জানলা খুলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অরিত্র। এ কি শান্তিনিকেতন? নাকি টুং-সোনাদা-ঘুম? কুয়াশা এত ঘন যে কয়েক হাত দূরে বাতাবি গাছটাও প্রায় মিলিয়ে গেছে! আর কী হাড় হিম করা ঠান্ডা রে বাবা। জানলা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই দাপুটে ঠান্ডা ঘরের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন জাপটে ধরল অরিত্রকে! জগিংয়ে বেরনোর তো কোনও প্রশ্নই নেই, আগে চা।

বসার ঘরে ঢুকে দেখল, সোফায় পা তুলে খবরের কাগজ পড়ছে দেবদীপ, গায়ে শাল, মাথায় কান-ঢাকা টুপি। অরিত্রকে দেখেই বলল, “চা দিতে বলেছিস? আমাকেও আর একবার দিতে বল তো।”

চা-পর্ব শেষ করে একটু ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নিল অরিত্র। অভ্যেস মতো পরে ফেলেছে ট্র্যাক স্যুট আর স্নিকার্স। যদিও কোথাও বেরনোর কোনও ইচ্ছেই আজ আর নেই তার। কিন্তু একটা কথা কাল জানা হয়নি। কুর্চি এখন করে কী?

কুয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। আবছা মুখ দেখা যাচ্ছে রোদের। নরম আলোয় মায়াময় হাসিতে উজ্জ্বল বাগানের ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গাঁদা, কসমস, পিটুনিয়া। শিশির-ভেজা লনে মুখোমুখি দুটো চেয়ার নিয়ে বসে একথা-সেকথার পর দেবদীপকে কুর্চির কথা জিজ্ঞেস করল অরিত্র। দেবদীপ নিঃস্পৃহ গলায় জানাল,

– পিএইচডি করছে একটা বছর নষ্ট করে। তবে শান্তিনিকেতনে। কলকাতার বন্ধুবান্ধব, আড্ডা কিছুই নাকি আর ভাল লাগে না ওর। তাছাড়া, ওর ঠাম্মার নাকি ইচ্ছে ছিল কুর্চি শান্তিনিকেতনে রিসার্চ করুক। ঠাম্মা মারা যাওয়ার পর সেই ইচ্ছেটার ওজন অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল কুর্চির কাছে। সুজাতদা খুব চেয়েছিলেন এই বাড়ি বন্ধ করে কুর্চিকে নিয়ে যেতে কলকাতা বা অন্য কোথাও। কিন্তু কুর্চি জেদ ধরে বসে, ঠাম্মার বাড়ি ছেড়ে সে কোত্থাও যাবে না! ওই বাড়ির সর্বত্র সে নিত্যদিন তার ঠাম্মাকে খুঁজে পায়। কুর্চির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় তাকে এতটা পাল্টে দিয়েছে দেখে মেয়ের ইচ্ছে মানতে বাধ্য হয়েছিল সুজাতদা।

– সেই থেকে কুর্চি শান্তিনিকেতনেই থাকে। মাঝে মধ্যে যায় কলকাতায়। কখনও রিসার্চের কাজে, কখনও অন্য দরকারে। যায় নিজে গাড়ি চালিয়ে, কুকুরদের নিয়ে। কলকাতায় বাবার কাছে দু’চার দিন থেকেই আবার ফিরে আসে। সুজাতদা নিজে কিন্তু শান্তিনিকেতনে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। পাঠভবনের ছেলে, সেই কোন ছোটবেলায় আমাদের শান্তিনিকেতন গানটা আমি প্রথম শুনেছিলাম সুজাতদার গলায়। এখনও কানে লেগে আছে। কী চমৎকার গলা ছিল! কী সুন্দর গাইত। এখন আর তার নাকি কোনও টানই নেই শান্তিনিকেতনে। তবে কুর্চি এখানে কী করে, কোথায় যায়, কার সঙ্গে দেখা করে, কারা আসে কুর্চির কাছে, কতক্ষণ থাকে, সে সব খবরই এখনও রাখেন সুজাতদা।

– মানে, তোমাদের ডিটেকটিভ এজেন্সি এখনও বহাল?

– সে আমি কী করে জানব? চোখে যা দেখি, কানে যা আসে, তা-ই বললাম তোকে।

– আর একটা কথা বলো। কুর্চি কি জানে ওর জীবনে এত বড় বিপর্যয়ের আসল কারণ ওর বাবার কলকাঠি নাড়া?

– সেটা তোকেই বা কে বলল? এত বড় কথাটা যে বললি, পারবি কোনও প্রমাণ দিতে? তুই দেখেছিলি হোটেলের ঘরে প্রশান্ত আর কুসুম আসলে কী করেছিল? ওই ছবিগুলোতে যা আছে সেটাই একমাত্র ভার্সন রে অরি। আজ প্রশান্ত পারিজা নেই, কুসুম স্যানন বলে কোনও অভিনেত্রীর কথা কেউ জানে না। সেই প্রোডাকশন কোম্পানি চিত্রাঙ্গদা করেনি, তাদের কথাও কেউ বলতে পারবে না। সুতরাং অন্য কোনও ভার্সন নেই। আর, এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেওয়া হয়েছে, ওই ছবিগুলো মর্ফড নয়। সমস্ত ছবি জেনুইন। ব্যস, কার বলার কী আছে!

– উফ, তার মানে কুর্চি জানেও না যে সে বাঘের খাঁচায় বন্দী। খাঁচায় কে ঢুকল-বেরোল স-ব খবর রিং মাস্টার ডাক্তারবাবুর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ডিটেকটিভ এজেন্সির বাঘ। রিং মাস্টারের যাকে পছন্দ হবে না, বাঘ তাকেই খাবে। মেয়েটা কিচ্ছু জানতে পারবে না, শুধু দেখবে, সেই মানুষটা উধাও।

– একজ্যাক্টলি। এই কথাটাই তোকে বোঝাতে চেয়েছিলাম। দেখ অরি, কুর্চির জন্যে আমার মাথাব্যথা নেই। ওর জীবনটা পাল্টানো আমার সাধ্যের বাইরে। তার কারণগুলো তুই কিছুটা বুঝেছিস, কিছুটা আন্দাজ করেছিস। কিন্তু তোর জন্যে আমার যথেষ্ট মাথাব্যথা। তুই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। মন দিয়ে খেললে তোর ফিউচার আছে। সেটাই তোর কাজ। বাঘের খাঁচায় ঢুকে রিং মাস্টারকে চ্যালেঞ্জ করাটা তোর কাজ নয়।

বলতে বলতে দেখা গেল, শীতের সকাল ঝলমলিয়ে মোরাম বিছোনো রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে কুর্চি। বাড়িতে ঢুকে সোজা চলে এল লনের মাঝখানে। এক মুখ হাসি। চোখের তারা কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গোলকিপারের হাত কী বলছে? ব্যথা বেড়েছে, না কমেছে?”

– দূর। ব্যথা কালও ছিল না, আজও নেই। তোমার শুধু শুধু হয়রানি। বারান্দা থেকে আরও একটা চেয়ার আনতে আনতে বলল অরিত্র।

– তা বললে কি হবে? দেখতে হবে না, জায়গাটা ফুলেছে কিনা, পাস জমতে পারে কি না? বলতে বলতেই চেয়ারে বসে অরিত্রর বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে কুর্চি ক্ষতটা ভাল করে দেখল। তারপর গম্ভীর মুখে রায় দিল, “দেবুদা, তোমায় কোত্থাও ছুটোছুটি করতে হবে না। এক রাতেই অনেকটা শুকিয়েছে উন্ড। ইনফেকশনের চান্স নেই আর। তোমার গোলকিপার বেঁচে গেল।”

– অরিও তাই বলছিল। ম্রিয়মাণ মুখে বলল দেবদীপ।

– কিন্তু দুষ্মন্তবাবুর খবর কী? অরিত্র জিজ্ঞেস করল, “তিনি ফুর্তিতে আছেন তো?”

– কাল খুব বকাটকা খেয়েছে। বেঁধে রাখা ছিল সারা রাত। সকালেও দেখি পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তারপর আমিই দু’টোকে সঙ্গে নিয়ে একটু বেরোলাম। ঘুরেটুরে এসে মন ভাল হয়ে গেছে দুষ্মন্তর, আর কোনও প্রবলেম নেই। ভেবেছিলাম সঙ্গে আনব, গোলকিপারকে সরি বলতে হবে তো। পরে ভাবলাম, গোলকিপারের হাত কেমন সেটা তো আগে দেখে আসি। দুষ্মন্ত ক্যান ওয়েট।

– ভালই করেছ, আমি একটা চান্স পেলাম দুষ্মন্তকে বাড়ি গিয়ে হ্যালো বলার। ওর গার্লফ্রেন্ড শকুন্তলাকেও তো দেখা হয়নি।

– যাবে তুমি ওদের মিট করতে? চলো, চলো। টাটা দেবুদা, আর চিন্তা কোরও না। উচ্ছ্বসিত কুর্চি বলল চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে।

– তুমি এগোও, আমি ফোনটা নিয়েই আসছি।

কুর্চি দু’পা এগোতেই গলা নামিয়ে অরিত্র বলল, “আমি যে আদতে গোলকিপার, দেবুদা। এই গোলটা আমাকে বাঁচাতেই হবে। তার জন্যে না হয় বাঘের খাঁচাতেই ডাইভ দিলাম।”

পকেট থেকে ফোনটা বার করে হাতে নিয়ে কুর্চির পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল অরিত্র।

আগের পর্ব পড়তে হলে – https://banglalive.today/goalkeeper-an-episodic-novel-on-relationships-and-social-norms-5/

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *