স্যুটকেস গোছানো হয়ে গিয়েছিল রাতেই। সুমিত্রা ঢুকেছিলেন রান্নাঘরে। লম্বা সফরের আগে হালকা ব্যায়াম সেরে নিচ্ছিল অরিত্র। ছটা বাজতে না বাজতেই ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে দেবদীপ এসে ঢুকল। স্যুটকেস গাড়িতে তোলার জন্যে সাজানো আছে দেখে এসে অরিত্রকে বলল, “তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক।” দেবদীপের গলা পেয়ে সুমিত্রা বেরিয়ে এলেন। বললেন, “তোমরা একটু চা-স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলেই বেরিয়ে পড়া যায়।”

চা খেতে তিনজনে বারান্দায় গিয়ে বসলেন। সুমিত্রা দেবদীপকে জিজ্ঞেস করলেন, “শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি তো বুঝলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থাটা কী? তুমি সেদিন বলে গেলে কুর্চি সব ব্যবস্থা করছে। ছোটুকে জিজ্ঞেস করলে বলছে, সব দেবুদা জানে, আমি কিছুই জানি না! তা, এবার তো বলবে ব্যবস্থাটা কী? আমরা উঠছি কোথায়?” দেবদীপ বলল, “ওদের বাড়িতেই তো আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে কুর্চি। দিদিকে বলিসনি, অরি?”

আকাশ থেকে পড়ল অরিত্র। “ওদের বাড়িতে! তুমি ঠিক জানো? আর, ওদের বাড়ি মানে কোন বাড়ি? কুর্চি তো আজকাল নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে থাকে! আমরা সেই বাড়িতেই উঠব, কুর্চির সঙ্গেই থাকব, এরকম তো মনে হয়নি আমার কুর্চির কথায়!”

“উফ, সে বাড়ি হতে যাবে কেন? তোরা থাকবি কুর্চির নিজের বাড়িতে। তুই তো গিয়েছিস সেখানে।” দেবদীপ বুঝল, অরিত্র আর তার মা-কে কুর্চি যে নিজের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছে, সে কথা স্পষ্ট করে বলেইনি অরিত্রকে। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল? যা-ই ভেবে থাকুক, এখন তো হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখল, ভুরু কুঁচকে গেছে অরিত্রর। দেবদীপকে জিজ্ঞেস করল, “কুর্চির বাবা তো এখন ওই বাড়িতেই আছে, তাই না?”

– এসব কথা তো আমার চেয়ে এখন তুইই ভালো জানিস, অরি।

অরিত্রর মুখের সমস্ত পেশি ততক্ষণে শক্ত হয়ে উঠেছে। চোখ স্থির করে বলল, “কুর্চির বাবার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে আমি পারব না দেবুদা,… কুর্চি এটা ভাবল কী করে? আমাকে একবারও না জানিয়ে… আমরা কোথাও যাচ্ছি না, মা। সরি, দেবুদা। সক্কাল সক্কাল তোমার মিথ্যে হয়রানি হল। আশ্চর্য! আমার সঙ্গে একবারও কথা না বলে এরকম ব্যবস্থা করা কুর্চির মোটেই উচিত হয়নি।”

এতক্ষণ মুখ খোলেননি সুমিত্রা। এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে মেয়েটা তোর ভালোর কথা ভেবেই এত কিছু করছে, আমি তো দেখছি সেই একেবারে প্রথম দিন থেকে, তার সঙ্গে কোনও কথা না বলে তাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না ছোটু। সে যদি তার বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে থাকে…” মা’কে কথা শেষ করতেও দিল না অরিত্র, ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে উঠল, “তুমি কিছু জানো না মা। কুর্চি আমার বন্ধু বলে এই লোকটা, কুর্চির বাবা, আমাকে শেষ করে দিতে চায়। দেবুদাই দুদিন আগে বলছিল, ভাড়াটে খুনি লাগাবে আমার পেছনে। এখন ওরই সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে? পাগল নাকি!”

ছেলে থামতেই সুমিত্রা বললেন, “আচ্ছা, আমি না হয় কিছু জানি না। কিন্তু কুর্চিও কি জানে না? সে মেয়ে যদি সব জেনেশুনে তার বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে থাকে, সেটা আর যাই হোক, তোর অসম্মানের জন্যে, কি তোকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবার জন্যে, এরকম হতেই পারে না।” দেবদীপ চুপ করে ছিল। চুপ থাকাই উচিত মনে করল। অরিত্র মুখ খুলল মায়য়ের কথাগুলো মনের মধ্যে একটু নাড়াচাড়া করে। বলল, “সব জেনেশুনেও যদি এমন ব্যবস্থা করে, তাহলে আর কী বলব বলো! কিন্তু ওর বাবার সঙ্গে থাকার এতটুকু ইচ্ছে নেই আমার। আমি পারব না।”

অরিত্রকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করে কুর্চি হঠকারিতা করছে কিনা, এই প্রশ্নটা দেবদীপের মনেও উঁকি দিয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তার ধারণা ছিল, কুর্চির পরিকল্পনায় অরিত্রর সম্মতি আছে। এখন অরিত্রর মনের অবস্থাটা দেবদীপ পরিষ্কার বুঝতে পারছে। অরিত্রকে বলল, “আমি যা বুঝছি, সবচেয়ে আগে তোর সঙ্গে কুর্চির কথা হওয়া দরকার। তোরাই ঠিক কর এরপর কী করবি। কিন্তু কুর্চি কি এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে? আমি জানি না। বুঝলি, আমি তাহলে এখন ফিরেই যাই। তোরা কী ঠিক করলি আমাকে জানাস, সেই মতো ব্যবস্থা করা যাবে।” সুমিত্রা বললেন, “সে কী! ফিরে যাবেন কেন? ছেলেটা কত দিন ধরে হাসপাতালে বন্দি। আজ বেরোব বলে তৈরি হয়ে বসে আছি যখন, তখন বাড়ি থেকে তো বেরোই। তাতে মনও ভালো হবে। অবশ্য আপনার যদি অন্য কাজ না থাকে – ”

তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে দেবদীপ বলল, “সুমিত্রাদির এই প্ল্যানটা চমৎকার। অন্য কাজ আবার কী! লং ড্রাইভে যাব, এটাই তো ঠিক ছিল। সবাইকে বলে এসেছি, এখন তিন দিন আমাকে কলকাতায় পাওয়া যাবে না। চলুন, কোলাঘাটে পরপর কয়েকটা খাবার জায়গা আছে, জলখাবারটা কোলাঘাট গিয়ে খাই।”

অরিত্রর মুখ তখনও কঠিন। বলল, এত তাড়াহুড়োর কী আছে মা! কুর্চিকে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফোনে পাওয়া যাবে। তখন বুঝিয়ে বলব, অন্য কোনও বাড়ি ভাড়া নিতে পারলে শান্তিনিকেতনে যেতে পারি, কিন্তু তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার বাবার সঙ্গে থাকতে পারব না। কুর্চির সঙ্গে কথা হয়ে যাক, তারপর দেখি জিয়ারুল কোথায় আছে। অনেক দিন বলেছে ওদের মাকালপুরের বাড়িতে যেতে। আজ কি প্র্যাকটিস আছে দেবুদা?”

“গুড আইডিয়া!” বলে একমুখ হেসে বসে পড়ল দেবদীপ। “প্র্যাকটিস নেই রে অরি, তিন দিন বন্ধ। আর জিয়ারুল কাল মাকালপুর যাচ্ছে বলে জানিয়েও গেছে। কিন্তু আমরা ওকে আগে থেকে কিচ্ছু জানাব না। দুম করে গিয়ে হাজির হব।”

– ওমা! সে আবার কী! সুমিত্রা না বলে পারলেন না।

– আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, দিদি। ও হুগলির গ্রামে থাকে, বাড়ি থেকে হাঁক পাড়লেই দিশি মুরগি, পুকুরের মাছ, খেতের সবজি। চমৎকার দইও পাওয়া যায় মাকালপুরে। একবার খাইয়েছিল।

– আরে! লোকের বাড়িঘর গুছোতেও কিছুটা সময় লাগে তো!

– আমরা ওর বাড়ির ভেতরে বসব নাকি! বসব ওদের পুকুর পাড়ের চাতালে। ঠাকুরদার আমলের সম্পত্তি। ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে, কিন্তু বেশ পরিপাটি। চলুন, ভালো লাগবে। উঠে পড়, অরি। চল, স্যুটকেস নামাই।

– জিয়ারুলের বাড়িতে স্যুটকেস নিয়ে গিয়ে কী করব? যাচ্ছেতাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল অরিত্র।

– ওটাই তো তোর আইডিয়ার আসল মজা। মাকালপুর হুগলিতে। সিঙ্গুরের একটু পরেই, বাঁ দিকে। মানে এখান থেকে শান্তিনিকেতনের রাস্তায়। মাকালপুর পৌঁছতে পৌঁছতে তোর কুর্চির সঙ্গে কথা হয়ে যাবে। তারপরেও যদি ঠিক হয় শান্তিনিকেতন যাচ্ছি না, তাহলে মাকালপুর ঘুরে এসে স্যুটকেস আবার স্বস্থানে। আর, যদি ঠিক হয় শান্তিনিকেতনে যাওয়া হবে, তাহলে নো মাকালপুর, সোজা শান্তিনিকেতন।” ঘরের গুমোট কাটিয়ে ঝরঝরিয়ে হেসে উঠলেন সুমিত্রা। “আপনি ভাই পারেনও বটে!” হেসে ফেলল অরিত্রও। বলল, “এতই উৎসাহ যখন তোমার, স্যুটকেস নিচ্ছি। কিন্তু ফিরে আসার চান্সই নাইন্টি পারসেন্ট।”

ফোন করতে হল না, কুর্চিরই ফোন এল অরিত্রর কাছে সলপ পৌঁছনোরও আগে। “কদ্দুর?” জানতে চাইল কুর্চি। কুর্চিকে “একটু ধরো” বলে পাশে ড্রাইভারের সিটে বসা দেবদীপের পায়ে হাতের একটা চাপ দিয়ে ইশারায় তাকে গাড়ি থামাতে বলল অরিত্র। গাড়ি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে পিছিয়ে এল খানিকটা। তারপর কুর্চিকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তুমি যে আমাদের তোমার বাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করেছ, সেটা তো একবারও বলনি আমাকে!”

– আমার না, আমার বাবার বাড়ি।

– ওই হল। তোমার বাবার বাড়িতে আমি, আমার মা থাকব! এটা ভাবলে কী করে!

– সেটা মেনে নেওয়া কার পক্ষে বেশি সমস্যা? তোমার, না আমার বাবার?

– জানি না কুর্চি, জানতে চাইও না। আমার পক্ষে …

– জানতে চাইছ না, ভাবতেও চাইছ না, গোলকিপার। সমস্যা সেইখানেই। আমার বাবা সাংঘাতিক ভুল করেছে, মস্ত অন্যায় করেছে। আগেও করেছে। থামাতে না পারলে হয়তো এর পরেও করবে। কী করে থামাব? তোমার মাথায় মারার ব্যবস্থা করেছিল বলে বাবার মাথায় ডান্ডা মারতে লোক লাগাব আমরা? নাকি, কিছুই না করে আমরা বাবার নাগাল থেকে পালিয়ে গিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাব? বাবা আবার কবে কী ক্ষতি করে দেখার জন্যে বসে থাকব? ভাবো, ভেবে বলো।

থমকে গেল অরিত্র। যেভাবে ‘আমরা’ বলছে কুর্চি, যেভাবে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিচ্ছে অরিত্রকে, সেটা শাঁখের মতো বাজছে ওর কানে। থতমত খেয়ে কোনওমতে বলল, “তোমার বাবার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারছি না কুর্চি!”

– আর আমার বাবা কী করে মেনে নেবে তার নিজের বাড়ি জুড়ে তোমার থাকা? তোমার খাতির, তোমার যত্ন, তোমার সুবিধে, তোমার অসুবিধে নিয়ে তার নিজের মেয়েকে মেতে থাকতে দেখবে কী করে সেই অহংকারী বাঘটা? তুমি তো সারা মাঠের খেলা দেখতে পাও গোলকিপার, এটা দেখতে পাচ্ছ না?

হেসে ফেলল অরিত্র। “ম্যাডাম, আপনি কোচিং শুরু করবেন? আইএফএ-র এক বস আমার খুব চেনা। তাকে বলব?”

“তাকে বল, কোচ ম্যাডাম আজ নিজে বাগান থেকে ফুল তুলে বাড়ি সাজাচ্ছেন। দেরি হলে সব ফুল শুকিয়ে যাবে।”

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *