ভিলেন জমিদার নরসুন্দর বাঁধা আছে তার কাঠের সিঁড়ি সমেত সিংহাসনের ধাপে। এক এক করে দর্শক অকাদেমির প্রেক্ষাগৃহ থেকে বা’র হয়ে যাচ্ছেন। হাসাহাসি চলছে! কেন না গোপাল উড়ের ভাইপো, দলের মোশনমাস্টার বারংবার মঞ্চে সেট-প্রপার্টি নিতে আসছেন আর বলে দিচ্ছেন, দর্শক যদি মনে করেন বাঁধন খুলে দিতে পারেন, কিন্তু তাঁরা খুলবেন না। নাট্যের প্রক্রিয়ায় দর্শককে অংশগ্রাহী করে তোলার নানা প্রচেষ্টা আধুনিক নাট্যে বারংবার হয়েছে; প্রসেনিয়াম, থার্ড থিয়েটার, স্পেস অথবা ইন্টিমেট সর্বত্র। সেদিক থেকে এই প্রচেষ্টাটি বেশ।

আবার এই বেশটি এবং বেশ হাসাহাসিটিই একটু রক্তাক্ত হয়ে যাবে যখনই ‘গোপাল উড়ে অ্যান্ড কোং-এর অনুচ্চারিত অনুপ্রেরণা উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’-এর ময়নার সংলাপটি আমাদের মাথায় ধাক্কা দেবে। ময়নাকে আলুবেচা সবজিওয়ালি থেকে অভিনেতা করে তুলেছিলেন ‘দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’র কাপ্তানবাবু, বেণীমাধব। সেই ময়নাকে তিনিই বাবু বীরকৃষ্ণ দাঁ-র কাছে থিয়েটার চালাবার জন্য বেচে দিয়েছিলেন আবার রক্ষিতা করে।

Gopal Ure co

প্রিয়নাথ, যে ইংরেজসেবী বাবু বংশের সন্তান হয়েও বাবাকে ঘৃণা করে, দেশকে ভালবেসে, বাংলা পেশাদার নাটকের অধোগতি রোধ করার জন্য এসেছিল বেণীমাধবের কাছে, সে ময়নাকে ভালবেসে ফেলেছিল। ময়নাও তার নটী জীবনের রং-ঢং-আলোর রোশনাইতে ভাসতে ভাসতেই জেনেছিল সেও ভালবেসেছে প্রিয়নাথকে।

‘টিনের তলোয়ার’-এ বেণীমাধব যখন সাহেবদের নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনে জেলে যাবার এবং থিয়েটার বন্ধ হওয়ার ভয়ে ‘তিতুমীর’ করতে অনিচ্ছুক হয়, ময়না তখন বলে, “ঐ শয়তান বীরকেষ্ট তোমাদের মেয়েকে মারে জানো? প্রিয়নাথের নাম করলেই মারে। তাই আমিও চব্বিশ ঘণ্টা প্রিয়নাথবাবুর নাম করি। (হাসে) মার খেলে গা জুড়োয়। মনে হয় তলিয়ে যাইনি এখনো।” থিয়েটারের জন্য সে নিজেকে রক্ষিতা করেছে, মন-শরীর সবে এত অত্যাচার সইছে, আর থিয়েটার তাতেও স্বাধীন হবে না? ন্যায্য লড়াই লড়বে না?

Gopal Ure Poster

আমাদের পেশাদার থিয়েটারের শুরুর যুগে যখন অভিনেত্রীরা এলেন, তাঁরা যৌনপল্লী থেকে এসেছেন সকলেই জানি আজ। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে তাঁদের আপাত সাফল্যের নেপথ্যে চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁদের শরীর-মনের উপর হওয়া অত্যাচারগুলি। বিনোদিনী, যৌনপল্লী থেকে এসেছেন বলে, তাঁকে রক্ষিতা হিসেবে গুরমুখ রাই-এর কাছে বিক্রি করা টাকায় রঙ্গমঞ্চ হতে পারে, তাঁর নামে মঞ্চটি হতে পারে না। গিরিশবাবুর মতন মানুষও সেই ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতায় সামিল ছিলেন ভাবতেও কষ্ট হয়। অথচ বিনোদিনী জানতেন, তাঁর তৎকালীন প্রেমিকটি যে টাকা দিতে পারবে না, গুরমুখ দিতে পারবে। সে টাকায় মঞ্চ হলে তাঁর নামে হবে মঞ্চ। এমন কত শত উদাহরণ দেওয়া চলে। সেই সব উদাহরণের পরে কি আর হাসি থাকে? হাসি পায়?

এবং আরেকটি কৌতুহলজনক বস্তু হল যাত্রাশিল্পের নারীদের কথা। চেতনার ‘গোপাল উড়ে অ্যান্ড কোং’-এর যে নারীরা তাঁরা সকলেই এসেছিলেন যৌনপল্লী থেকেই? লিয়েবেদেফের প্রথম বাংলা প্রসেনিয়ামে তাঁর ভাষা শিক্ষক পণ্ডিত গোলোকনাথ দাস যে নারীদের এনে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী হিসেবে, তাঁদের কোথা থেকে এনেছিলেন জানা যায় না। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের সমকালীন রায় রামানন্দের দলে নারীরা অভিনয় করতেন। তাঁরা যৌনকর্মী এমন কোনও কথা গবেষক অমূল্যচরণ জানাননি। এমনকী উনিশ শতকেও মহিলা পরিচালিত দুটি যাত্রাদলের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, ‘বৌ-মাস্টারের দল’ এবং ‘বৌ-কুণ্ডুর দল’। এঁদের সকলেই যৌনকর্মী ছিলেন এমন ধারণা কতটা ইতিহাস-সম্মত?

বিনোদিনী, যৌনপল্লী থেকে এসেছেন বলে, তাঁকে রক্ষিতা হিসেবে গুরমুখ রাই-এর কাছে বিক্রি করা টাকায় রঙ্গমঞ্চ হতে পারে, তাঁর নামে মঞ্চটি হতে পারে না। গিরিশবাবুর মতন মানুষও সেই ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতায় সামিল ছিলেন ভাবতেও কষ্ট হয়। অথচ বিনোদিনী জানতেন, তাঁর তৎকালীন প্রেমিকটি যে টাকা দিতে পারবে না, গুরমুখ দিতে পারবে। সে টাকায় মঞ্চ হলে তাঁর নামে হবে মঞ্চ।

গোপাল উড়ের প্রসিদ্ধ দলে পুরুষ নারীর ভূমিকাভিনয় করতেন, যেমন গোপাল নিজেও করেছেন। গোপাল, উড়িষ্যা থেকে কলকাতায় এসে রাস্তায় ফেরি করতেন ফল-সব্জী। তাঁর সুরেলা কণ্ঠের হাঁকের মুগ্ধতায় বিশ্বনাথ মতিলালের ‘বিদ্যাসুন্দর’ যাত্রাদলে তাঁর ঠাঁই হয়। মালিনীর ভূমিকায় মাতিয়ে দিতেন গোপাল উড়ে। সেখান থেকে বিপুল যশ-মান-অর্থ। এমনকী গোপালের কাঁধে যখন দলের দায়িত্ব এল তখনও মালিনীর ভূমিকা থেকে নিজে সরে গিয়ে আরেক পুরুষকে এনেছিলেন মালিনীর চরিত্র করতে।

সেই গোপালের ভাইপো যখন দল করলেন এত দ্রুত সে সব পুরুষেরা সরে গিয়ে নারীরা চলে এলেন তাঁদের ভূমিকায়? তাও সারি-জারি-ঝুমুর ইত্যাদি গানের মেয়েরা নয়, অন্যান্য যাত্রার মেয়েরা নয়, শুধু যৌনপল্লী থেকে আসা মেয়েদেরই, সেকালের পেশাদার থিয়েটারের নকলে এই দলে আনা হল?

Female Actors of Chetana
চেতনার ‘গোপাল উড়ে অ্যান্ড কোং’-এর যে নারীরা তাঁরা সকলেই এসেছিলেন যৌনপল্লী থেকেই

কাহিনীর প্রয়োজনে অবশ্য অনেক কিছুই হয় যা একেবারে হুবহু ইতিহাস মেনে চলে না। কিন্তু সমস্যাজনক জায়গা আরও থেকে গেল। সে হল জমিদার বাঁধা। কাহিনীর আশাবাদ খুবই ভাল। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশে ব্রিটিশ-বন্ধু জমিদার বেঁধে রেখে অন্য জায়গায় পালাগানের দল করাটা ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে এতটাই ছাপিয়ে যায় যে ভাবনাপীড়া তৈরি করে। জমিদারেরা, ব্রিটিশ-বন্ধু হবে বলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল কর্নওয়ালিশ। বাবুরা ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ থেকে শুরু করে বেশিরভাগ বিদ্রোহে ব্রিটিশ পক্ষে ছিলেন। একমাত্র নীল বিদ্রোহে যেহেতু তাঁদের জমিতে নীল হলে তাঁদেরই লাভ কমে, চাপ বাড়ে, তাই কেউ কেউ নীলবিদ্রোহের পক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন। সেখান থেকেই ‘নীলদর্পণ’ নাটক জন্মায়। সেখানে পালা শেষে জমিদারকে বেঁধে রাখাটা নিছকই ইচ্ছাপূরণের গল্প হয়ে গেল না?

কাহিনীর আশাবাদ খুবই ভাল। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশে ব্রিটিশ-বন্ধু জমিদার বেঁধে রেখে অন্য জায়গায় পালাগানের দল করাটা ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে এতটাই ছাপিয়ে যায় যে ভাবনাপীড়া তৈরি করে। জমিদারেরা, ব্রিটিশ-বন্ধু হবে বলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল কর্নওয়ালিশ। বাবুরা ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ থেকে শুরু করে বেশিরভাগ বিদ্রোহে ব্রিটিশ পক্ষে ছিলেন।

উৎপল দত্ত-ও টিনের তলোয়ারে তিতুমীরের ভূমিকায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাস্তবতা অমৃতলাল বা উপেনবাবুর মতো জেলে যাওয়া। পালাগানের দল জমিদার বাঁধলে জেলে বিষয়টা শেষ হয়ে যায় না। এবং জমিদারের লেঠেলের দল, ব্রিটিশ পুলিশ কোত্থাও না থাকাটাও, সঙ্গী-সাথী ছাড়া আচমকা বড়লাটের চলে আসার মতই কল্পনার বিরাট উড়ান। গল্পের গরু গাছে উঠতেই পারে, শুধু চেতনার মতো গ্রুপ থিয়েটারের জগন্নাথ, মারীচ সংবাদ থেকে মেফিস্টো, কোরিওলেনাস ইত্যাকার ঐতিহ্যসম্পন্ন দলের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়াটা একটু কষ্টকর রসিকতা।

অবশ্য এমন ঢের ঐতিহাসিক রসিকতা আমরা মেনেই নিয়েছি। যেমন বাংলা থিয়েটার পাড়ায় এ প্রশ্নটা এলই না, যে স্বাধীনতার আগের কাল অবধি যে যৌনপল্লী এত এত অভাবনীয় অভিনেত্রী যুগিয়েছে, তা কোন ভিক্টোরিয়ান মর‍্যালিটির দায়ে মধ্যবিত্ত নবনাট্য থেকে গণনাট্যে একেবারেই ব্রাত্য হয়ে গেল! মেনে নিয়েছি এমনভাবে যেন ওটুকুই তো যৌনপল্লীর কাজ ছিল, হয়ে গেছে, এখন মুখ মুছে ফেলা গেল।

Gopal Ure Sujan

নাট্যটির মূল ভার বহন করছেন অভিনেতা নীল মুখোপাধ্যায় এবং নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়। তাঁরা যথাক্রমে গোপাল উড়ে (নবীন) এবং তরঙ্গ, তথা বিদ্যা-সুন্দরের মালিনী মাসী। দুই দীর্ঘদিনের অভিনেতা তাঁদের সক্ষমতায় রঙ্গমঞ্চকে নানা রঙে রাঙিয়েছেন। গানে গোপাল, বিশেষ করে তরঙ্গ এবং বিদ্যার ভূমিকাভিনেতারা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু রাজপুত্র সুন্দর, এই চরিত্রাভিনেতার শারীরিক কাঠামোটি দুর্বল। নাচে মানানসই হলেও শারীরিক অভিনয়ের অন্যান্য অঙ্গে অতিক্ষিপ্রতার ম্যানারিজমটি এবং বাচিকের প্রতি অতিনির্ভরতা তাঁকে সুন্দর হতে বারেবারে বাধাই দিয়েছে। রাজা, জমিদার এবং অন্যান্য চরিত্রেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বলাই যায়।

এই প্রসঙ্গেই নাচ নিয়ে একটি-দুটি কথাও বলা উচিত। কলকাতা সংক্রান্ত নানা বই থেকে সেকালের যাত্রার গান-নাচ এবং গোপাল উড়ের সম্পর্কেও আমরা আরও কিছু তথ্য পাই। গোপালকে গান শিক্ষার তালিম দেওয়ার জন্য নিয়োজিত ছিলেন হরিকিষেণ মিশ্র। পানিহাটির মোহন মুখোপাধ্যায় আসতেন নাচ শেখাতে। কলকাতার পতিতা মহলে বাইজিদের তিনি লাস্যময়ী খেমটা আর আড় খেমটা নাচের তালিম দিতেন। কিংবদন্তি ছিলেন প্রায়। শোনা যায় গোপালকে নাচে-গানে তালিম দিতে রাধামোহনবাবু দু বছরে প্রায় ১ লাখ টাকা গোপালের পিছনে খরচ করেছিলেন। সে সব নাচকে মনে রেখে এ নাট্যে কোরিওগ্রাফিটি হলে আবারও শিল্পের ইতিহাসের আরেকটু ঠাঁই হত। আজকের তথাকথিত ধ্রুপদী নাচের ভঙ্গিমাগুলি বিদ্যা-সুন্দরের রমণ দৃশ্যে যতই দর্শকমনোমোহন হোক, মোহন মুখোপাধ্যায়ের শেখানো নাচ কিন্তু নয়।

Nivedita and Sujan
নাট্যটির মূল ভার বহন করছেন অভিনেতা নীল মুখোপাধ্যায় এবং নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়

মঞ্চটির উপরিভাগের একেবারে কেন্দ্রে পটের ব্যবহার, সময়টি ও ঘটনাক্রমকে চিহ্নিত করতে এবং দৃষ্টিকে নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ রাখতে খুবই উপযোগী ছিল। নানা ধরণের পাটাতনকে রাজপ্রাসাদের কক্ষ-গবাক্ষ থেকে সুড়ঙ্গে পরিণত করার স্পেক্টাকলটিও ভাবনার খোরাক যোগায়। আলোর অনুচ্চকিত কিন্তু দৃঢ় উপস্থিতি প্রশংসনীয়। বিশেষ করে সঙ্গম দৃশ্যে বাকি মঞ্চকে নিবিড় অন্ধকার দিয়ে ঘিরে কেন্দ্রে বিদ্যা আর সুন্দরের ছায়ারচনা এমন একটি নাট্যমুহূর্ত যা মনে থাকার। যন্ত্রসঙ্গীত শুধু যথাযথ বললেই হবে না, বলা ভাল এই গীতধর্মীতাকে ক্রমাগত অলঙ্কৃত করে গিয়েছে। মাঝখানে মাঝখানে ইদানীংকার দর্শকের পেশাদারী মঞ্চের ম্তো হাততালির অনুপ্রেরণা বিঘ্ন না ঘটালে নাট্য প্রযোজনার পক্ষে ভালই হত।

চেতনার পঞ্চাশ বছরে চেতনা-র পর্যায়ের নাট্যপ্রযোজনা না হলেও, দর্শক, যাঁদের অনেকেরই সম্ভবত ‘টিনের তলোয়ার’ আর চেতনাতে নেই, তাঁরা কিন্তু উপভোগ করেছেন। তথাকথিত স্ল্যাং-এর ব্যবহার, যৌন ইশারা-ইঙ্গিত ইত্যাদি রসদ যুগিয়েছে। তাছাড়াও যাঁরা অভিনয় জীবনের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত তাঁদের পুঁজির দাসত্বটি জানা আছে। তাঁদেরও ছুঁয়েছে প্রযোজনাটি। অতএব বলাই চলে, ঐতিহাসিক ইত্যাদি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে খানিক আমোদিত এবং খানিক বর্তমানে শীতল হয়ে যাওয়া রক্তে উষ্ণতা সঞ্চার করতে চাইলে দেখে আসতেই পারেন ‘গোপাল উড়ে অ্যান্ড কোং’।

ছবিঋণ:  চেতনা নাট্যগোষ্ঠী

শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে মূলত নাটক, মহাভারত ও পুরাণ বিষয়ক গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেছেন। লেখালেখি ও নাট্য গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষকতা করেন। ওঁর লেখা মহাভারত একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত ও পাঠকমহলে সমাদৃত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *