তাঁবু থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে একটু হেঁটে দুরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখছি, এমন সময় একটা শব্দ পেয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল । এই কনকনে ঠাণ্ডায় একটা লোক স্নান করছে। একটা নতুন ট্রেকিং টিম এসেছে। জনা সাতেক লোক। দেখে মনে হল সবাই বাঙালি। তাদের পোর্টাররা তাঁবু খাটাবার তোড়জোড় করছে। বাকিরা গরম জামাকাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকলেও, এই লোকটি বিন্দাস ঠাণ্ডা জলে স্নান করছে ।
আমাদের তাঁবুগুলো ট্রেকিং রুটের ডানদীকে একটা উঁচু টিলার উপর খাটানো হয়েছে। রুটের বাঁ দিকে একটা কাঠের ঘর। ওটা রান্নাঘর। ট্রেকারদের রান্নাবান্না ওখানেই হয়। সাধারণত ওই ঘরের চারপাশেই তাঁবু খাটানো হয়, কিন্তু আমাদের ট্যুর অপারেটর ইন্দ্রনীল কর একটু নিরিবিলিতে থাকার জন্য টিলার উপর তাঁবু খাটানো ঠিক করেছিল।
এই জায়গাটার নাম সাচেন। আমরা চলেছি সিকিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দুর্গম ট্রেকে – যার নাম জোংরি গোচালা ট্রেক রুট। এই পথে এটা আমার দ্বিতীয় অভিযান। বছর দুয়েক আরেকবার এসেছিলাম।
প্রথমে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি করে সিকিমের পুরানো রাজধানী ইয়াকসাম (১৭৪০ মিটার)। রাতে হোটেলে থেকে পরদিন তল্পি তল্পা গুটিয়ে গাইড, পোর্টার আর ইয়াক বাহিনী নিয়ে পারমিট বানিয়ে হাঁটা শুরু । প্রথম গন্তব্য সাচেন। সরু রাস্তা দিয়ে চড়াই ভেঙে উঠতে উঠতে চোখে পড়েছিল অনেক নীচে রাথোং চূ নদী। সাচেনের পথে তিনটে ছোট সেতু পার হতে হয় । এর মধ্যে দুটো আবার ঝুলন্ত সেতু। তাদের তলা দিয়ে পাখোলা আর সুসে খোলা নামের দুটি ঝোরা বয়ে চলেছে। তৃতীয়টি বেশ ছোট, সেতু না বলে সাঁকো বলা ভাল।
প্রথম দিনের হাঁটার শেষে খিদেটা বেশ চাগিয়ে উঠেছিল। এখনকার আধুনিক অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর অপারেটররা খাবার দাবারে কার্পণ্য করেন না। সাচেনে পৌঁছে দেখেলাম আমাদের জন্য ছোট ছোট পিৎজা, চিকেন মোমো, গারলিক সুপ আর অ্যাপেল টার্ট তৈরি করে টেবিল চেয়ার সাজানো রয়েছে। খেয়ে দেয়ে চটপট তাঁবুতে ঢুকে জামাকাপড় পাল্টে নিলাম। সাচেন একটুখানি জঙ্গলের মধ্যে। গাছপালার মধ্যে দিয়ে খুব দুরের একটা পাহাড় দেখা যায় যার ওপর সামান্য বরফের ছিটে লেগে। সেটাই দেখছিলাম, যখন হঠাৎ জল ঢালার শব্দে তাকিয়ে যা দেখলাম তা তো গোড়াতেই বলেছি।
যে লোকটি স্নান করছিল তার বয়স তিরিশের বেশি নয়। একদম ফিট চেহারা নয়, গায়ে বেশ মেদ আছে, সাথে একটা নেয়াপাতি ভুঁড়ি।
ইন্দ্রনীল আমার পাশে এসে দাঁড়য়েছিল। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল
“এই লোক জোঙরি টপে উঠতে বা গোচালা ভিউ পয়েন্টে যেতে পারবে না ।”
আমি বললাম “এটা কীভাবে বলছ?”
ইন্দ্রনীল বলল “মিলিয়ে নিও। সঙ্গেই তো যাচ্ছে।”
গৌতমদা আর অর্ণবও তাঁবু থেকে বেরিয়ে ছেলেটাকে দেখছিল।
জ্যোৎস্না মাখা রাতে সাচেনের জঙ্গলে বসে রুমালী রুটি আর চিকেন কষা দিয়ে দারুণ ডিনার হলো। এই জঙ্গলের মধ্য স্রেফ একটা স্টোভ সম্বল করে এরা এই রান্না কিভাবে নামায়, খোদায় মালুম।
সাচেনে যেদিন পৌঁছালাম সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল। মাঝে অল্প একটু বৃষ্টিও হয়েছিল। পরদিন কিন্তু আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে পাহাড়ী রোদ গায়ে মেখে এসে পড়লাম এই রুটের সবচেয়ে সুন্দর সেতুটির সামনে। এটাও ঝুলন্ত সেতু । অনেক নীচে প্রেক চু নদী বয়ে চলেছে| ওপারে গিয়ে একটু চড়াই ভাঙতেই একটা বসতি চোখে পড়ে। এই জায়গাটার নাম বাখিম (২৭০০ মিটার)। এখান থেকে দূরের পাহাড়গুলো পরপর একটা স্তরের মত দেখা যায়। কয়েকটা ছবি তুলে আবার চড়াই ভাঙা শুরু। সোজা রাস্তা। পোর্টার আর ইয়াক বাহিনী আগে চলে গেছে। আমাদের আগে আমাদের গাইড বিক্রম চলেছে। ও মাঝে মাঝে থেমে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে যাতে আমাদের পথ ভুল না হয়ে যায় । একদম পিছনে রয়েছে ইন্দ্রনীল। সে খেয়াল রাখছে যাতে কেউ দলছুট না হয়ে যায়।
এরপর রাস্তা একটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে একটা হাল্কা চড়াই ধরে এগিয়ে চলে। একটা বাঁক ঘুরতেই এই পথের প্ৰথম তুষার শৃঙ্গগুলো চোখে পড়ে। পর পর দেখা যায় পান্ডিম , তিয়েন চেং খাঙ ও জোপুনো । আগের বার সোকা থেকে এই তিনটি চুড়োর উপর সূর্যাস্তের অপূর্ব আলোমাখা দৃশ্যপট দেখেছিলাম। কিন্তু এবার সে গুড়ে বালি, কারণ বিকেলের আলোটা বেশ ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে ।
সোকা গ্রামটা (৩৪০০ মিটার) ছবির মত সুন্দর। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। কয়েকটা চোর্তেন রয়েছে। একটা মনাস্টেরি ও আছে। আগে লোকজনের বসতি ছিল, কিন্তু এখন গ্রামের বেশিরভাগ লোক ইয়াকসামে বসবাস করেন। অধিকাংশ বাড়ি এখন ট্রেকারদের থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গ্রামে ঢুকতেই একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড আছে । সেখানেই তাঁবু খাটানো হয়। আমাদের তাঁবু গুলো সেখানেই খাটানো হয়েছে।
সোকা তে কিছু বাঙালি ট্রেকারদের সঙ্গে দেখা হল যারা গোচালা ট্রেক সেরে নেমে আসছিল। তারা জানাল উপরে প্রচুর তুষারপাত হয়েছে । জোংরি আর সোকার মাঝে ফোডং বলে একটা খোলা প্রান্তর আছে । সেখানেও বরফ ছিল। তবে সেগুলো অনেকটা গলে গিয়েছিল বলে নামতে বেশ কষ্ট হয়েছে।
এটা শুনে ইন্দ্রনীল একটু ভুরু কুঁচকে বসে রইল। আমি প্রশ্ন করলাম “কী হলো? চিন্তা কীসের ?”
ইন্দ্রনীল বলল “চিন্তার কিছু নেই। কাল যখন উঠব তখন বরফ গুলো আরও গলে যাবে। বরফে কাদায় একটু ল্যাবড়া লেবড়ি হবে। জুতোর উপরে গেইটার পড়ে নিও। আর একটা পাপ দাও। আমার প্যাকেট ফাঁকা ।” ল্যাবড়া লেবড়ি কথাটা ইন্দ্রনীলের নিজস্ব। আর পাপ হলো সিগারেট।
সকালে উঠে দেখলাম যে বাঙালি দলটাকে সাচেনে দেখেছিলাম তারা তাঁবু থেকে বেরিয়ে ছবি তুলছে । আর সেই লোকটিও আগের মতই এই সাত সকালে ঠান্ডা জলে স্নান করছে। আমি ভাবলাম লোকটার চেহারা যাই দেখতে হোক, শরীরে দম আছে ।
সোকা থেকে ফোডং ওঠার রাস্তাটা সবচাইতে কষ্টকর। চড়াইটা একদম শুরু থেকে। মানে রেডি স্টেডি বলে কিছু নেই, একদম সোজা “গো”। প্রথম চড়াইয়ের ধাক্কা টা সামলে গৌতমদা আমাকে বলল “মামা, আমি কি বুড়িয়ে যাচ্ছি ? আজ ফার্স্ট রাউন্ডেই এত হাঁপাচ্ছি কেন?”
আমি বললাম “বুড়িয়ে যাওনি , ফালতু তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেছো। তাই হাঁপাচ্ছ। একটু দাঁড়িয়ে যাও। তারপর হেঁটো ।”
এরপর যত উপরে উঠতে থাকলাম তত গলে যাওয়া বরফ আর কাদার সম্মুখীন হলাম । মাঝে কিছুটা সমতল থাকলেও তারপর সুকঠিন চড়াই। এবং অনেক জায়গায় পা পুরো স্ট্রেচ করে উঠতে হচ্ছিল। গৌতমদা বলল “কিরে, আর কতটা? তুই তো এসেছিস আগে।”
আমি জানি তখনও আধঘন্টা বাকি। তবুও মিথ্যে করে বললাম “এই তো আর একটুখানি।”
ফোডং পৌঁছে গৌতমদা আমার মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে বলল “হতচ্ছাড়া মিথ্যেবাদী।” তারপর জায়গাটা জরিপ করে বলল “ইস জায়গাটা তো কাদা আর বরফে মাখামাখি হয়ে গেছে।” বরফ আর কাদা থাকলেও একটা জিনিস ভালো লাগল যে আকাশটা আজ পরিষ্কার হয়ে আছে । রোদও উঠেছে, আর তাই সামনের বরফ ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ গুলো দেখতে অপরূপ লাগছে । এখান থেকে পাহাড়গুলোর একটা “Wide angle View” পাওয়া যায়।
ফোডং থেকে দেওরালি টপ উঠতে লাগলো আরও দু ঘন্টা। এই রুটে এইখান থেকেই প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায়। শুধু কাঞ্চনজংঘা নয়, তার বাঁ পাশে উত্তর ও দক্ষিণ কাবরু, কাবরু ডোম, ব্ল্যাক কাবরু এবং রাথোঙ চোখে পড়ল। ডান দিকে সোকা থেকে দেখতে পাওয়া সেই তিন মূর্তি – পান্ডিম , তিয়েন চেং খাঙ ও জোপুনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনের মাঠে রং বেরং-এর পতাকা থাকার জন্য পুরো দূশ্যপট স্বর্গীয় লাগছিল।

দেওরালি টপে পৌঁছে কুড়ি মিনিট জিরিয়ে নিলাম । এখান থেকে সোজা নেমে গেলেই জোংরি উপত্যকা (৪২০০ মিটার)। আমি বাকিদের বললাম নামার সময় নাকে রুমাল চেপে নামতে, কারণ নামার রাস্তায় দুদিকে জুনিপার গাছের ঝোপ রয়েছে। নভেম্বরে পাতাগুলো শুকিয়ে একটা তীব্র গন্ধ বেরোয় যেটা নাকে বেশিক্ষণ গেলে মাথা ধরা অবধারিত।
রাতের বেলা জোংরিতে ঠান্ডা চতুর্গুণ বেড়ে গেল। এখান থেকে একটা খাড়াই সোজা পথ ধরে হেঁটে গেলেই জোংরি টপ। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার আশেপাশের অন্যান্য পর্বতশৃঙ্গ পরিষ্কার দেখা যায়।
খেয়েদেয়ে আমরা ট্রেকার্স হাটে বসে একটু গল্প করছি, সেই ছেলেদের দলের একজন এসে হাজির। কাতর কণ্ঠে জানাল যে ওদের একজন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে , তার খুব মাথা ধরেছে – আমাদের কাছে কি ডায়ামক্স জাতীয় কোনো ওষুধ হবে? ডায়ামক্স হলো হাই অল্টিচ্যুড সিকনেসের ওষুধ। ইন্দ্রনীল অসুস্থ ছেলেটিকে ডাকলে দেখলাম সে সেই স্নানরত লোকটি । এখন তাকে প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে । ওর সঙ্গে একটু কথা বলে ইন্দ্রনীল ব্যাগ থেকে বের করে একটা সাদা বড়ি দিলো। বলল “ এই নাও ডায়ামক্স। একটা খেলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।” মনে হলে হাতে ওষুধ পেয়েই তার রোগ অর্ধেক সেরে গেল।
পরদিন ভোর চারটে নাগাদ জোংরি টপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। টপে একটু আগে পৌঁছে যাওয়া ভালো । আস্তে আস্তে সূর্যের আলো যখন পর্বতশৃঙ্গের উপর পড়ে তখন সেটা দেখতে বেশ ভালো লাগে। এখানেও সামনে রং বেরং-এর পতাকা। একটু বাদে সেই বাঙালি ছেলের দলটিও জোংরি টপে চলে এল। শুনলাম অসুস্থ ছেলেটি অনেক ভাল আছে। কিন্তু সে এত নার্ভাস হয়ে আছে যে তার আর জোংরি টপে ওঠার সাহস নেই।
জোংরি টপ থেকে যতগুলো পর্বত শৃঙ্গ দেখা যায় তেমনটা এই রুটের অন্য কোথাও থেকে দেখা যায় না।
প্রথমে যে পর্বত শৃঙ্গগুলো তে আলো পড়ে সেগুলো হলো (ডান থেকে বাঁ দিক, পুব থেকে পশ্চিম) পান্ডিম, কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাবরু ডোম, কাবরু উত্তর, কাবরু দক্ষিণ, রাথোঙ, কোকতাং ও ফ্রে পিক। এদের সবার সামনে জোংরি টপের খুব কাছে রয়েছে ব্ল্যাক কাবরু বা মাউন্ট কাবুর। জোংরি থেকে গোচালা যাওয়া পথে এটা রাস্তায় পড়ে। খাড়া নিকষ কালো একটা পাহাড়। এর গায়ে বরফ পড়ে না।
আরও পশ্চিমে দেখা যায় মাউন্ট খাং। পান্ডিম থেকে আর পুবদিকে দেখা যায় তিয়েন চেং খাঙ জোপুনো। এগুলোতে আলো পড়ে আরও দেরিতে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পান্ডিমের মাঝখান দিয়ে একটা পাহাড়ের সাদা মাথাটুকু দেখা যায়। এটি হল মাউন্ট সিম্ভো।
জোংরি টপ থেকে নেমে ব্রেকফাস্ট সেরে চটপট বেরিয়ে পড়লাম। জোংরি তৃণভূমি থেকে মাউন্ট কাবুরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর কোকচুরান বলে একটা জায়গায় নামতে হয়। সেটা অসম্ভব একটা বাজে উৎরাই। তার উপর আধা গলা বরফ থাকায় এবার এই রাস্তায় নামা বেশ চাপের কাজ। আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমরা খুব আস্তে আস্তে কিছুটা বসে এবং কিছুটা গড়িয়ে নামছিলাম। এখানেও জুনিপারের ঝোপ আছে, কিন্তু সেগুলো শুকিয়ে যায়নি। গৌতমদা নামতে নামতে বলল “ওরে এটা তো শুধু নামছি না, এটা তো মহাপতনে যাচ্ছি।”
কোকচুরান জায়গাটা আমার বেশ লাগে। একটা ট্রেকার্স হাট রয়েছে। পাশেই প্রেকচু নদী বেয়ে চলেছে । তার কয়েকটা ছোট শাখা ট্রেকার্স হাটের নীচে দিয়ে বয়ে যায়। আমরা সাধারনতঃ ফেরার সময় এখানে থাকি। চারপাশে বড় বড় শ্যাওলা মাখা পাথর ও অনেকটা জঙ্গল।
প্রেকচু নদী পেরিয়ে একটা জঙ্গলে ঢুকতে হয়। সেখান থেকে কিছুটা গেলেই থানসিং (৩৯৩০ মিটার)। আমাদের রাতের থাকার জায়গা। খোলা মাঠের মধ্যে অনেক তাঁবু খাটানো রয়েছে। সম্প্রতি আগের পুরানো ট্রেকারস হাটটা ভেঙে একটা নতুন ট্রেকার্স হাট তৈরী হয়েছে। এখান থেকে পান্ডিম পাহাড়টা দারুণ লাগে। মনে হয় পাহাড়ের কোলে শুয়ে আছি। কিছু অপূর্ব ছবি তোলা হল। এখান থেকে আমাদের শেষ ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড লামুনে আর দেড় ঘন্টার রাস্তা। পরদিন সকালে বেরোতে হবে। লামুনে থেকেই তার পরের দিন চড়াই ভেঙে গোচালা যেতে হবে।
গোচালা মানে আদতে যেটা গোচা পাস – অত পর্যন্ত ট্রেকাররা সাধারনতঃ যান না। প্রথমে সমিতি লেক পেরিয়ে পড়ে চেমাথাং

উপত্যকা যেখান থেকে সব চাইতে সুন্দর ছবি ওঠে। এটাকে বলে ফার্স্ট ভিউ পয়েন্ট। তার পরে একটা প্রচণ্ড সরু রাস্তা দিয়ে গোচা লেকের সামনে দাঁড়ালে চোখের সামনে শুধু কাঞ্চনজংঘা। এটা সেকেন্ড ভিউ পয়েন্ট। এটা পেরিয়ে তবে গোচা পাস। তার পরে রয়েছে তালুং গ্লেসিয়ার। সাধারনতঃ চেমাথাং উপত্যকা থেকেই লোকে ফেরত আসে। বরফ কম থাকলে গোচা লেক পর্যন্ত যাওয়া যায়। এবারে সে আশা নেই বললেই চলে।
কাঞ্চনজংঘা সারাদিন দেখতে পাওয়া খুব কপালের ব্যাপার। পরদিন সেটাই ঘটল। আমরা থানসিং থেকে লামুনে যাওয়ার পথে এবং লামুনে পৌঁছে রাত পর্যন্ত কাঞ্চনজংঘা দেখতে পেলাম। ছবি যে কত তুললাম তার কোনও ইয়ত্তা নেই। প্রেকচু নদীর জলের খুব কাছে ট্রাইপড বসিয়ে ক্যামেরা কাঞ্চনজংঘা নিয়ে একটা লো অ্যাঙ্গেল স্লো শাটার ছবি তুলছি হঠাৎ পাশ থেকে কে বলল “সাব, চায়।” আমি ক্যাম্প থেকে প্রায় তিনশ মিটার দূরে ছিলাম। পোর্টারটা ওই দূরত্ব হেঁটে এসেছে আমাকে গরম চা খাওয়াবে বলে । অভিভূত হয়ে গেলাম।
সেই অসুস্থ ছেলেটি আবার আমাদের তাঁবু তে এসেছিল। সে অনেকটা ভালো আছে কিন্তু তার মনে হচ্ছে আরো একবার ডায়ামক্স খাওয়া দরকার। ইন্দ্রনীল দ্বিরুক্তি না করে ব্যাগ থেকে ওকে একটা সাদা বড়ি ধরিয়ে দিল। সে চলে যাওয়ার পর আমি বললাম“ তুমি ঠিকই বলেছিল, এ কোনোটাই যেতে পারবে না। ভাগ্যিস তোমার কাছে ডায়ামক্স ছিল।”
ইন্দ্রনীল একটু হেসে বলল “ওকে তো ডায়ামক্স দিইনি। ওকে সিম্পল মাথা ধরার ওষুধ দিয়েছি। বাকীটা কাছ করেছে ওর সাইকোলজি। ওর অল্টিচ্যুড সিকনেস হয়নি। জাস্ট নার্ভাস হয়েছে।”
আমি হাঁ করে ইন্দ্রনীলের দিকে চেয়ে রইলাম।
লামুনে থেকে ভোর তিনটে নাগাদ বেরোলাম। হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে সমিতি লেকের (৪০৬০ মিটার) পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল আগেরবার এই রাস্তায় প্রচুর বরফ পড়েছিল। এবার সারা ট্রেক রুটে বরফ থাকলেও এখানে নেই।
অর্ণব একটু তড়বড় করে হাঁটছিল। ইন্দ্রনীল ওকে স্পিড কমাতে বলল। সে বলল “এখানে যদি স্লিপ খেয়ে সমিতি লেকে পড়ে যাও, বাঁচার কোনও চান্স নেই । হাইপোথার্মিয়া তে অবধারিত মৃত্যু। কেউ তোমায় তোলার চেষ্টাও করবে না।”
অর্ণব একটা ভয়ের আওয়াজ করে হাঁটার স্পিড কমাল।
চেমাথাং উপত্যকা পৌঁছে সকলে পাথরের উপর বসলাম। বিক্রম ছুটল সেকেন্ড ভিউ পয়েন্ট এর রাস্তার অবস্থা দেখতে। এদিকে বরফ নেই দেখে আশা করেছিলাম যে ওদিকে অবস্থা ভালো হবে। কিন্তু বিক্রম এসে জানাল ওদিকে রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। বরফে ডুবে আছে।
অতএব অপেক্ষার পালা। প্রকৃতির ম্যাজিক শোয়ের জন্য।
মোটামুটি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কাঞ্চনজংঘার উপর প্রথম আলো পড়ল। তারপর তার পাশে ফর্কড পিক এর উপর আলো পড়ল আর তারও পরে কাবরু পর্বতমালা আলোকিত হল। ফর্কড পিক শুধু গোচালার কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যায়। প্রচুর লোক, এমনকি প্রচুর লেখক ফর্কড পিক কে গোচা পিক বলে ভুল করেন। গোচা পিক পাস পেরিয়ে তালুং গ্লেসিয়ারের কাছ থেকে দেখা যায়।
ছবি তুলতে তুলতে আবিষ্কার করলাম আমরা চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তারপর বুঝলাম আমি কাঁদছি। কেন কাঁদছি বুঝতে পারলাম না, এরকম ভাবে কখনও নিজের অজান্তে কাঁদিনি ।
ইন্দ্রনীল পাশে দাঁড়িয়েছিল । সে এবার আস্তে করে বলল “তুমি কাঞ্চনজংঘাকে তোমার স্বজন বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছ অমিতাভদা। এটা হল এক্ষুনি বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার কান্না। ফেরার সময় তো আমরা জোংরি বাইপাস করে ফিরব, সারা রাস্তায় আর দেখতে পাবে না।”
একটু থেমে সে বলল “পাহাড় যখন আত্মীয় হয়ে যায় , সে ডাকে অমিতাভদা। সে ডাক আমরা অগ্রাহ্য করতে পারিনা। তুমিও পারবে না।“
সেই থেকে শুরু। ডাক অগ্রাহ্য করতে পারিনা। বার বার ছুটে যাই পাহাড়ের ডাকে।
জরুরি তথ্য
গোচালা ট্রেক একটি হাই অল্টিচ্যুড ট্রেক। গোচালার অবস্থান প্রায় ৫০০০ মিটার বা ১৬০০০ ফিটের একটু উপরে আর জোংরির উচ্চতা প্রায় ১৪০০০ ফিটের কাছাকাছি। সুতরাং এই ট্রেক করার আগে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে ফিট থাকা খুব জরুরি। হার্টের বা হাই প্রেসারের অসুখ আছে এমন লোকের এই ট্রেক করা উচিৎ নয়।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে ইয়াকসাম পৌঁছতে হবে। ১৪২ কি.মি. যেতে সারাদিন লেগে যায়। গোটা ট্রেকটা করে ফিরে আসতে আট দিন লাগে । পোর্টার আর গাইড ইয়াকসামে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর গোচালা ট্রেক করান। দেখে শুনে ট্যুর অপারেটর ঠিক করা উচিৎ। মাথায় রাখতে হবে যে এই ট্রেকে ক্রমাগত চড়াই থাকার জন্য খাটুনিতা বেশি হয়। তাই বেশি পরিমানে ভালো খাবার দাবার খাওয়া দরকার। অল্টিচ্যুড সিকনেস হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি আছে। তাই ধীরে ধীরে শরীরকে মানিয়ে হাঁটতে হবে।
ছিলেন নামী কোম্পানির দামী ব্র্যান্ড ম্যানেজার | নিশ্চিত চাকরির নিরাপত্তা ছেড়ে পথের টানেই একদিন বেরিয়ে পড়া | এখন ফুলটাইম ট্র্যাভেল ফোটোগ্রাফার ও ট্র্যাভেল রাইটার আর পার্টটাইম ব্র্য্যান্ড কনসাল্টেন্ট | পেশার সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছেন নেশাকেও | নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয় বেড়ানোর ছবি এবং রাইট আপ |
Apnar guide Indranil Kar er contact number share korte parben?