্গ থেকে নীল পাখি’, ‘কাঁচা রোদ’, ‘সুর বাজে মনের মাঝে’ ইত্যাদি।

এবার একটু আসা যাক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রসদনের একাধিক অনুষ্ঠান, দূরদর্শনের নানা রেকর্ডিং, পার্থদার কাছে কবিতা শেখার কারণে তাঁর সান্নিধ্যে আসা। আকাশবাণীর ডিউটি রুমের পাশের ঘরে পার্থদা যখন কবিতা শেখানোর মাঝখানে উঠে স্টুডিওতে গিয়ে ঘোষকের কাজ করতেন, সেই সব সময় গৌরীদি এসে জানতে চাইতেন, কোন কবিতাটা শিখছি। সেই অল্প সময়ের মধ্যে কবিতার উচ্চারণের বিষয়ে দু’ একটি মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও দিতেন। 

Gouri Ghosh
সহজ উচ্চারণ, স্বাভাবিক উপস্থাপন আর অসাধারণ বাচনভঙ্গি ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য

আমার মায়ের সঙ্গে ছিল ওঁর গভীর সখ্য। আমার কাছে জানতে চাইতেন বাবা-মায়ের কথা। দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করতে গেলে অবশ্য মায়ের সঙ্গে ওঁর দেখা হত। ওঁদের নির্দেশনায় দুবার ‘উপমা’-র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। পার্থদা-গৌরীদির দমদম ক্যানটনমেন্ট ধোপাপুকুরের বাড়িতে সপ্তাহে একদিন গিয়ে গল্প করে আসতাম। সেইখানেই পরিচয় আর এক বাচিক শিল্পী অমিতাভ বাগচির সঙ্গে। তিনি অবশ্য অনেক দিন আগেই প্রয়াতদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। 

তবে এসব সম্পর্ক আর হৃদ্যতা তৈরি হওয়ার আরও অনেক আগেই আমার বাবা অঞ্জনকুমার মৈত্র ওঁদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন, কারণ তিনি ছিলেন রবীন মজুমদারের অন্ধ ভক্ত। বাবার মুখেই শুনেছি, সেই সময় রবীনবাবুর সঙ্গে এক অসমবয়সী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বাবার। গত বছরের গোড়ায় প্রয়াণের কিছুদিন আগেও আমার কাছে ইউটিউবে শুনতে চেয়েছিলেন ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি না-ই বা জ্বলে’। সেই সময় থেকেই গৌরীদির সঙ্গে ওঁর পরিচয়।

এবার একটু আসা যাক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রসদনের একাধিক অনুষ্ঠান, দূরদর্শনের নানা রেকর্ডিং, পার্থদার কাছে কবিতা শেখার কারণে তাঁর সান্নিধ্যে আসা। আকাশবাণীর ডিউটি রুমের পাশের ঘরে পার্থদা যখন কবিতা শেখানোর মাঝখানে উঠে স্টুডিওতে গিয়ে ঘোষকের কাজ করতেন, সেই সব সময় গৌরীদি এসে জানতে চাইতেন, কোন কবিতাটা শিখছি। সেই অল্প সময়ের মধ্যে কবিতার উচ্চারণের বিষয়ে দু’ একটি মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও দিতেন। আমার মায়ের সঙ্গে ছিল ওঁর গভীর সখ্য। আমার কাছে জানতে চাইতেন বাবা-মায়ের কথা। দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করতে গেলে অবশ্য মায়ের সঙ্গে ওঁর দেখা হত। ওঁদের নির্দেশনায় দুবার ‘উপমা’-র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। 

Gouri-Ghosh
আকাশবাণীর অন্যতম রত্ন শ্রীমতী গৌরী ঘোষ

পার্থদা-গৌরীদির দমদম ক্যানটনমেন্ট ধোপাপুকুরের বাড়িতে সপ্তাহে একদিন গিয়ে গল্প করে আসতাম। সেইখানেই পরিচয় আর এক বাচিক শিল্পী অমিতাভ বাগচির সঙ্গে। তিনি অবশ্য অনেক দিন আগেই প্রয়াতদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তবে এসব সম্পর্ক আর হৃদ্যতা তৈরি হওয়ার আরও অনেক আগেই আমার বাবা অঞ্জনকুমার মৈত্র ওঁদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন, কারণ তিনি ছিলেন রবীন মজুমদারের অন্ধ ভক্ত। বাবার মুখেই শুনেছি, সেই সময় রবীনবাবুর সঙ্গে এক অসমবয়সী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বাবার। গত বছরের গোড়ায় প্রয়াণের কিছুদিন আগেও আমার কাছে ইউটিউবে শুনতে চেয়েছিলেন ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি না-ই বা জ্বলে’। সেই সময় থেকেই গৌরীদির সঙ্গে ওঁর পরিচয়।

পার্থদা-গৌরীদির একমাত্র সন্তান অয়নের বিয়ের অনুষ্ঠানে গৌরীদির উষ্ণ অভ্যর্থনার কথা মনে পড়ে। ঠিক দু’বছর আগে একদিন গৌরীদিকে ফোন করাতে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর মেজদা রবীন মজুমদারের জন্মদিবসের অনুষ্ঠান কভার করার জন্য। অনুষ্ঠান হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। সেদিন ফোনের ওপারের গলা ছিল বড়ই ক্ষীণ। বুঝতে পারছিলাম, যে সময় বোধহয় আর বেশি নেই। সেই আশঙ্কা সত্যি হল। ২৬ অগস্ট বর্ষা ঘনঘোর হবার আগেই সকালের মেঘ-কালো আকাশের নীচে থাকা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে অজানা কাব্যময় জগতে, বোধহয় নতুন কোনও ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলে গেলেন গৌরী ঘোষ। স্মৃতিভারাক্রান্ত মনে অনেক ধুসর হয়ে যাওয়া কথা আলোর সামনে আসে, আবার মিলিয়ে যায়। ক’টাই বা ধরতে পারি? বেশিরভাগটাই হাত ফসকে চলে যায়। 

 

*ছবি সৌজন্য: Facebook, newsunzip, Indiatimes

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *