কুর্চি-প্রশান্তর তখন বিয়ের কথা ভাবার ফুরসত কোথায়? কুর্চি সবে এম এ শেষ করে পি এইচ ডি-র জন্যে তৈরি হচ্ছে। বাবার প্রশ্নের উত্তরে নেহাতই আলগাভাবে বলেছিল, “এখন ওসব কিছুই ভাবছি না বাবা। তাড়া কিসের? আগে রিসার্চ শেষ করি, প্রশান্তও আর একটু দাঁড়াক, ইন্ডাস্ট্রিতে একটু চেনাশোনা বাড়ুক। তখন না-হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।”

তার মানে আজ হোক বা কাল, প্রশান্তকেই বিয়ের কথা ভাবছে কুর্চি! এই করতে করতে যত দিন যাবে, ওদের সম্পর্কটা ততই পোক্ত হবে। ভাবতে ভাবতে সুজাতদার পায়ের নিচের মাটি যেন কেঁপে উঠেছিল। মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন তাঁর! তাকে বানাতে হবে সত্যিকারের ওয়র্ল্ড সিটিজেন। সেইজন্যে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে কুর্চিকে বেশ কয়েকবার ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরিয়ে এনেছেন সুজাতদা। প্রাক্তন স্ত্রী রুচিরা, মানে কুর্চির মা, এখন থাকেন অ্যারিজোনার ফিনিক্সে। তিনিও অবশ্য আবার বিয়ে করেছেন। কুর্চিকে নিয়ে দু’দুবার আমেরিকা ঘুরে এলেও ফিনিক্সের ধার কাছ দিয়ে কিন্তু ওরা কখনই যায়নি। দেখতে যায়নি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। এমনকি শাশুড়ি মংলিমাসি আর মেয়ে কুর্চিকে রুচিরাদি যে কখনও সখনও ফোন করতেন, সেটাও জোর করে বন্ধ করিয়েছেন সুজাতদা। কুর্চির ব্যাপারে তিনি এতটাই পজেসিভ। মংলিমাসির সঙ্গেও এই নিয়ে সুজাতদার মতের অমিল হত মাঝে মাঝে। কিন্তু মংলিমাসির ওপর কোনোদিনই খবরদারি করতে পারেননি সুজাতদা। পারেননি, কিন্তু চেষ্টা করে গেছেন। আর সব সময় আক্ষেপ করে এসেছেন, কুর্চি সারা জীবন আটকে থাকবে কলকাতা আর শান্তিনিকেতনের মধ্যবিত্ত জগতে? অসম্ভব!

প্রশান্তর কথা জানার পর সুজাতদার মনে হল, সবচেয়ে আগে দরকার তার ঠাম্মার থেকে কুর্চিকে আলাদা করা।নইলে ঠাম্মার কাছ থেকে এ ব্যাপারে কুর্চি কতটা প্রশ্রয় পাবে, তার কোনও ঠিক নেই। তাছাড়া, মেয়ের জীবনে তার বাবার প্রভাব বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না? কুর্চির পিএইচডি করার স্বপ্ন কি এই অবস্থাটা পাল্টানোর একটা সুযোগ হতে পারে? কুর্চিকে বললেন, “পিএইচডি ইন্ডিয়ায় করবি কেন? ইংল্যান্ডে চল, কি আমেরিকায়। চিন্তার কিচ্ছু নেই, তুই অ্যাপ্লাই তো কর। তারপর আমি দেখছি কোথায় কী হয়।”

তার বৃদ্ধা, নড়বড়ে, অসুস্থ ঠাম্মাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। ঠাম্মাই তার অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-হার্ভার্ড, স্পষ্ট জানিয়েছিল কুর্চি। আর, তার ঠাম্মারও বিশেষ উৎসাহ ছিল না কুর্চির তখনই বিদেশে পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে। সুজাতদা বুঝলেন, এই জায়গাটার নড়চড় করা অসম্ভব। তাহলে প্রশান্ত পারিজা, তোমার একটা ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হয়! অনেক ভাবলেন সুজাতদা, তারপর যোগাযোগ করলেন তার অনেক দিনের চেনা একটা ডিটেকটিভ এজেন্সির সঙ্গে।

– তোমাদের এজেন্সি? অরিত্র না জিজ্ঞেস করে পারল না।

– দূর বোকা। আমি কি ফ্যামিলি বিজনেসের কোনও খবর রাখি? নাকি, কলকাতায় ডিটেকটিভ এজেন্সি একটাই? অন্ধকার যেন কুয়াশার চাদর জড়াচ্ছে একটু একটু করে। সেদিকে তাকিয়ে উদাসী গলায় বলল দেবদীপ। কী যেন ভাবল। তারপর আবার ফিরে গেল তার গল্পে।

“তার কদিন পর, বুঝলি, বম্বের একটা প্রোডাকশন হাউস থেকে ফোন এল প্রশান্ত পারিজার কাছে। মহাভারত থেকে চিত্রাঙ্গদার গল্প নিয়ে বড় বাজেটের পিরিয়ড ফিল্ম তাদের পরের ছবি। কিন্তু কাজ করা হবে সব নতুন প্রতিভাদের নিয়ে। সেই ছবিতে প্রশান্ত যদি এডিটর হিসেবে কাজ করতে চায়, তাহলে বম্বেতে গিয়ে কথাবার্তা বলতে হবে।”

“গেল প্রশান্ত, শিবাজি পার্কের কাছে একটা মাঝারি হোটেলে বিজনেস সেন্টার ভাড়া করে অফিস খুলেছে প্রযোজক সংস্থাটি। সেখানেই প্রশান্তর থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। অফিসে যেতেই আলাপ হল প্রোডিউসার নির্ভয় মেহরা, ডিরেক্টর কেতন গৌতমের সঙ্গে। শুরু হল মিটিং। মিটিং বলতে সাধারণভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হাল-হকিকত, কে কেমন কাজ করছে এই সব। প্রশান্ত দেখল, কোনও টেকনিকাল আলোচনার ধারকাছ দিয়ে যাচ্ছে না কেউ। তার মধ্যে একবার খবর আসে অমুক অভিনেতা, অমুক অভিনেত্রী এসেছেন তমুক তমুক চরিত্রের জন্যে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে একবার এ বেরিয়ে যায়, একবার ও। ঘণ্টাখানেক এইভাবে চলার পর প্রশান্তকে বলা হল, স্ক্রিপ্ট রাইটার সাহানা আসছে কয়েক ঘন্টা পরে, তখনই আসল মিটিং শুরু হবে। মাঝখানের সময়টা প্রশান্ত ফ্রি। ডিরেক্টর কেতনের সঙ্গেই প্রশান্ত বেরিয়ে এল বিজনেস সেন্টার থেকে। বাইরেই দেখা একটি মেয়ের সঙ্গে। সে বলল, আমি কুসুম স্যানন। ডেকেছিলে তো একটার সময়, অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ।”

“কেতন অম্লান বদনে বলল, মিট প্রশান্ত, নিউ এডিটর অফ দ্য ইউনিট। হি ইজ থর‍্যো উইথ দ্য স্টোরি, কাস্টিংয়েও সাহায্য করছে আমাদের। ও এখানেই উঠেছে। তুমি প্রশান্তের ঘরে যাও, ওর কাছ থেকে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের ফিলটা আগে বুঝে নাও।”

 “ঘরের ভেতর কী হয়েছিল, আমি ঠিক জানি না, বুঝলি। প্রশান্তের সঙ্গে কুসুমের প্রায়-পোশাকহীন খুব অন্তরঙ্গ কিছু ছবি কুর্চির ইনবক্সে পৌঁছে গিয়েছিল প্রশান্ত বম্বে থেকে ফেরার আগেই। ওই প্রোডাকশন কোম্পানিই মেল করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, অভিনেত্রী কুসুম স্যানন অভিযোগ করেছে ছবিতে সুযোগ দেবার নাম করে হোটেলের ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রশান্ত তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। এক ফাঁকে কোনও বন্ধুকে ডেকে পাঠাতে পেরেছিল বলেই বেঁচেছে কুসুম, ছবিগুলো সেই বন্ধুরই তোলা। পাঁচ লাখ টাকা পেলে কুসুম পুলিসকে কিছু জানাবে না। প্রশান্ত বলেছে, ওর এত টাকা নেই, কিন্তু ওর বান্ধবীকে জানালে টাকার ব্যবস্থা হতে পারে।”

“বোকা কুর্চি। সব কথা গিয়ে বলেছিল ওর সবচেয়ে বড় আশ্রয়, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, ওর ঠাম্মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মংলিমাসির বুকে প্রচণ্ড ব্যথা, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। খবর পেতেই সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটে এসেছিলেন সুজাতদা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, জানা গেল আশঙ্কাটাই সত্যি। সাংঘাতিক হার্ট অ্যাটাক। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি সুজাতদা। ডেকে এনেছেন একের পর এক অভিজ্ঞ সতীর্থকে, কেউ যদি কিছু করতে পারে! তবু রাত পেরল না। কোনও চেষ্টাতেই সাড়া পাওয়া গেল না মংলিমসির। ওঁকে দাহ করে ভস্ম নিয়ে সোজা হরিদ্বারে চলে গিয়েছিল সুজাতদা, বিধ্বস্ত কুর্চিকে সঙ্গে নিয়ে। যেখানে ছিল, সেখানে মোবাইল ফোনের সিগনাল ধরে না।”

সাত দিন পর কলকাতায় ফিরে কুর্চি খবর পেল, আগের রাতে স্লিপিং পিলস খেয়ে আত্মহত্যা করেছে প্রশান্ত পারিজা। একা থাকত, তাই কিছু জানতেই পারেনি কেউ। হাসপাতালে নিয়ে যেতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। না, কোনও সুইসাইড নোট রেখে যায়নি সে।

কুয়াশা আরও খানিকটা জমাট বেঁধেছে। বাগানের আলোর সারি অনেক দূরে সরে গিয়ে টিমটিম করছে এখন। রুদ্রপলাশের পাতা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে শিশিরের ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে বারান্দার মেঝে। বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক বসে আছে দুজনে। যেন সেই স্তব্ধতা আরও জমিয়ে দিয়ে দূর হেকে ভেসে এল দ্রুতগামী ট্রেনের ছুটে যাওয়ার আওয়াজ। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে দেবদীপ বলল, “কী রে শুনলি তো কুর্চি আর কুর্চির বাবার গল্প হলেও সত্যি? ঘুম আসবে এর পর? তবু চল, শুতে তো যাই।”

আগের পর্ব পড়তে হলে – https://banglalive.today/goalkeeper-an-episodic-novel-on-relationships-and-social-norms-4/

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *